আলপথে এসে পড়ে অন্য গ্রহের ঘুড়ি
এই গ্রহে তখনও চলে নি আমির খানের পিকে
ফিকে হয়ে আসা অসমান আশমানে
পথের পাঁচালী ম্যাজিক মল্লারে উঠে পড়ে
দুর্গার কপালের টিপের মতো চাঁদ
অপুর মাথায় রাংতা হয়ে জ্বলে।
আলপথে এসে পড়ে অন্য গ্রহের ঘুড়ি
এই গ্রহে তখনও চলে নি আমির খানের পিকে
ফিকে হয়ে আসা অসমান আশমানে
পথের পাঁচালী ম্যাজিক মল্লারে উঠে পড়ে
দুর্গার কপালের টিপের মতো চাঁদ
অপুর মাথায় রাংতা হয়ে জ্বলে।
অসংখ্য রঙিন ব্যান্ডেজ
মানুষের কথা বলার দায় ছিল তাঁর। স্মৃতি আর শূন্যতার মুসাফির ছিলেন তিনি। মানুষের সঙ্কটগুলো ছুঁয়ে দেখেছেন খুব সহজেই। ক্ষত যত ক্ষতি যত, সেখানে যদি কেউ মমতার তুলো বেঁধে দিতে চান, বলতে চান সমব্যাথার কাহিনি, ভাগ করে নিতে চান একে অপরের কথা, কথাহীনতা ,
দাঁড়ি- কমা, তাহলেই গড়ে উঠতে পারে এমন সব কবিতা। অসংখ্য রঙিন ব্যান্ডেজের মত কবিতা, ক্ষতর মুখে পলি পড়ার কবিতা ।নাসের হোসেনের কবিতা।
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়ছে কবিতার পাঠক।পাঠক সেখানে শুধু সার্জারিটুকুই দেখবেন না, দেখবেন পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের দৃশ্য। নাসের হোসেনের কবিতার নিউরোনে ছড়িয়ে রয়েছে এই ট্রমা। কেমন ঘোলাটে এই শহর, কেমন বিষণ্ণ এই পৃথিবী। এরই মাঝে তবু নদীর মতো বয়ে চলেছে জীবন । এই আস্তাবলেই জন্ম নেবেন জীবনের যিশু।
নাসের হোসেন পাবলো পিকাসোর সাথে যে বিষয়ে একাত্মতা অনুভব করেন সেটি হল, শিল্পী নদীর মত, নদীটি সময়ের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ের মধ্যে শুভ অশুভ দুইই আছে। শিল্পীকে এগিয়ে যেতে হয় অশুভের সাথে যুদ্ধ করতে করতে। নাসের হোসেনের কবিতায় এই যুদ্ধক্ষেত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সহজেই। যাবতীয় ধ্বংসের মধ্য থেকে সৃজনের ছন্দটি খুঁজে বার করেবেন তিনি। মনখারাপের মধ্যে ঝরিয়ে দেবেন গোলাপি বৃষ্টি। বন্দুকের নলের পাশে জাগিয়ে রাখবেন জীবনের দু বিঘা জমি। লাশের বিস্ময়ে তৈরি করবেন অভিমানের টেরাকোটা। হিংস্রতাকে বন্দী করবেন ভালবাসার উন্মুক্ত আলিঙ্গনে। অনুভূতিহীন সময়ের ঘ্রাণে পৌছে দেবেন সম্পর্কের ধূপগন্ধ। এইসব আতরের দেশ ছড়িয়ে আছে নাসের হোসেনের কবিতার কৃষ্ণগহ্বরে।
এই কাশবনে এখনো ছিটেফোঁটা রক্তের দাগ লেগে আছে
এই দুনিয়ার অমঙ্গলকে অস্বীকার করার উপায় নেই । অনুভূতিহীন চামড়া দিয়ে ঢাকা আমাদের আপাদমস্তক । রবীন্দ্রনাথ তাঁর জুতা আবিষ্কারে দুটো পায়ের চেটো ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন । সময় যত এগিয়েছে আমরা আমাদের শরীর ও আত্মাকে বজ্র-আঁটুনি ফস্কা গেড়োতে কৃত্রিমতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছি । এই পৃথিবী হত্যা দেখেছে , যুদ্ধ দেখেছে , পারমাণবিক আস্ফালন দেখেছে , দেখেছে বায়োকেমিক্যাল দানবের হুঙ্কার। এই অমঙ্গলের বলয় অস্বীকার করার উপায় নেই । নাসের হোসেনের কবিতায় সেই অমঙ্গলের অশনিসংকেত স্পষ্ট হয়ে ওঠে । ‘ভৌতিক চোখ’ কবিতাটি ফ্যাসিস্ত বর্বরতার প্রতীক । ফ্যাসিস্ত প্রভু তাঁর রক্ত-চোখের দাপটে এই দুনিয়াকে গোলরক্ষকহীন ফুটবলের মতো নিয়ে চলেছে । সেই ভয়ঙ্কর দুটো চোখের দেখা পেয়েছি নাসের হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই । অসাধারণ উপমা ---
বাদুড়ের মতো ডানা ঝাপটিয়ে সন্ধে নামে
নাকি হিটলার ? (হোসেন,২০০৪ ঃ৩২)
হিটলার তো একটি প্রতীকী উপস্থাপনমাত্র । একটি বাদুড়ের নাম দিয়ে পৃথিবীর ঘাতকদের নাম পাঠকের মনে মুদ্রিত করে দেয় এই উপমা । বাদুড়ের ডানার তলায় ভীত কম্পিত পৃথিবীর মানুষজন বসে আছে । নাসের হোসেন এইসব মানুষদেরই ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়েন ।তদের পাংশু মুখের দিকে তাকান । প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন একটি নতুন সকালের গায়ত্রীমন্ত্র ।আতঙ্কের এক উন্মাদ পরিবেশ নাসের হোসেনের কবিতার আবহ কে স্তব্ধ করে রাখে । অথচ মানুষ প্রতিবাদহীন । মানুষের ক্লীবতার এই বিষয়টিকে শ্লেষবিদ্ধ করেছেন নাসের হোসেন ক্লীব(হোসেন,২০০৪ঃ ২৬) কবিতায় । হিংসা আর প্রেমহীনতার পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আর্তনাদ । এই আর্তনাদ সূত্রে আমরা জানতে পারছি অন্ধকারের ভিতর দিয়ে চলা অন্তহীন ভয়ের মিছিলের কথা । এই ভয়ের পৃথিবীকে শাসন করছে একদল ঘাতক আর মানুষকে নপুংসক ক্লীব করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে অন্ধকার এক আলমারিতে । ‘একটা বিশাল ভয়’ কবিতাতেও এই ভয়ের চিত্র আমরা দেখতে পাই --- ‘মানুষের দারুণ দুঃস্বপ্ন ভেঙে পড়ে /আর একটি বিশাল ভয় কেঁপে যায় ‘(হোসেন,২০০৪ ঃ২৭) । পুড়ে যাওয়া পৃথিবীর ছবি নতুন কিছু নয়, কিন্তু নাসের হোসেনের কবিতার মধ্যে এই যে পোড়া পৃথিবীর ছাই উড়ে বেড়াচ্ছে , তাও এক ভস্মপুরাণের গল্প বলে চলে আমাদের । পৃথিবীর এই ভস্মায়ন এক প্রলয় মুহূর্তের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের । যেখানে ইনফের্নোর আগুনে দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে সব । অভিশপ্ত সেই আগুনের কাছে মানুষ অসহায় । পৃথিবীপোড়া ধুম্রকুণ্ডলীতে ঢেকে যাচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড । ‘ধুম্রকুণ্ডলী ‘ কবিতাটির পাঠ ও অনুভবে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে । “পোড়া শহর’ কবিতাটিতেও এ রকম সব জীবিত মানুষ পোড়ার গন্ধ ---
ফিরে এলি সেই আবার পোড়া শহরে … চারিদিকে
খাঁ খাঁ পুড়ে যাচ্ছে মানুষের কঙ্কাল , হীরক যন্ত্রপাতি
বৃক্ষহীন শাখাপ্রশাখাহীন পাতাহীন ফুলহীন
এই রুক্ষ প্রান্তর --- (হোসেন,২০০৪ ঃ ৪৩)
অমঙ্গলের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘ব্লেড’ কবিতাতিতেও । অসুন্দরকে প্রকাশ করার এই চোখ নাসের হোসেন ছাড়া আর কোথাও দেখিনি । ব্লেড দিয়ে অনবরত চিরে দেওয়া হচ্ছে মানুষের শরীর মজ্জা হাড় । কবিতার পাতায় সেই রক্ত পুঁজ ক্ষত স্পষ্ট হয়ে ওঠে । এই নির্মমতার কোনও অন্তিম নিয়তি নেই । মুক্তি নেই এই ধ্বংসের বিষাদসিন্ধু থেকে । নাসের হোসেনের কবিতার পাতায় পাতায় এই শবভাষ কথা বলে চলে । রক্তের দাগ কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না । কাশবন আমাদের জীবনের পাঁচালির কথা বলে । আমাদের আবহমানের রোমান্টিকতার কথা বলে । সেইসব নিভৃত নন্দনে ছড়িয়ে পড়েছে অমঙ্গলের চিহ্ন , রক্তের দাগ ।
এই প্রত্যাশা শব্দটিকে উদ্ধৃত করতে চাই বারবার
এক ত্রাতা বা মসিহাকে বারবার বিনির্মাণ করে নিয়েছেন কবি । কালের অন্ধকার জরায়ুতে যার জন্ম , অথচ মৃত্যুর টানেলে যে ভরে দিতে চায় জীবনের অলকানন্দা । নাসের হোসেনের কবিতার ‘তুমি’ এই মসিহাকেও এঁকে নিতে চেয়েছে । মগ্নতা দিয়ে । ধ্যানবিন্দু দিয়ে । পাথরের চোখ কবিতা যে সমাহিতি অর্জন করে নিতে পেরেছিল , সেই দর্শনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ---
আমি আমার চোখের উপর বসিয়ে নিয়েছি
আরো দুটি চোখ, পাথরের, স্বভাবতই সব কিছু দেখতে পাব বলে নয়
আমি কোনোকিছু না দেখে কেবল
অনুভব করতে চাই ,এই জোড়া দাঁত হাঁ করে অপেক্ষা করতে চাই
আজীবন ; দেখা যাক পাই কিনা
(হোসেন,২০০৪ঃ ৬৩)
পাথরের চোখের ভিতর এই যে অনুভবের জগতটি , স্মৃতি ও শুন্যতার সাথে তাই লালন করেন কবি । অপেক্ষা করে থাকেন তাঁর জন্য , যিনি মসিহা । অপেক্ষার কথা তাই বারেবারে ফিরে ফিরে আসে নাসের হোসেনের কবিতায় । এই অপেক্ষা অসুন্দর এই উপত্যকাকে বদলে দেবে সুন্দরের স্নিগ্ধতায় । অপেক্ষা কবিতাটি সেই শাশ্বত অপেক্ষার কথাই বলে চলছে ---
শোক নেই ! অদ্ভুত মানুষ ! ভুলো না
যখনই দেখতে পাবে বলে দেবে ---
আমি তার অপেক্ষায় রইলাম ।
(হোসেন,২০০৪ঃ ৭৩)
সুন্দরের জন্য এই যাপনশৈলীটিকেই নাসের হোসেনের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ মনে হয় । তাঁর কবিতা পাঠে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের অজানা ঠিকানা আবিষ্কার করে ফেলি , কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে ঢুকে পড়তে
পারি , সাল্ভাদার দালি বা পাবলো পিকাসোর নন্দনজগতে পৌঁছে যেতে পারি , গ্যাব্রিয়েলের সাথে কথা বলতে
পারি----এইসব বিচিত্র কবিতার ইশারা নাসের হোসেনের কবিতার জগতকে বহুমাত্রিক করে তোলে । তবে এই সমস্ত অনুধাবনের কেন্দ্রীয় সুর এই মঙ্গলবোধের কাছেই ফিরতে চেয়েছে । এই ফের মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে যেমন সম্ভব হয়েছে , তেমনি সম্ভবপর হয়েছে জাগতিক প্রেক্ষাপটেও ।
কালের অন্তর্গত প্রেম নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি
নাসের হোসেনের কবিতার মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটটি’ কৃষ্ণগহ্বর’ কাব্যে তাৎপর্য পূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে । তবে তাও এক অর্থে দেশ-কাল- পাত্রেরই প্রতিফলন । মঙ্গলচেতনার প্রেক্ষাপটি সমকালের রক্তস্রাব পেরিয়ে যেতে চেয়েছে । সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ,বিভাজনের রাজনীতিকে অস্বীকার করে , যেকোনো মেরুকরণের বিরুদ্ধে কথা বলে নাসের হোসেন মূলত মঙ্গলময় ভালবাসার সপক্ষে তাঁর কবিতাকে নির্মাণ দিয়েছেন ।ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে তা সত্য , তা প্রাসঙ্গিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও । তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ---
মানুষকে বিদ্বেষমুক্ত করে তবেই যাব হে ঈশ্বর
রক্তপাত তো অনেক হল
এবার শান্ত হোক সবকিছু
সব কান্না মুছে যাক
সব পুড়ে যাওয়া ঘর গড়ে উঠুক আবার
সব শিশু নেচে উঠুক জীবনের আনন্দে
(হোসেন,২০০৪ ঃ৮২)
এই সময়ের যাপনে নাসের হোসেন তাই বিশেষ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন ।যেখানে রাম আর রহিমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ; একজন হিন্দু মসজিদের সপক্ষে কথা বলতে পারেন , যেমন একজন মুসলমান বলতে পারেন মন্দিরের জন্য আবেদন করতে পারেন । নক্ষত্র বিহার শেষে মানুষ যে মাটিতে ফিরবে , সে মাটি থেকে সমস্ত রক্তের দাগ মুছে দিতে চেয়েছিলেন নাসের হোসেন । সেই যে এক ত্রাতার কথা, মসিহার কথা বিভিন্ন ভাবে নাসেরের কবিতায় ফিরে ফিরে আসে ,একজন তুমির সাথে যে নাসের অন্তহীন বার্তা বিনিময় করে চলেন , তাও সেই সুন্দরের টানেই ।সমাজ, অর্থনীতি , রাজনীতির নানা আখ্যানে নাসের হোসেন সেই শুভবোধকেই ফিরিয়ে আনতে চান । এক কথায় তাঁর কবিতা মঙ্গলের ছায়া , মঙ্গলেরই পুরাণ ।
হোসেন নাসের(২০০৪)ঃনির্বাচিত কবিতাঃ কলকাতাঃ কবিতাপাক্ষিক
'গাণিতিক অনুপাতে ঝরে গভীর শূন্যতা'
একটা পুরনো পৃথিবীর বেড়ে চলা বয়সের হিসেব কষে সত্তর দশকের কবি তরুণ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন এই পুরনো পৃথিবীতে “গাছ, নদী ও চাঁদের গল্প শোনে না কেউ’’ (মুখোপাধ্যায়ঃ১৯৭৭, ১৩)। সেই না-শোনা-গল্পের মেহফিলে ঢুকে পড়লাম আমরা।
পুরনো পৃথিবী আর নতুন যাপনের নকশা বিপরীত মেরুতে হেঁটে যাচ্ছে। পৃথিবীর বয়সের গাছ-পাথর সিসিফাসের মতো বয়ে নিয়ে চলেছে আধুনিক মানুষ। এই সিসিফাসের শীৎকার ও শিহরণ বিশেষভাবে অনুভূত হয় তরুণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে পড়তে। সেই যে অসমান পাহাড়ের উপর গড়িয়ে তোলা পাথরপিণ্ডের ছবিটা মিথ হয়ে গেছে , তার দিকে ফিরে যায় ক্যানভাস। রঙ তুলি ।ইজেল।
চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে ভোগের উপকরণ। পচে গেছে আদিম নদীর জল। মানুষের শরীরেও ক্ষয়। পৃথিবী তার খোলনলচে পাল্টে ফেলছে। এখানেই অস্তিত্ব সংকটের সার্কাস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ধরা পড়ে বিচ্ছিন্নতার সুর। “যে নিঃসঙ্গতায় আমি আত্মঘাতী ‘—কবির প্রথম বইটি যেকোনো আধুনিক মানুষের কার্ডিওগ্রাফ তুলে ধরে। ইসিজির রেখাগুলোকে যেন কবি বাঁকিয়ে অক্ষর করে তুলছেন কবিতার। জীবনের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এসে পড়েছেন শূন্যতার শতদল ঝরনায়।
২
কবির বাড়ি অতটা গুরুত্ব না পেলেও , তাঁর মনের বাড়িটি অযোধ্যার থেকেও সত্য –--
এ তো আজ প্রবাদ। তরুণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে পড়তে সেই মনের বাড়ির উঠোনটিতে দু-দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যাক।
তরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বইয়ের উৎসর্গের পংক্তিটি এক আত্মিক উদ্বোধনের দ্যোতক। কবির ‘বিষণ্ণ- বিধুর আত্মা’কে উৎসর্গ করা হচ্ছে এই বইটি। এ কবিতার বই তাই এক আত্মিক উৎসারণের কথা ভাবিয়ে তোলে আমাদের।শরীরের খোল থেকে বেরিয়ে আত্মা কথা বলবে। জিভের কথা নয়। কথা বলবে অনুভবে। উপলব্ধিতে।
শব্দকে সত্তায় ধারণ করা সহজ নয়। অথচ সত্তার ব্রেইলে সেই নিঃসঙ্গতার বয়ান তুলে চলেছেন কবি। এই বিশুদ্ধ শূন্যতাকে অভিবাদন জানাতেই হয়। কারণ সামাজিক স্খলনকে এই শূন্যতা সমর্থন করে না। প্রশ্ন তোলে। হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করেন, তা বলতে কলমে বাধে না। দিনের আলোর মত স্পষ্ট কথা অন্ধকার ভেদ করে ফুটে ওঠে।
৩
সবার থাকে না । কারো কারো থাকে --- ‘ নিজস্ব দর্পণ’।
এই দর্পণের সামনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দাঁড়ানো যায়। সেখানে যাপনের মুখোশ ছিঁড়ে পড়ে। অভিনয় খুলে পড়ে। হাতের মুদ্রায় কোথাও বাঘনখ থাকে না।
পরম শূন্যতাই পূর্ণতার পূর্ণিমা ফুটিয়ে তোলে । এই নিজস্ব দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ স্থিত হতে শেখে । সীমার মধ্যে থেকে অসীমকে ছুঁতে পারে । বলতে পারে “ আসলে যুদ্ধ তো নিজের সঙ্গে প্রতিদিন , প্রতিরাত্রি / তারপর একাকী দ্বৈপায়নে ফিরে যাওয়া ‘(মুখোপাধ্যায়ঃ ১৯৮৩, ০৬)।
নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে যে বুকের পাটা লাগে, তা সবার থাকে না। নিজের ভিতর ডুবে অরূপ রতন খুঁজে আনার রিটার্ন টিকিট একটি কবিতা এনে দিতে পারে। বেলাশেষে, খেলাশেষে এই নিজস্ব দর্পণের মুখোমুখি হওয়াটাই জীবনের সার্থকতা।
৪
নদীর একটি স্রোত দুবার স্নানের ফরমান দেয় না। জীবনও এই স্নানের ব্যাকরণ সবক্ষেত্রে শিখে ওঠে না। যথার্থ স্নানের বার্তাটি ধরা দেয় কবিতায় ---
‘জীবন মানুষের একটাই। আর তাতে বড় স্রোত!
সবাই কি স্নানের নিয়ম জানে?’
(মুখোপাধ্যায়ঃ ১৯৮৩, ১৬)
এই স্নানের রূপকটি বিশেষ ভাবে ভাববার বলে মনে হয়। জীবনের স্খলন,পতন ত্রুটির মধ্যে স্নানের প্রহরটির কাছে এ কবিতা পৌঁছে দেয়। স্নান এখানে আত্মদর্শন। শরীরের সাবান তো বটেই, এই স্নান, আত্মারও আবেজমজম।
গ্রন্থঋণ
মুখোপাধ্যায় তরুণ (১৯৭৭) : যে নিঃসঙ্গতায় আমি আত্মঘাতী : বহরমপুর
মুখোপাধ্যায় তরুণ ও উদয়কুমার চক্রবর্তী (১৯৮৩): নিজস্ব দর্পণে দুজনঃ সারস্বত লাইব্রেরীঃ কলকাতা