সম্রাট লস্কর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সম্রাট লস্কর লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সম্রাট লস্কর-এর অনুবাদ কবিতা

কামাল এলগিজুলি


রাতের এক খণ্ডচিত্র

 

রাতের শেষতম প্রহরে,

বড়ো মসজিদের ভাঙা দেওয়াল ঘেঁষে,

এক কুষ্ঠরোগী, নোংরা আর দুর্বল,

তার পুরুষত্ব নিয়ে চুপিসাড়ে এগিয়ে যায় একইরকম নোংরা আর দুর্বল  

আরেক কুষ্ঠরোগীর বুকের দিকে, তারপর…

ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে।

উটের খুরের মতো তাদের হাতের তালু,

আর শুকনো কাঠের মতো তিনটে হাত দিয়েই

ওরা পরস্পরকে নিবিড় আলিঙ্গন করে

বড়ো মসজিদের ওই ভাঙা দেওয়ালটা ঘেঁষে,

রাতের শেষ প্রহর যখন মিশে যাচ্ছে ভোরে।

কিন্তু ঠিক তখনই ওই রাতের শেষতম পথচারী,

উবু হয়ে মাটিতে পেটের সব বমি উগরে দিয়ে  

নিজের পথ ধরে আবার।

না, ওই পরিশ্রান্ত মাতালটা বুঝতেও পারে নি

কীভাবে কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার সেই স্বর্গীয় মুহূর্তটা

ও নষ্ট করে দিয়েছে এক লহমায়।       


গোপন কথাগুলি

 

আমি আসলে হত্যাকে ভয় পাই না।

ভয় পাই না কোনো করুণ পরিণতিকে।

এই ভয়টাও পাই না যে এই দরজাটা পুরোপুরি উড়ে যাবে

বিস্ফোরণে, বা মাঝরাতে উদ্ধত বন্দুকগুলো হাতে নিয়ে       

ওরা হানা দেবে।

না।

কোনো বিষিয়ে যাওয়া ক্ষত, রক্তের স্রোত,

আমার খুলির টুকরোগুলো দিয়ে দেওয়ালে আঁকা ওই অদ্ভুত নকশা

এসব কোনো কিছুতেই আমার একটুও ভয় আসে না।

তবে বলি শোনো, আমি সবথেকে বেশি ভয় পাই, ভয়কেই।

সেই ধূর্ত, অধরা অনুভূতি

যা মুহূর্তে কোন এক ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে

ফিসফিস করে শোনায় এড়িয়ে চলার বাহানাগুলোর কথা

কত রঙিন, কত আকর্ষণীয়,

অথচ ওরাই গোপনে আমাদের আত্মার রন্ধ্রগুলোতে ভরে দেয়

দুর্বলতা আর নিঃসীম হতাশা।

সেই সুন্দর, মন-কাড়া জিনিসটা

আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে, আমি দেখি তরোয়ালের চকচকে ধার,

সেই উজ্জ্বলতা আমার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মুহূর্তেই

ওটা আঘাত হানে

দ্বিখণ্ডিত হই আমি:

একটা ভাগ উপরে—ওই মায়ার জগতে,

সেখানে তার মৃত্যু হয় দু’বার।

অন্য ভাগটা তো এখানেই থাকে,

অর্ধমৃত।

তোমার মৃত্যু তো নিশ্চিত—আর ওদেরও তাই;

জেনে রেখো, বাঁচবে না কেউ-ই।

তাই তোমার প্রত্যাখানের ভাষা স্পষ্ট করে বলো এখানে!

ওই বাইরে, তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হবে

যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে।

মরো এখানে,

যাতে ওখানে বেঁচে থাকতে পারো!          




বক্তব্য

 

ক্ষয়িষ্ণু ওই বাঁকা চাঁদ যা আমাদের দেখছে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে

আর এক একাকী নক্ষত্র

যা ক্রমে মিশে যাচ্ছে বিস্মৃতির কৃষ্ণগহ্বরে,

ওদের ঠিক নীচে আমি চুপ করে বসি আর ভাবি,

একবার ওকে দেখি আর একবার নিজেকে—

আর ভাবতেই থাকি।

আঁধার ঘিরে থাকে আমায়, তবুও আমার স্বপ্নে আসে

এক ক্যারাভান যা চলতে চলতে থেমে যায়,

আর আমাকে তুলে আনে ওই গভীর কূপ থেকে।

ও ওখানেই আছে,

হাতে বন্দুক উঁচিয়ে, উঁচু কাঁটাতারের সীমানার চারিদিকে

একঘেয়ে প্রহরায় মগ্ন।

“তুমি তো আমাকে প্রায় চেনোই না!” আমি বলি —

“আর আমিও তোমায় তেমন চিনি না,

এমনকি তোমার ভালো নামটাও আমার জানা নেই।

বাজারের হল্লা আর শোরগোলের মধ্যে

তুমি হয়তো তখন দুটো বোমার ফাঁপা খোল নিয়ে

হেঁটে যাচ্ছ দোকানগুলোর সামনে দিয়ে,

সেই সময় যদি আমাদের দেখা হয়েও যেত কখনও

আমরা তো ভালো করে চিনতেও পারতাম না একে অপরকে।

তাহলে কী করে আমরা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেলাম, বলো তো?

সত্যিই কি আমরা তাই?    

আমাদের দু’জনকে এখানে অস্থির, নিদ্রাহীনতায় মুড়ে দিয়েছে যে,

আমাদের ঘুম থেকে বিন্দু বিন্দু প্রশান্তি শুষে নিয়েছে যে

সেই কি ওখানে গভীর নিদ্রায় মগ্ন?

সেই কি আজকের এই রাতে আমাদের দাঁড় করিয়েছে পরস্পরের মুখোমুখি?

সেই কি আমাদের খণ্ডিত করেছে দুই স্পষ্ট বৈপরিত্যে?

সেই আবার আগামীকাল আমাদের মিশিয়ে দেবে,

দুই যমজ ভ্রাতার মতো, একই বেদনার তীক্ষ্ণতা যাদের এক করেছে—

পৃথিবী যখন তীব্র ব্যথায় কাঁপতে কাঁপতে

বমি করে উগরে দেয় তার অবাঞ্ছিত দায়গুলো,

ভোরের শিরা বেয়ে দাপিয়ে বেড়ায় ক্রোধ—

সেই সময়ও আমাদের কথাবার্তা কী সীমিত থাকবে

শুধু এই মৃত্যু-মাখা লেখায়?”

আমি তাকে বলি,


আর সে কী করে?

চোখ সরু করে সে দেখে বোমার ফাঁপা খোল দুটোকে,

তারপর নাক দিয়ে বাতাসের ঘ্রাণ টানতে টানতে,

শীতার্ত সে, নিজের রুগ্ন, ঠান্ডা দেহে

উষ্ণ বাতাস ঢুকিয়ে নেয় আর

হেঁটে চলে যায়, না জানি কোথায়!  



[কামাল এলগিজুলি/Kamal Elgizouli: ১৯৪৭-এর জাতক কামাল এলগিজুলি একাধারে কবি, সাহিত্য সমালোচক, সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। কামালের লেখা তিনটি কাব্যগ্রন্থ এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে সব চেয়ে বিখ্যাত অবশ্যই ২০০৪ সালে প্রকাশিত অমদুরমান তা’তি ফে কিতর অল-থামিনাহ (‘অমদুরমান আটটার ট্রেনে আসে’)। কবিতার বই ছাড়াও কামালের অন্য বিষয় নিয়ে প্রকাশিত বই আছে ছয়টি; তাছাড়াও উনি লিখে চলেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সমালোচনা যেগুলোতেও সাহিত্যের সাথে সাথেই উঠে এসেছে/আসছে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, মানবাধিকারের মতন বিষয়গুলো। তাঁর লেখায় বারে বারে এসেছে লাগাতার গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সুদানের অস্থির, হিংস্র রাজনীতির প্রতিফলন। সুদানের সাহিত্যিকদের সংগঠন, Sudanese Writers’ Union-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য কামাল এলগিজুলি ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সাধারণ সচিব হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে গেছেন। এখানে কবির তিনটি কবিতার অনুবাদ করা হয়েছে। মূল আরবি থেকে সরাসরি অনুবাদ নয় বরং আদিল বাবিকিরের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকেই এই বঙ্গানুবাদ করা হল।]

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সম্রাট লস্কর-এর অনুবাদ কবিতা


রাইনে মারিয়া রিলকে

 

অর্ফিউসের প্রতি সনেট


১: ১


একটা গাছ উঠেছে ওখানে। কী স্বর্গীয় আনন্দ আহা!

ওই শোনো অর্ফিউস গাইছে! লম্বা গাছটাও শুনছে কান পেতে!

সব কিছু স্তব্ধ একেবারে। তবুও ভেঙে সেই স্তব্ধতার মায়া

হয় নতুনের সূচনা, হাতছানি ডাক, পরিবর্তনের এই প্রভাতে।

 

স্তব্ধতার প্রাণীরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে সব

উজ্জ্বল, বিস্তৃত ওই বনানী ছেড়ে, পরিত্যক্ত তাদের বাসা,

না, কোনো ক্লান্তি নয়, ভয় নয়, তাদের এই ছুটে আসা,

যে গোপন কারণে ওরা সব হয়েছে নীরব

 

তা হলওরা শুনছে মন দিয়ে। গম্ভীর নাদ, চিৎকার, গর্জন —    

এসব হৃদয়ে চুপসে বসেছে একেবারে। যেখানে ছিল ছোটো

এক ভাঙাচোরা কুটির, শুধু নিভৃতে গান শোনার মতো

 

যে কুটির ওদের আঁধার-বাসনা উৎসারিত

বাতাসে কাঁপা দরজা দিয়ে প্রবেশ দ্বিধান্বিত

সেখানেই গড়েছ তুমি এক মন্দির, শ্রবণের গহীনে রয়েছে তা গোপন।    



:


হ্যাঁ, একটা মেয়েই তো হবে বোধহয়

তার আবির্ভাব যেন সঙ্গীত বীণার ঐক্যতান

থেকে বেরিয়ে আসা স্বচ্ছ, নির্মল এক প্রাণ

আমার কানের কুহরে প্রবেশ করে এখন সে শয্যায়।

 

আমার ভিতর ঘুমিয়ে পড়েছে সে। নিদ্রাই সব তার।

অসাধারণ বৃক্ষগুলো, তাদের বিপুলতা মেপে যাই নিরন্তর

হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে দিই তাদের, আর বসন্তের প্রান্তর:

আমার হৃদয় দখল করেছে, এই বিস্ময় একান্ত আমার।  

 

মেয়েটি ঘুমোয় এক পৃথিবী। সুরের দেবতা, করি অনুনয়,

বলুন তো কী করে হয় তার ঘুম এত বিঘ্নহীন, ইচ্ছে হয় উধাও

জেগে ওঠার? দ্যাখো তোমরা: মেয়েটা জেগে ওঠে, আবারও ঘুমোয়।

 

ওর মৃত্যু কোথায় এখন? খুঁজে কি পাওয়া যায়

সেই সত্য, যতক্ষণ না তোমার গান নিজেকে পোড়াচ্ছে দাউ দাউ?

কোথায় যাচ্ছে হারিয়ে? …একটা মেয়েই তো, প্রায়



:


দেবতা তো পারে জানি, তুমি শুধু আমায় বলো

কোন রহস্যে মানবও মিশে যায় বীণার সুরেলা তারে?

মন হয় দ্বিখণ্ডিত। ছায়াঢাকা এই আধেক-আঁধারে

হৃদয়-পথের কাটাকুটিতে, নেই একটাও মন্দির অ্যাপোলোর।

 

সঙ্গীত, যা তোমার থেকে শেখা, সে তো নয় কামনা কোনো

নয় কোনো কৃপা লাভের চেষ্টা নিরন্তর;

সঙ্গীত- তো সত্য, সরল যেন ঈশ্বর।

কিন্তু কবে আমরাও হয়ে উঠব সত্য, আসে প্রশ্ন;

 

কবে তিনি আমাদের মাঝে পৃথিবী আর নক্ষত্রদের দেবেন ঢেলে?

শোনো রে ছেলে, ওটা মোটেও প্রেম নয়, যা ভাষা

হয়ে ছিটকে আসে তোমার ওই মৌন মুখ ঠেলে

 

শেখো তুমি ভুলে যেতে সেই আশ্লেষী সঙ্গীত। হবে ক্ষয়, নিশ্চয়।

সার্থক সঙ্গীতের তো অন্য কোথা থেকেই উঠে আসা,

সে গান শূন্যতার। ঈশ্বরে নিহিত পবিত্র বাতাস, অন্য কিছু নয়।    



[রাইনে মারিয়া রিলকে/Rainer Maria Rilke (১৮৭৫-১৯২৬): অস্ট্রিয়ার কবি রাইনে মারিয়া রিলকের কবিতায় অনেক সমালোচকই লিরিক কবিতার সার্থকতার চূড়ান্ত রূপ খুঁজে পেয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম আড়াই দশক যদি হয়ে থাকে মর্ডানিজম (আধুনিকতাবাদ) নিয়ে সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষার সফলতম সময়কাল; রিলকে সেই সময়কালেই তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা অনন্য কবিতাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর একেবারে স্বতন্ত্র কাব্যস্বরকে। মর্ডানিজম তাঁকে মোহিত করেছে, রঁদ্যার সাহচর্যে এসে বদলে নিয়েছেন তাঁর প্রথমদিককার কবিতাগুলোর আবেগী বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু নিজেকে কোনোইজমবাবাদেরমধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখেই তিনি নিজের কাব্যসত্তাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতাগুলোতে। বারে বারে তাঁর লেখায় এসেছে মৃত্যু আর পুনরুত্থানের অনুষঙ্গ, এসেছে দেবতা আর দেবদূতেদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির দোলাচল, এসেছে কবিতার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত শূন্যতাকে কোনো মহত্তর ভাবনায় রূপান্তরের আকূতি।

 

অসংখ্য কবিতা লিখলেও রিলকের কবিখ্যাতি মূলত দুটি বিশিষ্ট সৃষ্টির সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে — ‘দুইনো এলেজিসআরদ্য সনেটস টু অর্ফিউস’, দুটিই ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। অর্ফিউস সনেটগুলোর সব টাই (মোট ৫৫টি) রচিত হয় ঠিক তার আগের বছর, ১৯২২ সালে। সনেটগুলো রচনার অনুপ্রেরণা আসে এক অকালমৃত্যুর সংবাদে। তাঁর মেয়ে রুথের বন্ধু ভেরা নুপের আকস্মিক মৃত্যু কবিকে এতটাই আলোড়িত করে যে কবি সেই দুঃসংবাদ পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সনেটগুলো লেখা শুরু করেন। অর্ফিউসের জন্য লেখা এই ৫৫টি সনেট দুটি পর্বে বিভক্ত; প্রথম পর্বে ২৬টি, আর দ্বিতীয় পর্বে মোট ২৯টি সনেট রয়েছে। এখানে প্রথম পর্বের প্রথম তিনটি সনেট অনুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। মূল জার্মান থেকে নয় বরং স্টিফেন মিচেলের করা ইংরেজি অনুবাদের থেকেই এই বঙ্গানুবাদের চেষ্টা; তবে অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে রিলকে-কেই অনুসরণ করা হয়েছে, ইংরেজি অনুবাদককে নয়।]