রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪
সফিউন্নিসা-র কবিতা
রবিবার, ১ মে, ২০২২
সফিউন্নিসা-র ঝুরোগল্প
রিটায়ারমেন্টের পরদিন বিকাশ বাবু ভেবেছিলেন আজ থেকে আর তাড়া নেই—সকাল ন’টার আগে বিছানা ছাড়বেন না। পৌনে আটটায় এক কাপ চা হাতে বড় ভাইপো-বউ সুনীতাকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হলেন ।
অবিবাহিত বিকাশ বাবুর জীবন কেটে গেল চাকুরি করে আর অকালমৃত দাদাবৌদির ছোট ছোট তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করে। মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন সুপাত্রে। দুই ছেলের একজন ইঞ্জিনিয়ার অন্যজন ব্যাঙ্কে কর্মরত। ওদের স্ত্রীরাও চাকুরি করায় দু’জন কাজের মেয়ের ওপর সংসার। চা তো এনে দেয় তারাই। আজ হঠাৎ…। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই সুনীতা বলে—ওরা দুই ভাই আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবে অফিস যাওয়ার আগে। আর দাঁড়ায় না সে।
আধঘণ্টার মধ্যে তাঁর আদরের কৃতি দুই ভাইপো দরজায় এসে দাঁড়াল। ‘আয়’ –সাদর আহ্বান জানালেন বিকাশ বাবু। দেখে বুঝলেন দু’জনেই অফিস যাওয়ার জন্য রেডি। মুখ খুলল প্রথমে ছোটজন—সুরজিৎ, ‘বলছিলাম কি ছোটকা, আমরা দু‘ভাই ঠিক করেছি একটা ব্যবসা শুরু করব। মানে চাকরির আর কটা পয়সা! আমাদের দুজনের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠছে, ওদের জন্য প্রচুর খরচ। তারপর ওদের কেরিয়ারটাও ভাবতে হবে, তাই এখন থেকে অল্টারনেটিভ একটা রোজগারের পথ তো বার করতে হবে। বিকাশ বাবু সুরজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন যে, ঠিক কী সে বলতে চায়। এবার কথা বলে বড়জন, অঞ্জন—‘আসলে কী জানো, আমরা তো আর ইট কাঠের ব্যবসা করতে পারব না। আর, সফ্ট অয়ার কেনা বেচার ব্যবসায় ইনভেস্টমেন্টটা বেশ বেশি। তাই বলছিলাম তুমি তো রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট মোটা টাকা পাবে। খরচও তোমার তেমন কিছু নেই। তাই বলি টাকাটা আমাদের ব্যবসায় ইনভেস্ট করে দাও। তুমিও অংশীদার হিসেবে লাভের হিস্যা পাবে।’
স্মিত হেসে বিকাশ বাবু বললেন, আরে তোরা মনে মনে এতকিছু ভেবে রেখেছিস সেটা আগে বলবি তো! আমি তো সব টাকা ; মানে পি এফ, গ্রাচুইটির সব কিছু এক জায়গায় চুক্তির ভিত্তিতে দিয়ে দিয়েছি। যতই হোক সরকারি চাকরির টাকা তো মার যাবেনা। সেজন্য বৃদ্ধাবাস কর্তৃপক্ষ সাগ্রহে তাতে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে ওদের অ্যাকাউন্ট যোগ করেও দিয়েছি।’
দৃশ্যত স্তম্ভিত দুই ভাই। সুরজিৎ শুধু প্রশ্ন করল, এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের একবার জানালে না! বিকাশ বাবু হেসে জবাব দিলেন, ‘এই বাড়ির ওপর অধিকার আমি ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। তোরা ভাগ করে নিস।’
বেজার মুখে দুই ভাই বেরিয়ে গেল। মনে পড়ল বিকাশ বাবুর সেই দিনটির কথা যেদিন স্বাতীকে বলে দিয়েছিলেন, ঈশ্বর চান না আমরা ঘর বাঁধি। মনে পড়ল,বাইক অ্যাক্সিডেন্টে দাদা-বৌদির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর নাবালক শিশুগুলিকে দেখিয়ে তাঁর মা বলেছিলেন, ‘কথা দে, বিয়ে করবি না। এরা ভেসে যাবে।’
স্বাতীও আর বিয়ে করেনি। গত বছর যেদিন জেনেছিলেন জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বাতী এখন বৃদ্ধাবাসে, সেদিনই শেষের এই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। আর তা স্বাতীর সম্মতিতেই। ইহজীবনে আর তাঁদের যোগাযোগ ছিন্ন হবেনা।
শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২
সফিউন্নিসা-র ঝুরোগল্প
নিরালম্ব
নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত দূরে চলে এসেছে রীতা! মহানন্দায় এখন জল বেশি নেই। বড় বড় উপলখণ্ডে পা ফেলে ফেলে তিরতিরে, খরস্রোতা জলে চুপড়ি দিয়ে মাছ ধরছে বাহেদের কয়েকটা ছেলে।
ওই দূরে ওদের পাড়াটা দেখা যাচ্ছে--ছোট ছোট মাটির ঝুপড়ি। ওদের মায়েরা বেশিরভাগ বিভিন্ন বাড়িতে ভোর না হতেই কাজ করতে বেরিয়ে যায়। বাবারা ইচ্ছে হলে কাজের ধান্দায় বেরয় না হলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। কোনওরকমে দিনটা কাটিয়ে ক’পাত্তর ধেনো মেরে দিয়ে সন্ধের পর ঘরে ফেরে। জানে, বউ খাবার আনবে। ছেলেগুলোর স্থানীয় স্কুলের খাতায় নাম আছে। স্কুলমুখো হয়না প্রায় কেউ। রীতার কোয়ার্টারে কাজ করতে আসা ফুলমতি এই নিয়ে রোজ গজ গজ করে। খাবার যে যা দেয় প্রায় সবটাই নিয়ে যায় ওদের জন্য।
গতবার পুজোয় রীতার কাছে ফুলমতির একখানা লাল রঙের পিছলা শাড়ির আবদার ছিল। শাড়িটি হাতে পেয়ে, খানিকক্ষণ কেঁদে নিল। তারপর কত কথা! মাতাল স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে তেরো বছর বয়স থেকে আজ সে ত্রিশের নারী। মার খেতে আর তার কষ্ট হয়না। তবে যেদিন ওর স্বামী ওকে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলেছিল, দূর হ’ মাগী। সেদিন প্রথম মাতাল স্বামীকে আচ্ছামতন পিটিয়ে দিয়ে ফুলমতি সাবধান করে দিয়েছিল, এ ঘর আমার। তুকে তো আমি পুষছি। তুই দূর হয়ে যা না পোষালে। তারপরে আর কোনোদিন ওকে ঘরের বার করার সাহস করেনি ওর বর।
কত কী ভাবতে থাকে রীতা! গতকাল দুপুরে মা ফোন করেছিল। পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে বাবার। রাতে সে কথা বলে বাবার কাছে একবারটি যাওয়ার কথা বলতেই কৃশাণু নস্যাৎ করে দিল। রীতা কান্নাকাটি করে জেদ ধরতেই তার ইঞ্জিনিয়ার, লোকের কাছে সুভদ্র, মার্জিত স্বামী হঠাৎ তেতে উঠে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলেছে, আমি যা বলব তা-ই হবে। রীতা প্রশ্ন করে, আমি কি কেনা বাঁদি তোমার? কৃশাণুর সপাট জবাব-আবার কি? এখানে না পোষালে বেরিয়ে যাও।
সারা রাত ভেবেছে বিনিদ্র রীতা। একটা শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের বিদুষী মেয়ের মূল্যায়ন হয় এভাবে শুধুমাত্র বিয়ের ফাঁসটি গলায় পরলে? চাকরি না পেয়ে বিয়েতে তার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা-মার ইচ্ছেয় এই বিয়ে।অতি সুপাত্র তার উন্নাসিক স্বামীর কাছে মানুষ হিসেবে রীতা কোনোদিন সম্মান পায়নি এতটুকু। মতবিরোধ হলেই বেরিয়ে যাও বলাটা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ইদানিং।
হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে রীতার। হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি চলে এসেছে সে। সূর্য কখন ডুবে গেছে। আকাশে রেখে যাওয়া তার লাল আভাটুকুও মুছে যাচ্ছে। এখনই সন্ধ্যা নামবে নির্জন চরাচরে। শন শন হাওয়া আর মহানন্দার কলস্বন সঙ্গী করে দ্রুত পা চালিয়ে ফিরতে থাকে রীতা।