সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

রঙিন ক্যানভাস ।। বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩৩-৩৫ (জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা) ।। জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রচ্ছদ {উৎসব সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩৩-৩৫) [জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা] {উৎসব সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩৩-৩৫) [জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা] {উৎসব সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ৩ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩৩-৩৫) [জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা] {উৎসব সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ৪ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩৩-৩৫) [জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যা] {উৎসব সংখ্যা}


 

সম্পাদকের নিবেদন


সম্পাদকের নিবেদন


কবিতা’- জন্য কিছু কথা। কবিতা আমাদের মনকে আন্দোলিত করে, মানবিক চেতনার জাগরণ ঘটায় অর্থাৎ দার্শনিক ভাবনার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটায় বলেই মনে হয়। কবিতার ক্ষেত্রে যথার্থ শব্দচয়ন গুরুত্ব পেয়ে থাকলেও, সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতাও আছে। একজন কবি দার্শনিকের দৃষ্টিতে সময়কে আঁকেন। একজন যথার্থ পাঠক সেই ভাবনায় আন্দোলিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করেন। একটা দারুণ আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে কবিতা জন্মলাভ করে। তবুও প্রশ্নচিহ্ন জড়িয়ে ধরে, ‘কবিতা কি?’ সত্যিই কি কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা যায়? প্রকৃতিপ্রেমিক রোমান্টিক কবি বলে ওঠেন, কবিতা অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। সময়ের দাবি মেনে কবিতায় তথা সমগ্র শিল্পকলায় বার-বার বাঁকবদল ঘটে থাকে এবং ঘটে চলেছে। ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে কবিতা রচিত হয়ে থাকে। সবটাই মানবিক বলাইবাহুল্য। 


যেমন একসময় প্লেটো বলেছেন, শিল্প হচ্ছে ইমিটেশন বা নকল এবং কারণেই সত্য থেকে অনেক দূরে। প্রতিউত্তরে অ্যারিস্টটল বলেছেন, যেহেতু ইমিটেশনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষ সচল এবং সজীব থাকে, তাই শিল্প সত্য বস্তুর চেয়ে অধিকতর জীবন্ত।


একজন শিল্পীর অনুভব, কল্পনা বোধের সুপ্ত তরঙ্গে পার্সেপশন যতক্ষণ না উন্মোচিত হয়, ততক্ষণ তাঁর এক্সপ্রেশন বা প্রকাশ-ক্ষমতাও সৃষ্টি হয় না। কেবল ব্যাকরণ বা ছন্দের নিয়ম মেনে শব্দ সাজিয়ে গেলে বা রেখা-রঙের প্রয়োগে নিয়ম মেনে ছবি আঁকলেই যথার্থ কবি বা শিল্পী হয়ে ওঠা যায় না। এজন্য অনুভূতির তীব্রতা অর্জন করতে হয়। 

তাই জীবন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কবি কবিতা লিখতে থাকেন।  কবিতার দীক্ষিত পাঠক কবিতার শক্তি স্পর্শ করে নিবিড় এক বীক্ষণে জড়িয়ে পড়েন।


সকলে ভালো থাকুন। সকলকে শারদ উৎসবের শুভেচ্ছা অভিনন্দন –––

রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম

 

কবি সুধেন্দু মল্লিক-কে শ্রদ্ধাঞ্জলি

 


চলে গেলেন 'পতিত পৌত্তলিক' কবি

১৪ জুলাই, ২০২৩শ্রাবণী মধ্যাহ্নে বাংলা কবিতাজগৎ হারালো এক উদারমনা নিভৃতচারী কবিকে। কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁরছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগজার্নালেকৃত্তিবাস’-এর ত্রয়োবিংশ সংখ্যায় পঞ্চাশের কবি সুধেন্দু মল্লিক (১৯৩৫-২০২৩)-এরস্নিগ্ধকবিতাগুচ্ছের দুইভাগে প্রকাশ করার কাহিনি শোনান আমাদের, যা তাঁর মতে কৃত্তিবাসী সমাদরের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সেই সূত্রেই আজ অনেকেরই জানা, দুই পর্যয়ে আঠারোটি কবিতা নিয়ে সেই সংখ্যার প্রধান কবি ছিলেন সুধেন্দু, সম্পাদক অবশ্য শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় (যদিও কবি তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এবং শরৎকুমারের লেখা থেকেও জানা যায়এই ঘটনায় মূল সম্পাদক সুনীল খুব খুশি হননি আর শঙ্খ ঘোষ সরাসরি -ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না কখনো) আবারআধুনিক কবিতার ইতিহাস’- দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে হয় : ‘সুধেন্দু মল্লিক, যাঁর শান্ত সাত্ত্বিক কবিতাতে ফুটেছিল স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম পরবর্তীকালে কবিবন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতবিরোধের কারণেই হয়তো বাকৃত্তিবাসদেশপত্রিকা থেকে ক্রমশ মুছে যান তিনি। তবে সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত দেশ কবিতা সুবর্ণজয়ন্তী সংকলনে তাঁর দুটি কবিতা (শূন্যতাই কি রাজা, বোন) আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে। যদিও তাঁর কবিতা নিয়ে চর্চা সীমিত, তবু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে এসেছিলেন তিনি। এছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু প্রবন্ধ, সমালোচনা সাক্ষাৎকার এবং তরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পুস্তিকা (কবি সুধেন্দু মল্লিক : এক পতিত পৌত্তলিক, ২০১০) গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি সংকলন (ঐশী ভাবনায় সুধেন্দু মল্লিক, ২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে বিগত কয়েক বছরে আর ২০২২- সাতকর্ণী ঘোষ সম্পাদিতকলকাতার যীশুপত্রিকার সুধেন্দু মল্লিক সংখ্যার পরিবর্ধিত রূপসঙ্গে প্রসঙ্গে সুধেন্দু মল্লিকসংকলন। মৃত্যুর আগেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গদ্যসংগ্রহ কবিতাসমগ্র-ও। রয়েছে শেষবেলায় ২০২৩-এর জানুয়ারিতেলুব্ধকপত্রিকায় দেশভাগ স্বাধীনতা-৭৫ নিয়ে এক মনোজ্ঞ সাক্ষাৎকার। 



২০২৩-এর শূরুর দিকে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর নির্বাচিত কবিতার এক প্রামাণ্য সংকলনকবিতা মঞ্জুষা’, আর সেই বইকেই যেন সামনে রেখে আজীবন কবিকৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি তাঁকে দিয়েছে ২০২৩-এরজীবনানন্দ দাশ সম্মানহিরণ্ময় অন্ধকার’ (১৯৬৩) থেকেসঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’ (১৯৭৯) পেরিয়েদেরী হবে রে...তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ’ (২০২২) এবংশ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০১৭) কবিতা মঞ্জুষা’ (২০২৩) –-পর্যন্ত তেরোটি কাব্যের কবি অকৃতদার সুধেন্দু মল্লিক পঞ্চাশের সমুজ্জ্বল কবিকুলের অন্যতম; স্বভাবত স্বতন্ত্র, মৃদুকণ্ঠ এই কবি রক্তে বহন করেছেন কবিতার উত্তরাধিকার। পিতামহ পদ্মশ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিক, পিতা জ্যোৎস্নানাথ। কয়েকবছর কাটোয়া কলেজে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনার পর বিচারকের পেশাকেই গ্রহণ করেছিলেন। কখনো তিনিবিশ্বাসপরায়ণ নাস্তিককখনো বাপতিত পৌত্তলিক বাংলা কবিতার মনস্ক পাঠকের কাছে তাঁরসঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’(১৯৭৯) কাব্যটি আধুনিক মনের ঈশ্বরভাবনার এক অনন্য নিদর্শন। তবে কেবল আস্তিক্যচেতনা নয়, প্রেম-সমাজ এবং শোককবিতার বৃত্তেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। প্রিয় কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে লেখেনস্বর্গে বাউণ্ডুলে’, অরুণকুমার সরকারের মৃত্যুতেকবির মৃত্যু’, সত্যপ্রিয় ঘোষের স্মরণেজরাকিংবা বোনের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু তাঁকে লিখিয়ে নেয়বোননামের এক অসামান্য এলিজি : ‘আগুনের বসন পরে কোন্‌সংসারের দিকে ফিরে গেলি বোন  আবারসামনে মহান বিচারপতি’, ‘নীরব গর্দভ’, ‘ধর্মের কল’, ‘যাজক গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস্‌এর  রক্ততিলক’, ‘আমিও হত্যাকারী’ – ইত্যাদি কবিতার লেখকও তিনিই। ইন্দিরা গান্ধি তাঁর কাছে দেশজননীর প্রতিভূ। একদাধর্মের কাহিনি আজ চোরারাই শুনুক’ – এই উচ্চারণ যাঁর, তিনি- একালে করোনার আবহে লেখেনব্যাধ’-এর মতো এক চমৎকার কবিতা। তাই কবিবন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেনসময়বিবেকী কবিতাবলীর অন্তর্লীন মাহাত্ম্য ১৯৯০ সালে পেয়েছিলেন ভারত সরকার নির্বাচিত জাতীয় কবির সম্মান। ২০২০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের শেষ বাছাইয়ে উঠে এসেছিল তাঁর কাব্যপুষ্পিত ধিক্কার’-এর নাম। বেসরকারি উদ্যোগে পেয়েছেন আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন সুবর্ণপদক, ঝড়ো হাওয়া পত্রিকার মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সম্মান, সারঙ্গ পত্রিকার কবি দিনেশ দাস স্মারক সম্মান, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, দীনেশ-রবীন্দ্র পত্র সম্মান ইত্যাদি। তবে ৮৮ বছর বয়সে অকৃতদার কবির প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক পরিবারের চার পুরুষের কবিতাচর্চার ধারায় একরকম ছেদ পড়ে গেলো। আমাদের রঙিন ক্যানভাসে তাঁর একাধিক কবিতা প্রকাশ পায়। অক্টোবর ২০২১ সংখ্যার প্রধান কবি ছিলেন তিনি-ই। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চারটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ করা হলো :  


সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ 

ঘুরছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার

বালক কৃষ্ণ।

থামছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার 

বালক কৃষ্ণ।

তোমার জন্যে হাত করি জোড়

ভালোবাসার বকুল প্রহর

তোমার নামে ভাসাই জলে সঙ্গে আমার

বালক কৃষ্ণ।              (সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ, ১৯৭৯)                            



নদী 

ছোটবেলায় আমারো এক নদীর 

সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

এপার ওপার বিস্ময়। বলেছিলাম,

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছো?

নদী হাসলো। বললো, বালক

রবীন্দ্রনাথের হৃদয় হইতে।


বলেছিলাম, নদী তুমি কোথায় ফিরিবে?

নদী হাসলো। বললো, বালক

রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে।


আমাকে নেবে?

এসো! ভয় পেয়ো না।

আমার প্রতিটি তরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ।       (পুষ্পিত ধিক্কার, ২০১৬)



সাক্ষাৎ 


ভাবিনি এমন হবে। শুধু না দেখে না দেখে

না পেয়ে না পেয়ে

ঘটনাদুর্লভ দিন কেটে গেছে অবসাদে

অবিরামে।

আজ কেন এমন হলো যে।

তুমি যাচ্ছো একেবারে সামনে রাস্তায়

দুপায়ের ছন্দে জোড়া শালিখের আসন্ন মঙ্গল

পৃথিবীর চিত্রিত কুশল।


আর আমি সেই রাজার নর্তক

উচ্ছল ভ্রূক্ষেপহীন

যেন সে সময় নেই বলবো তোমাকে

একটু দাঁড়াও

অজন্তার গুহাগৃহে অবলুপ্ত অপরূপ

মোহ।                                     (পুষ্পিত ধিক্কার, ২০১৬) 




ছর কুড়ি বাইশ 

(কবি ঋতম্‌ মুখোপাধ্যায়কে)


দরজাটা বাজছে। দাঁড়িয়ে আছে এক

কুড়ি বাইশ বছরের তরুণ মহিমা

হাতে তার ফুল নয়

বিস্তৃত উদ্যান।

মুখে প্রথম আলোর স্থিতি।

যেন এক উদ্গত আশ্চর্য দেশ

যেন প্রথম দিগন্তের তোড়া বাঁধা হাত।


এসো অপেক্ষা

এসো মধুবাতা

এসো বোধন।        (দেরী হবে রে...তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ, ২০২৩) 





তথ্য সংকলন ছবি : ঋতম্‌ মুখোপাধ্যায়