রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

সম্পূর্ণ সূচি (বর্ষ ১ ।। সংখ্যা ১০) [আগস্ট সংখ্যা]

 


ঋতম্‌ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"


 উইলিয়াম ওয়ার্ডসোয়র্থ (১৭৭০-১৮৫০) : আড়াইশোতম জন্মবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য

বাজে অফুরান সে-গানের রেশ বাজে

১.

Type of the wise who soar, but never roam

True to the kindred points of Heaven and Home!  (To The Skylark)

 

ওয়ার্ডসোয়র্থের সঙ্গে আমার পরিচয় সিলেবাসের হাত ধরেই। ছোটবেলায় বাবা তরুণ মুখোপাধ্যায়-এর মুখে কিটসশেলি আর কোলরিজের নাম কিংবা কবিতাংশ বারংবার শুনেছি। ক্রিস্টাবেলের গল্প শুনে কাঁটা দিয়ে উঠত গায়ে। কিন্তু ‘লুসি’ ছাড়া সেভাবে ওয়ার্ডসোয়র্থের নাম বা কবিতা শুনিনি। তাই উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসেই আমি প্রথম পড়েছিলাম তাঁকে। পাঠ্য কবিতার নাম ‘দি সলিটারি রিপার যদিও  সংকলনে অন্যান্য কিছু কবিতাও ছিল ওয়ার্ডসোয়র্থের। যথা : দ্য রেভারি অব পুওর সুসানসারপ্রাইজড বাই জয় স্লাম্বার ডিড মাই স্পিরিট সিলবাই দ্য সী। এর বাইরেও মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম ‘দ্য ড্যাফোডিলস্‌’, ‘টু  স্কাইলার্ক’ কিংবা ‘মাই হার্টস লিপস্‌ আপ’ কবিতাগুলি। আমার বড়পিশেমশাই জাতীয় শিক্ষক অরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও ওয়ার্ডসোয়র্থ অনুরাগীতাঁর কাছে একবার ‘দি ফ্রেঞ্চ রেভোলিউশন...’ পড়েছিলাম মনে পড়ে। কিন্তু পাঠ্য থাকার কারণেই ‘দ্য সলিটারি রিপার’ বারবার পড়তে হয়যার অভিঘাত আজও ভুলিনি। এক সামান্যা কৃষাণীর গানকে কেন্দ্র করে প্রকৃতি  মানুষের যে অসামান্য মেলবন্ধন রচনা করেছেন কবিসঙ্গে জুড়ে আছে লোকজীবনের চেনা ছবি -  তা যেন তাঁর সমস্ত কবিতার মূলমন্ত্র। কবিতার ভিতরে ‘নেচার পোয়েট’ হিসেবে সেই যে ওয়ার্ডসোয়র্থকে চেনা শুরুতারপর কলেজে পড়তে গিয়ে এবং পড়াতে গিয়ে সেই পরিচয় নিবিড়তর হয়েছে। তবে হ্যাঁছোট কবিতার সূত্রেই তাঁকে পড়েছি। দীর্ঘ প্রিলিউড পড়া হয়ে ওঠেনি আমার। বাংলা অনার্সে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়ার সময় বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়  প্রদীপরঞ্জন সেনগুপ্ত সম্পাদিত ‘ওয়ার্ডসোয়র্থ  তাঁর কবিতা’ (সাহিত্যলোক১৯৯৯বইটি হাতে এসেছিলো। সেখানে বেশ কিছু বাংলা প্রবন্ধ  বঙ্গানুবাদে ওয়ার্ডসোয়র্থকে পড়ে আরো একবার ভালো লাগা শুরু। প্রকৃতি মানুষ আর স্মৃতিলোকের এক চেনা জগৎ তাঁকে আমার প্রিয় করেছিলো। তাছাড়াও শিশুশ্রমিক সুসানের দিবস্বপ্নের বেরঙিন হয়ে যাওয়াগভীর সুপ্তির মায়া কিংবা সমুদ্রের প্রশান্তি – উদারশান্ত আর নির্জন এক অন্তর্লোক আমি আজও পাই তাঁর কবিতায়।

 


২.

যদিও এই ওয়ার্ডসোয়র্থকে কেন্দ্র করে আরো একটি বিষণ্ণ স্মৃতি রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক আর্টস নিয়ে জেলা বৃহত্তর কলকাতা থেকে প্রথম হওয়ার পর ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ি, বাবা-মায়ের তেমনই ইচ্ছে ছিল। প্রেসিডেন্সির ইংরেজি অনার্সের প্রবেশিকা পরীক্ষায় যে-কবিতাটি উদ্ধার করে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছিল, আজও মনে পড়ে সে কবিতাটি ওয়ার্ডসোয়র্থেরলুসিকবিতাগুচ্ছের একটি অংশ।  ততদিনে তাঁর কবিসত্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে গেছে। প্যালগ্রেভেরগোল্ডেন ট্রেজারিথেকে তাঁর আরো কিছু কবিতা পড়েছি, অ্যালবার্টের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে জেনেছি তাঁর জীবনী কবিকৃতি। অতএব অন্যান্য কঠিন প্রশ্নের পাশে কবিতাটি আমার কাছে মরূদ্যানের মতো মনে হয়েছিলো। জুন মাসের গোলাপ আর লুসির যৌবনের সাদৃশ্য বছর আঠারোর তরুণের কাছে মনোমুগ্ধকর ছিল সন্দেহ নেই। ফলেআনসিনপ্রবেশিকা পরীক্ষায় আগে পড়া এমন একটি কবিতাকমনপেয়ে প্রাণ খুলে লিখেছিলাম। ২০০১ সালের সেই প্রশ্নপত্র আর বাড়ি ফিরে স্মৃতিমন্থন করে লেখা উত্তরপত্রের প্রতিলিপি আজও সযত্নে ফাইলে রাখা আছে দেখি। সকলের চেনা সেই কবিতাটির প্রথম দুই স্তবক এইরকম :  

Strange fits of passion have I known:

And I will dare to tell,

But in the Lover’s ear alone,

What once to me befell. 

 

When she I loved looked every day

Fresh as a rose in June,

I to her cottage bent my way,

Beneath an evening-moon.

 

প্রশ্নপত্রে -কবিতার চাঁদ ঘোড়ার তাৎপর্য এবং কবিতার থিম ভাষা-ছন্দ-অলংকার নিয়ে সংক্ষেপে লিখতে বলা হয়েছিল। আর সেইসঙ্গে একটি উপযুক্ত নামকরণ। আমি নাম দিয়েছিলাম লাভার্স ড্রিমতথা এক প্রেমিকের স্বপ্ন। সমগ্র কবিতা জুড়ে লুসি নামের এক তরুণীকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আর হারানোর ভয় মিলেমিশে রয়েছে। যদিও সে অপ্রাপণীয়া। চাঁদনি রাতের মাধুর্য আর রোম্যান্টিক আবহ যেন পাঠকের মনে স্বপ্নের মায়া রচনা করে; অন্যদিকে ঘোড়ায় চড়ে লুসির কাছে পৌঁছতে চাওয়া যেন উচ্চাকাঙ্ক্ষার রূপক হয়ে ওঠে। বেশ একটা পুরুষালি  মিলের (hoof / roof, head / dead, stopped/ dropped etc) কথাও ভেবেছিলাম তখন। আসলে এই কবিতায় আমাদের চেনা জগতের ছবিপ্রেম, স্বপ্ন আর না-পাওয়ার বেদনামাধুরী প্রাঞ্জল ভাবে উঠে এসেছিলো বলেই তা আজও পাঠকের কাছে আবেদন রাখে। কবিতার অন্তিমে চাঁদে ডুবে যাওয়া অন্ধকারে প্রেমিক কবির আর্তি আমাদের মনকে বিষণ্ণ করে :

What fond and wayward thoughts will slide

Into a Lover’s head!

‘O mercy!’ to myself I cried,

‘If Lucy should be dead!’

(অনেক পরে পড়েছি হীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এই তরজমা : প্রেমিক খেয়ালী প্রাণীতোমরা নিশ্চয় জানো তাহা – / কী-যে ঘটে তাহার অন্তরে! / ‘দয়া করো, দয়া করো’, কেঁদে উঠি, ‘আহা / লুসিকে নিও না তুমি কেড়ে।)  

না, এই প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম তালিকায় আমার নাম ওঠেনি। ভাষা ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের মতো প্রাঞ্জল নয়, শুনেছিলাম এটাই আমার ত্রুটি। তাই শ্রীরামপুর কলেজে ইংরেজি অনার্সের সুযোগ পেলেও ভর্তি হইনি প্রেসিডেন্সির প্রবেশিকা পরীক্ষাকে মানদণ্ড মেনে নিয়ে। পরিবর্তে প্রায় প্রস্তুতিহীনভাবে দেওয়া বাংলার প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হই। আমার শ্রদ্ধেয় ইংরেজির অধ্যাপক সুব্রত রায়চৌধুরী আমাকে বাংলা নিয়ে পড়তে বলেন, মনও তাতেই সায় দেয়। আর দ্বিতীয় তালিকার জন্য অপেক্ষায় না থেকে বাংলা পড়তে চলে আসি প্রেসিডেন্সিতে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গ ছাড়িনি কখনো। এম -তে তুলনামূলক সাহিত্য বিশেষপত্র বেছে নেওয়ার ইচ্ছেটাও ওই ইংরেজি বিশ্বসাহিত্যের প্রতি নিবিড় আগ্রহ থেকেই।





৩.

ওয়ার্ডসোয়র্থের সঙ্গে আমার স্মৃতি বলতে এটুকুই। নবগঠিত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে এসে থেকে এখন আমিই গত পাঁচবছর ধরে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়াই। ওয়ার্ডসোয়র্থ মাঝে মাঝেই পড়াতে হয়কোনো বছর পড়াই কিটস্‌, শেলি বা বায়রন। মনে পড়েঅনার্সের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসেও আমি ওয়ার্ডসোয়র্থ নয় কিটস্‌-এর কবিকৃতি নিয়েই লিখেছিলাম। কিন্তু এইবছর কবির আড়াইশোতম জন্মবর্ষের কথা মাথায় রেখে নতুন করে তাঁকে পড়তে ইচ্ছে হলো। ‘দেশ’ পত্রিকার বই সংখ্যায় ( ফেব্রুয়ারি২০২০চিন্ময় গুহের একটি প্রবন্ধ ছাড়া -বছর তাঁকে নিয়ে বিশেষ চর্চা বাংলায় চোখে পড়েনি। আসলে ওয়ার্ডসোয়র্থ  রবীন্দ্রনাথের তুলনা কিংবা তাঁর প্রকৃতিময়তা এখন খুব জানা একটি বিষয়। এছাড়াও সমালোচক ওয়াটসনের মতে“The doctrine of nature in Wordsworth’s poetry is an unremitting campaign against the destruction of the individual by material and social pressures”  (Watson, J. R. English Poetry of the Romantic Period 1789-1830. London: Longman, 1985.)

এরপর বড়জোর তত্ত্বের চশমা পড়ে তাঁকে ইকোক্রিটিসিজম / ইকোফেমিনিজমের আলোকে পুনর্পাঠ করা যেতে পারে। তেমন কিছু ইংরেজি প্রবন্ধ সম্প্রতি পড়েওছি আমি ইন্টারনেট ঘেঁটে। সেসব প্রবন্ধে ইকোক্রিটিকেরা প্রিলিউডসলিটারি রিপারড্যাফোডিলস কিংবা অন্যান্য নিসর্গ-নিবিড় কবিতার সূত্র টেনে দেখাতে চেয়েছেন কিভাবে এই নিসর্গজীবিত কবি প্রকৃতি  মানুষের আত্মিক সম্পর্ক এঁকেছেন এবং নাগরিক ক্লান্তি  শিল্পবিপ্লবের যান্ত্রিকতার মধ্যে দাঁড়িয়ে যেন ‘রোম্যান্টিক ইকোলজি ভাষ্য রচনা করেছেন। প্রকৃতি  নারীর মাতৃরূপকে একাত্ম করে দেখানো তো বটেইপাশাপাশি তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সমাজচেতনাকে প্রকৃতির প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে। যেখানে গবেষকেরা সিদ্ধান্তে আসেন : Wordsworth’s poetry shows, as ecofeminsts contend, that to end oppression and establish progressive human society and harmonious human-nature relations, humans must practice the discipline of love, respect equal rights to existence, and cultivate a sense of place.’ (An Ecofeminist Study of Wordsworth’s Poetry, p.152)




৪.                                            

এসব তত্ত্বালোচনা এবার থাক। আমার প্রিয় কবিতা আজও দি সলিটারি রিপার’ ( রচনা : ১৮০৫/ প্রকাশ : পোয়েমস্‌, ১৮০৭) চার স্তবকে  লেখা এই অন্ত্যমিলের কবিতায় মাঠে  কর্মরতা একলা কৃষাণীর বিষাদমাখা গান যেন শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির নিজস্ব কণ্ঠস্বর শোনায় আমাদের। যে-প্রকৃতি থেকে মানবসভ্যতার বিযুক্তি বারংবার রুশো থেকে ওয়ার্ডসোয়র্থ রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করেছে আজীবন। এর অভিঘাত এসে পড়েছিল রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাতেও, যদিও সে অন্য প্রসঙ্গ। অতএব কৃষাণীর গানের বিষয় নিয়ে কবির কল্পনা ডানা মেলে, ব্যক্তিগত দুঃখ নাকি সার্বজনীন কোনো বেদনার কথা কিংবা  যুদ্ধে নিহত কোনো স্বজন হারানোর বেদনা বা অন্য কোনো যন্ত্রণার কাহিনি সে গানের সুরে মেশে? কবি সেই গানের ভাষা বোঝেন না, আচ্ছন্ন হন তার সুরে। যা উপত্যকা জুড়ে সুরের মূর্ছনা ছড়ায় :

 

Whate’er the theme, the Maiden sang

As if her song could have no ending;

I saw her singing at her work,

And o’er the sickle bending; –

I listened, motionless and still;

And, as I mounted the hill,

The music in my heart I bore,

Long after it was heard no more.   

 

দুটি চমৎকার তরজমা পাই -কবিতার, প্রথমটি করেছেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং অন্যটি শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা। উৎকলিত মূল কবিতাংশের অনুবাদ-দুটি উদ্ধার করি এই অবসরে :


কৃষাণী আপন মনে

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত


গানের বিষয় যা- হোকতন্বীর

গাওয়া সেই গানে অশেষ ব্যঞ্জনা সে;

তাকে তো দেখেছি কাস্তের পরে নত

গান করে যায় কাজের অনবকাশে;

শুনেছি সে গানস্তব্ধ নির্নিমষে;

চড়াই ভেঙেছিতবু সে গানের রেশ

আমার হৃদয়ে থামে না যে থামে না যে

বাজে অফুরান সে-গানের রেশ বাজে।   


কিষাণী বালিকা

শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা


যে বিষয় হোক তার বিমুগ্ধ গানের

কোথাও সমাপ্তি নেইনেই তার ছেদ।

দেখেছি কাজের সঙ্গে চলে তার গান,

হাতে কাস্তেনুয়ে পড়া অঙ্গে ঝরে স্বেদ।

শুনেছি সঙ্গীত তার প্রাণ রে স্থির শান্ত হয়ে

যখন উঠেছি ওই পাহাড়ের উঁচু পথে বেয়ে।

দীর্ঘদিন পর আর সেই গান শুনিনি যখন

হৃদয়ে লালিত সেই গানের মূর্ছনা মুগ্ধ করেছে তখন।


স্বভাবতই অলোকরঞ্জন তাঁর নিজস্ব কাব্যশৈলীতে ওয়ার্ডসোয়র্থকে অনুবাদ করেছেন। -অনুবাদ মূলানুগত হয়েও স্বদেশি চেহারা নিয়েছে। শেষ দুই লাইনে অলোকরঞ্জনের ভাব  ছন্দ হৃদয়ে দোলা দেয়আমাদের মনেও গানের রেশ বাজতে থাকেসেখানে শক্তিপ্রসাদ মূলানুগত হলেও অনেকটা সহজ বাকরীতিকে এনেছেনযে-সারল্য ওয়ার্ডসোয়র্থের কবিতার ভাষার বৈশিষ্ট্য। কবিতার প্রথম স্তবকে  ‘And sings a melancholy strain’ অলোকরঞ্জনের অনুবাদে ‘বিষাদ বিধুর পূরবী’ হয়েছেযা শক্তিবাবু ‘গানে গানে বিষাদ ছড়ায়’ করেছেন। একই ভাবে অলোকরঞ্জন নাইটিঙ্গেলকে বুলবুলি করেন বা ‘old, unhappy, far-off things’ হয়ে যায় ‘সুদূর বেদনার পদাবলী’; কিংবা মূল কবিতার মতো যুদ্ধের সরাসরি উল্লেখ না করে ‘হারজিতে সবে মেদিনী উঠত কেঁপে’ ইত্যাদি অলোকরঞ্জনীয় পুনর্লিখন ঘটেছে। সেখানে শক্তিপ্রসাদ নাইটিংগেলকে বদলাননি, ‘করুণ কাহিনী পুরাতন’ বা ‘যুদ্ধ কথা হয়েছে বাঙ্ময়’ ইত্যাদি অনেকাংশে মূল কবিতার অনেকখানি বিশ্বস্ত ভাষান্তর। যদিও অবিশ্বস্ততা  মূলানুগত্যের ভারসাম্য রক্ষার আদর্শে অলোকরঞ্জন বিশ্বাস করেন এবং ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘অনুবাদকের দায়িত্ব’ (১৯২৩ )প্রবন্ধে তারই সমর্থন পান যেউৎসভাষাকে নিজের ভাষায় বিমুক্ত করে দেওয়াই অনুবাদকের কাজ। মুক্তি ছাড়া বিশ্বস্ততার কোনো অর্থ নেই – এই তত্ত্বাদর্শ মেনে নিলে অলোকরঞ্জনের অনুবাদে কবিতাটি নতুন দেশে নতুন ভাষায় পুনর্জন্ম নিয়েছে বলতে পারি। ওয়ার্ডসোয়র্থ তাঁর দেওয়া কবিতার বিখ্যাত সংজ্ঞায় স্মৃতিলোকআবেগের শান্তায়ন  তার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের যে সূত্রটি দিয়েছেনতা এই কবিতা সম্পর্কে বিনা দ্বিধায় প্রযোজ্য। ফলে  কৃষাণী  তার তুলনারহিত গান শাশ্বত মূল্য পেয়ে যায়। অধ্যাপক মঞ্জুভাষ মিত্র এর অনুষঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘কৃষ্ণকলি থিম্যাটিক সাদৃশ্যের কথা আমাদের মনে করাতে চান। তাঁর চোখে এই পার্বতী কন্যা ‘আসলে কবিতা-অমরাবতীরই এক বিরল প্রতিমা আর -কবিতার পিছনে ১৮০৩- বোন ডরোথির সঙ্গে স্কটল্যাণ্ডের পার্বত্যভূমিতে ভ্রমণকালে ইনভার্সনেডের শস্যভূমিতে দেখা একটি কৃষাণী মেয়েই যে অনুপ্রেরণা -তথ্যও তিনি পুনরুল্লেখ করেছেন। এছাড়াও কৃষাণীর গানের সঙ্গে কোকিল  নাইটিংগেলের তুলনাগানটির ভাষা না জানাশস্যবপন ইত্যাদি দেখে কেউ কেউ কিটসের কিছু ওডের (নাইটিংগেলঅটামগ্রিসিয়ান আর্ন ইত্যাদিপূর্বাভাস এখানে দেখেন। আর টমাস উইলকিনসনের ‘ট্যুর ইন স্কটল্যাণ্ড’ (১৭৮৭)- এই কবিতার সংকেত মেলে। এসব ছাড়াও আমার মনে -কবিতা কেন জানি না ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’ রবীন্দ্রগানটিকেও বাজিয়ে তোলে। যেখানে বিদেশি নায়ে ভেসে চলা বংশীবাদকের করুণ সুরে কবির মনে ছবি বিজন নদীতে জল ভরতে যাওয়া এক নারীর ছবি জেগে ওঠে। আর সেই সুরে আমাদের কবিও তো শুনেছেন অচেনা কোনো ‘সুদূর বিরহবিধুর হিয়ার অজানা বেদনা ভোরের প্রশান্তিশরতের আবহনদীসমুদ্র এবং নারী -গানে একাকার।         

 

যদিও প্রকৃতির করাল রূপকে তিনি কবিতায় চিত্রিত করেননিফরাসি বিপ্লবের শেষে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা তাঁকে পীড়িত করেছিল এবং প্রকৃতির কাছে আশ্রয় খুঁজেছিলেন এসব তথ্য ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই আমরা জানতে পারি। তাছাড়া নৈতিকতাআদর্শবাদপ্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক সত্তা  মানুষের শিক্ষক ভাবা এসব তো রয়েছেই। তাই ওয়ার্ডসোয়র্থের কবিতার আগ্রাসী পাঠক না হয়েও তাঁর কবিতার ভিতরে  যে প্রশান্ত সর্বব্যাপী প্রকৃতিসাধারণ মানুষমুখের সহজ ভাষা  মানবতার  বিষাদসঙ্গীত আজও বেজে চলেতাকে এড়িয়ে চলবার উপায় নেই আমাদের। আজকের এই সংকটমুখর সময়ে তাঁর স্কাইলার্কের মতো তাঁকেও বলতে ইচ্ছে হয় : ‘স্বর্গের সাথে অন্বয়ে বাঁধো মাটির মর্ত্যভূমি’ (অনুবাদ : শক্তিপ্রসাদ রায়শর্মা )।।      

 

ঋণস্বীকার :

) Higher Secondary English Selections (Poems and Plays), Reprint July 1998, WBCHS, Kolkata

) ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়, অগাস্ট ২০১২, সাহিত্যলোক, কলকাতা

) ওয়ার্ডসোয়র্থ তাঁর কবিতা, বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রদীপরঞ্জন সেনগুপ্ত সম্পাদিত, এপ্রিল ১৯৯৯, সাহিত্যলোক, কলকাতা

) সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত, শঙ্খ ঘোষ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত, ২০১০, দে সংস্করণ, কলকাতা

) ইংরেজি রোম্যান্টিক কবিসঙ্ঘ রবীন্দ্রনাথ, মঞ্জুভাষ মিত্র, ২০০৯, পুস্তক বিপণি, কলকাতা

) নগ্ন, নির্জন পথচারী, চিন্ময় গুহ, দেশ : বই সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২০

) প্রেমে পরবাসে (হাইনের কবিতার দ্বিভাষিক সংকলন), অনুবাদ-ভাষ্য-ভূমিকা-সম্পাদনা : অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, ১৯৮৩, নাভানা, কলকাতা

) An Ecofeminist Study of Wordsworth’s Poetry, Liúhuángchéng, zhāngjiǎnlì shū, WHAMPOA - An Interdisciplinary Journal 51(2006) 143-153 (PDF)

) A History of English Literature, Michael Alexander, 2nd edition 2007, Indian reprint 2014, Palgrave Macmillan, NY

১০) sparknotes.com     

১১) poets.org

১২) ons.wordsworth.org.uk