শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২

সফিউন্নিসা-র ঝুরোগল্প

নিরালম্ব


নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত দূরে চলে এসেছে রীতা! মহানন্দায় এখন জল বেশি নেই। বড় বড় উপলখণ্ডে পা ফেলে ফেলে তিরতিরে, খরস্রোতা জলে চুপড়ি দিয়ে মাছ ধরছে বাহেদের কয়েকটা ছেলে। 

ওই দূরে ওদের পাড়াটা দেখা  যাচ্ছে--ছোট ছোট  মাটির ঝুপড়ি। ওদের মায়েরা বেশিরভাগ বিভিন্ন বাড়িতে ভোর না হতেই কাজ করতে বেরিয়ে যায়। বাবারা ইচ্ছে হলে কাজের ধান্দায় বেরয় না হলে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। কোনওরকমে দিনটা কাটিয়ে পাত্তর ধেনো মেরে দিয়ে সন্ধের পর ঘরে ফেরে। জানে, বউ খাবার আনবে। ছেলেগুলোর স্থানীয় স্কুলের খাতায় নাম আছে। স্কুলমুখো হয়না প্রায় কেউ। রীতার কোয়ার্টারে কাজ করতে আসা ফুলমতি এই নিয়ে রোজ গজ গজ করে। খাবার যে যা দেয় প্রায় সবটাই নিয়ে যায় ওদের জন্য।

গতবার পুজোয় রীতার কাছে ফুলমতির একখানা লাল রঙের পিছলা শাড়ির আবদার ছিল। শাড়িটি হাতে পেয়ে, খানিকক্ষণ কেঁদে নিল। তারপর কত কথা! মাতাল স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে  তেরো বছর বয়স থেকে আজ সে ত্রিশের নারী। মার খেতে আর তার কষ্ট হয়না। তবে যেদিন ওর স্বামী ওকে ধাক্কা মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলেছিল, দূর মাগী। সেদিন প্রথম মাতাল স্বামীকে আচ্ছামতন পিটিয়ে দিয়ে ফুলমতি সাবধান করে দিয়েছিল, ঘর আমার। তুকে তো আমি পুষছি। তুই দূর হয়ে যা না পোষালে। তারপরে আর কোনোদিন ওকে ঘরের বার করার সাহস করেনি ওর বর। 

কত কী ভাবতে থাকে রীতা! গতকাল দুপুরে মা ফোন করেছিল। পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে বাবার।  রাতে সে কথা বলে বাবার কাছে একবারটি যাওয়ার কথা বলতেই কৃশাণু নস্যাৎ করে দিল। রীতা কান্নাকাটি করে জেদ ধরতেই তার ইঞ্জিনিয়ার, লোকের কাছে সুভদ্র, মার্জিত স্বামী হঠাৎ তেতে উঠে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়ে বলেছে, আমি যা বলব তা- হবে। রীতা প্রশ্ন করে, আমি কি কেনা বাঁদি তোমার? কৃশাণুর সপাট জবাব-আবার কিএখানে না পোষালে বেরিয়ে যাও। 

সারা রাত ভেবেছে বিনিদ্র রীতা। একটা শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের বিদুষী মেয়ের মূল্যায়ন হয় এভাবে শুধুমাত্র বিয়ের ফাঁসটি গলায় পরলে? চাকরি না পেয়ে বিয়েতে তার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাবা-মার ইচ্ছেয় এই বিয়ে।অতি সুপাত্র তার উন্নাসিক স্বামীর কাছে মানুষ হিসেবে রীতা কোনোদিন সম্মান পায়নি এতটুকু। মতবিরোধ হলেই বেরিয়ে যাও বলাটা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ইদানিং। 

হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে রীতার। হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি চলে এসেছে সে। সূর্য কখন ডুবে গেছে। আকাশে রেখে যাওয়া তার লাল আভাটুকুও মুছে যাচ্ছে। এখনই সন্ধ্যা নামবে নির্জন চরাচরে। শন শন হাওয়া আর মহানন্দার কলস্বন সঙ্গী করে দ্রুত পা চালিয়ে ফিরতে থাকে রীতা। 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন