বাংলা কবিতার
বিশশতক১.
বিশশতক বাংলা কবিতার স্বর্ণসময়।চর্যাপদ থেকে শুরু করে ধারাবাহিক ভাবে পর্যবেক্ষণে এটা সন্দেহাতীত ভাবে বেরিয়ে আসবে যে এই একটি শতকে যতো বেশী ভালো কবি এসেছেন এবং তাদের হাত দিয়ে যতো উৎকৃষ্ট কবিতা বেরিয়েছে তার তুলনা, ঊনিশশতকের মধুসূদন দত্তের কথা মনে রেখেও, আগের কোনো শতকের সাথে চলে না। এ সময়ে কবিতা রোমান্টিকতা থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার গোড়াপত্তন করেছে; এবং এক পর্যায়ে স্পর্শ করেছে কাক্সিক্ষত চূড়া। সাথে সাথে নতুন বাঁক নিয়ে বিশ্বকবিতার উত্তরাধুনিক ধারার সাথে প্রবল জোয়ারের স্রোতে একীভূত হয়ে চলমানতাকে সমুন্নত রাখতে সক্ষম হয়েছে। উপর্যুপরি রোমান্টিকতা, আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার ভেতরেও ছোটো ছোটো বাঁক লক্ষ্য করা গেছে, যেমন বিদ্রোহ, সাম্যবাদ ইত্যাদি; এবং এইসব ক্ষেত্রেও কোনো কোনো কবি বলয় ভেঙে বেরিয়ে এসে বুনন, ভাষার সৌকর্য, ছন্দের ব্যবহার, চিত্রনির্মাণের অভিনবত্ব দিয়ে বিশাল স্রোত তৈরী করে প্রকারান্তরে বাংলা কবিতাকেই এগিয়ে নিয়েছেন।
আজ আর অনস্বীকার্য নয়, রোমান্টিকতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসার যে প্রচেষ্টা তার ভেতর দিয়ে বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার সূচনা। কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” বা ওই ধারার কবিতা রবীন্দ্রবলয় ভেঙে আসার জন্যে তিরিশি পঞ্চপাণ্ডব─জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু─ও তাঁদের সহযাত্রী আধুনিক কবিদেরও ভিন্ন ধারার কবিতা রচনায় এবং নানাবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষায় যথেষ্ট সাহস যুগিয়েছিলো; যদিও নজরুল নিজে ছিলেন রোমান্টিক ধারার কবি। তাঁর দেশাত্ববোধ, সাম্যবাদী কবিতা, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের আপ্রাণ চেষ্টা বা শিকল ভাঙার গান সবই এক ধরনের রোমান্টিকতা, যদিও প্রক্ষেপণের সামগ্রিকতা ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা; এবং আজ যাঁকে আধুনিক কবিতার শ্রেষ্ঠতম ফসল বলে মনে হয়, সেই জীবনানন্দ দাশও শুরুতে কতোটা নজরুল দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন তা তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাঠেই স্পষ্ট হয়। এমনকি এও বলা যায়, পুরোপুরি একশত আশি ডিগ্রী ঘুরে এই কবি যদি তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থেই স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে না পারতেন তবে আজ যে জীবনানন্দকে নিয়ে আমরা গর্ব করি তাঁকে পাওয়া যেতো কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিলো; যদিও জীবদ্দশায় তিরিশি কবিতার কেন্দ্র তিনি হয়ে উঠতে পারেননি। স্বভাবের লাজুকতা ও ভীড় থেকে দূরে থাকার নিয়ত সাধনার কারণে সেটা সম্ভবও ছিলো না। তাই হাল ধরেছিলেন বুদ্ধদেব বসু, একখানা চটি পত্রিকার মাধ্যমে। ফলত কবিতা পত্রিকা ছিলো আধুনিক কাব্য প্রসবের প্রথম অপারেশন টেবিল যার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছিলেন এই ধীমান আধুনিক। তরুণ কবিদের দিকনির্দেশনা দেয়া, আধুনিক কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি কেমন হবে এ কবিতা, কেমন হবে এর ভাষা বিন্যাস তার একটি ছকও তিনি এঁকেছিলেন নিপুণ ভাবে। কখনো কখনো প্রাপ্ত কবিতাকে ওই অপারেশন টেবিলে ফেলে যথাসাধ্য কেটে ছিঁড়ে প্রকাশযোগ্য করে তুলেছেন। শতাব্দী পেরিয়ে এসে মনে হয়, যদি বুদ্ধদেব বসুর জন্ম না হতো তাহলে কি হাল হতো বাংলা ভাষার আধুনিক কবি ও কবিতার? আবিষ্কৃত কি হতেন জীবনানন্দ দাশ! কেমন হতো আমাদের কবিতার আধুনিক বা উত্তরাধুনিক ভাষা বিন্যাস?
তিরিশি কবিরা প্রাথমিক ভাবে রোমান্টিকতা-আক্রান্ত ভাষাকে পুরোপুরি বর্জন করতে না পারলেও তাঁদের শিখরস্পর্শী কাব্যবিন্যাসে ওই ভাষাভঙ্গির অনেকটাই লুপ্ত হয়েছিলো। তদুপরি, ছিটোফোঁটা আভাস এখানে-সেখানে, কানে-কলসিতে, ভাবভঙ্গিতে যা লেগেছিলো তাও উপ্ত হয়ে যায় পঞ্চাশের কবিতা থেকে। অতএব আধুনিকতার এই দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে─শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এমনকি ষাটের হুমায়ুন আজাদ সহ একঝাঁক কবির হাত ধরে বাংলা কবিতা আধুনিকতার চূড়া স্পর্শ করে। অন্যদিকে তিরিশি কবিদের সহযাত্রী হয়েও জসীমউদ্দীন থেকে গেলেন নিজের গোত্রে; পূর্ণ করে দিলেন ব্যালাডের বেলাভূমি। আর সাম্যবাদের ছায়ায় বেড়ে ওঠা চল্লিশের কবিরা পরবর্তী সময়ে কিছুটা ম্লান হয়ে উঠলেও, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের কাব্যধারার বিপুল গতিবেগের কারণেই আলাদা স্রোত তৈরী করতে পেরেছিলেন।
একটু পরখ করলেই দেখতে পাই যে প্রথম মহাযুদ্ধের পরে যেমন বেরিয়ে এলেন নজরুল এবং তারই ধারাবাহিকতায় তিরিশ, ঠিক তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হতেই ’৪৭-এর দেশ বিভাগ আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক ও পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে যে বিপুল প্রভাব ফেলে তার থেকে হয়তো বেরিয়ে আসেন পঞ্চাশের উজ্জ্বল কবিরা; পশ্চিমা হাঙ্গরি জেনারেশনের আদলে এর একটি সূত্র ধরে রাখতে সক্ষম হয় ষাটও। এরই মাঝে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন যুগিয়ে যায় বিপুল শক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যতোই ঘনিয়ে আসে ততোই বেগবান হয় পঞ্চাশ ও ষাটের কবিদের কলম। তুঙ্গে থাকা তাদের শক্তি শব্দের মিতব্যয়ী অভ্যাসে পূর্ণ করে তোলে বাংলা কবিতার প্রতিটি প্রকোষ্ঠ। অথচ স্বাধীনতা উত্তর কবিদের ভেতর থেকে উৎকর্ষতার সেই ধারাটি নানা কারণে স্তিমিত হয়ে যায়। স্লোগান ধর্মিতা, অতিকথন ও নাম সর্বস্বতা বাংলা কবিতাকে গ্রাস করে। প্রকাশ ও দলবদ্ধতাই বড়ো হয়ে দেখা দেয়। কবি থেকে অকবিকে আলাদা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। হঠাৎ করে প্রকাশের অনেকগুলো মাধ্যম পেয়ে যাওয়া কবিতার এই নিম্নমুখীতার কারণ হতে পারে; রাতারাতি গজিয়ে ওঠা অসংখ্য পত্রিকা সাহিত্যের ধারাবাহিকতার বিবেচনায় না যেয়ে খাতা-কলমের ঠোকাঠুকিকেই উৎকর্ষের অলীক নিক্তিতে তুলে দিতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গেও এর তেমন বেতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না। এ সময়ের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অকাল মৃত্যু যেমন কাব্যাঙ্গনের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে, তেমনি জয় গোস্বামীর একটি বাজারমুখী সংস্থার সাথে যুক্ত হওয়া তাঁর শক্তিকে ম্রিয়মান করে তোলে। তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু শৈল্পিক মান সম্পন্ন উৎকৃষ্ট কবিতা প্রকাশের যে হালটি ধরেছিলেন, সেটি বেয়ে নেয়ার মতো আর কেউ জেগে ওঠে না।
স্বীকৃতি পাগল পঞ্চাশ বুদ্ধদেব বসুর ছায়ায় নিজেদের পুষ্ট করার রসদ পেয়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পত্রিকা সম্পাদনার কাজে হাত দেন না; বরং অসংখ্য বাজে বইয়ের ফ্ল্যাপ লিখে কবি ও অকবির ভেতরের দূরত্ব কমিয়ে দিতে থাকেন। ফলত, বিপুল সংখ্যক অকবির সাথে উচ্চারিত হতে থাকে দু’একজন কবির নাম; ওঁদের আলাদা করার তাগিদ অতোটা জোরালো হয়ে ওঠে না।
আশিতে সামরিক জান্তার করালে কবিতা আরো দুরূহ হয়ে পড়ে; যদিও ইনিয়ে বিনিয়ে এসময়ের কিছু কবি আলাদা হওয়ার চেষ্টা চালান, তথাপি উপযুক্ত চর্চা ও মেধা-শূন্যতার কারণে তারাও হাঁপিয়ে ওঠেন। অতএব একটি বা দু’টি কবিতা ফুটে উঠলেই তৃপ্তির ঠেকুর তুলতে থাকেন; যদিও এইসব কবিদের হাতে উত্তরাধুনিকতার ধারাটি লালিত হওয়ার যথার্থ সুযোগ এসেছিলো। শতাব্দীর শেষ দশকে, যখন পৃথিবী জুড়ে অন্তর্জালের বিস্তার; বইছে উদার নৈতিক হাওয়া─ঢাকা-নিউইয়র্কের দূরত্ব যখন মাউসের একটি ক্লিকে এসে ঠেকেছে, মানবেতিহাসের বিপুল ভাণ্ডার হয়েছে সকলের জন্যে উন্মুক্ত─তখনই একঝাঁক কবি বিপুল শক্তি দিয়ে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন বাংলা কবিতার ঐতিহ্যিক ধারা─বাঁক বদল হয়─ বিকশিত হয় উত্তরাধুনিকতা এবং শূন্য দশকেও দেখা যায় এর নানামুখী বিস্তার।
২.
রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার ছান্দিক দুর্বলতার জায়গাটি পূরণ করে দিয়েছিলেন। রোমান্টিকতার বিপুল ঐশ্বর্য বইয়ে দিয়ে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কারণ নোবেল পুরস্কার পাবার পর যে ২৮ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, সেই সময়কালে কোনো বাঙালি কবিকে বিপুল সংখ্যক পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া তো দূরের কথা, পশ্চিম থেকে বাংলা কবিতার একটি সংকলন প্রকাশেরও ন্যূনতম উদ্যোগ তিনি নেননি। হতে পারে, তিনি বাংলা কবিতার আধুনিক ধারাকে মেনে নিতে পারেননি─যা স্পষ্ট হয় শেষের কবিতায়─যদিও আধুনিকেরা রবীন্দ্রনাথকে সর্বদাই উপযুক্ত মর্যাদার আসনে রেখেছিলেন। কিন্তু, একটি শতাব্দী পেরিয়ে পিছনের দিকে তাকালে আজ স্পষ্ট হয়ে যায় যে আমাদের চারিদিকের পঙ্কিলতা, যন্ত্রণা, নগর সভ্যতার অসহিষ্ণুতা, ব্যথাদীর্ণ জটিল একটি আধুনিক জীবনে তিরিশের কবিরাই বেশী প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। জারিত যন্ত্রণার স্বরূপ এ পর্যায়ে অনেক বেশী অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। ওইসব কবিতা তাই আরো বেশী আপন হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। এদের মধ্যে নাই রোমান্টিকতার সহজ সরল সৌন্দর্য বা আবেগী প্রেমের নরম সান্নিধ্য কামনার ভিজে তিরতির স্বাচ্ছন্দ্য; কিন্তু অবক্ষয়মান সভ্যতার কণ্টকাকীর্ণ খোয়া-ওঠা বিষাধগ্রস্থ ধোঁয়াদীর্ণ একটি সময় জীবনের সমস্ত জটিলতা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে এইসব কবিতায়। ফলতঃ সুন্দরের সরল বর্ণনা আর সার্থক প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া রোমান্টিক মনন বাদ দিয়ে, অর্থাৎ নিজের সমৃদ্ধির স্তর রেখে, রবীন্দ্রনাথ যখনই আধুনিক কবিতা বা গদ্য কবিতা লিখতে বসেছেন তখনই সহজ চৈতন্যের দ্বারে এসে ধাক্কা খেয়েছেন; যেখানে তিরিশের কবিদের হাতে নির্মিত আধুনিক কবিতা উৎকর্ষতার শিখর ছুঁয়েছে। তাই “বোধ” বা “শাশ্বতী”র সামনে “আমি”বা “সাধারণ মেয়ে” অনেকটাই ঝুলে পড়েছে। স্পষ্টত, “যে মহান জটিলতা তিরিশের পাঁচ কবির মধ্যে রয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে নেই, যদিও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অন্যরকম আবেগের তীব্রতা রয়েছে, অসামান্য সারল্য রয়েছে (হুমায়ুন আজাদ)।”যে সারল্য হয়তো আধুনিক কবিতার জন্যে বেশ বেমানান। যদিও “উপলব্ধি ও শিল্পিতায় উৎকৃষ্ট মধ্যযুগের যে-কোনো ধারার কবিতার থেকে, আর মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সাফল্য সত্ত্বেও বাঙলা মহাকাব্যিক ও রোম্যান্টিক কবিতার থেকে অনেক উন্নত আধুনিক বাঙলা কবিতা (হুমায়ুন আজাদ)।”কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত ও কলম ঠোকাঠুকির প্রবন্ধকার এমনকি আবৃত্তিকারেরাও লোক ঠকানোর মাধ্যম হিসেবে কবিতার সরলতাকে প্রাধান্য দিয়ে গেছেন, এবং কৌশলে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন জটিল জীবনের জ্বালা-পোড়ন ও বহুরৈখিকতাকে। অন্যদিকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক কবিযশপ্রার্থীরাও হয়েছেন প্রচারসর্বস্ব। প্রধান কবিদের হাতেই রচিত হয়েছে উৎকৃষ্টতর কবিতার স্বর্ণদানা, যদিও সিংহভাগ ক্ষেত্রে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা এসেছে অনেক দেরীতে। প্রচলিত ধ্যান ধারণার থেকে আলাদা, এমন কিছু মেনে নিতে প্রভূত সময় নিয়েছে পাঠকসমাজ।
একদা কবি ছিলেন সমাজের গুরুত্বস্থানীয় ব্যক্তি, যার লেখা ‘বাণী’ রূপে স্থান পেয়েছে সবার উপরে। তার ভাবনায় ব্যতিব্যস্ত হয়েছে মানুষ, মুষড়ে পড়েছে তার ব্যথায়। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে এমনই একটি অবস্থা যখন ইয়োরোপীয় কবিদের, তার ঢেউ জাহাজে ভেসে এসে বাংলায়ও পড়েছিলো বইকি! অতএব গুরু-শিষ্যের মধুর উপলব্ধিতে কবি যেমন হয়ে উঠতেন বিভোর, তেমনি সমাজের একশ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ তাকে উঁচু আসনে বসিয়ে পদসেবা করতে চাইতেন প্রতিনিয়ত। তাই, রাজসভা বা রাজার পৃষ্ঠপোষকতা ও নেক নজর কবির উপরে থাকতো সমাসীন। রাজাকে নিয়ে কাব্য লেখা বা রাজার অনুরোধ রক্ষা ছিলো কবির প্রধান কাজ। (সেই আদলে এখনো ইংল্যান্ডে রয়েছেন রাজকবি এবং আমেরিকায় পোয়েট লরিয়েট, যদিও রাজাকে নিয়ে এখন ওঁদের এতোটা ব্যস্ত থাকতে হয় না।) সম্ভবত এই অবস্থার প্রথম পরিবর্তন চান শার্ল বোদলেয়ার; কি ভাষায়, কি বক্তব্যে, কি উপস্থাপনায়, কি জীবনাচরণে, দিনানুদৈনিক নিপুণতায়; তাই তিনি প্রথম আধুনিক কবি। “প্রফেট অব মডার্নিটি (জনাথন কুলার)।” তাঁর হাতে ‘সুন্দর’ নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়। শিল্পে আসে নতুন আশাবাদ। অন্যদিকে বিশ শতকের শুরুর দিকে─প্রধানত বিশের দশকে─বাঙালী কবির এই সামাজিক মোড়লত্বের বিশেষ রূপটি আস্তে আস্তে উঠে যেতে থাকে। নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে রুটির দোকান থেকে উঠে আসা একজন জেলখাটা নজরুল; বাস্তবিক আলাভোলা চৈতন্যের অসাধারণ সাধারণ মানুষ─চাকরী হারানো একজন জীবনানন্দ; দাদীর সাহচর্যে বেড়ে ওঠা মা-মরা শিশু─আধুনিক কবিতার জন্যে অনন্ত নিবেদিত একজন বুদ্ধদেব; চাষীদের হৃদয় উৎসারিত হালের গরুর সাথে দৌড়ানো একজন জসিমউদ্দীন এসে ভিড়ে যান কাব্যান্দোলনের সাথে। সাম্য ও ন্যায়ের জন্যে কলম ধরেন একজন সুকান্ত, পথ হেঁটে হেঁটে মানুষের পায়ের ভাষা উপলব্ধি করেন একজন সুভাষ। মিছিলে মিছিলে ঘুরে স্বাধীনতাকামী জনতার বুকের কথা লেখেন একজন শামসুর। তাইতো আমাদের আধুনিকতা, যেখানে রাস্তার পাশে মরে পচে থাকা পশুটিও শিল্পের উপজীব্য হয়ে ওঠে, না-খেয়ে অসুস্থ মায়ের পেটের উপর হামাগুড়ি দেয়া শিশুটির কান্না ধ্বনিত হয়, কুষ্ঠ রোগীর জল খাওয়ার শব্দ আঁকা থাকে। বন্দুকের নলের সামনে─ধর্মীয় দাঙ্গা হানাহানি, রক্তের স্রোতে, এমনকি উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-স্বৈরতন্ত্রের উঁচিয়ে ধরা ঝাণ্ডার মুখে প্রতিবাদী কিম্বা পলায়নপর মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে কবিতা। ‘আমি’ হয় একযোগে সবার প্রতিচ্ছবি। ‘আমার’ অভিজ্ঞতা-জারিত শক্তি সময়কে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে ঘাড় ধরে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় উৎকৃষ্ট
শিল্পের সুষমায়।
তাহলে কবিতা
কি নিপীড়ন,
নির্যাতন, শোষণের
প্রতিবাদ? মিছিলের
প্রত্যয়ী আওয়াজ,
প্রেমিকের রাঙা
দুলদুল, আকাশের
মেঘ, সমুদ্রের
ঢেউ, গঙ্গা
ফড়িঙ? নাকি
একেকজন ‘আমি’র
অভিজ্ঞতা-প্রসূত
পরিশীলিত আবেগের
সামগ্রিক দলিল?
অথবা এইসব
প্রশ্নের মুখাপেক্ষী
হতে না-চাওয়া
সৃষ্টির আলাদা
জৌলুস? আমরা
যা কিছু
কল্পনা করি
বা করতে-পারি-না,
যা কিছু
ভাবি বা
ভাবতে-পারি-না,
যা কিছু
বুঝি বা
বুঝতে-পারি-না
বা যা
কিছু উপস্থাপন
করি বা
করতে-পারি-না;
কবিতা কি
তার সমস্তটাই?
হয়তো তাই।
কিন্তু বলার
ভঙ্গি, বুননের
ঢং, নির্মাণের
সৌকর্য, ছান্দিক
অবয়ব, চিত্রকল্পের
মাধুর্য, উপমার
অভিনবত্ব সব
কিছু মিলেই
ভাষার এক
অনন্য অবস্থান।
শ্রেষ্ঠতম শব্দের
শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস।
তাকে বাধা
যায় না
কোনো সংজ্ঞায়ই,
আবার সব
সংজ্ঞাই সে
মেনে চলে।
ছোঁয়া যায়
না কোনো
ভাবেই, আবার
সবটাই ছুঁয়ে
থাকে পরিপূর্ণ
শরীরের চঞ্চলতায়।
অনুভব করা
যায় না
কিন্তু সতত
অনুভূতিকে নাড়াও
দেয়। কাল,
অবস্থান, পারিপার্শ্বিকতার
দোলাচলে এই-সব-কিছু
নিয়ে আবার
পাল্টেও যেতে
থাকে─হয়ে
উঠতে থাকে
আরো প্রাসঙ্গিক।
বদল করতে
থাকে বাঁক।
একই বাঁকের
সহযাত্রী থাকা
সত্ত্বেও “কবিদের
মধ্যে ব্যক্তিস্বরূপের
বৈশিষ্ট্যগত প্রচুর
পার্থক্য[ও]
দেখা যায়
(বুদ্ধদেব বসু);”
আর এই
পার্থক্য কবিতাকে
করে তোলে
বিচিত্র, বহুমুখী;
ছন্দে প্রকরণে
মনস্বিতায়।
আমাদের
পরাক্রমশালী রোমান্টিকতা
মিলে যেতে
পারেনি সাধারণ
মানুষের সাথে।
“মৃত্যুর কিছুকাল
আগে (মাঘ,
১৩৪৭) গভীর
বেদনায় তিনি
[রবীন্দ্রনাথ] স্বীকার
করেছেন, এইসব
মানুষের ভেতরে
তিনি প্রবেশ
করতে পারেননি,
কারণ, ‘বাধা
হয়ে আছে
মোর বেড়াগুলি
জীবন-যাত্রার
(শিবনারায়ণ রায়)’।”
অথচ পরবর্তীতে
কবিরা ওইসব
মানুষের সাথে
মিলে, তাদের
দুঃখ-শোক
আনন্দ-ভালবাসায়
অংশ নিয়ে
কবিতা যেমন
বদলে ফেলতে
থাকেন, তেমনি
ব্যাপক পঠন-পাঠনের
ভেতর দিয়েও
পরিবর্তনের জোয়ারে
প্রবল বেগের
সঞ্চার করেন।
পশ্চিমের নানা
তন্ত্র, মূল্যবোধ,
ভাব-ভাষা
পুবের আলো-বাতাস
ও নদীমাতৃক
ঐতিহ্যের সাথে
মিশে যায়।
“বাঙালির ব্যক্তি
স্বাতন্ত্র্যে এসে
মিলল ইয়োরোপীয়
বুদ্ধিবিলাস, এবং
তার ফলে
ব্যক্তি চেতনার
যে-সূক্ষ্ম
ও উগ্র
পরিণতি, তার
অতিবর্ধনে ব্যক্তির
ব্যক্তিত্ব পর্যন্ত
বিছিন্ন ও
খণ্ড বিখণ্ড
হয়ে পড়ল
(হুমায়ুন কবির)।”
আধুনিকতায় বহুবিচিত্রতা
যুক্ত হওয়ার
এটিও একটি
গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
ফলত, “এ
যুগ অনেক
লেখকের─একজনের
নয়─অনেকজন
কবির যুগ
(জীবনানন্দ দাশ)।”আধুনিক
কবিতা তাই
পৌরহিত্যের নয়,
অংশীদারিত্বের।
৩.
বাংলা কবিতার
জন্যে “কবিতা
নানা রকম
(জীবনানন্দ দাশ)”
উক্তিটি বেশ
তাৎপর্যপূর্ণ। একই
ভাষার মধ্যে
থেকেও একজন
প্রধান কবি
যেমন অন্যজন
থেকে আলাদা,
তেমনি কাব্যাঙ্গনে
উত্থিত ছোটো
ছোটো ঢেউগুলোও
যথার্থ মনোযোগ
দাবি করে।
যেখানে বোবা অতীত তার ভাঙা কীর্তি কোলে নিয়ে নিস্তব্ধ
(শিশুতীর্থ/ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর)
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন
আমি থর-থর-থর
প্রথম প্রকাশ
কুমারীর!
(বিদ্রোহী/কাজী
নজরুল ইসলাম)
তোমার পাখনায়
আমার পালক,
আমার পাখনায়
তোমার রক্তের
স্পন্দন─
নীল আকাশে
খইক্ষেতের সোনালি
ফুলের মতো
অজস্র তারা,
শিরীষ বনের
সবুজ রোমশ
নীড়ে
সোনার ডিমের
মতো
ফাল্গুনের চাঁদ।
(আমি
যদি হতাম/জীবনানন্দ
দাশ)
আমি
বিংশ শতাব্দীর
সমানবয়সী; মজ্জমান
বঙ্গোপসাগরে; বীর
নই, তবু
জন্মাবধি যুদ্ধে
যুদ্ধে, বিপ্লবে
বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি
দেখে, মনুষ্যধর্মের
স্তবে
নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে
অবিশ্বাসী, প্রগতিতে
যত না
পশ্চাৎপদ, ততোধিক
বিমুখ অতীতে।
(যযাতি/সুধীন্দ্রনাথ
দত্ত)
যীশু
কি পরোপকারী
ছিলেন তোমরা
ভাবো? না
কি বুদ্ধ
কোনো সমিতির
মাননীয় বাচাল,
পরিশ্রমী, অশীতির
মোহগ্রস্ত সভাপতি?
উদ্ধারের স্বত্বাধিকারী
ব্যতিব্যস্ত পাণ্ডাদের
জগঝম্প, চামর,
পাহারা
এড়িয়ে আছেন
তাঁরা উদাসীন,
শান্ত, ছন্নছাড়া!
(রাত
তিনটের সনেট
: ১/বুদ্ধদেব
বসু)
তারপর কণা-কণা
রাত্রি মুখে
ক'রে
ফিরে
যায় আপন
বিবরে।
(ইঁদুরেরা/প্রেমেন্দ্র
মিত্র)
কে কতোটা
সমৃদ্ধ সেই
বিবেচনায় না
গিয়ে, বা
কার থেকে
কে বড়ো
কবি সেই
তর্কে ডুব
না দিয়ে,
অনায়াসে বলা
যায় উদ্ধৃত
কাব্যখণ্ডগুলি একে
অন্যের থেকে
আলাদা। চিত্রকল্প
নির্মাণ, বুননের
কৌশল এমনকি
ভাষা ব্যবহারের
দিক দিয়েও
স্বতন্ত্র এইসব
উচ্চারণ।
বিশ
শতকের শুরুর
দিক থেকে
এইভাবে কাব্যের
মহাসমুদ্রে অবগাহন
করলে এমনতর
নতুন নতুন
ঢেউয়ের দেখা
পাওয়া যায়
প্রায়শই। চোখ
কান খোলা
রেখে হাঁটলে
শব্দও শোনা
যায় পাহাড়ী
ঝরণা থেকে
তিরতির গড়িয়ে
পড়া স্বচ্ছ
জলের। শব্দ
কাটার অপরিসীম
খেলা মুগ্ধতা
এনে দেয়।
স্পষ্ট দেখা
যায়, বিশশতকের
বাংলা কবিতা
ইংরেজী, ফরাসী,
জার্মান ইত্যাদি
ভাষার শিল্পকর্মের
সাথে পাল্লা
দিয়ে দাঁড়
টেনে চলে
বহুমুখী ধারায়।
যদিও প্রায়ই
সমালোচকদের কলমে
বাংলা কবিতার
উপর পশ্চিমী
প্রভাবের কথা
জোরেসোরে উঠে
আসে। কিন্তু
“বাংলা ভাষা
কবিতার ভাষা
(স্ট্যানলি বারকান)”
এটা ভুলে
গেলে চলে
না। এই
ভাষার ফ্রেমে
শক্তিশালী যে
কোনো প্রভাব
স্ব-স্বভাবে
আরো বেগবান
হয়ে ওঠে।
তাই এলেন
পো বা
ইয়েটসের প্রভাব
থাকার পরেও
জীবনানন্দকে মনে
হয়, অবশ্যই
অন্যান্য ভাষার
বড়ো কবিদের
কথা স্মরণে
রেখে, বিশ
শতকের শ্রেষ্ঠ
কবি।
একবিংশ শতাব্দীর সিঁড়িতে পা রেখে বিশ্বখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিতগণ মনে করেন সংস্কৃত ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান সমস্ত ভাষার মূল; তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া হয় যে বিষয়টি সঠিক, তবে পুবের সাথে পশ্চিমের একটি সেতু তো আদিকাল থেকেই নির্মিত হয়ে আছে। আর সেই সেতু দিয়ে আসা যাওয়া করেছে নিমগ্ন চিন্তার অজস্র রশ্মি। অতএব পুবের কবিতায় পশ্চিমের প্রভাবের আগে, পশ্চিমের কবিতায় পুবের প্রভাবও হয়তো খতিয়ে দেখা দরকার। মহাভারতের বিষয়াদি, আর চীন ও জাপানী কবিতার আঙ্গিক নিয়ে পশ্চিম যে কয়েক শতাব্দী আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো সে কথা ভুললে কি চলে? ওয়েস্ট ল্যান্ড-এ সংস্কৃত-র প্রভাব কি উড়িয়ে দেয়া যায়? অতএব শিল্পের উৎকর্ষতাই বড়ো কথা, প্রভাব যতোটা নয়। একদেশের সংস্কৃতির প্রভাব অন্যদেশের জীবনযাত্রার উপর, একদেশের ভাষার প্রভাব অন্যদেশের বাঁকনির্মাণের উপর এবং একদেশের অর্থনীতির প্রভাব
অন্যদেশের মুদ্রার
উপর চলছে
সভ্যতার শুরু
থেকে। অতএব
প্রভাব বা
ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপারে
বিচলিত না
হয়ে আবারও
ফিরে যাই
উৎকৃষ্ট কবিতার
কাছে।
পিরামিডে থাক
পিরীতি কফিন
ঢাকা
অহল্যা হোক
পিচ্ছিল হাতছানি,
প্রগলভ যুঁই
মেলুক বন্ধ্যা
শাখা,
চাঁদের চোখেতে
পড়–ক
অন্ধ ছানি।
উপবাসী রাত
অক্ষম অভিনেতা।
(পদাতিক/সুভাষ
মুখোপাধ্যায়)
হাজার-হাজার
বছরের ঢের
পুরনো প্রেমের
কবিতার রোদে
পিঠ দিয়ে
বসি, প্রগাঢ়
মদের
চঞ্চলা সেই
রসে-টুপটুপ
নর্তকী তার
নাচের নূপুর
বাজায়
হৃদয়ে মদির
শব্দে, ভ'রে
ওঠে সুরে
শূন্য দুপুর...
(রূপালি
স্নান/শামসুর
রাহমান)
পা থেকে
মাথা পর্যন্ত
টলমল করে,
দেয়ালে দেয়াল,
কার্নিশে কার্নিশ,
ফুটপাত
বদল হয়
মধ্যরাতে
বাড়ি ফেরার
সময়, বাড়ির
ভিতর বাড়ি,
পায়ের ভিতর
পা,
বুকের
ভিতরে বুক
আর কিছু
নয়...
(সে
বড়ো সুখের
সময় নয়.../শক্তি
চট্টোপাধ্যায়)
অতীতে যাদের
ভয়ে বিভেদের
বৈদিক আগুন
করতোয়া পার
হয়ে এক
কঞ্চি এগোতো
না আর,
তাদের ঘরের
ভিতে ধরেছে
কি কৌটিল্যের
ঘুণ?
ললিত সাম্যের
ধ্বনি ব্যর্থ
হয়ে যায়
বার বার:
বর্গীরা লুটেছে
ধান নিম
খুনে ভরে
জনপদ
তোমার চেয়েও
বড়ো হে
শ্যামাঙ্গী, শস্যের
বিপদ।
(সোনালী
কাবিন ৯/আল
মাহমুদ)
একাকী পথিক
ফিরে যাবে
তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির
গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত
ঠিক উঠবেই
ফুটে তারাপুঞ্জের
মতো,
পুরোনো গানের
বিস্মৃত-কথা
ফিরবে তোমার
স্বরে
প্রেমিক মিলবে
প্রেমিকার সাথে
ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি
পাবে না,
পাবে না,
পাবে না...
(সঙ্গতি/শহীদ
কাদরী)
অন্ধ রেলগাড়ি
বধির রেলগাড়ি
অন্ধ রেল
বেয়ে চলছে
দ্রুত বেগে
দু’চোখে
মরা ঘুম
আকাশে মরা
মেঘ সঙ্গে
মরা চাঁদ
অন্ধ আছি
জেগে
অন্ধ বগিগুলো
ক্লান্ত হয়ে
গেছে এগিয়ে
চলে তবু
অন্ধ প্রতিযোগী
চলছে ট্র্যাক
বেয়ে জানে
না কোথা
যাবে নষ্ট
রেলগাড়ি অন্ধ
দুররোগী
(অন্ধ
রেলগাড়ি/হুমায়ুন
আজাদ)
পরিলক্ষিত এই বাঁকটিও আধুনিক; বরং আধুনিকতার পূর্ণতা টানা হয় এখানেই। শব্দবন্ধ এখানে এসে সম্পূর্ণভাবে রোমান্টিকতা মুক্ত হয়ে যায়। তিরিশি আধুনিকতার যে ধরনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, ঠিক তারই স্পষ্ট সম্প্রসারণে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর পৃথিবীজোড়া নৈরাজ্য হাহাকার অত্যাচার আর অন্যায়ের বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে
যে ভাষা
নিয়ে, নগর
সভ্যতার যে
জ্বালাপোড়ন নিয়ে
হাজির হন
এইসব কবিরা;
বিশ শতকের
মাঝামাঝি সময়ে
তার প্রবল
জোয়ারে আরেকবার প্লাবিত
হয় বাংলা
কবিতা। এর
পরেও কিন্তু
এঁদের হাতছানি
চলে, এঁদের
স্বর্ণাক্ষর আলোকিত
করতে থাকে
আরো কিছুটা
কাল; যদিও
একক চৈতন্যের
উদ্ভাসনে তখনও
চলে এর
ধারাবাহিকতা; কারণ,
তুমি মহাশূন্য
কল্পনার
প্রচণ্ড উল্কাবর্ষণ─প্রচণ্ড
তাপ সহ্য
করেও তুমি
বেঁচে থাকো
তুমি রহস্যময়
আগন্তুক, সমুদ্রের
জলস্তম্ভের মতো...
(প্রিয়
ধ্বনির জন্যে
কান্না/শম্ভু
রক্ষিত)
পুবদিকে সাদা
করোটি রঙের
আলো
পিছনে নামছে
সন্ধ্যার মতো
ঘোর
পৃথিবীর শেষ
শ্মশানের মাঝখানে
বসে আছি
শুধু দুই
মৃতদেহ চোর!
(সৎকার
গাথা/জয়
গোস্বামী)
হাত বাড়ালেই
মুঠো ভ'রে
ওঠে ঋণে,
অথচ আমার
শস্যের মাঠ
ভরা।
রোদ্দুর খুঁজে
পাই না
কখনো দিনে,
আলোতে ভাসায়
রাতের বসুন্ধরা।
(খতিয়ান/রুদ্র
মুহম্মদ শহিদুল্লাহ)
বাংলা কবিতা অমিত সম্ভাবনার ধারক। সুদূর অতীত থেকে এমনই একটি প্লাটফর্ম তৈরী করে নিতে সক্ষম এই ভাষাস্রোতে যতোই গড্ডালিকা প্রবাহ চলুক, যতোই নাম সর্বস্বতায় ভরে উঠুক বর্তমানের আকুতি, যতোই পঠন-পাঠনের ব্যত্যয় ঘটুক, একটি ক্ষীণ স্রোত আপন মহিমায় নিজস্ব ঐতিহ্যকে ধারণ করে নিম্নসুরে প্রবাহিত হতে থাকে এবং কালক্রমে বিশাল বৃক্ষ রূপে আবির্ভূত হয়। অতএব আমরা বিচলিত হই না; সাময়িক বিরহের পর─হয়তো তা-ও কালের কোলে বিপুল কোনো সময় নয়, যেখানে মধ্যযুগে কিম্বা আদিপর্বে একজন প্রধান কবির জন্যে ভাষাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো শত শত বছর─আবারো ঋদ্ধ হয়ে ওঠে কবিতার অঙ্গন, উত্তরাধুনিকতার জোয়ারে। কিম্ভূত হবার কথা ছিলো, সার্কাস মুখরিত গ্রাম, আঁধারের সমান বয়স, ও আয়ুর সিংহাসন-এর মতো কয়েকখানা কাব্যগ্রন্থ হয়তো অগ্রণী ভূমিকা রাখে এ যাত্রায়, যদিও একে অন্যের থেকে এরাও যথেষ্ট আলাদা। এ পর্বে এসে আরো পাওয়া যায় মানুষ ও মহাবিশ্ব নিয়ে মহাকাব্যিক বুনন ও সনেটের নতুন আঙ্গিক। এ সবই সম্ভব হয় কারণ, “আরববিশ্ব কিম্বা ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় অন্যকোনো ভাষায় সুগোছালো আধুনিকতা ছিলো না যেমনটি দেখা যায় বাংলায়। বাংলাদেশের উত্তরাধুনিক ধারা সে জন্যেই মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের থেকে আলাদা হয়ে ওঠে (নিকোলাস বার্নস)।” ভাষার ভেতরে আধুনিতকার বিপুল জাগরণ ও উত্তরআশিতে অন্তর্জালের সাহচর্যে পৃথিবী একই ছাতার নিচে চলে আসায় বাঙালীর উত্তরাধুনিকতা হয়ে ওঠে ঋদ্ধ। অতএব, “উত্তরাধুনিকতা মুক্তি ও নতুনকবিতার আশ্বাস নিয়ে এসেছে। এই মুক্তি কাঠামোর ধ্রুবতা থেকে, নির্মাণ ও সংশ্লেষের দায় থেকে, আদর্শিকতার শর্ত থেকে, স্থির লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যের আবশ্যকতা থেকে, আখ্যানের ঘেরাটোপ থেকে, নির্দিষ্টতা থেকে সীমাহীন অনির্দিষ্টতায় উত্তরণের (ফয়জুল লতিফ চৌধুরী)।”
কিন্তু লক্ষ্য করার মতো, ’৪৭ পরবর্তী বাংলা কবিতায় বাংলাদেশের বা তৎকালীণ পূর্ববঙ্গের কবিতা যে বিপুল অবদান রেখেছে, এবং এখনও রাখছে, সেই অর্থে পশ্চিমবঙ্গের কবিতা অনেকটা দূরাবহ সম্পর্কের হয়ে পড়েছে। পঞ্চাশ ও ষাটের সেই ধারাবাহিকতা উত্তরাধুনিক কালেও পরিলক্ষিত। কবিতা পত্রিকার মতো একটি নিরপেক্ষ শিল্পমান সম্পন্ন কাব্য-প্লাটফর্মের অভাব, আনন্দবাজার গোষ্ঠী প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকায় পদলেহনবাদীদের প্রাধান্য ও হিন্দী ভাষার অভূতপূর্ব প্রভাব হয়তো এর মূল কারণ। বাংলাদেশের উৎকৃষ্ট কবিতার ধারা থেকে দেশ পশ্চিমবঙ্গের পাঠক ও কবিদের বঞ্চিত রেখেছে দশকের পর দশক। তবে আশার কথা কলকাতা বা কলকাতার বাইরের বিপুল সংখ্যক লিটল ম্যাগাজিন বাজার-সংস্কৃতির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের দৈনিক কাগজ নির্ভর সাহিত্য পাতাগুলো আনন্দবাজার স্টাইলে গোষ্ঠী নির্ভর হয়ে পড়ায় স্বাধীনতা উত্তর কবিতায় গড্ডালিকা প্রবাহকেই সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা দেখা যায়, যদিও শক্তিশালী কবিরা ওই ফাঁদে পা দেননি। প্রচার সর্বস্বতাই সাহিত্যের উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি নয় এই প্রত্যয়ে সুদৃঢ় থাকতে দেখা গেছে প্রকৃত কবিদের; তিরিশ, পঞ্চাশ, ষাট ও নব্বইয়ে এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
[লেখক সম্পাদিত ‘বিশশতকের বাংলা কবিতা’ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০১৫) সংকলনের ভূমিকা থেকে]
[মতামত লেখকের নিজস্বঃ সম্পাদক 'রঙিন ক্যানভাস']