রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

গালিব উদ্দিন মণ্ডল-এর প্রবন্ধ

 

নাসের হোসেন  ছায়া ও পুরাণে'


অসংখ্য রঙিন ব্যান্ডেজ

মানুষের কথা বলার দায় ছিল তাঁর স্মৃতি আর শূন্যতার মুসাফির ছিলেন তিনি  মানুষের সঙ্কটগুলো ছুঁয়ে দেখেছেন  খুব সহজেই ক্ষত যত ক্ষতি যতসেখানে যদি কেউ মমতার তুলো বেঁধে দিতে চানবলতে চান  সমব্যাথার কাহিনিভাগ করে নিতে চান একে অপরের কথাকথাহীনতা , 

দাঁড়িকমা,  তাহলেই গড়ে উঠতে পারে এমন সব কবিতা অসংখ্য রঙিন ব্যান্ডেজের মত কবিতাক্ষতর মুখে পলি পড়ার কবিতা  নাসের হোসেনের কবিতা

    অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে পড়ছে কবিতার পাঠকপাঠক সেখানে শুধু সার্জারিটুকুই দেখবেন নাদেখবেন পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখের দৃশ্য নাসের হোসেনের কবিতার নিউরোনে ছড়িয়ে রয়েছে এই ট্রমা কেমন ঘোলাটে এই শহরকেমন বিষণ্ণ এই পৃথিবী এরই মাঝে তবু নদীর মতো বয়ে চলেছে জীবন । এই আস্তাবলেই জন্ম নেবেন জীবনের যিশু

    নাসের হোসেন পাবলো পিকাসোর সাথে যে বিষয়ে একাত্মতা অনুভব করেন সেটি হলশিল্পী নদীর মতনদীটি সময়ের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সেই সময়ের মধ্যে শুভ অশুভ দুইই আছে শিল্পীকে এগিয়ে যেতে হয় অশুভের সাথে যুদ্ধ করতে করতে নাসের হোসেনের কবিতায় এই যুদ্ধক্ষেত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সহজেই যাবতীয় ধ্বংসের মধ্য থেকে সৃজনের ছন্দটি খুঁজে বার করেবেন তিনি মনখারাপের মধ্যে ঝরিয়ে দেবেন গোলাপি বৃষ্টি বন্দুকের নলের পাশে জাগিয়ে রাখবেন জীবনের দু বিঘা জমি লাশের বিস্ময়ে তৈরি করবেন অভিমানের টেরাকোটা হিংস্রতাকে বন্দী করবেন ভালবাসার উন্মুক্ত আলিঙ্গনে অনুভূতিহীন সময়ের ঘ্রাণে পৌছে দেবেন সম্পর্কের ধূপগন্ধ এইসব আতরের দেশ ছড়িয়ে আছে নাসের হোসেনের কবিতার কৃষ্ণগহ্বরে

এই কাশবনে এখনো ছিটেফোঁটা রক্তের দাগ লেগে আছে

এই দুনিয়ার অমঙ্গলকে অস্বীকার করার উপায় নেই  অনুভূতিহীন চামড়া দিয়ে ঢাকা আমাদের আপাদমস্তক  রবীন্দ্রনাথ তাঁর জুতা আবিষ্কারে দুটো পায়ের চেটো ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন  সময় যত এগিয়েছে আমরা আমাদের শরীর ও আত্মাকে বজ্র-আঁটুনি ফস্কা গেড়োতে কৃত্রিমতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছি  এই পৃথিবী হত্যা দেখেছে , যুদ্ধ দেখেছে , পারমাণবিক আস্ফালন দেখেছে , দেখেছে বায়োকেমিক্যাল দানবের হুঙ্কার এই অমঙ্গলের বলয় অস্বীকার করার উপায় নেই  নাসের হোসেনের কবিতায় সেই অমঙ্গলের অশনিসংকেত স্পষ্ট হয়ে ওঠে  ‘ভৌতিক চোখ’ কবিতাটি ফ্যাসিস্ত বর্বরতার প্রতীক  ফ্যাসিস্ত প্রভু তাঁর রক্ত-চোখের দাপটে এই দুনিয়াকে গোলরক্ষকহীন ফুটবলের মতো নিয়ে চলেছে  সেই ভয়ঙ্কর দুটো চোখের দেখা পেয়েছি নাসের হোসেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই   অসাধারণ উপমা ---

বাদুড়ের মতো ডানা ঝাপটিয়ে সন্ধে নামে

                      নাকি হিটলার ? (হোসেন,২০০৪ ঃ৩২)

হিটলার তো একটি প্রতীকী উপস্থাপনমাত্র  একটি বাদুড়ের  নাম দিয়ে পৃথিবীর ঘাতকদের নাম পাঠকের মনে মুদ্রিত করে দেয় এই উপমা  বাদুড়ের ডানার তলায় ভীত কম্পিত পৃথিবীর মানুষজন বসে আছে  নাসের হোসেন এইসব মানুষদেরই ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়েন তদের পাংশু মুখের দিকে তাকান  প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন একটি নতুন সকালের গায়ত্রীমন্ত্র আতঙ্কের এক উন্মাদ পরিবেশ নাসের হোসেনের কবিতার আবহ কে স্তব্ধ করে রাখে   অথচ মানুষ প্রতিবাদহীন  মানুষের ক্লীবতার এই বিষয়টিকে শ্লেষবিদ্ধ করেছেন নাসের হোসেন ক্লীব(হোসেন,২০০৪ঃ ২৬কবিতায়  হিংসা আর প্রেমহীনতার পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আর্তনাদ  এই আর্তনাদ সূত্রে আমরা জানতে পারছি অন্ধকারের ভিতর দিয়ে চলা অন্তহীন ভয়ের মিছিলের কথা  এই ভয়ের পৃথিবীকে শাসন করছে একদল ঘাতক আর মানুষকে নপুংসক ক্লীব করে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে অন্ধকার এক আলমারিতে  ‘একটা বিশাল ভয়’ কবিতাতেও এই ভয়ের চিত্র আমরা দেখতে পাই --- ‘মানুষের দারুণ দুঃস্বপ্ন ভেঙে পড়ে /আর একটি বিশাল ভয় কেঁপে যায় ‘(হোসেন,২০০৪ ঃ২৭ পুড়ে যাওয়া পৃথিবীর ছবি নতুন কিছু নয়কিন্তু নাসের হোসেনের কবিতার মধ্যে এই যে পোড়া পৃথিবীর ছাই উড়ে বেড়াচ্ছে , তাও এক ভস্মপুরাণের গল্প বলে চলে আমাদের  পৃথিবীর এই ভস্মায়ন এক প্রলয় মুহূর্তের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের  যেখানে ইনফের্নোর আগুনে দাউদাউ পুড়ে যাচ্ছে সব  অভিশপ্ত সেই আগুনের কাছে মানুষ অসহায়  পৃথিবীপোড়া ধুম্রকুণ্ডলীতে ঢেকে যাচ্ছে ব্রহ্মাণ্ড  ‘ধুম্রকুণ্ডলী ‘ কবিতাটির পাঠ ও অনুভবে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে  “পোড়া শহর’ কবিতাটিতেও এ রকম সব জীবিত মানুষ পোড়ার গন্ধ ---

ফিরে এলি সেই আবার পোড়া শহরে … চারিদিকে

খাঁ খাঁ পুড়ে যাচ্ছে মানুষের কঙ্কাল , হীরক যন্ত্রপাতি

বৃক্ষহীন শাখাপ্রশাখাহীন পাতাহীন ফুলহীন

এই রুক্ষ প্রান্তর --- (হোসেন,২০০৪ ঃ ৪৩)

অমঙ্গলের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘ব্লেড’ কবিতাতিতেও  অসুন্দরকে প্রকাশ করার এই চোখ নাসের হোসেন ছাড়া আর কোথাও দেখিনি  ব্লেড দিয়ে অনবরত চিরে দেওয়া হচ্ছে মানুষের শরীর মজ্জা হাড়  কবিতার পাতায় সেই রক্ত পুঁজ ক্ষত স্পষ্ট হয়ে ওঠে  এই নির্মমতার কোনও অন্তিম  নিয়তি নেই  মুক্তি নেই এই ধ্বংসের বিষাদসিন্ধু থেকে   নাসের হোসেনের কবিতার পাতায় পাতায় এই শবভাষ কথা বলে চলে  রক্তের দাগ কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না  কাশবন আমাদের জীবনের পাঁচালির  কথা বলে  আমাদের আবহমানের রোমান্টিকতার কথা বলে  সেইসব নিভৃত নন্দনে ছড়িয়ে পড়েছে অমঙ্গলের চিহ্ন , রক্তের দাগ 

এই প্রত্যাশা শব্দটিকে উদ্ধৃত করতে চাই বারবার

এক ত্রাতা বা মসিহাকে বারবার বিনির্মাণ করে নিয়েছেন কবি  কালের অন্ধকার জরায়ুতে যার জন্ম , অথচ মৃত্যুর টানেলে যে ভরে দিতে চায় জীবনের অলকানন্দা  নাসের হোসেনের কবিতার ‘তুমি’ এই মসিহাকেও এঁকে নিতে চেয়েছে  মগ্নতা দিয়ে  ধ্যানবিন্দু দিয়ে  পাথরের চোখ কবিতা যে সমাহিতি অর্জন করে নিতে পেরেছিল , সেই দর্শনটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ---

আমি আমার চোখের উপর বসিয়ে নিয়েছি

আরো দুটি চোখপাথরেরস্বভাবতই সব কিছু দেখতে পাব বলে নয়

আমি কোনোকিছু না দেখে কেবল

অনুভব করতে চাই ,এই জোড়া দাঁত হাঁ করে অপেক্ষা করতে চাই

আজীবন ; দেখা যাক পাই কিনা

(হোসেন,২০০৪ঃ ৬৩)

পাথরের চোখের ভিতর এই যে অনুভবের জগতটি , স্মৃতি ও শুন্যতার সাথে তাই লালন করেন কবি  অপেক্ষা করে থাকেন তাঁর জন্য , যিনি মসিহা  অপেক্ষার কথা তাই বারেবারে ফিরে ফিরে আসে নাসের হোসেনের কবিতায়  এই অপেক্ষা অসুন্দর এই উপত্যকাকে বদলে দেবে সুন্দরের স্নিগ্ধতায়  অপেক্ষা কবিতাটি সেই শাশ্বত অপেক্ষার কথাই বলে চলছে ---

শোক নেই ! অদ্ভুত মানুষ ! ভুলো না

যখনই দেখতে পাবে বলে দেবে ---

আমি তার অপেক্ষায় রইলাম 

(হোসেন,২০০৪ঃ ৭৩)

সুন্দরের জন্য এই যাপনশৈলীটিকেই নাসের হোসেনের কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ মনে হয়  তাঁর কবিতা পাঠে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের অজানা ঠিকানা আবিষ্কার করে ফেলি , কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে ঢুকে পড়তে 

পারি , সাল্ভাদার দালি  বা পাবলো পিকাসোর নন্দনজগতে পৌঁছে যেতে পারি , গ্যাব্রিয়েলের সাথে কথা বলতে 

পারি----এইসব বিচিত্র কবিতার ইশারা নাসের হোসেনের কবিতার জগতকে বহুমাত্রিক করে তোলে  তবে এই সমস্ত অনুধাবনের কেন্দ্রীয় সুর এই মঙ্গলবোধের কাছেই ফিরতে চেয়েছে  এই ফের মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে যেমন সম্ভব হয়েছে , তেমনি সম্ভবপর হয়েছে জাগতিক প্রেক্ষাপটেও 

কালের অন্তর্গত প্রেম নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি 

নাসের হোসেনের কবিতার মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটটি’ কৃষ্ণগহ্বর’ কাব্যে তাৎপর্য পূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে  তবে তাও এক অর্থে দেশ-কালপাত্রেরই প্রতিফলন  মঙ্গলচেতনার প্রেক্ষাপটি সমকালের রক্তস্রাব পেরিয়ে যেতে চেয়েছে  সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ,বিভাজনের রাজনীতিকে অস্বীকার করে , যেকোনো মেরুকরণের বিরুদ্ধে কথা বলে নাসের হোসেন মূলত মঙ্গলময় ভালবাসার সপক্ষে তাঁর কবিতাকে নির্মাণ দিয়েছেন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে তা সত্য , তা প্রাসঙ্গিক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও   তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ---

মানুষকে বিদ্বেষমুক্ত করে তবেই যাব হে ঈশ্বর

রক্তপাত তো অনেক হল

এবার শান্ত হোক সবকিছু

সব কান্না মুছে যাক

 

সব পুড়ে যাওয়া ঘর গড়ে উঠুক আবার

সব শিশু নেচে উঠুক জীবনের আনন্দে

(হোসেন,২০০৪ ঃ৮২)

এই সময়ের যাপনে নাসের হোসেন তাই বিশেষ  প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন যেখানে রাম আর রহিমের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই ; একজন হিন্দু মসজিদের সপক্ষে কথা বলতে পারেন , যেমন একজন মুসলমান বলতে পারেন  মন্দিরের জন্য আবেদন করতে পারেন  নক্ষত্র বিহার শেষে মানুষ যে মাটিতে ফিরবে , সে মাটি থেকে সমস্ত রক্তের দাগ মুছে দিতে চেয়েছিলেন নাসের হোসেন  সেই যে এক ত্রাতার কথামসিহার কথা বিভিন্ন ভাবে নাসেরের কবিতায় ফিরে ফিরে আসে ,একজন তুমির সাথে যে নাসের অন্তহীন বার্তা বিনিময় করে চলেন , তাও সেই সুন্দরের টানেই সমাজঅর্থনীতি , রাজনীতির নানা আখ্যানে নাসের হোসেন সেই শুভবোধকেই ফিরিয়ে আনতে চান  এক কথায় তাঁর কবিতা মঙ্গলের ছায়া , মঙ্গলেরই পুরাণ 


গ্রন্থঋণ

হোসেন নাসের(২০০৪)ঃনির্বাচিত কবিতাঃ কলকাতাঃ কবিতাপাক্ষিক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন