শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২

সম্পূর্ণ সূচি ১ (বর্ষ ২ ।। সংখ্যা ১৮) [এপ্রিল সংখ্যা]





 

সম্পূর্ণ সূচি ২ (বর্ষ ২ ।। সংখ্যা ১৮) [এপ্রিল সংখ্যা]

 


সম্পাদকের নিবেদন


 

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

আল মাহমুদের কবিতা : ‘পরে নাও হরিৎ পোশাক

‘Ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment…takes an earth-centred approach to literary studies’.  (The Ecocriticism Reader, 1996)

 

তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার

কুরুলিয়ার পুরানো কই ভাজা;

কাউয়ার মতো মুনসি বাড়ির দাওয়ায়

দেখব বসে তোমার ঘষা মাজা

 

বলবে নাকি এসেছে কোন গাঁওয়ার?

 

ভাঙলে পিঠে কালো চুলের ঢেউ

আমার মতো বোঝেনি আর কেউ।

তবু যে হাত নাড়িয়ে দিলে হাওয়ায়

শহরে পথ দেখিয়ে দিলে যাওয়ার।   (তোমার হাতে)

 

খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনে শুনে স্মৃতিধার্য হয়ে গিয়েছিল উপরের শ্রবণসুভগ চিত্রময় পঙ্‌ক্তিমালা একটু বড়ো হয়ে দেখেছিলাম সবুজ মলাটের একটা বইয়ে আছে কবিতা আর কবির নাম আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯)  তারপর  বিচ্ছিন্নভাবে  পড়েছি তাঁর কবিতা, অনেকবার। দেখেছি তাঁর কবিতায় নষ্ট্যালজিয়া, আঞ্চলিকতা আর প্রকৃতির অবয়বে ধরা পড়েছে প্রেমের রক্তিম ছায়া। যে-প্রেম সংরাগদীপ্ত এবং দেহকে ছুঁয়েও দেহাতীত, সেই প্রেমের কবিতাই যেন আজীবন লিখতে চেয়েছেন আল মাহমুদ।  তাঁর কবিতায় একটা পর্বে এসে ইসলাম ধর্মের অভিঘাত এবং ধর্মপ্রীতি তীব্র হয়ে উঠলেও আল মাহমুদের কবিতার মূল সুর বেঁধে দেন রবীন্দ্রনাথ, সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের কবি লেখেন : ‘পুনর্জন্ম নেই আর। অথচ পেকে উঠেছে বাংলা ভাষা / আরও একজন রবীন্দ্রনাথের জন্য। এই ঢাকায়।যদিও রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করা সহ্য করার মত আমাদের স্বদেশ-স্বকাল আজ প্রস্তুত নয় তবু এই বাঙালি কবির মননে রবীন্দ্রনাথ ধরা দেন বৃক্ষের প্রতীকে। যে-বৃক্ষের অন্তরে আছে সহনশীলতার দীক্ষা, যার শরীরে মরুবিজয়ের কেতন। আল মাহমুদ তাঁর কবিতার সবুজে জাগিয়ে দেন সেই প্রবল প্রাণের স্পর্শের প্রজ্জ্বলন। তাঁর কলমে প্রেম প্রকৃতি একাকার হয়ে বলে ওঠে :

আমি ভালোবাসি নদী, তাই হাসতে হাসতে সেও

হয়ে যেত নদী।

নিসর্গের নীতি তাকে বোঝাতে গেলেই,

আহা তুমি গাছ হও যদি

আমার আদেশ শুনে অমনি সে

এই দেখো, বলে মেলে দিত তার ডালপালা।  (আমার অনুপস্থিতি)


২।।

 

নেচার পোয়েট্রি আর ইকোপোয়েট্রি এই দুয়ের স্পষ্ট বিভাজন করা অনেক সময়েই সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে প্রকৃতি তথা নিসর্গনিবিড় কবিতা মাত্রই ইকোপোয়েট্রি নয়। গ্রিক ঐকোস্‌ শব্দের অর্থ বাড়িসকলের বাসা রক্ষা করার ভাবনা যে কবিতায় ফুটে ওঠে তাকে এককথায় ইকোপোয়েট্রি বলা চলে। যদিও -প্রসঙ্গে বিখ্যাত ‘পোয়েট্রি’ (জানুয়ারি২০১৬পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করা প্রয়োজনসেখানে বলা হয়েছে :

‘Ecopoetry is nature poetry that has designs on us, that imagines changing the ways we think, feel about, and live and act in the world.’ (Why Ecopoetry? / John Shoptaw/ pg.408

সাহিত্য পরিবেশের নিবিড় সংযোগ এখানে আমাদের যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই বলতে চায়এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে ইহার মাধুরী বাড়াও হে জীবনানন্দ নষ্ট পৃথিবীর বদলে আলো পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাঁর বনলতা সেন আসলে সবুজ ঘাসের দেশ - যার পাখির নীড়ের মতো চোখে রূপসী বাংলার ছায়া। প্রেমেন্দ্র মিত্রেরহরিণ চিতা চিলআসলে প্রকৃতি আধিপত্যকামী মানুষের দ্বান্দ্বিক ছবি, অমিয় চক্রবর্তীরগাছধ্যানী, সুকান্ত লিখেছেন চারাগাছের প্রতীকে নবীন প্রজন্মের কথা, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন গাছ না কাটার কথা। পঞ্চাশের অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তেরআয়ুকর’, কবিতা সিংহেরশাপকিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় বারংবার গাছের প্রতিমা আমরা পেয়েছি।  এঁদেরই পাশে আল মাহমুদের কবিতায় তাই প্রকৃতির বর্ণনা, পাখি-নদী-পাহাড়-সবুজের সমারোহ আর বৃক্ষের প্রতীকে নিজস্ব মাত্রা নিয়ে ধরা দেয় আমাদের চোখে। বিশেষভাবে তাঁররসায়নের রান্নাকবিতাটি  ইকোপোয়েম হিসেবে অসামান্য :

গ্লোবের গায়ে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না

বিশ্বগোলক ফুঁপিয়ে ওঠে, আর পারি না, আর আর না।

মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে

আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে।

ক্লোরোফিলের সবুজভরা ছিল আমার গাত্র

সাগরভরা ছিল আমার লবণজলের পাত্র।

সব বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষ ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধ

কলের বিষে তলিয়ে গেছে গোলাপফুলের গন্ধ।

শস্য ছিল, শ্যামল ছিল, ছিল সুখের পার্বণ

শান্তিটাকে পুড়িয়ে মানুষ করল কালো কার্বণ।

পক্ষী কাঁদে পুষ্প কাঁদে, রসায়নের রান্না

বন্ধ করো, বন্ধ করো, আর পারি না, আর না 

আপাতদৃষ্টিতে ছড়ার ছন্দে লেখা -কবিতা শিশুপাঠ্য মনে হতেই পারেকিন্তু পরিবেশচেতনার যে প্রবল উদ্ভাস -কবিতায় তা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না। শ্রীমতী রাচেল কারসন তাঁর ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’(১৯৬২গ্রন্থে রাসায়নিক সার ব্যবহারের কুফল নিয়ে যে সতর্কবাতা আমাদের দিয়েছিলেনতার অভিঘাতে আমরা আজ পরিবেশ-সচেতন। ইদানীং পরিবেশদূষণের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে সব ক্ষেত্রেই ‘ইকো-ফ্রেণ্ডলি’ কনসেপ্ট জন্ম নিয়েছে। পরিবেশবান্ধব রসায়ন বা গ্রিন কেমিস্ট্রির জন্ম হয়েছেযা এমন এক গবেষণা-দর্শন যার উদ্দেশ্য এমন রাসায়নিক পদ্ধতির উদ্ভাবন  অবলম্বন করা যাতে শিল্পজাত বর্জ্যের পরিমাণ হ্রাস পায়ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার  শক্তির অপচয় কমে। এর লক্ষ্য মানবদেহের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান বর্জিত পণ্য  পদ্ধতি আবিষ্কার করা। আবার ‘ডীপ ইকোলজি’ বলতে চায় পরিবেশ-কেন্দ্রিক দর্শনের কথা। যেখানে পরিবেশ-সচেতনতা বা পরিবেশরক্ষার বাহ্যিক দায়িত্বের সীমানা পার করে এই দর্শন চায় আমাদের নিহিত মূল্যবোধের জাগরণ  জীবনযাত্রার অনুপুঙ্খ পাঠ। এই দর্শনের লক্ষ্য : প্রকৃতি অমূল্য তা বোঝানোপ্রযুক্তি-নগরায়ণ  জড়বাদী সভ্যতা  শিল্পায়নের সংকট দেখানো এবং পরিবেশ-রক্ষার নিয়ম-নীতি সম্পর্কে মানুষকে নৈতিক ভাবে সচেতন করা। আল মাহমুদের ‘রসায়নের রান্না’ আমাদের সেই পরিবেশবোধের শিকড় ধরে নাড়া দেয়। সমাসোক্তি অলংকারে এখানে নির্যাতিতা পৃথিবীর কান্নাকে সজীব করে তুলেছেন কবি। আবার এরই বিপরীতে ধর্মীয় উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে কবি লেখেন ‘সবুজের আশ্রয়’ কবিতা :

অন্য তারায় আছে কি ভাই এমন মাটির টান?

কোথাও নেই ঋতুর বাহার দোয়েল পাখির গান।

শুক্র বলো, শনি বলো কিম্বা বৃহস্পতিবার

কোথাও নেই প্রাণের আরাম কিংবা বায়ুর গতি।

আমাদের সেই মহান প্রভু আল্লা দয়াময়

এই গ্রহকেই দিলেন দয়া সবুজের আশ্রয়।

আসলে কবি বোঝেন নিসর্গের গূঢ় ভাষা। প্লেনে যেতে যেতে মেঘের সঙ্গে কথা বলেন আর বৃক্ষের আওয়াজ, নদীর তরঙ্গের ভাষা, এমনকি সাপের ভাষাতে অর্থ খুঁজে পান। কিন্তু এই ভণ্ড রাজনীতির আবহে তাঁর হাহাকার আমাদের বিষণ্ণ করেমানুষের ভাষার মত দুর্বোধ্য পৃথিবীতে আর কিছু নেই’ (বিপরীত উচ্চারণ) তবু এক সবুজ বালক হয়ে তিনি পৃথিবীকে বাঁচাতে চান :

নিজেকে বাঁচাতে হলে পরে নাও হরিৎ পোশাক

সবুজ শাড়িটি পরো ম্যাচ করে, প্রজাপতিরা যেমন

জন্ম-জন্মান্তর ধরে হয়ে থাকে পাতার মতন।

প্রাণের ওপরে আজ লতাগুল্ম পত্রগুচ্ছ ধরে

তোমাকে বাঁচাতে হবে হতভম্ব সন্ততি তোমার।

 

নিসর্গের ঢাল ধরো বক্ষস্থলে

যেন হত্যাকারীরা এখন

ভাবে বৃক্ষরাজি বুঝি

বাতাসে দোলায় ফুল

অবিরাম পুষ্পের বাহার।  (ক্যামোফ্লাজ)


৩।।

 

যৌন কৃতজ্ঞতার নামই প্রেমএকথা ভাবতেই হৃদয় / কাঁচের মতো শব্দ করে ভেঙে যায়’ – বাংলাদেশের কবি কবিতায় যাঁরা যৌনতার স্বরকে সুতীব্র ভাবেন, তাঁদের এই পঙ্‌ক্তির দিকেও দৃষ্টিক্ষেপ করতে অনুরোধ জানাই। পরিণত বয়সে আল মাহমুদের লেখাঘৃণার পালঙ্কেকবিতায় আত্মজীবনের ছায়া পড়লেও একদা দেহময় প্রেমের উত্তরণ ঘটেছে দেখি। যে কবি একদা যৌবনে লিখেছিলেনতোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল / শোনিতে মেশাল কি মধুর সৌরভ। / তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি / দেবে কি গুল্মের উষ্ণ সানুদেশ?’  কিংবাতখন কবিতা লেখা হতে পারে একটি কেবল, / যেন রমণে কম্পিতা কোনো কুমারীর / নিম্ননাভিমূলতাঁকেই পরিণত বয়সে লিখতে দেখিচুম্বন কার ফুল হয়ে দোল খায়?’ তাই অন্য মানবীর মুখ তাঁর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে আজ :

দেখি অন্য মানবীর মুখ

আমাকে আহার দেয়

অন্ন দেয় স্তন্য দেয় ঢেলে দেয় বুকের উষ্ণতা

আমি এঁকেই প্রেম বলে ভাবি মাতৃহারা বালকের মতো।  (প্রেম)

কবিতাকে যিনিব্যক্তিগত শিল্পভাবেন সেই আল মাহমুদের জীবনে নানা সম্পর্কের আসঙ্গ লিপ্সায় নারীকে গ্রহণ করার কথা পাওয়া যায় তাঁর সাক্ষাৎকারেই। বিখ্যাত প্রেমের কাব্যসোনালি কাবিন’-  কাম প্রেমকে সমীকৃত করে একদা তিনি বলেছিলেনভালবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন প্রেমের জন্যঅভাবের ক্ষিপ্র তরবারিজয় করার অভীপ্সাও আল মাহমুদের কবিতার স্বরকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। তাইপৃথিবীকে নগ্ন দেখার মানে হল / তোমাকেই নিরাভরণ দেখাএই অনুভব ব্যক্তি বিশ্বকে এক বৃন্তে গেঁথে ফেলে। আসলে কবি সুন্দরের অন্বেষায় রত হন, যে সুন্দর একাধারে নারী প্রকৃতি :

জনক-জননী? নাকি কোনো সহোদরা বোনের হিংস্রতা

ওষ্ঠের দক্ষিণ পাশে সুন্দরের নখ বসিয়েছে?

অথবা পুরুষ সেই

যার জন্য অন্তত দুবার

পৃথিবীকে দিয়েছিলে মানুষের বংশ উপহার!  (সুন্দরের নখ)


৪।।

 

আল মাহমুদের কবিতায় মনীষী-বন্দনা এক বিশেষ স্থান করে নেয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, ইকবাল, গোর্কি প্রমুখ তাঁর কবিতায় এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ-কেন্দ্রিক কবিতায় গাছের প্রতীক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে বারংবার। কয়েকটি পঙ্‌ক্তি এইরকম :

) বুঝি না, রবীন্দ্রনাথ কী ভেবে যে বাংলাদেশে ফের

বৃক্ষ হয়ে জন্মাবার অসম্ভব বাসনা রাখতেন।

গাছ নেই নদী নেই অপুষ্পক সময় বইছে

পুনর্জন্ম নেই আর, জন্মের বিরুদ্ধে সবাই... (রবীন্দ্রনাথ)

) অনেকটা পরিত্যক্ত পাণ্ডুলিপির মতো। অনেক কাটাকুটির পর

নির্বাচিত গাছপালা। খুব নির্জন নয়। কিন্তু কেউ কি

বাস করে এখানে? না, করবে না কোনদিন।  (রবীন্দ্রনাথের বাড়ি)

) রক্ত, ক্লেদ, বোমা মৃত্যুর অরণ্যের মধ্যে

রবীন্দ্রনাথ যেমন চেয়েছিলেন তেমন বৃক্ষ হয়ে জন্মান আবার।  (রবীন্দ্রনাথ)

আসলে এই বৃক্ষ প্রতীক উপনিষদেই (বৃক্ষ ইব স্তব্ধ দিবি তিষ্ঠ্যতেক - / স্তেনেদং পূর্ণ পুরুষং সর্বম্‌’- শ্বেতাশ্বতর) আমরা পাই। আল মাহমুদ হিন্দু শাস্ত্র পড়েছেন, তাই ধর্মের দিক থেকে মুসলমান হয়েও নিজেকে ব্রাহ্মণের অধিক ব্রাহ্মণ ভাবেন। তাঁর উত্তরকালের কবিতা সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট, অতিরিক্ত মুসলিম ভাবাপন্ন এই অভিযোগ আংশিক ভাবে মেনে নিয়েও আমরা দেখি তাঁর কবিতায় নিসর্গছবির ভেতর পাখি, প্রজাপতি আর নদীকে ছাপিয়ে বৃক্ষচ্ছবি জেগে ওঠে ধ্যানের মতন বারংবার। তাঁর স্মৃতির কন্দরে যেচিরহরিৎ দেবদারু গাছটা কোথাও আছে’ – এই গাছ তাঁর নষ্ট্যালজিয়ার দোসর, প্রকৃতি পরিবেশচেতনার চিহ্নবাহী। রবীন্দ্রনাথ তাঁরঅরণ্যদেবতা সেই কবে লিখেছিলেনলুব্ধ মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতিকে ডেকে এনেছে; বায়ুকে নির্মল করবার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে। বিধাতার যা-কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই নষ্ট করেছে তাঁর যৌবন থেকে বার্ধক্যে উজ্জ্বল এই সবুজের ইমেজ কিংবা প্রজনন তথা ফার্টিলিটি কাল্ট :

) ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে

কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে

ভাবলাম, মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষানি আমার। (প্রকৃতি)

) চাষির বিষয় বৃষ্টি, ফলবান মাটি আর

কালচে সবুজে ভরা খানাখন্দহীন

সীমাহীন মাঠ।

চাষির বিষয় নারী

উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা

পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।                (কবির বিষয়)

প্রাজ্ঞ সমালোচক দেখেন, তাঁর নিসর্গগামী কবিতা প্রকৃতিময় প্রতিলিপি হয়ে যায়, সময়ে-দুঃসময়েপ্রকৃতির সংস্পর্শে সঞ্জীবিত হন তিনি। সঞ্জীবিত করেন অন্যদের। সেই সবুজায়নে তাঁর প্রত্যয়ী উচ্চারণ –  ‘আমার নিঃশ্বাসে সবুজ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের প্রান্তর / পৃথিবীর শস্যক্ষেত্র (প্রহরান্তের পাশফেরা) কারণ, কবি জানেনআমি পৃথিবীতে এসেছি সৌন্দর্যের  / দেনা শোধ করব বলে   (দ্র. তরুণ মুখোপাধ্যায়, কবি আল মাহমুদ, বাংলাদেশের কবিতা : ভাবনার জলছবি, ২০১৫) 


 ৫।।

 

কবিতা প্রতিমাসে’ (জুলাই২০০৫পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে কবি নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘দেখুন আমাকে তো এটা মনে রাখতেই হবে যে আমি কবি। কবিতা একা আমার কথা না। সকলের কথাই বলবে। সেখানে পরিবেশ-পরিস্থিতি প্রভাব তো আসবেই এই সকলের কথা বলতে গিয়েই কবিতায় সমাজ-রাজনীতি-ধর্ম-প্রেম  প্রকৃতি সব এসে মেশে আশ্চর্য রসায়নে। কবিতা তাঁর কাছে কেমন? ‘কবিতা চরের পাখিকুড়ানো হাঁসের ডিমগন্ধভরা ঘাস / ম্লান মুখ বৌটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর / গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর / কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েষা ডাক্তার মার্ক্সীয় চেতনায় দীক্ষিত হয়েও তিনি রোম্যান্টিক কবিতাঁর যাপন করা জীবনই পরিশ্রুত হয়ে কবিতার জন্ম দেয়। সমকালের দুর্নীতি আর অমানুষদের মাঝখানে বসে রক্তবর্ণ হৃদয়েও স্মৃতিকাতর ‘মায়াবৃক্ষ’-এর কবি রচনা করেন ‘পান্থপাদপ’ – যে গাছ মরুভূমিতে জলের আস্বাদ দেয় :

মগজ বারুদ ভরা। আত্মা যাচে তোমাতে আরাম

তবু তো হাতড়ে ফিরিযদি পাই পল্লবের ছোঁয়া,

তুমি তো গন্তব্য নওমাত্র পান্থপাদপের নাম

বৃক্ষতলে পড়ে থাক অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট মহুয়া।

 

আমার চলার পথে যত গাছ দিয়েছিল ছায়া

তাদের নামের স্মৃতি ভুলে গিয়ে এখন কাঙাল

শুধু মনে পড়ে এক আমলকী ধরেছিল কায়া

হরিণের খাদ্য হয়ে তারই রক্তে হল লালে লাল।  

অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে কবি আত্মার আরাম খোঁজেন গাছের ইমেজেই। নির্ঝরসমুদ্রপাখি  বৃক্ষের কাছে তিনি খুঁজে পান সত্যকে। আজীবন এই ‘earth centred approach’ তাঁর একাধিক কবিতাকে ইকোপোয়েট্রি করে তুলেছেতাতে সন্দেহ নেই।।   

 

 

[ঋণস্বীকার : আল মাহুমুদেরশ্রেষ্ঠ কবিতা’, প্রতিভাস, ২০০৭ এবংকবিতা প্রতিমাসেআল মাহমুদ বাংলাদেশের কবিতাএই দুটি বিশেষ সংখ্যা।]