শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩

রঙিন ক্যানভাস ।। বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩০-৩২ (এপ্রিল-জুন সংখ্যা) ।। এপ্রিল-জুন সংখ্যার প্রচ্ছদ


 

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩০-৩২) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা]


 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩০-৩২) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা]

 


সম্পূর্ণ সূচি ৩ (বর্ষ ৩ ।। সংখ্যা ৩০-৩২) [এপ্রিল-জুন সংখ্যা]




 

সম্পাদকের নিবেদন

সম্পাদকের নিবেদন

 

পোস্টমডার্ন ভাবকল্প  বাংলা কবিতা নিয়ে কিছু কথা বলছি। আমরা জানি যে, ‘পোস্টমডার্ন’ শব্দটির উদ্ভব ১৯৩৪ সালে হিসপানিক আমেরিকায়। স্প্যানিশভাষী তরুণ কবিদের কবিতার বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি-তাত্ত্বিক ফেদেরিকো দ্য ওনিস ‘পোস্টমডার্নিজম’ বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জাক দেরিদামিশেল ফুকোজাক লাঁকাজাঁ বদ্রিলার  আরও অনেক ভাবুক দর্শনইতিহাস

রাজনীতিবিজ্ঞান-দর্শননৃত্যসঙ্গীতচিত্রকলাস্থাপত্যসাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে এই ভাবকল্পটিকে নিয়ে কাজ করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে পোস্টমডার্ন অভিধাকে ‘অধুনান্তিক’ বাংলা প্রতিশব্দে গ্রহণ করেছেন ভাষাবিদ প্রবাল দাশগুপ্ত। বাংলায় পোস্টমডার্ন কবিতা রচনার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় বিশ শতকের নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকেই। এবং এই সময় পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনা প্রথম স্পষ্ট করে তোলেন সমীর রায়চৌধুরী।

আমাদের দেশে অধুনান্তিক ভাবনার ইতিহাস ইউরোপের ভাবনা থেকে অনেক আলাদা। ইউরোপ-আমেরিকায় অধুনান্তিক চিন্তাচেতনার উদ্ভব ঘটেছে আধুনিকতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এদেশের অধুনান্তিকতা উপনিবেশের শাসকদের দ্বারা লালিত সাহিত্যসঙ্গীতসংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছে। সে উপনিবেশ-পূর্ব ঐতিহ্য  সংস্কৃতিকে আত্তীকৃত করে ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হতে চেয়েছে।

কবি  প্রাবন্ধিক সমীর রায়চৌধুরী এবং রুদ্র কিংশুক পোস্টমডার্ন বাংলা কবিতা  তার গতিপ্রকৃতির চেহারা  লক্ষণগুলি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। সে বিশাল কর্মকান্ড। এখানে সংক্ষিপ্ত কয়েকটি কথা বলছি। পোস্টমডার্ন চিন্তাচেতনার কবিতা এক ধরনের নয়। বহুত্ব বা প্লুরালিজম্ তার বহুমুখীনতায়। অধুনান্তিক কবিতায় যুক্তিকাঠামো ভেঙে ফেলার আয়োজন ––– এই ‘যুক্তি ফাটল’ (logical cleft বা logical crack)-এর পথ ধরে চিন্তাচেতনার বিস্তৃত পরিসর গড়ে উঠেছে। পরিবর্তনের পথে এগিয়ে চলেছে বাংলা কবিতা ––– এর গড়ন একরৈখিক নয়বহুরৈখিক।

অধুনান্তিক কবিতা সময়ের দাবি মেনেজন্ম হওয়া কাব্য প্রয়াস।

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনকে স্মরণ করে ‘রঙিন ক্যানভাস’-এর এই সংখ্যা। তিনি যে রয়েছেন আমাদের সবার হৃদয়ে। তাঁকে শ্রদ্ধা  প্রণাম জানাই।

 

সকলকে শুভেচ্ছা  ভালোবাসায় –––

রোশনি ইসলাম

সোনালি বেগম

 

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

 

এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই

ভারতবর্ষে সাধারণ সন্তান প্রায় মায়ের দুধের সাথে সাথেই ঈশ্বরবিশ্বাস এবং পরাপ্রকৃতির উত্তরাধিকারী হয় নজরুল এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলেন না  (গোপাল হালদার)

 

আধুনিক বিশ্বের মূল সুর ‘সেক্যুলারিজ়ম’ তথা ধর্মনিরপেক্ষতা। বিশ শতকের রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারায় ‘ঈশ্বর’-এর ভাবমূর্তিও সেই অর্থে সেক্যুলার। মহাবিশ্বলোকের ইশারাজাত কবিতার মগ্ন শব্দমালায় বিধৃত সমস্ত ঈশ্বরায়িত ধারণার উৎস আসলে কী এক অনন্ত সত্তার চিন্ময় প্রকাশরবীন্দ্রনাথ থেকে রবীন্দ্রেতর বাঙালি কবিদের ঈশ্বর-ভাবনা আসলে সু-চেতনার উন্মেষ ঘটাতে চায়। ঈশ্বর-কে স্বীকারঅস্বীকার কিংবা আধুনিক ভক্তিময়তার ভিতরে একধরণের আশ্রয় খোঁজার প্রয়াস রয়েছে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ আর একাধিক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম  বিপ্লবের আগুনে দগ্ধ পৃথিবীতে এই ঈশ্বর কবিদের কাছে অনেকাংশেই ‘পার্সোনাল গড রবীন্দ্রোত্তর পর্বের আধুনিক কবিতায় ঈশ্বর-ভাবনা আসলে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ইমেজ তথা ভাবমূর্তির কথাই বলে আমাদের কাছে। ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে’ – এই উত্তরাধিকার স্বতন্ত্রধারায় আজও প্রবাহিত। তাই আমরা দেখিযিনি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্বামী’ কিংবা ‘মহামানব’ বা ‘মানুষের ঈশ্বর’, ‘ত্রিভুবনেশ্বর’, তিনিই ১৮৯৯ সালে জন্ম নেওয়া রবীন্দ্র-পরবর্তী দুই কবির ঈশ্বর-ভাবনায় ধরা দেন দুই ভিন্ন রূপে। ধর্মের মতো কবিতার কোনো শেষ ঈশ্বরঘন আশ্রয় নেইএকথা জানিয়ে জীবনানন্দ অন্তিম পর্বের কবিতায় লিখেছিলেন : ‘মানুষের পৃথিবীতে  সে অনেক শতাব্দী আগে / ঈশ্বর স্খলিত হয়ে গেছে – তবু মানুষের স্বভাবের গভীরতা আছে / প্রেম চায়ন্যায় চায়জ্ঞান চায় –’ (এখন  পৃথিবীতেআলোপৃথিবী) যদিও প্রথম জীবনে ‘বনলতা সেন’ কাব্যে তিনি ‘নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বর’-এর কথাও বলেছিলেন আমাদের। আর তাঁরই সমবয়সী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২২ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘোষণা করেছিলেন : ‘আমি বিদ্রোহী ভৃগুভগবান্‌ বুকেএঁকে দেবো পদচিহ্ন! / আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!’ নিজেকে তিনি ‘জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য’ বলে ঘোষণা করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পটভূমিতে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার সাহস দেখালেন এই মুসলমান কবি। একজন ঈশ্বরকে অপ্রয়োজনীয় বলে দূরে সরিয়ে রাখলেনঅন্যজন তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। এই ঈশ্বর-ভাবনার দুটি ধরণই আধুনিক যুগের অন্যতম লক্ষণ।  

২।।

 

বুদ্ধদেব বসু তাঁররবীন্দ্রনাথ উত্তরসাধকপ্রবন্ধে মন্তব্য করেছেন, ‘তাঁর (কাজী নজরুল ইসলামের) কবিতায় যে পরিমাণ উত্তেজনা ছিলো, সে পরিমাণ পুষ্টি যদিও ছিলো না, তবু অন্তত নতুনের আকাঙ্ক্ষা তিনি জাগিয়েছিলেন                                                      কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) কবিতায় হিন্দু ইসলামধর্মের এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ লক্ষ করা তাঁর কবিতার উর্দু আরবি-ফারসি শব্দ মেশানো বিশিষ্ট বাচনরীতি পাঠকের কাছে অভিনব স্বাদ-গন্ধ আনতে পেরেছিলো। তাই তাঁর স্বভাবকবিত্বে মননের গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাঁর কবিতার তেজস্বী উচ্চারণভঙ্গিমা আমাদের আকৃষ্ট করে আজও।বিদ্রোহীকবিতাটির ভিতরে যে অস্মিতাবোধের সুতীব্র প্রকাশ তা রবীন্দ্রেতর হয়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট ছিল তাঁর সমকালে। আর একালের পাঠকও এই কবিতার পাঠ আবৃত্তি শুনে পুলকিত হন। সমগ্র কবিতা জুড়ে যেচির-উন্নত শিরআমির জয়গান গাওয়া হয়েছে সে হিন্দু ইসলামী পুরাণের সমস্ত দেব-দেবতাকে তুচ্ছ করে মানবমহিমার কথাই বলে আমাদের। আমরা সকলেই জানি রুশ বিপ্লবোত্তর বঙ্গদেশে সাম্যবাদী চেতনার ধারায় যেসব বাঙালি কবি সাহিত্যিকের দল দীক্ষিত হয়েছিলেন, নজরুল তাঁদের অগ্রণী। বিশ শতকীয় রুশ সাহিত্যের উজ্জ্বলতম মুখ ম্যাক্সিম গোর্কিও বিশ্বাস করতেন মানুষের সর্বোচ্চ মহিমায়, ঈশ্বর তাঁর চোখে মানবসত্তারই ফটোগ্রাফ – ‘বিদ্রোহীকবিতায় মানবমহিমার এই উচ্চকিত ঘোষণায় আমাদের তাই সমকালীন সাহিত্যিক গোর্কিকে মনে পড়তেই পারে। যদিও অনেকেই হুইটম্যানেরসং অফ মাইসেলফ’-এর কথা -প্রসঙ্গে বলেন। তবেসর্বহারাকাব্যে নজরুলের ঈশ্বর-ভাবনার স্পষ্ট প্রকাশ লক্ষ করে আমরা উচ্ছ্বসিত হতে পারি। এই সাম্যবাদী চেতনা রুশ বিপ্লব মার্ক্সীয় দর্শন জাত, -বিষয়ে সন্দেহ নেই। এই কাব্যে ঈশ্বর-ভগবান-দেবতা নানাভাবে বিকীর্ণ হয়ে আছে, যদিও কোনো অন্ধ ভক্তিতে নজরুল এখানে নত নন দেখা যায়। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পঙ্‌ক্তি এইরকম :

) তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার,

তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকলের দেবতার।  (সাম্যবাদী)

) সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি,

আমারে দেখিয়া আমার -দেখা জন্মদাতারে চিনি!  (ঈশ্বর)

) আমার আমি সে কত অতল অসীম,

আমিই কি জানি, কে জানে, কে আছে আমাতে মহামহিম!  (মানুষ)

) মহামানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,

ঊর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!  (কুলি-মজুর)

)  তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা কামান?

হবেনা সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবেনা প্রতিবিধান?

                          ভগবান! ভগবান!          (ফরিয়াদ)

এই উদ্ধৃতি-পঞ্চকে লক্ষ করা যাচ্ছে, নজরুল ভগবান বা ঈশ্বরকে মানবমহিমার প্রেক্ষিতে স্মরণ করছেন বারংবার। ভগবানের কাছে যে প্রতিবিধান তিনি প্রার্থনা করেছেনসেখানেও মানুষের প্রতি অত্যাচার-অনাচারের জন্যই তিনি উচ্চকণ্ঠ, প্রতিবাদী। তাঁর ঈশ্বর-ভাবনা এখানে মানবমুখী হয়ে উঠেছে দেখা যায়।


৩।।

 

সুন্দরশব্দটিকে নজরুল নানাভাবে তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছেন। কবিতায়, গানে, গদ্যে এই সুন্দর কখনো রূপমাধুর্যকে চিহ্নিত করে, কখনও বা তা হয়ে ওঠে অধ্যাত্ম-চেতনার চিহ্নায়ক শব্দ। রবীন্দ্রসাহিত্যে এই সুন্দরকে সত্য মঙ্গলের সঙ্গে অন্বিত হয়েছে দেখেছি আমরা। উপনিষদ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যভাবনায় ফরাসি দার্শনিক ভিক্তর কুজ্যাঁরসত্য সুন্দর মঙ্গল’-এর প্রেরণার কথা এতদিনে আমরা সকলেই জানি। নজরুলের সৌন্দর্যভাবনায় সেই কল্যণময় সুন্দর কখনো বা দারিদ্র্যের তাপে ব্যথাতুর, তিনি প্রশ্ন রেখেছেন :

                   দারিদ্র্য অসহ

পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ

আমার দুয়ার ধরি! কে বাজাবে বাঁশী?

কোথা পাব সুন্দরের আনন্দিত হাসি?  (দারিদ্র্য)

আবার সেই নজরুলকেই আমরা দেখি তাঁর শেষ পর্যায়ের রচনাযদি বাঁশী আর না বাজেএবংআমার সুন্দর’- আরো স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর সুন্দরের ধারণাকে :

) অসুন্দরের সাধনা আমার নয়, আমার আল্লাহ পরম সুন্দর। তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয়ঘন সুন্দর, প্রেমঘন সুন্দর, রসঘন সুন্দর, আনন্দঘন সুন্দর। আপনাদের আহ্বানে যখন কর্মজগতে ভিড়ে নেমে আসি তখন আমার পরম সুন্দরের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই... আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই, আমার ক্ষমাসুন্দর প্রিয়তম আমার আমিত্বকে গ্রহণ করেছেন।   (যদি আর বাঁশী না বাজে)

) গোপনে পড়তে লাগলাম, বেদান্ত, কোরান। আমার পৃথিবীর আকাশ যেন কোন বজ্রনাদে তড়িৎ-লেখার তলোয়ারে বিদীর্ণ হয়ে গেল। আমি যেন আরো, আরো ঊর্ধ্বে যেতে লাগলাম। দূর হতে দেখতে পেলাম অপরূপ স্বর্ণসুন্দর জ্যোতি। এই আমার স্বর্ণজ্যোতি সুন্দরকে প্রথম দেখলাম।   (আমার সুন্দর)

তাঁর জীবনের চলার ছন্দে তিনি সুন্দরকে নানা রূপে দেখেছেন। প্রেমসুন্দর, শোকসুন্দর, প্রলয়সুন্দর ইত্যাদি নানা নামে সুন্দরকে অভিহিত করেছেন কবি। নজরুল জীবনীকার অধ্যাপক অরুণকুমার বসু মনে করছেন, এই সুন্দর-ভাবনাতে নজরুলের আধ্যাত্মিকতার পরিচয় মেলে। সাহিত্যজীবন থেকে কবির এই মরমিয়াতত্ত্বে পৌঁছনোর এই পথ তাঁর কাছে ভাবে ভাষায় রাবীন্দ্রিক বলেই মনে হয়েছে। সুন্দরের হাতে বীণা পদ্মফুলের পাশাপাশি যিনি চোখভরা জল দেখেন, সেই কবি তাঁর জীবন সৃষ্টি দিয়ে চান অসুন্দরকে ক্ষমা করেঅভেদ-সুন্দর সাম্যকেপ্রতিষ্ঠিত করতে। সাম্যের গান গেয়ে তিনি আমাদের জানিয়েছেনমানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান এই মানবমহিমার অনুকীর্তনে আরো একবার মাক্সিম গোর্কিকে মনে পড়ে। নজরুল সম্পাদিতলাঙলপত্রিকায় প্রথমমাউপন্যাসের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। আর সেইমাউপন্যাসেই গোর্কির খখল চরিত্র বলে : ‘সময় আসবে যখন প্রতিটি মানুষ আর সকলের কাছে তারার মতো হয়ে উঠবে কারো মনে দ্বেষ হিংসা থাকবে না। জীবন রূপ পাবে মানুষের সেবায় মানুষের মূর্তি পাবে স্বর্গের দেউল। কিছুই মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়। মানুষ সেদিন সুন্দর হবে, সত্য সুন্দরের মুক্তিতে পাবে সে তার বীজমন্ত্র এমন সাম্যবাদী সমাজ চান নজরুলও। এই সুন্দরের অনুধ্যানে নজরুলের ঈশ্বর-ভাবনা আরো একবার মানবতার দীপ্ত মন্ত্রে আলোকিত হয়। গজদন্তমিনারে নয়, তাঁর সুন্দর থাকে সবার পিছে, সবার নিচে সবহারাদের মাঝে। সমালোচক লেখেন :

প্রলয়সুন্দরের আশীর্বাদে কবি হলেন ব্যথাবিষে নীলকণ্ঠ কবি। অসুর দমনের শক্তি পেলেন কর্মে লেখনীতে। ভেঙে গড়ার আনন্দবেদনায় খুঁজে পেলেন আমার সুন্দরকে।’        (নজরুল সুন্দর, তরুণ মুখোপাধ্যায়)

 

৪।।

 

জন্মসূত্রে মুসলিম হলেও তাঁর কবিতার সুর অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু ইসলামী পুরাণকে নজরুল বারংবার নানাভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। তাই খোদা, আল্লাহ, জিব্রাইলের পাশাপাশি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী, সরস্বতী ইত্যাদি সকলেই এসেছেন। এসেছে রামায়ণ-মহাভারতের একাধিক মিথ। এইসব উদাহরণ প্রমাণ করে ধর্ম পুরাণ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল যথেষ্টই। প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বর অধ্যাত্মচেতনা তাঁর কবিতায় প্রথাগত ভাবে আসেনি, তা আমরা দেখেছি। কিন্তু পরিণত বয়সে তিনি অধ্যাত্মসাধনার দিকে ঝুঁকেছিলেন, যোগাভ্যাস অনুশীলনও করতেন। বিশ শতকের তিনের দশকে পুত্র বুলবুলের মৃত্যুশোক তাঁকে আধ্যাত্মিকতার পথে ঠেলে দেয় বিশেষভাবে। গৃহী সাধক বরদাচরণ মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে তাঁর অলৌকিকতার উপর আস্থা বিশ্বাস বেড়ে যায়। শ্যামা মায়ের প্রতি সুগভীর বিশ্বাস নিয়ে একাধিক গানও লেখেন কবি, একটি গানে যেমন স্পষ্ট আর্তি : ‘ফিরিয়ে দে মা ফিরিয়ে দে গো দে ফিরিয়ে মোর হারানিধি’; কখনো বা লেখেনসকল শান্তি আমার হরে নিল যে পাষাণী এসময় শোক ভুলতে তিনি ইসলামী ধর্মের প্রতিও ঝুঁকেছেন, হজরত মহম্মদের জীবনীমরু-ভাস্কর’ (১৯৫০) লিখেছেন, কোরানের অংশবিশেষ অনুবাদ করছেন। তাঁর আরেক জীবনীকার গোলাম মুরশিদের চোখে নজরুলের এই মানসিক পরিবর্তন অনেকটাই শোকের যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টাজনিত ভ্রান্তি বলে মনে হয়েছে। কারণ মুরশিদের মতে সাধু-সন্ন্যাসী-ফকির এসবই বুজরুকদের ক্রিয়াকলাপ মাত্র! নজরুলের জীবনে ঘটা নানা অলৌকিক ঘটনাকেও তিনি মানসিক বিকারের পূর্বলক্ষণ, দিবাস্বপ্ন বা অতিরঞ্জন বলে উপেক্ষা করেছেন। যাইহোক এসব ক্ষেত্রে তর্ক চলে না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু আর অবিশ্বাসীর কাছে সবই মিথ্যা বা বুজরুকি। যাইহোক, ১৯৩০- বুলবুলের মৃত্যু তাঁকে ক্রমশ দেব-দেবতামুখী করে, এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৩৮-এর শেষ দিকে স্ত্রী প্রমীলার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনা। কালীবাড়িতে পাঁঠাবলি থেকে নানা কবচ-তাবিজ-মাদুলি, পূজা-পাঠ এসব নজরুল করেছেন তখন। বরদাচরণকে তিনি শিব-স্বরূপ মানতেন। বাড়িতে কালীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা অসামান্য শ্যামাসঙ্গীত লেখার পিছনে এই ধর্মগুরুর প্রেরণা সক্রিয় ছিল। একদা নাস্তিক বিদ্রোহী কবির এই পরম আস্তিক্য অনেকের চোখেই স্বাভাবিক ঠেকেনি। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যাওয়ার বছর খানেক আগে তাঁর হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থা কমে আসে বলেন মুরশিদ ইতোমধ্যে গুরু বরদাচরণ মারা গেছেন, স্ত্রীর রোগমুক্তি ঘটেনি তবে কী নমাজ পড়াই উচিত কাজ ছিল? এরকম প্রশ্ন জেগেছে তাঁর মনে। এসময় লেখা একটি কবিতাআর কতদিন?’-এ আমরা হিন্দু পুরাণ বা দেব-দেবী নয়, আল্লা-আল্লাহ-রসুল বারংবার ব্যবহৃত হতে দেখি। এসময় লেখা অন্যান্য কবিতার মধ্যে আছে : ঈদের চাঁদ, শেষ সওগাত, নবযুগ, বকরীদ, ভয় করিয়ো না হে মানবাত্মা, একি আল্লাহর কৃপা নয়?, এক আল্লাহ জিন্দাবাদ, আজাদ, মোবারকবাদ সালাম অস্ত রবি ইত্যাদি। এসব কবিতায় অতিরিক্ত আল্লাহ-আসক্তি তাঁর ধর্মপরিচয়ের সংকট চিত্রিত করেছে। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পঙ্‌ক্তি চয়ন করা যেতে পারে :

) কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ মুক্ত মুসলমান

আল্লা ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ? (আজাদ)

) আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে কভু শির করিয়ো না নীচু

এক আল্লা ছাড়া কাহার বান্দা হবে না, বলো

দেখিবে তোমার প্রতাপে পৃথিবী করিতেছে টলমল। (মোবারকবাদ)

সাম্যবাদী চেতনাদীপ্ত হয়েও তাঁর শেষপর্বের কবিতাতে আল্লাহর অনুষঙ্গ এসেছে বারংবার :

) আল্লা আমার সহায়আল্লা পুরাবেন মোর আশ;

গরীব ভাইরা ভয় নাই, আসে আল্লার আশ্বাস। (দরিদ্র মোর পরমাত্মীয়)

) নহে আল্লার বিচার ভাই, মানুষের অবিচারে

আমাদের এই লাঞ্ছনা, আছি বঞ্চিত অধিকারে।  (শ্রমিক মজুর)

প্রতিবাদী সত্তা বিলুপ্ত না হলেও তাঁর ধর্মবিশ্বাসে ইসলামী অনুষঙ্গ নিবিড় হয়েছে এসময়। ক্রমশ সরে এসেছেন রাজনীতি থেকেও। শ্রদ্ধেয় গোপাল হালদার লক্ষ করেছেন, নজরুলের মধ্যে গভীর নাস্তিক্য কখনোই ছিল না। ঈশ্বর, জাত বা ধর্মের নামে মানুষে মানুষে শোষণ, অনাচার তাঁর অপছন্দ ছিল; তাঁর ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার মূলে ছিল এইসব সামাজিক অসাম্য। তবে ১৯২০-২১-এর নজরুল একরকম; আর ১৯৩৬-এর পর থেকে নজরুলের অনেকটাই বদল ঘটে। পুত্রের মৃত্যু তাঁকে অনেকখানি ধর্মনির্ভর করে তোলে, আপাত নাস্তিক্যের অবসান হয়। গোপাল হালদার বলেন,

ভক্তির দুই ধারাহিন্দুদের শ্যামাসঙ্গীত ধরণের এবং ইসলামীয় আরাধনার গানসমানভাবে পাশাপাশি চলতে লাগল, যেন দেখিয়ে দিল উভয়ের সানন্দ স্বীকৃতিতেই মূলত সমান আধ্যাত্মিক মূল্য রয়েছে। জীবনে এবং আত্মার অনির্ণেয় গভীরতায় নজরুল যেমন ছিলেন কালীভক্ত তেমনই তাঁর মধ্যে এক খোলা প্রগাঢ় উপলব্ধি ছিল যে সত্য একটাই। ঈশ্বরে পৌঁছবার জন্য অনেক পথই খোলা আছে। যার মধ্যে রয়েছে সগুণ, নির্গুণ এবং অন্য ধরণের আরাধনা।

শ্রী হালদার এই পর্বকে তাঁর প্রায়শ্চিত্তের কাল বলতে চাননি কিংবা গোলাম মুরশিদের মতো অতি-যুক্তিবাদের নিরিখে নজরুলের নানা অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হওয়াকে হ্যালুনশিনেশন বা মনোবিকারের পূর্বলক্ষণ বলে উড়িয়েও দেননি। নজরুলের এই ঈশ্বর-ভাবনার স্বরূপ যে খুব অভিনব তা বলা যায় না, তবে একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়েও তাঁর ঈশ্বরান্বেষণের চেহারা বেশ সেক্যুলার তাতে সন্দেহ নেই। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় শেষদিকে তাঁর যোগসাধনা এবং আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের মধ্যে কিছুটা আবেগ যুক্তিহীনতা কাজ করলেও তিনি আসলে ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অনুবর্তন করেছেন। ১৯৩৫- বিরজাসুন্দরী দেবীকে একটি চিঠিতে তাঁকে লিখতেও দেখা গেছে গীতার শ্লোকযথা নিযুক্তোস্মি তথা করোমি তিনি বিশ্বাস করতেনএই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই নিপীড়িত জনগণের নব উত্থানে যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব অবধি তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছেন, সে ঈশ্বর বা আল্লা আসলে তাঁর পরম আশ্রয়শুভবোধের ধারক তাই ধর্মের স্থূল আস্তিক্য অপেক্ষা এক মাঙ্গলিক আস্তিক্যবোধের প্রেরণাতেই তাঁর ঈশ্বরচেতনা উজ্জ্বল হয়ে আছে, এমন ভাবা অসঙ্গত হবে না মনে করি।।

 

ঋণস্বীকার :

) সঞ্চিতা নজরুল ইসলাম। সপ্তচত্বারিংশৎ সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৯৬। ডি এম লাইব্রেরি

) কাজী নজরুল ইসলাম। গোপাল হালদার (শিবপ্রসাদ সমাদ্দার অনূদিত) চতুর্থ মুদ্রণ ২০১৫। সাহিত্য অকাদেমি

) নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। প্রথম আনন্দ সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৭। আনন্দ পাবলিশার্স

) বিদ্রোহী রণক্লান্ত : নজরুল-জীবনী। গোলাম মুরশিদ। দ্বিতীয় সংস্করণ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৮। প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

) নীলকণ্ঠ নজরুল। তরুণ মুখোপাধ্যায়। ডিসেম্বর ২০০৬। অচিন প্রকাশনী

) মা। মাক্সিম গোর্কি। অনুবাদ : পুষ্পময়ী বসু। পঞ্চম সং, ১৯৮১। প্রগতি প্রকাশন, মস্কো