রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০২৪

রঙিন ক্যানভাস ।। বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৩৯-৪১ (জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা) ।। জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যার প্রচ্ছদ {বইমেলা সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৩৯-৪১) [জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা] {বইমেলা সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৩৯-৪১) [জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা] {বইমেলা সংখ্যা}


 

সম্পূর্ণ সূচি ৩ (বর্ষ ৪ ।। সংখ্যা ৩৯-৪১) [জানুয়ারি-মার্চ সংখ্যা] {বইমেলা সংখ্যা}


 

সম্পাদকের নিবেদন

সম্পাদকের নিবেদন


পৃথিবীর সব ভাষায় যে সাহিত্য রচিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা প্রায় সবই সুখপাঠ্য। যেমন ইংরেজি, ফরাসি, রাশিয়ান, স্প্যানিশ, জাপানি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, বাংলা, ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে। পাঠক আত্মস্থ করছেন এক ভাষার সাহিত্য অন্য ভাষার সমাজ-জীবন-সাংস্কৃতিক চেতনাকে। লেখকদের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসিকতা অনেকটাই সহজাতভাবে গড়ে উঠেছে। ধারা আগেও ছিল, বর্তমানেও প্রবাহিত। সাহিত্য বিস্তারে ইংরেজি ভাষার অবদান অবশ্য স্বীকার্য। প্রায় সব ভাষার সাহিত্যই ইংরেজিতে অনুদিত হয়। সাহিত্যের কোনো বাউন্ডারি নেই। কিছু রচনা হৃদয়কে স্পর্শ করে, মানুষের চিন্তা-চেতনা উদ্বুদ্ধ হয়। 


যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সিগমন্ড ফ্রয়েড-এর মনস্তত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থদি ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম ১৯০০ সালে প্রকাশ পায় এই গ্রন্থটি। মানুষের কামনা-বাসনা-স্বপ্ন নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে এই গ্রন্থটিতে। অবচেতন মনের এই গবেষণা তাঁকে পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। অস্তিত্ববাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বেশ সাড়া ফেলে দেয়। ১৮৫৬ সালে তাঁর জন্ম। বিশ্বজুড়ে এখনো বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সিগমন্ড ফ্রয়েডের নাম অনায়াসে চলে আসে। 


কবিতা-গল্প-উপন্যাস পাঠে জীবনের গভীরতর অর্থ বুঝতে আগ্রহী হয়ে উঠি আমরা তথা পাঠককুল।


রঙিন ক্যানভাস’-এর সকল লেখক এবং পাঠককে শুভেচ্ছা অভিনন্দন রইলো। সকলে ভালো থাকুন।


রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম

 

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

জীবনানন্দ  ১২৫


আমাদের জীবনানন্দ-চর্চা 


রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাদের কফির ক্রীম, জীবনানন্দ তা সযত্নে সরিয়ে দিয়েছেন৷

(ডায়েরি : ১৫.০১.৮৩, ভাস্কর চক্রবর্তী)

মানুষের পৃথিবীতে সে অনেক শতাব্দীর আগে

ঈশ্বর স্খলিত হয়ে গেছেতবু মানুষের স্বভাবের গভীরতা আছে

প্রেম চায়, ন্যায় চায়, জ্ঞান চায়            (এখন পৃথিবীতে)


কি অমোঘ আর অবিস্মরণীয় এই পঙ্‌ক্তিমালা। উত্তর-রৈবিক যুগের নচিকেতা-কবির এই উপলব্ধি তাঁর মৃত্যুর ষাট বছর তথা কপিরাইটমুক্তির পরেও আমাদের মনে উজ্জ্বল হয়ে থাকে। ১৭.০২.১৮৯৯ থেকে ২২.১০.১৯৫৪ : এই স্বল্পায়ু, অশান্তিপীড়িত অস্থির জীবনে যেটুকু পেয়েছেন, তার থেকেও বেশি প্রাপ্তির যোগ্য ছিলেন তিনি। আজ দেখা যায়, জীবনানন্দ-চর্চার অ্যাকাডেমিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো জায়গা রাখেনি বাংলা সাহিত্যের সিলেবাসকর্তারা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার অঙ্গনে বাংলা সাহিত্য-চর্চার অন্যতম স্তম্ভ হয়ে আছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। শতবার্ষিকী উদ্‌যাপন, রচনাবলী প্রকাশ কিংবা তাঁরই নামাঙ্কিতজীবনানন্দ সভাগৃহ’- জন্মদিনের বক্তৃতার আয়োজন এসব কিছুর মধ্যে কর্তব্য আছে, দায়িত্বও আছে কিন্তু জীবনানন্দকে সার্বজনীন করে তোলার প্রয়াসও কি জরুরি নয়? ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া কলকাতারজীবনানন্দ আকাদেমি’ (. তাপস বসুর উদ্যোগে) এখন আর নেই। আর চন্দননগরে আমাদের বাসগৃহেজীবনানন্দ চর্চা কেন্দ্র’ (১৯৯৪ : . তরুণ মুখোপাধ্যায় লীনা মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে) গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থনও ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশিদিন টানা যায় নি। তাছাড়া জীবনানন্দের চেয়ে আহূত বক্তারা নিজেদের প্রচার চাইতেন বেশি! সেই চর্চা কেন্দ্রের মুখপত্রে দশ-দফা দাবির মধ্যে : জীবনানন্দের নামে সরকারি পুরস্কার, রাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়েচেয়ার পোস্ট’ (যেমন, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়েনজরুল অধ্যাপকহয়েছে কবির জন্মশতবর্ষে) ইত্যাদি ছিল। তৎকালীন তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রীকে (তাঁরহৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতরনামে জীবনানন্দ কেন্দ্রিক বই আছে) কেন্দ্র থেকে চিঠিও দেওয়া হয়  ১৯৯৭ সালে। কিন্তু  কেবল প্রাপ্তিস্বীকার-এর সৌজন্য ছাড়া কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। ফলত এসবই ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা হিসেবে হারিয়ে যাবে হয়তো একদিন। রবীন্দ্রতীর্থ আর নজরুল তীর্থের মতো জীবনানন্দ-চর্চার একটা পূর্ণাঙ্গ সরকারি প্রতিষ্ঠান আজও কেন নেই, একথা ভেবে দেখার প্রয়োজন এসেছে। তবে সুখের কথাপশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমিকয়েক বছর হলো জীবনানন্দ দাশের নামে সরকারি পুরস্কার চালু করেছে, নিয়মিত স্মারক বক্তৃতার আয়োজনও করেন তাঁরা।  

২।।


সিলেবাস-ভুক্তি এবং গবেষণাপত্র রচনা একজন কবিকে চর্চার মধ্যে রাখে, তাতে সন্দেহ নেই। এখনো আমরা দেখি সিলেবাসভুক্ত হওয়ার জন্য কবিদেরও আগ্রহ আছে। সিলেবাসভুক্তি একজন সাহিত্যিক-কে জাতে তোলে কিনা জানি না, কিন্তু তাঁর পাঠক-পরিধি নিঃসন্দেহে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু একদা উপেক্ষিত, সমালোচিত জীবনানন্দের কবিতা আজ পাঠ্যসূচিতে এসেও নির্বাচিত তথা মুষ্টিমেয় কবিতার পাঠ ব্যাখ্যা নিয়েই বছরের পর বছর পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। অভ্যেস বা ফ্যাশনের অন্য নামবনলতা সেনকিংবারূপসী বাংলাবাআটবছর আগের একদিনআওড়ানো। এহেন জীবনানন্দ চর্চার ভিতরে জন্ম নিতে থাকে অভ্যাস আর তাঁকে ব্যবহার করে শুয়োরের মাংস করে তোলার অপপ্রয়াস। তাই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত প্রয়োজনীয় লেখা শেষ হলে, অপ্রয়োজনীয়, বর্জিত, দুর্বল লেখালেখি সুযোগ পেলেই প্রকাশ করাটা জীবনানন্দ-প্রেমিকদের একমাত্র কাজ হতে পারে না। কারণ, এসবের মধ্যে জীবনানন্দ হয়তো আছেন, কিন্তু তাঁকে অনুভবের নির্জনতা কই?  তার মানে এই নয় জীবনানন্দের উপর স্মরণীয়, গবেষণাঋদ্ধ গ্রন্থ বা প্রবন্ধ লিখিত হয়নি, তেমন অনেক কাজই হয়েছে, এখনও হয়। কিন্তু জনমানসে জীবনানন্দ জটিলতাময় মৃত্যু হতাশার কবি। তাঁর কবিতার ইতিবাচক ভাব বা সূর্যোদয়ের আকাঙ্ক্ষা আজও অনেকের কাছে নিছকইট্র্যাজিক বোধহিসেবে ভুল-ভাবে ব্যাখ্যাত হয়। আরেকটি আলো-পৃথিবীর দাবিতে আমাদের কাছে স্বপ্ন দেখানোর প্রয়াসী এই কবি সর্বকালের হয়েও কতটা আম-বাঙালির দৈনন্দিনের দোসর হয়েছেন?  


৩।।


উত্তর হিসেবে কেউ বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং দ্বিজেন্দ্রলালের গান আছে। গানের ভিতর দিয়ে যত সহজে লোকমানসে পৌঁছনো সম্ভব কবিতা সেইভাবে সর্বত্রগামী নয় [যদিও তাঁর কিছু কবিতা গান হয়েছে যেমন : ‘আবার আসিব ফিরেএবং তিনি নিজেও গান লিখেছিলেন] সকলেই কবিতা বুঝবে এই আশা করা বৃথা। কিন্তু গল্প-উপন্যাস পড়তে সবাই ভালোবাসেন। কবি জীবনানন্দের পাশে কথাসাহিত্যিক জীবনানন্দ কিন্তু আজও যথেষ্ট মনোযোগ পাননি। তাঁরমাল্যবান’, ‘কারুবাসনা’, ‘বিলাস’, ‘নিরুপম যাত্রাইত্যাদি উপন্যাস গল্পের নাট্যরূপ হয়েছে।মাল্যবানকারুবাসনা’- মঞ্চায়নও আমরা দেখেছি। কিন্তু সীমিত তার দর্শক। প্লটলেস কাহিনি লেখার একটা নিজস্ব শৈলী আয়ত্ত করেছিলেন জীবনানন্দ। নিটোল গল্প নেই অথচ গল্প লিখছেন তিনি। আত্মজীবনের ছায়া তো আছেই সেই সঙ্গেই ভাষাবয়নেও তাঁর নিজস্বতা।প্রেতিনীর রূপকথাকিংবাকারুবাসনা পাঠক তাঁর মৌলিকতা স্বীকার করবেন। তাঁর কিছু গল্পের এইসব আশ্চর্য উচ্চারণ কি চিরকালীন নয় :

) আর্টিস্টের জীবন নিষ্ফল। তার চিন্তার শেষে কোনও সিদ্ধান্ত নেই, তার কাজ পরে কোনো বিশ্রাম আনে না। (বিস্ময়)

) কিন্তু আর্ট মানুষকে না দেয় সুখ, না দেয় সোনা। (আর্টের অত্যাচার)

কারুবাসনার গল্পকার জীবনানন্দপ্রবন্ধে . তরুণ মুখোপাধ্যায় লক্ষ করেছেন : 

দাম্পত্য প্রেমের সংকট, প্রেমের বিচিত্র বর্ণরাগ, নারী সম্পর্কে জুগুপ্সা নির্মম নিরাসক্তি, সমকাল রাজনীতি বিষয়ক ভাবনা, শিক্ষা শিক্ষকতা বিষয়ে কটাক্ষ, আর্ট সাহিত্যচর্চা নিয়ে অনুধ্যান, জীবন-মৃত্যু-বেঁচে থাকা বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ  - অন্তত এই সূত্র-সপ্তকে গল্পকার জীবনানন্দ অনেকখানি উদ্ভাসিত।

কবি হিসেবে পরিচিতি, কিছু খ্যাতি জীবৎকালে পেলেও গল্প-উপন্যাস লিখলে যে পয়সা বেশি পাওয়া যায় একথা জীবনানন্দ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর কথাকার হওয়ার পিছনে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ যেমন ছিল তেমনই এই বৈষয়িক কারণটিকেও উপেক্ষা করা যায় না। শতাধিক গল্প আর একডজনের বেশি উপন্যাস লিখেও তাকে প্রকাশের সাহস তিনি পাননি বেঁচে থাকাকালীন। আজ সব প্রকাশিত, কিন্তু যথাযথভাবে মূল্যায়ন চর্চার অবকাশ এখনো ফুরিয়ে যায়নি। ভূমেন্দ্র গুহের পথে চলে কবির জীবন ডায়েরি নিয়ে সম্প্রতি গৌতম মিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের কাজ করেছেন (‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি’, ‘প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত দ্য ম্যাজিসিয়ান’) ফলত তাঁর ডায়েরি স্রষ্টাজীবন এখন বিদ্যায়তনিক গবেষণার বিষয়, নিয়ে পিএইচ.ডি গবেষণার কাজও করেছেন আমার স্ত্রী ঐন্দ্রিলা। হচ্ছে তাঁর অনুবাদ নিয়ে চর্চা, আমারই তত্ত্বাবধানে, এম.. ক্লাসে জীবনানন্দের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদতাত্ত্বিক পাঠ নিয়ে একটি প্রোজেক্ট করেছেন প্রেসিডেন্সির ছাত্রী স্নিগ্ধদীপ্তা মজুমদার। কথাসাহিত্যিক জীবনানন্দ পাঠ্যসূচিতে এসেছেন। আমি নিজেই কয়েকবার তাঁরমাল্যবানপড়িয়েছি প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে। আমাদের বিভাগের অগ্রজ অধ্যাপকেরা (. সন্দীপকুমার মণ্ডল, . শাওন নন্দী) তাঁকে নিয়ে নিজেরা কাজ করেছেন, অন্যদের কাজ করিয়েছেন। আমরা বাংলা বিভাগীয় আলোচনাকক্ষেরও নাম রেখেছিজীবনানন্দ সভাকক্ষ’ - তিনি যে আমাদেরই ইংরেজি বিভাগের উজ্জ্বল প্রাক্তনী!     

৪।। 


২০১৪ সালে তাঁর রচনার কপিরাইটমুক্তি ঘটে গেছে। ২০২৪- তিনি জন্মের ১২৫ বছরে পা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে একাধিক জীবনানন্দ সমগ্র সম্পাদিত সটীক রচনাবলী। তবে শুধু পাঠান্তরের তালিকা আর হস্তাক্ষরের ফ্যাক্সিমিলি প্রকাশ, বাতিল করা দুর্বল লেখা পুজোসংখ্যায় প্রকাশ, ডায়েরি ছাপানো আর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না। সেই দায়িত্বের প্রকৃত অর্থ গোষ্ঠীবাজি ছাড়িয়ে যথার্থ জীবনানন্দ-চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেমন, বাংলাদেশের মাসউদ আহমাদজীবনানন্দনাম দিয়েই প্রকাশ করে চলেছেন আস্ত একটি পত্রিকা। রবীন্দ্রোত্তর পর্বের এই অগ্রণীনিঃসঙ্গ বিহঙ্গ’-কে তন্নিষ্ঠভাবে পাঠ বিশ্লেষণ-এর পরিসর যেমন এখনো রয়েছে, তেমনি যথার্থ জীবনানন্দ-চর্চাকারীদের সামনে রেখে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়াও ভীষণ জরুরি। সেখানে রাজনৈতিক ভাবে কাছের লোক নয়, কাজের লোকেদের কদর হওয়াই প্রয়োজন। যে অদ্ভুত আঁধারের কথকতা আমরা নিত্য দেখে যাই, যেখানে যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি চোখে দেখে তারা, সেইখানে জীবনানন্দ আমাদের শোনাতে পারেন শুশ্রূষার মতো শত জলঝর্ণার ধ্বনি। প্রেম-বিষাদ-মৃত্যু আর আলোকচেতনাকে বাদ দিয়েও তাঁর ডায়েরি-চর্চা, তুলনাত্মক বিচার, ঈশ্বর-ভাবনা, ইকোলজিময়তা, অনুবাদ অধ্যয়ন, উত্তর-আধুনিকতা আমাদের নতুনসূত্র দিতে পারে। তাঁরপ্রবন্ধসমগ্রমন দিয়ে পড়লে, বুঝলে কবিতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত অথচ তীক্ষ্ণ মূল্যায়ন আমাদের বারংবার ভাবতে বাধ্য করে : ‘কবিতা সৃষ্টি করে কবির বিবেক সান্ত্বনা পায়, তার কল্পনামনীষা শান্তিবোধ করে, পাঠকের ইমাজিনেশন তৃপ্তি পায়  কবিতাচর্চা আজও বহমান, রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দের প্রভাব প্রেরণাকে স্বীকার না করে ভালো কবিতা লেখা যায় না এখনও। তাই আমরা তাঁকে নিয়ে আরো নতুন কিছু কাজ করার শপথ নিতে পারি। জীবনানন্দ আকাদেমি, চেয়ার প্রফেসর পোস্টের পাশাপাশি তাঁর বাসগৃহ-সংরক্ষণ, মর্মর মূর্তি প্রতিষ্ঠা, রাস্তার নামকরণ, জীবনানন্দ রচনাবলীর বৈদ্যুতিন-সংস্করণ এগুলিরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রক তথা রাজ্য সরকার এবং বাংলা আকাদেমি, কবিতা আকাদেমি, সাহিত্য অকাদেমি ভেবে দেখবেন, এই আশা নিয়ে আমরা জীবনানন্দের ভাষাতেই বলতে পারি : ‘আমাদের মৃত্যু হয়ে গেলে এই অনিমেষ আলোর বলয় / মানবীয় সময়কে হৃদয়ে সফলকাম সত্য হতে বলে / জেগে রবে : জয়, আলো সহিষ্ণুতা, স্থিরতার জয় আজ তাই বলতে ইচ্ছে করে : জীবনানন্দ পড়ুন, জীবনানন্দ পড়ান; জীবনানন্দ চর্চাও হয়ে উঠুক আমাদের জীবনচর্যা।