সুধাংশুরঞ্জন সাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সুধাংশুরঞ্জন সাহা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র কবিতা

শ্রাবণমেঘ

চোখের সামনেই দিনগুলো সব ঝাপসা হয়ে গেল

সেসব ছিল অন্যরকম দিন।


নিজেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছি।

ভাঁজভাঙা নদীপথের মতো নিপাট সত্যি হল সব।

ঋতু বদলের মতো অগোছালো দিন,

তীব্র রোদ ঝলসে ওঠে চলাচলের পথে।


খুশির বদলে বিষণ্নতা 

আলোর বদলে অন্ধকার

এলোমেলো হয়ে যায় সব।


অচেনা হয়ে ওঠে চেনা পথের বাঁক

নিরুত্তর স্বপ্নসফর মেঘলা হল আজ,

শ্রাবণও মুখোশধারী যে কোনো ঋতু!


শ্রাবণমেঘ কি নতুন বর্ণমালা শেখাবে! 

রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র কবিতা

হারানো ঠিকানার শবরীমালা

ধূসর বোতামে অভিমান লেগে ছিল তার।
শীতের শাসনে চুরমার হয়ে গেছে সব প্রেম।
ব্যথার উপরে পলিমাটির প্রলেপ পড়ে রোজ...
কথায় কথায় জড়িয়ে পড়ে নদীর কৌতূহল।

যদি ফিরে আসে তাদের মাঝে উড়ে যাওয়া গানপাখি,
ফিরে আসে যদি কফিশপের উষ্ণ আখ্যানগুলো,
কিংবা শরতের বিকেল ফিরিয়ে আনে যদি
হেমন্তের কথোপকথন 
এবং পরিচিত পথের ছায়াসংকলন...

তাহলে রোদমাখা শীতের অপরাহ্নে
তুমুল মাঘের শরীরে ফুটে উঠবে
হারানো ঠিকানার শবরীমালা।
 

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র অনুবাদ কবিতা

সিমাস হিনি


স্ত্রীর গল্প

ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটা লাইনেন কাপড়ের উপর বীজ ছড়িয়ে দিয়ে শেষ করেছিলাম আমার কাজ।
গুঞ্জন : মুগুর এবং বড় বেল্টের সাহায্যে সজোরে ঘুরিয়ে অচল করে দেয়া হয় সেই মেসিন,
শুধু অসমর্পিত কিছু খড় ঝুলছিল মুখে।
এটা এতোই নিথর ছিল যে, আমি তার বুটের আওয়াজ পাচ্ছিলাম কুড়ি গজ দূরের শস্য কাটা মাঠের অবশিষ্ট খড়ের খড় খড় শব্দে।

সে নিচে বসে বলল,এইসব লোকের জন্য আমার কোনো তাড়া নেই।
হাতভর্তি ঘাস শূন্যে ছুড়ে বলল, দেখো কী সুন্দর দেখাচ্ছে।
ঘাসের উপর পাতা সাদা কাপড়ের দিকে মাথা ঝোঁকালো সে।
আমি ঘোষণা করে দিলাম, 
একজন নারীই পারে এই জমির নকশা আঁকতে।
যদিও আমাদের মতো ছেলেদের সামান্য  দাবিও নেই এক টুকরো কাপড়ের।
সে চোখ টিপে টিপে আমাকে দেখছিল,
যখন আমি একটা কাপ গড়িয়ে দিয়েছিলাম।
এবং তার পছন্দের মোটা পাউরুটিতে মাখন লাগাচ্ছিলাম।
আদতে আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে
ঢের ভালো শস্য মাড়াই হচ্ছিল।
ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ভাবি, 
এটা খুবই পরিচ্ছন্ন সুন্দর বীজ।
এই পরিদর্শন সবসময় চালিয়ে যেতে হবে।
এমনকি যখন আমি জানি না কী করতে হবে, তখনও।

আমি হাত ঢুকিয়ে দিই আধাভর্তি ব্যাগে,
হুক ঢুকিয়ে পরীক্ষা করি প্রতি পর্যায়ে।
এটা খুবই কঠিন কাজ।
অগুনতি উদাসীন ব্যাগ ফাঁক করে দেখা,
যা সংকীর্ণ ঢালু পথে চলে যায় স্টিলের ড্রামে,
আর কাঁটাগুলো থেমে যায় মাটির বাঁকে।
বল্লমই পারে হারানো এই যুদ্ধক্ষেত্রকে চিহ্নিত করতে।
আমি এই দুইয়ের মাঝে হেঁটে যাই
মাঠের অবশিষ্ট খোঁচা খোঁচা খড়ের উপর দিয়ে।

চুপচাপ ধূমপানে মগ্ন হয়ে তারা শুয়ে থাকে 
তাদের নিজেদের খড়ির রিং ও গাদের মধ্যে।
তাদের স্বগতোক্তি,এখানে কি কিছুই নেই!
ওরা এতোটাই গর্বিত যে, ওরাই যেন জমি।
মাড়াই এবং বীজ বোনার জন্য এটাই যথেষ্ট।
আমি আসব আর সে আমাকে দেখাবে।এটাই সব।
সুতরাং আমি আর এই কাজের মধ্যে নেই।
কাপ জড়ো করে,কাপড় গুছিয়ে চলে আসি।
কিন্তু তারা বিরামহীনভাবে তাদের কাজ করে যায়, 
দ্বিধাহীন, আন্তরিক, কৃতজ্ঞচিত্তে,
গাছের ছায়ায় বসে।


[কবি সিমাস হিনি (Seamus Heaney)-র জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে । ১৯৩৯ সালে। তিনি একজন আইরিশ কবি। প্রথম জীবনে ফ্রীলান্স লেখালেখি ও প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন, পরে অধ্যাপনা । বহু পুরস্কারে সম্মানিত। কবিতার জন্য পেয়েছেন Whit bread book of the year award ১৯৮৭ এবং ১৯৯৬ সালে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৯৫ সালে। তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ন্যায়বিচার। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে -- Death of a Naturalist(1966), Wintering out(1972), The Haw Lantern (1987) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নোবেলজয়ী এই কবি ২০১৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এখানে তাঁর New Selected Poems থেকে একটি কবিতা The wife's Tale এর বাংলা অনুবাদ করেছি।] 

শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র কবিতা

ঝিনুকের ভাষা

তুমি কি সেই বদলে যাওয়া অসময়ের পাখি?
যার উড়ালে ভেসে ওঠে বাঁক বদলের ইশারা!

তুমি তো সেই নদী,যার জলে সাঁতরে চলেছি জীবনভর।
তবু অপরাহ্নের ম্লান আলোয় বিষাদ ঘনায় মনে।

সব অশ্রুকণায় লুকনো থাকে কি অপরাধ?
নাকি থাকে অস্পষ্ট শূন্যের ঘরবাড়ি! 

বুকের সমুদ্রে অগুনতি ঝিনুক খেলে বেড়ায়...
যাদের ভাষা ঠিকঠাক পড়তে পারিনি আজও।

 

রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র কবিতা

তুমি আমার : সাত
তুমি আমার পোষ না-মানা নীল পায়রা
তুমি আমার ইছামতিতে রাতযাপন
তুমি আমার হেমন্তের খোলা হাওয়া
তুমি আমার আগুন চোখে বরফ জল
তুমি আমার হঠাৎ দেখা  পলাশ ফুল
তুমি আমার বর্ণহীন বিরল পাখি
তুমি আমার ঘুমিয়ে কাদা নিঝুম রাত
তুমি আমার অনুরোধের গল্পমালা
তুমি আমার অপরাধের ঘাটের কথা
তুমি আমার যাতায়াতের হুগলি সেতু
তুমি আমার ঋতুবিহীন ছোটগল্প
তুমি আমার গানমেলার হারানো সুর
তুমি আমার ডাললেকের না-জাগা রাত
তুমি আমার খুঁজে পাওয়া সবুজ দ্বীপ
তুমি আমার চেনা পথের অচিনপুর 
তুমি আমার চিরকালের রোদের সিঁড়ি
তুমি আমার হাতের কাছে মেঘবিলাস
তুমি আমার নিরুত্তর রাতদুপুর
তুমি আমার তেরো নদীর গানের ভাষা
তুমি আমার শব্দহীন জোছনাপুরী
তুমি আমার দশদিকের  আবছাপথ 
তুমি আমার সাতমহলা কবিতা বাড়ি
 

বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র কবিতা

প্রতীক্ষা 

প্রতিদিন মূল্যবোধের সংজ্ঞা বদলে যায়।
অবক্ষয়ের মুখোশে ঢেকে যায় মুখ।
ঐতিহ্য হোঁচট খায় পদে পদে।

চারিদিকে ছড়িয়ে আছে অজস্র প্রশ্ন...
সমস্ত প্রশ্নের রঙ যদি আলো হ'তো,
পৃথিবী আলোময় হয়ে উঠত এতোদিনে।
অন্ধকার একটু একটু করে
নির্ঘাৎ হারাত তার কুৎসিত রঙ,
নিজস্ব বৃত্ত অপূর্ণ রেখে ঝাঁপ দিত নদীতে!

প্রগতির পথ হতো আলোকিত,
মুছে যেত অন্ধকারের ছলাকলা।

প্রবল বৃষ্টিতে নদী ভেসে গেলে,
বিনা বাক্যব্যয়ে এখনও 
মানুষ নদীর কাছে নতজানু হয়...
আমি সেই কবিতার ইস্তেহার
লেখার প্রতীক্ষায় বুঁদ হয়ে প্রহর গুনি।

 

সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র দীর্ঘ কবিতা

কুয়াশাবলয় : তিন

অন্ধকার খুঁড়ে পাই গাঢ় অন্ধকার,
পাণ্ডুলিপি লিখে ফেলি নতুন আবার।
দর্শক দাঁড়িয়ে দেখে নাটকের শেষ,
সমাজ ঘাঁটতে গিয়ে পেয়ে যাই দেশ!
সমাজে ছড়িয়ে আছে নানা প্ররোচনা,
সুযোগ পেলেই রাষ্ট্র তোলে বিষ-ফণা।
আমিও দাঁড়াই এসে সংসার সীমান্তে,
খেয়াঘাট তুলে আনি জীবন জানতে।
জলে জলে নদী ভাসে ঋতুঘনবাণী,
সারা জীবন আমরা এইসব মানি।

জলে জলে প্রবাহিত বহুত্ববাদ কি?
দিনরাত উলু শঙ্খে প্রবল বিপত্তি।
গোধূলিও সেজে ওঠে নানাবিধ সাজে,
অবশেষে মায়াটান খুঁজে পাই কাজে।
স্বপ্নকে ধাওয়া করে মনের বিলাস,
যেদিকে তাকাই শুধু বসন্তবিলাপ।
করমর্দন ছেড়েছি মানুষের সাথে,
পাখি নিয়ে ঘুরি শুধু হাট থেকে হাটে।
কবিতা লিখতে এসে পড়েছি বিপদে,
আলাপে তুমুল ঢেউ অবরুদ্ধ পথে।


মেঘের মনখারাপে বৃষ্টি ঝরে পড়ে,
ঘর গৃহস্থালি নিয়ে ভুগি নানা জ্বরে।
ধানখেতে মাঝে মাঝে পাখি গান ধরে,
পড়ন্ত বিকেলে তবু সূর্য ঢলে পড়ে।
অবয়ব আর রূপে ছিল যত দ্বন্দ্ব,
অভাবের দিন ছিল ততোধিক অন্ধ!
ভালোবাসার জন্যও বিজ্ঞাপন লাগে,
বিশ্বাস আর আবেগ গাঢ় ছিল আগে।
ডায়েরিতে লিখে রাখি আমার হতাশা,
তাই বলে হারাইনি এখনও আশা।

একটি সুর বাজছে পাতার সেতারে,
এখনও কাক এসে বসে কালো তারে।
রাতভর লিখে দেখি অসমাপ্ত চিঠি,
নিজের সাথে নিজের লাগে খিটিমিটি।
আয়নায় চেনামুখ ভীষণ ঝাপসা,
ভেসে ওঠে বলিরেখা অভাবিত দশা।
সব মুখ চুপ ছিল অলস দুপুরে,
বসন্ত আসেনি সেই অসহায়পুরে।
ঘোলাটে আকাশ ঘিরে বিপন্ন ভুবন,
নদী থেকে শুরু করে পাশে ছিল বন।

ফাঁকা মাঠের ভিতর ঘন ছিল রাত,
শীতের কুয়াশা সব করেছিল মাত।
তবু, নানান কৌশলে বোনা হয় বীজ,
ব্যবধান গড়ে ওঠে মেশে যদি বিষ।
পাথর প্রতিমা হয় মানুষের ভুলে,
ইতিহাস লেখা হয় দুঃখ কষ্ট তুলে।
ছায়ার ভিতরে ছায়া দেখে দেখে হাঁটি,
বুকের ভেতর নদী ভাসে পরিপাটি।
বিশ্বাস আর ভরসা গড়ে ভালোবাসা,
অভিমানী বাংলাভাষা আমাদের আশা।

বিপরীতমুখী হয় না নদীর স্রোত,
নদীর মতো জীবন যদি পেতো বোধ।
ইচ্ছে ভাঙে ইচ্ছে গড়ে ইচ্ছে শক্তিধর,
ইচ্ছে এক মস্ত জেদ, বেড়ে ওঠা জ্বর।
ইচ্ছেরা ওড়ে আকাশে পাখির মতোই।
মনকে দেয় চাড়িয়ে অকপট বই।
অগ্নিপথ বেছে নেয় কঠিন ইচ্ছেরা, 
ষড়যন্ত্র মুছে দেয় সুভাষিত জেরা।
পায়ে পায়ে বাজে ভালোবাসার ঘুঙুর,
ইচ্ছে একা ছুটে চলে দূরবর্তী পুর।

ইচ্ছে আমার অনেক দূরদ্বীপমালা,
কী নামে ডাকব তাকে মেঘে মেঘে ঢাকা।
মনের ভিতর তবু হাজার গোলাপ,
নিজের সাথে নিজের অশেষ আলাপ।
বুকের নিভৃতে থাকে তমসার আলো,
ভ্রমণ শেষেই বলি জ্বালো মোম জ্বালো।
প্রশ্নপর্ব শেষে দেখি নিজের হৃদয়,
আমি তো অন্ধ বাউল গানে বিশ্ব জয়।
প্রবল জোয়ারে দেখি শূন্য পারাপার,
মায়াবী আকাশ গায় ভৈরবী আবার।

জানি না কবে ফুরবে জীবনের পালা,
কারা এসে খুলে দেবে হৃদয়ের তালা!
কার্তিকের ভোরে ছিল ভিজে ঘাসগুলি,
অরণ্যে খুঁজে পেলাম রঙ রূপ তুলি।
রডোডেনড্রন ফুটে আছে আশেপাশে,
দিনগুলি রাতগুলি মিটিমিটি হাসে।
ভয়ঙ্কর আলো খেলে জটিল চলনে,
সেই রঙ ছড়িয়েছে শিল্পিত মননে।
তারপর থেমে যাবে সব কোলাহল,
নেমে যাবে সব নদী-উপচানো জল।

একা একা ভাবি ভুল সরণি ধরেছি,
যৌনতাকে কোনোভাবে পোড়ানো যায় কি?
আগুন, আগুন আর আগুনের দিন,
হাত ধরে আছে শুধু জীবনের ঋণ।
সহসা ভোলে না দিক উপেক্ষিত নদী,
সব নদী ফিরে পায় না হারানো গতি।
অবাক দুচোখ ঘিরে খেলা করে আলো,
চোখের আলোয় ভাসে যত আছে কালো।
অচেনা সরণি আছে মানুষের মনে,
মানুষ খুঁজতে গিয়ে ফিরে যায় বনে।

পথে নামলে পথই নিয়ে যায় টেনে,
এপথ সেপথ ঘুরে জীবনকে চেনে।
কুয়াশায় ঢাকা থাকে কিছু জাদুপথ,
অবাধ নদীর মতো জলে যায় মত।
কুয়াশা মানেই শিরশিরে অনুভূতি,
ভিজে মনে করে ফেলি প্রকৃতির স্তুতি।
ঢিমেতালে বয়ে চলে জীবনের স্রোত
উপেক্ষিত মুখে কিছু ছায়া কিছু রোদ।
কোথায় অপেক্ষমান গোপন আগুন,
মেঘকিশোরীকে কিছু না-লেখা ফাগুন।

 

মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২

দীর্ঘ কবিতা : সুধাংশুরঞ্জন সাহা

কুয়াশাবলয় : এক 

কুয়াশা আমার কাছে শুধু এক নারী,
শীতের শিশির ছাড়া নিঃসঙ্গ বেচারি।
কিছু তার মেঘে থাকে কিছু ধারাপাতে,
কিছু মনে বাসা বাঁধে দিবস ও রাতে।
পাখিঠোঁটে ওড়ে কিছু, কিছু জলে মেশে,
কিছুটা বাতাসে ভাসে বাকিটা আবেশে।
সে অতি বিষম কথা তাকে বলা যায়,
অকপট কথা যত অবাধ্য শোনায়।
ঝড়ের স্বরলিপি কি লিখে রাখা যায়!
সে এক অনন্য ভাষা কুরে কুরে খায়।

ঘাটে নৌকো বাঁধা আছে মানা নেই যেতে,
ইশারায় ডাকে নদী মন খুঁজে পেতে।
হৃদয়ের কাছাকাছি যারা এসেছিল,
ফিরবার পথ তারা কেউ ভেবেছিল?
এ-কথার জবাব কি কেউ ঠিক জানে!
আমিও একা খুঁজেছি সে-কথার মানে।
মেঘের ভেলায় চেপে ঋতু আসে যায়,
অন্য পথ বন্ধ ছিল কপট ছায়ায়।
ছায়া নিয়ে এতো কথা, ভাষা চেনা দায়,
ভাষা নিয়ে ভাসা কথা কে জানতে চায়?

নেমেছে তুমুল বর্ষা রাস্তা ভেসে যায়,
জলে জলে লেখা হবে জনশূন্য রায়!
জল নিয়ে এতো কথা জানে নাকি জল,
জীবনের সবটুকু জল আর জল।
সৃষ্টি জুড়ে যত কথা সব জলময়,
মানুষের মনে তবু জল নিয়ে ভয়!
নদী খায় থতমত দিন যায় ভেসে,
ঢেউয়ের পর ঢেউ ওঠে হেসে হেসে।
নদীও জানে এসব একাকী গোপনে,
কথা নাকি জলে ভাসে গাঢ় ইচ্ছে মনে।

মানুষ জানে না তার নিজের ক্ষমতা,
ইচ্ছেপাখি উড়ে যায় ভুলে সব কথা।
ব্যথা যত কথা বলে সারা দিনরাত,
পাখিরাই গান গেয়ে দিয়েছিল সাথ।
মাঝে মাঝে প্রশ্ন তুলে নির্বাক তাকানো
এতোবড় পৃথিবীর কতটুকু জানো?
আমিও একাকী ভাবি কবিতাযাপন,
পৃথিবীতে কেউ কেউ স্বজন আপন।
চিঠি কিছু এসেছিল প্রিয়জনদের,
তাঁরা সব নাগরিক মেঘের দেশের।

তবুও সেসব চিঠি বুনে দেয় গল্প,
তাঁদের কথাই কানে বাজে অল্প কল্প।
এসব কথা সেভাবে কে আর বুঝবে?
দূর থেকে তোমাকেই নীরবে খুঁজবে।
কফিশপে,ডাকঘরে, কলেজের মোড়ে
ছেলেমেয়েরা ঘুরছে সব জোড়ে জোড়ে।
গল্পকথায় মাপছে মন, আচরণ, 
কারা কোথায় ঘুরছে মনে নিয়ে দ্রোণ!
জল ছুঁতে মন চায় নদী খুঁজে খুঁজে,
বুক জুড়ে তৃষ্ণা কত নিতে চায় বুঝে।

নদীতে সাঁতার কাটি চুপিচুপি একা,
অপেক্ষায় ছিল মন যদি হয় দেখা।
তারপর কী যে হ'লো নদীর ওপারে,
নদী নিয়ে লোককথা শুনি বারে বারে।
তাইতো নদীতে গান আছে, প্রাণ আছে,
দেহমন ছুঁয়ে আছে জলের আভাসে।
আমদের দুঃখ থাকে নদীর সকাশে,
জীবনের গল্প ভাসে শরতের কাশে।
যদিও শরৎ আসে সঙ্গে নিয়ে আলো,
এবার মুছতে হবে আছে যত কালো।

যে আগুন বুনেছিল অনন্ত প্রত্যাশা,
আমাদের ঘিরে আছে ছায়াদের ভাষা।
যে আগুন দাউদাউ পুড়ে যায় একা,
সে-আগুনে পুড়ে পুড়ে আমাদের দেখা।
বাতাসে আগুন ছিল, আগুন মননে,
দাবানলের আগুন ছিল বনে বনে।
আগুন যত পোড়ায়, বেড়ে যায় ক্ষত,
শাসন বসায় দাঁত, ত্বক,মেদে তত।
বিশ্বসংসার ভাবছে, জ্বলুক আগুন,
মনের মাটিতে তবু ফুটুক ফাগুন। 

আমাদের চারিদিকে বিষাদের রঙ,
অপমানে,অভিমানে মুখ ঢাকি বরং।
সাদা পায়রার রঙ তুলিতে উড়ান,
ক্যানভাস জুড়ে খুঁজি শান্তির পুরাণ।
এইভাবে কতদূর যেতে হবে আর?
পায়রার ওড়াউড়ি মাখি বারবার।
এ-যুগের ধর্মকথা মুলতুবি থাক,
ব্রহ্মচর্য,ত্যাগ,সত্য শুনেই অবাক।
নদীর স্রোতের মতো ভাঙছে সংসার,
সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, স্থৈর্য হয়েছে অসার।

এ-শহর বেসামাল, নিদ্রা, তন্দ্রা ঘোর,
আত্মবোধ,আত্মস্মৃতি অনুভূতি জোর।
অন্ধকারে ভেসে থাকে মনের অসুখ,
আলো এসে তুলে ধরে সময়ের মুখ।
কখনো দেখিনি যাকে তার ফোন পাই,
মিথ্যে বলে তাকে আমি কীভাবে ফেরাই!
সময় বলাই ছিল বিকেলের দিকে,
হৃদয়ে শূন্যতা বাড়ে, দিন হলে ফিকে।
যাব বলেও ভেবেছি এক এক বার,
দ্বিধা দ্বন্দ্বে নাজেহাল হয়েছি আবার।

বিষাদে মূর্তির মতো চুপচাপ থাকি,
ভালোবাসা ছাড়া আর বাকি সব ফাঁকি।
ছানার জলের মতো ভোর ভোর আলো,
সব কিছু ভুলে আমি খুঁজি শুধু কালো।
কালোর ভিতর আছে আলো রাশি রাশি,
দিনরাত এক করে খুঁজে মরি চাষি।
মানব জমিন চাষ কত যে কঠিন!
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় দিন।
মানুষ জানে না তার অফুরন্ত শক্তি,
না জানার ফলে তার পদে পদে ক্ষতি।

 

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র অনুবাদ কবিতা

সিমাস হিনি

যা কিছু তুমি বলছ সবই অনর্থক

(এক)


আমি যা কিছু লিখেছি একটা বিপদের মুখোমুখি হয়ে।
একজন ইংরেজ সাংবাদিকের সঙ্গে
আয়ারল্যান্ডের ভাষা বিষয়ক কিছু অভিমত অনুসন্ধানের জন্য
আমি শীতেই ফিরে এসেছি,
যেখানে খারাপ খবর কোনো খবরই না।

যেখানে গনমাধ্যমের লোক এবং কাঠামোর অবজ্ঞা
আর শক্তিশালী লেন্স, রেকর্ডার,
কুন্ডলী পাকানো সীসা
হোটেলের আবর্জনার স্তূপের অনুরূপ।
গুণ যেখানে সংযোগের বাইরে!
তবুও আমি ইচ্ছুক যতটা সম্ভব প্রার্থনা সম্বলিত জপমালায়।

রাজনীতিবিদ এবং সংবাদপত্রের লোকজনের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এবং বিশ্লেষণ নিয়ে
যারা হিজিবিজি লিখে প্রচার চালায়
অথচ গ্যাস এবং অ্যাসিডের বিরুদ্ধে 
দীর্ঘ প্রতিবাদেও তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ থাকে না!

এই যখন অবস্থা
তখন কে মাপবে ধাপে ধাপে বেড়ে ওঠা তাদের
নাড়ীর স্পন্দন, নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, আঘাত,
অস্থায়ী মঞ্চ, মেরুকরণ এবং দীর্ঘস্থায়ী ঘৃণা!
তথাপি আমি এখানে বেঁচে আছি,
এখনো বেঁচে আছি, আমার গান নিয়ে।

অভিজ্ঞ নাগরিকরা কথা বলবে প্রতিবেশী নাগরিকদের সঙ্গে
টেলিমাধ্যম অথবা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বেতারযন্ত্রে।
আস্বাদন করবে অনুমোদিত নকল স্বাদ, প্রস্তরময় সুগন্ধ, 
পুরনো, বিশদ সমুচিত জবাবে!

সত্যি, এটা মর্যাদা হানিকর, আমি অবশ্যই সহমত।
কে জানে, এর শেষ কোথায়? 
এটা খুব খারাপ হচ্ছে!
'ওরা খুনি, অন্তরীণ বোধগম্যহীনতায় ...'

দেহ ও মনের সুস্থতার স্বর ক্রমশ কর্কশ হচ্ছে।


[
কবি সিমাস হিনি (Seamus Heaney)-র জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে । ১৯৩৯ সালে। তিনি একজন আইরিশ কবি। প্রথম জীবনে ফ্রীলান্স লেখালেখি ও প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন, পরে অধ্যাপনা । বহু পুরস্কারে সম্মানিত । কবিতার জন্য পেয়েছেন Whit bread book of the year award ১৯৮৭ এবং ১৯৯৬ সালে এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার  ১৯৯৫ সালে। তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ন্যায়বিচার । তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-- Death of a Naturalist(1966), Wintering out(1972), The Haw Lantern (1987) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । নোবেলজয়ী এই কবি ২০১৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।]


 

বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র অনুবাদ কবিতা


 সিমাস হিনি


জলপান


রোজ সকালে সে আসতো জল তুলতে,

শস্যক্ষেতে হতভম্ব একটা বাদুড়ের মতো।

বালতির ঠকঠক শব্দে উঠে আসত পাম্পের হুপিং কাশি।

খুব ধীর গতিতে বালতি ভরছিল --

সে বলেছিল, আমি স্মরণ করতে পারছি।

তার ধূসর এপ্রোণে ঢাকা ছিল

সাদা কলাই রঙের বসন্ত-গুটিকা।

বালতি ছাপানো জল আর তার তিন গুণ

ক্যাচক্যাচে কন্ঠস্বর যেন পাম্পের হাতোলের শব্দ।

তার বাড়ির ত্রিকোণ যেন উত্তেলিত অতীতের

পূর্ণিমার চাঁদ।

তার জানালা দিয়ে এটা যেন ঢলে পড়ল

টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখা জলের পাত্রে।

পানের জন্য যেখানে ঠোঁট ডুবিয়েছি বারেবারে।

পেয়ালার উপর সতর্কীকরণে বিশ্বস্ত থেকে।

দাতাকে স্মরণ করে ম্লান হয়ে যায় ঠোঁট।



[কবি সিমাস হিনি (Seamus Heaney)- জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে ১৯৩৯ সালে। তিনি একজন আইরিশ কবি। প্রথম জীবনে ফ্রীলান্স লেখালেখি প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন, পরে অধ্যাপনা বহু পুরস্কারে সম্মানিত কবিতার জন্য পেয়েছেন Whit bread book of the year award ১৯৮৭ এবং ১৯৯৬ সালে এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার  ১৯৯৫ সালে। তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ন্যায়বিচার তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-- Death of a Naturalist(1966), Wintering out(1972), The Haw Lantern (1987) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী এই কবি ২০১৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।]

সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২

সুধাংশুরঞ্জন সাহা-র অনুবাদ কবিতা

 

সিমাস হিনি


মধ্যকালীন বিরাম

সারা সকাল আমি বসেছিলাম কলেজের

পীড়িত উপসাগরতীরে।

অপেক্ষায় ছিলাম ক্লাসশেষের মৃত্যুঘন্টার।

অবশেষে এক প্রতিবেশী আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।

 

বাড়ির গাড়ি-বারান্দায় ক্রন্দনরত বাবাকে পেলাম !

অন্তেষ্টির ব্যাপারে যে সবসময়েই এক পায়ে খাড়া।

বিগ জিম ইভান্স বলেন, এটাই মারাত্মক আঘাত।

 

বাচ্চারা কূজন করছিল, হাসছিল এবং 

এপাশ ওপাশ করছিল।

আমি ভেতরে ঢুকে খুব বিব্রতবোধ করি,

বয়স্ক লোকেরা দাঁড়িয়েছিলেন

আমার সঙ্গে হস্তমর্দন করার অপেক্ষায়।

 

ওঁরা বলেছিলেন, তোমার এই দুঃসময়ে আমরা পাশে আছি।

অপরিচিতদের ফিসফিসানিতে বুঝলাম

ক্লাসে আমি ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ।

স্কুলের বাইরে আমার হাত থাকত মা- হাতে বন্দি।

 

কান্নাশূন্য রাগী চোখে আমি ফোঁপাচ্ছিলাম।

 

সকাল দশটায় বায়ুরোধী অ্যাম্বুলেন্স এলো,

সেবিকা দ্বারা ব্যাণ্ডেজ করা মা- মৃতদেহ নিয়ে।

পরের দিন সকালে আমি উপরের ঘরে গিয়ে দেখলাম,

তুষারবৃষ্টি আর মোমের আলোয় প্রশমিত শয্যাধার।

গত 'সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবার আমি তাকে দেখলাম।

খুবই বিবর্ণ !

 

তার খাটের মতো চার ফুট বাক্সের মধ্যে তার দেহ শায়িত।

তার বাঁদিকের অংশ যেন থেঁতলানো আফিম!

ক্ষতযুক্ত রুচিহীন জমকালো গাড়ির বাম্পারের ঝাঁকুনিতে যা স্পষ্ট।

 

নিথর একটা চার ফুট বাক্স, প্রতি বছরের জন্য নির্ধারিত!


​[​কবি সিমাস হিনি (Seamus Heaney)- জন্ম উত্তর আয়ারল্যান্ডে ১৯৩৯ সালে। তিনি একজন আইরিশ কবি। প্রথম জীবনে ফ্রীলান্স লেখালেখি প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন, পরে অধ্যাপনা বহু পুরস্কারে সম্মানিত কবিতার জন্য পেয়েছেন Whit bread book of the year award ১৯৮৭ এবং ১৯৯৬ সালে এবং সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার  ১৯৯৫ সালে। তাঁর লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং ন্যায়বিচার তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে-- Death of a Naturalist(1966), Wintering out(1972), The Haw Lantern (1987) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নোবেলজয়ী এই কবি ২০১৩ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন​।]