সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র অনুবাদ কবিতা

মায়া এঞ্জেল্যু

একা        (Alone)

 

শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে

কাল রাতে

কিভাবে আমার আত্মার জন্য এমন এক ঘর খুঁজে পাব

যেখানে জল পিপাসার্ত নয়

এবং রুটি পাথর নয়

আমি একটা ব্যাপার খুঁজে পেলাম

আর আমার মনে হয় না যে আমি ভুল

যে কেউ

মানে কেউই

এখানে একা একা দাঁড়াতে পারে না।

 

একা, সম্পূর্ণ একা

কেউ, মানে কেউই

একা দাঁড়াতে পারে না এখানে।

 

কিছু কোটিপতি আছে

এত টাকা যে তারা খরচ করতে পারে না

তাদের বৌরা শাঁখচুন্নীর মতো ঘুরে বেড়ায়

তাদের সন্তানেরা ব্ল্যুজ গায়

তাদের খুব দামি ডাক্তার আছে

তাদের পাথরের হৃদয় সারানোর জন্য।

কিন্তু কেউ

মানে কেউই

এখানে একা একা দাঁড়াতে পারে না।

 

একা, সম্পূর্ণ একা

কেউ, মানে কেউই

একা দাঁড়াতে পারে না এখানে।

 

এখন তুমি যদি মন দিয়ে শোনো

আমি তোমাকে বলব আমি কি জানি

ঝড়ের মেঘ জমছে

বাতাস বইবে

মানুষ জাতি কষ্ট পাচ্ছে

আর আমি কান্নার ধ্বনি শুনছি

কারণ কেউ,

মানে কেউ

এখানে একা দাঁড়াতে পারে না।


 

এক দেবদূতের স্পর্শধন্য     (Touched by an Angel)

 

সাহসে অনভ্যস্ত,

আনন্দ থেকে নির্বাসিত আমরা

একাকিত্বের খোলায় কুন্ডলী পাকিয়ে থাকি

যতক্ষণ না প্রেম আসে তার পবিত্র মন্দির ছেড়ে

আমাদের দেখা দেয়

আমাদের জীবনের মাঝে মুক্তি দিতে।

প্রেম আসে আর তার পিছনে আসে পরমানন্দ

ফেলে আসা সুখের স্মৃতি

যন্ত্রণার প্রাচীন ইতিহাস

তবু, যদি সাহস করি

প্রেম ভয়ের সব শিকলকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়

আমাদের আত্মা থেকে।

 

আমাদের ভীরুতা থেকে আমরা মুক্তি পাই

ভালোবাসার আলোকসঞ্চারে

আমরা সাহস করতে ভয় পাই না

আর আমরা হঠাৎই দেখি

যে আমরা যা কিছু আছি, বা হতে পারি

তার সবটাই ভালোবাসার দাম।

তবু একমাত্র ভালোবাসাই

আমাদের মুক্ত করে।

 


তবু আমি উঠি      (Still I Rise)


তুমি ইতিহাসে লিখতে পারো

তোমার তেতো বিকৃত মিথ্যা দিয়ে,

তুমি আমাকে ধুলোতে পাঁড়াতে পারো

তবু, ধুলোর মতোই, আমি আবার উঠব।

 

আমার দুর্বিনীত ভাব তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলে?

তুমি এত দুর্ভারনত কেন?

কারণ আমি এমনভাবে হাঁটি যেন আমার বসার ঘরে

তেলের খনি পাম্প করছে।

 

ঠিক চাঁদ আর সূর্যের মতো,

জোয়ারের নিশ্চয়তা নিয়ে,

ঠিক লাফিয়ে ঊঁচুতে ওঠা আশার মতো,

আমি অনিবার্য উঠি।

 

তুমি কি চেয়েছিলে আমাকে ভেঙে যেতে দেখতে?

মাথা নিচু, নত দৃষ্টি?

চোখের জলের মতো নেমে যাওয়া কাঁধ,

আমার বুকভাঙা কান্নায় দুর্বল?

 

আমার ঔদ্ধত্য তোমাকে আঘাত করে?

তুমি খুব একটা বিচলিত হোয়ো না

যদি আমি এমনভাবে হাসি যেন আমার

পিছনবাগানে সোনার খনি খোঁড়া হচ্ছে।

তোমার কথা দিয়ে তুমি আমাকে গুলিবিদ্ধ করতে পারো

তোমার চোখ দিয়ে আমাকে কেটে ফেলতে পারো

তোমার পূর্ণ ঘৃণা দিয়ে তুমি আমাকে খুন করতে পারো

কিন্তু তবুও, হাওয়ার মতো, আমি উঠবই।

 

আমার যৌনতা তোমাকে বিচলিত করে কী?

তোমার কাছে কী এ এক বিস্ময়

যে আমি এমনভাবে নাচি যেন হীরে লুকোনো আছে

আমার উরুসন্ধিমূলে

 

ইতিহাসের লজ্জার কুঁড়েঘর থেকে

আমি উঠি

সেই অতীত থেকে যা ব্যথায় প্রোথিত

আমি উঠি

আমি এক কৃষ্ণ মহাসাগর, উচ্ছ্রিত আর পরিব্যাপ্ত,

বিস্ফারিত আর স্ফীত, আমি জোয়ার আনি।

 

আতঙ্ক এবং ভয়ের রাত্রি পিছনে ফেলে

আমি উঠি

অপূর্ব স্বচ্ছ এক প্রত্যুষে

আমি উঠি

আমার পূর্বপুরুষ যে উপহার দিয়েছে তাই এনে

আমি ক্রীতদাসের স্বপ্ন এবং আশা।

আমি উঠি

আমি উঠি

আমি উঠি



[মায়া এঞ্জেল্যু   (১৯২৮-২০১৪) 

 

মার্গেরিট অ্যানি জনসন ১৯২৮ সালে সেন্ট লুই মিসৌরিতে জন্মগ্রহণ করেন। একবছরের বড় দাদা বেইলি তাঁকে মায়া বলে ডাকতেন, আর সেই নামেই কবি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। বেইলির চার আর মায়ার তিনবছর বয়সে তাঁদের বাবা মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হলে এই দুটি শিশুকে ট্রেনে চড়িয়ে আরকানস-র স্ট্যাম্প শহরে তাদের ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই মায়ার বেড়ে ওঠা। ঠাকুমার একটা দোকান বেশ ভালো চলত, তাই শিশুদের সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মতো দারিদ্র্যের শিকার হতে হয়নি। কিন্তু মায়ার সাতবছর বয়সে দুই ভাইবোনকে আবার মায়ের কাছে পাঠানো হলে সেখানে মায়াকে তাঁর মায়ের বয়ফ্রেন্ড ধর্ষণ করেন। এই কাহিনি মায়া বড় হয় ’’আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংসগ্রন্থে বিবৃত করেছেন।  

 

কৃষ্ণাঙ্গ কবিদের মধ্যে মায়া এঞ্জেল্যু নিঃসন্দেহে এক বিশেষ্ট ব্যক্তিত্ব। কৃষ্ণজাতির নিপীড়নের ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ সব আফ্রিকান-আমেরিকান কবিই কমবেশি জাতিগত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবং মায়া এঞ্জেল্যুও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি মার্টিন লুথার কিং-এর পুত্র এবং ম্যালকম এক্স-এর সঙ্গে কাজ করেন। কিন্তু মায়ার বিশেষত্ব এই যে গায়ক, অভিনেতা, নাচিয়ে, সুরকার এবং হলিউডের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পরিচালক হিসাবে বিনোদন জগতে তাঁর এক বিশেষ প্রতিষ্ঠা ছিল। রুটসসিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, এবং তাঁর বই আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংসবইটি থেকে একটি টেলিভিশন সিনেমা হলে তিনি সেটির রূপান্তরণে বিশিষ্ট ভূমিয়া নিয়েছিলেন।

 

 বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মায়া পড়াশুনার জগতেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আমেরিকার ওয়েক ফরেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমেরিকান স্টাডিজের অধ্যাপকের পদ লাভ করেন। কিন্তু এত কিছুর পরেও তাঁর কবিখ্যাতি তাঁকে বিশ্বের সাহিত্যজগতের কাছে অনন্য করে তুলেছে। মৃত্যুর আগে পঞ্চাশটি ডিগ্রী পেয়েছিলেন তিনি, আর ২০১০ সালে বারাক ওবামা তাঁকে উচ্চতম আমেরিকান সম্মান হিসেবে স্বাধীনতা পদক বা দ্য মেডাল অফ ফ্রীডম প্রদান করেন।

 

বাস কনডাক্টর, নাইটক্লাবের নাচিয়ে, খাবার দোকানের রাঁধুনী ইত্যাদি নানা ধরণের কাজ করেন মায়া, এবং তাঁর অভিজ্ঞতার জগৎ অত্যন্ত বিস্তৃত। ছটি আত্মজীবনী তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে এনে দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর কবিতার আলোচনায় কাব্যগুণের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর বিষয়বস্তু। নারীর এবং মানবজাতির অন্তরের শক্তি তাঁর কবিতার একটি বিশেষ বিষয়। এছাড়া তাঁর কবিতায় পরতে পরতে খুলে যায় প্রেমের বিভিন্ন স্তরে মানবমনের বিভিন্ন অনুভূতি্র পর্যায়গুলি। আবার এমন কিছু কবিতা আছে যাতে আফ্রিকান-আমেরিকানদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পর্যন্ত সব অধ্যায়গুলি পর্যায়ক্রমে উঠে আসে। তাঁর আত্মজীবনীর এক খন্ড পুর্বোক্ত ‘আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস’ (I Know why the Caged Bird Sings)-এ তাঁর ছোটবেলায়  জাতিবিদ্বেষের অত্যন্ত তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

মায়া এঞ্জেল্যুর জীবনে এক বিশেষ ঘটনা বিল ক্লিন্টনের আমন্ত্রণে তাঁর প্রেসিডেন্ট হবার অনুষ্ঠানের জন্য কবিতা লেখা। কবিতাটির নাম ছিল অন দ্য পালস অফ মর্নিং। এই কবিতায় তিনি এখানে তিনি শান্তি, জাতিগত ও ধর্মীয় সমন্বয়, আমেরিকাবাসী বিভিন্ন জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ এবং আর্থিক অবস্থার মানুষের জন্য সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।

 

অভিনেতা ও গায়ক হিসাবে সফল হবার ফলে এঞ্জেল্যুর বিশেষ ক্ষমতা ছিল যে তিনি অসামান্য আবৃত্তি করতে পারতেন, আর তাই বহু মানুষের ভিড়কে সম্মোহিত করে রাখতেন তাঁর স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিতে। সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে তাঁর কবিতায় আমরা আফ্রিকান-আমেরিকান পুরোনো কবিতার যে মৌখিক ধারা, যেমন ক্রীতদাসদের গান এবং কর্মসঙ্গীতের ধারা, তার সঙ্গে বিশেষ মিল দেখতে পাই।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন