সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

সম্রাট লস্কর-এর অনুবাদ কবিতা


রাইনে মারিয়া রিলকে

 

অর্ফিউসের প্রতি সনেট


১: ১


একটা গাছ উঠেছে ওখানে। কী স্বর্গীয় আনন্দ আহা!

ওই শোনো অর্ফিউস গাইছে! লম্বা গাছটাও শুনছে কান পেতে!

সব কিছু স্তব্ধ একেবারে। তবুও ভেঙে সেই স্তব্ধতার মায়া

হয় নতুনের সূচনা, হাতছানি ডাক, পরিবর্তনের এই প্রভাতে।

 

স্তব্ধতার প্রাণীরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে সব

উজ্জ্বল, বিস্তৃত ওই বনানী ছেড়ে, পরিত্যক্ত তাদের বাসা,

না, কোনো ক্লান্তি নয়, ভয় নয়, তাদের এই ছুটে আসা,

যে গোপন কারণে ওরা সব হয়েছে নীরব

 

তা হলওরা শুনছে মন দিয়ে। গম্ভীর নাদ, চিৎকার, গর্জন —    

এসব হৃদয়ে চুপসে বসেছে একেবারে। যেখানে ছিল ছোটো

এক ভাঙাচোরা কুটির, শুধু নিভৃতে গান শোনার মতো

 

যে কুটির ওদের আঁধার-বাসনা উৎসারিত

বাতাসে কাঁপা দরজা দিয়ে প্রবেশ দ্বিধান্বিত

সেখানেই গড়েছ তুমি এক মন্দির, শ্রবণের গহীনে রয়েছে তা গোপন।    



:


হ্যাঁ, একটা মেয়েই তো হবে বোধহয়

তার আবির্ভাব যেন সঙ্গীত বীণার ঐক্যতান

থেকে বেরিয়ে আসা স্বচ্ছ, নির্মল এক প্রাণ

আমার কানের কুহরে প্রবেশ করে এখন সে শয্যায়।

 

আমার ভিতর ঘুমিয়ে পড়েছে সে। নিদ্রাই সব তার।

অসাধারণ বৃক্ষগুলো, তাদের বিপুলতা মেপে যাই নিরন্তর

হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে দিই তাদের, আর বসন্তের প্রান্তর:

আমার হৃদয় দখল করেছে, এই বিস্ময় একান্ত আমার।  

 

মেয়েটি ঘুমোয় এক পৃথিবী। সুরের দেবতা, করি অনুনয়,

বলুন তো কী করে হয় তার ঘুম এত বিঘ্নহীন, ইচ্ছে হয় উধাও

জেগে ওঠার? দ্যাখো তোমরা: মেয়েটা জেগে ওঠে, আবারও ঘুমোয়।

 

ওর মৃত্যু কোথায় এখন? খুঁজে কি পাওয়া যায়

সেই সত্য, যতক্ষণ না তোমার গান নিজেকে পোড়াচ্ছে দাউ দাউ?

কোথায় যাচ্ছে হারিয়ে? …একটা মেয়েই তো, প্রায়



:


দেবতা তো পারে জানি, তুমি শুধু আমায় বলো

কোন রহস্যে মানবও মিশে যায় বীণার সুরেলা তারে?

মন হয় দ্বিখণ্ডিত। ছায়াঢাকা এই আধেক-আঁধারে

হৃদয়-পথের কাটাকুটিতে, নেই একটাও মন্দির অ্যাপোলোর।

 

সঙ্গীত, যা তোমার থেকে শেখা, সে তো নয় কামনা কোনো

নয় কোনো কৃপা লাভের চেষ্টা নিরন্তর;

সঙ্গীত- তো সত্য, সরল যেন ঈশ্বর।

কিন্তু কবে আমরাও হয়ে উঠব সত্য, আসে প্রশ্ন;

 

কবে তিনি আমাদের মাঝে পৃথিবী আর নক্ষত্রদের দেবেন ঢেলে?

শোনো রে ছেলে, ওটা মোটেও প্রেম নয়, যা ভাষা

হয়ে ছিটকে আসে তোমার ওই মৌন মুখ ঠেলে

 

শেখো তুমি ভুলে যেতে সেই আশ্লেষী সঙ্গীত। হবে ক্ষয়, নিশ্চয়।

সার্থক সঙ্গীতের তো অন্য কোথা থেকেই উঠে আসা,

সে গান শূন্যতার। ঈশ্বরে নিহিত পবিত্র বাতাস, অন্য কিছু নয়।    



[রাইনে মারিয়া রিলকে/Rainer Maria Rilke (১৮৭৫-১৯২৬): অস্ট্রিয়ার কবি রাইনে মারিয়া রিলকের কবিতায় অনেক সমালোচকই লিরিক কবিতার সার্থকতার চূড়ান্ত রূপ খুঁজে পেয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম আড়াই দশক যদি হয়ে থাকে মর্ডানিজম (আধুনিকতাবাদ) নিয়ে সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষার সফলতম সময়কাল; রিলকে সেই সময়কালেই তাঁর জার্মান ভাষায় লেখা অনন্য কবিতাগুলোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁর একেবারে স্বতন্ত্র কাব্যস্বরকে। মর্ডানিজম তাঁকে মোহিত করেছে, রঁদ্যার সাহচর্যে এসে বদলে নিয়েছেন তাঁর প্রথমদিককার কবিতাগুলোর আবেগী বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু নিজেকে কোনোইজমবাবাদেরমধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখেই তিনি নিজের কাব্যসত্তাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতাগুলোতে। বারে বারে তাঁর লেখায় এসেছে মৃত্যু আর পুনরুত্থানের অনুষঙ্গ, এসেছে দেবতা আর দেবদূতেদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতির দোলাচল, এসেছে কবিতার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্নিহিত শূন্যতাকে কোনো মহত্তর ভাবনায় রূপান্তরের আকূতি।

 

অসংখ্য কবিতা লিখলেও রিলকের কবিখ্যাতি মূলত দুটি বিশিষ্ট সৃষ্টির সঙ্গেই সম্পৃক্ত হয়ে আছে — ‘দুইনো এলেজিসআরদ্য সনেটস টু অর্ফিউস’, দুটিই ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। অর্ফিউস সনেটগুলোর সব টাই (মোট ৫৫টি) রচিত হয় ঠিক তার আগের বছর, ১৯২২ সালে। সনেটগুলো রচনার অনুপ্রেরণা আসে এক অকালমৃত্যুর সংবাদে। তাঁর মেয়ে রুথের বন্ধু ভেরা নুপের আকস্মিক মৃত্যু কবিকে এতটাই আলোড়িত করে যে কবি সেই দুঃসংবাদ পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই সনেটগুলো লেখা শুরু করেন। অর্ফিউসের জন্য লেখা এই ৫৫টি সনেট দুটি পর্বে বিভক্ত; প্রথম পর্বে ২৬টি, আর দ্বিতীয় পর্বে মোট ২৯টি সনেট রয়েছে। এখানে প্রথম পর্বের প্রথম তিনটি সনেট অনুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। মূল জার্মান থেকে নয় বরং স্টিফেন মিচেলের করা ইংরেজি অনুবাদের থেকেই এই বঙ্গানুবাদের চেষ্টা; তবে অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে রিলকে-কেই অনুসরণ করা হয়েছে, ইংরেজি অনুবাদককে নয়।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন