অপরাহ্ণ সুসমিতো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অপরাহ্ণ সুসমিতো লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

অপরাহ্ণ সুসমিতো-র কবিতা

বাংলাদেশ

খোলা আকাশে রঙ মচমচে ডুমুর হয়ে যে ঘুড়ি উড়ছে সে আমাদের

টকটক ঘোড়ার পায়ের শব্দে ভেসে আসে মঙ্গল যাত্রা, মুখোশ ছবি

বটের অন্য পিঠে দাপুটে রোদের ছায়া

আমাদের জমে ওঠা হালখাতা, রেশম সরু চাল, চৈত্র চাল ধোয়া নারকেল পাতা

ঢোল বাজছে,বাজুক আনন্দ শংখ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ।


আমাদের ঢেকি ছাটা চাল, মায়ের নড়ে উঠা মাথার ঘোমটা, এইসব নোলক দীর্ঘ বৈশাখ

চুলা থেকে আগুনে কয়লা,ধনে পাতা মাছের ঝোল
কিছু হোক, কিছু স্বপ্ন শালপ্রাংশু হোক,
কিশোরী উবু হয়ে স্বরবর্ণ শিখুক

 

আমাদের হাতের পাতায় লিখে রাখুক নতুন দিনের রোগশোকহীন খলবল কৈ ,নদী ঢেউ

হেসে দাও, হেসে খিলখিল হোক মানচিত্র ভরা সব নদী-মা
রাস্তার ধারে দাঁড়ানো ফলবান সুখী কৃষক

ডাক দিলাম আমরা, প্রতিধ্বনি করে।

মায়ের মঙ্গল ধ্বনি, হাতের চুড়ি, ছোটভাইয়ের দেনাবিহীন শান ধানী জমি

বোন জামাই দাসখত লিখে দিচ্ছে বৈশাখের অপার রোদে, সুখী পরিবারের ফ্রেম

সবগুলো অমল দিনরাত্রি আমরা বুনছি, বুনেছি, আহ বুনবোই আজ।


 

সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২

অপরাহ্ণ সুসমিতো-র ঝুরোগল্প

রোদের বাদলে আমরা

(আহমেদ রেজা, শ্রদ্ধাস্পদেষু)

 

রোদ বাদল সবসময়ই আপনি আড়ংয়ের স্ট্রাইপ শার্ট। ফুল স্লিভ পরতেন শার্ট গুঁজে। ঢিলে ঢালা প্যান্ট। কাঁধে ঝোলানো বাদামি রঙের ব্যাগ। ব্যাগে কি এত ছাই ভস্ম জিনিষ পত্তর? ব্যথা করে না বুঝি ভারে?

 

ক্যাম্পাসে এত রোদ। রোদের একটা বিদ্যাসাগরীয় দাপট আছে। এরকম খরতাপ দেখলেই আমার মনে হতো রোদ বুঝি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ক্যাম্পাসের দামোদর নদী পার হচ্ছে মায়ের ডাকে। আপনাকে রোদের সৈনিক মনে হতো।

রোদ চশমা পরেন না কেন স্যার?

 

টিচার্স বাস দেরি করলে আপনি ছাতিম তলায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ব্যাগ থেকে একটা ভারি বই বের করে পড়তেন। সারাক্ষণ পড়তে হয় কেন? ভাগ্যিস তখন মোবাইল ফোন ছিল না, না হলে আপনি ফোনটা বের করে বাটন টেপাটিপি করতেন। এই মোবাইল টেপাটিপি করে আমার এক বন্ধুর এখন হাতে কার্পাল টানেল সিনড্রোম।

 

সেদিন ফোনে বললেন: প্যানডেমিকের আগে একদিন মনজু সস্ত্রীক ক্যাম্পাসে এসেছিল। সারাদিন ডিপার্টমেন্টে ছিল। মনজু বেশ মুটিয়েছে। যে মনজু একসময় ডিম পরোটা খেতে খুব পছন্দ করত, ওকে এত সাধাসাধি করেও ডিম-পরোটা খাওয়ানো গেল না।

 

বাংলাদেশে আমরা কখনো ফোনে কথা বলিনি। সেদিন আশ্চর্য এত এত বছর পর আমরা প্রথম ফোনে কথা বললাম। সেই উত্তাপ, সেই নীরদ কণ্ঠ। আপনি নাক টানছিলেন। বললাম; স্যার নাক টানছেন কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?

আমাদের শহরে তখন রাত নামছে সেকেন্ড কাপ কফি শপের পাশে কফির ঘ্রাণে, বাংলাদেশে তখন প্রভাত, শ্রাবণের নিমন্ত্রণ। কী অবাক কাণ্ড আমরা একসাথে সেই রিহার্সেলের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। অভিব্যক্তি আবৃত্তি পর্ষদ’ এর  সেই সোনালি কাঁকন পরা দিন।

আপনি আমি একসাথে তখনই রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যা প্রভাত স্মরণ করলাম। বললেন যে বাংলাদেশে তখনও তেমন কেউ সন্ধ্যা প্রভাত আবৃত্তি করেনি।

 

আপনার মায়ের কথা জানতে চাইলাম। জানলাম তিনি আর নেই। আমি মুষড়ে উঠি। পৃথিবীর কোথাও মা হারানোর কথা শুনলে আমার বুক ভারী হয়ে ওঠে আর্দ্রতায়। সেই উত্তরার বাসা, বিকেল বেলা আপনার নরম মায়ের বাংলাদেশের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, আপনাদের গৃহকর্মীর সাথে আপনার প্রমিত বাংলায় কথা বলা, বিকালের চা। সেই বিকেলে উত্তরায় নেমে এসেছিল বিষণ্ণ সন্ধ্যা। পড়ন্ত সাঁঝে আপনার মুখ ছিল জাহাঙ্গীরনগরীয় সুন্দর।

 

আমরা বিকেলে হাঁটি পকেটে হাত ঢুকিয়ে।

 

মন্ট্রিয়লে তখন কুসুম রাত। আমার সঙ্গীদ্বয় তাড়া দিচ্ছিল কমলার রস খেতে যাবে দূর পাল্লায়। আমার ফোন ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না স্যার। আপনি মনে করিয়ে দিলেন যে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল জাহাঙ্গীর নগরের বিলে শীতকালীন পাখি দেখার আসরে। আপনি মৃদু স্বরে বললেন,

: আমরা পাখি দেখছিলাম, একটা একটা পাখি ক্লান্ত ডানায় রোদ মেখে নামছিল আবার চলে যাবে বলে। প্রস্থানের জন্যই এই আগমন।

 

গাঢ় অন্ধকার জামরঙা কামিজ পরে তালেবানি দাপটে তখন আমাদের শহর।

 

সেকেন্ড কাপ কফি শপের হা হা হো হো ভিড়েও কেউ জানল না যে আপনি বা আমি বা আমরা সবাই একা।

 

                               

 

শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

অপরাহ্ণ সুসমিতো-র ঝুরোগল্প

শব্দে মৃত্যু

ঠাস করে শব্দ হলো। শব্দের আওয়াজ কি ঠাস?

তার কি গুলি লেগেছে? কোথাও তো ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না।

সেদিন একজনের ফেসবুক পোস্টে পড়ল যে তার স্কুলগামী মেয়ে একদিন ঘোড়ার ফার্মে গিয়ে ঘোড়াকে হত্যা করবার পদ্ধতি দেখে ভেজিটারিয়ান হয়ে গেছে। ফার্মে এক লোক ঠোঁট গোল করে একধরনের শিস দেয়। টগবগ ঘোড়াটা শিসের নিপুণ ধ্বনি শুনে লোকটার দিকে তাকায়। তখনই লোকটা ঘোড়ার কপাল লক্ষ্য করে গুলি করে।

 এই গল্প শুনে সে শিউরে উঠেছিল। পরে অবশ্য তার বন্ধু নন্দন বলেছে এতেই নাকি ঘোড়াটা সবচেয়ে কম যন্ত্রণা পায়। মাথায় গুলি লাগার সাথে সাথে ঘোড়াটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা যায়।

ঠাস শব্দ হবার সাথে মনে হলো তবে কি তার মাথায় গুলি লেগেছে? কোনো যন্ত্রণা নেই বলে সে কি ক্রমশ: মরে যাচ্ছে? মার সাথে শেষবার একটু কথা বলবে? স্টোর রুমটায় যাবার প্যাসেজে তার একটা টিয়া পাখি আছে সেটাকে খাবার দেয়া দরকার। নিজ হাতে ওকে খাওয়ায় সে। মরে গেলে পাখিটাকে খাওয়াবে কে? নাকি পাখিটাকে জানালা গলে মুক্ত করে দেবে?

বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। আরাম লাগছে এই চেনা শক্ত বিছানাটা। মাথার পেছনে জানালাটা খোলা, বুঝতে পারছে। পর্দা উড়িয়ে অল্প বাতাস লাগছে, বাতাসটা শান্তিপুর। শান্তি শান্তি লাগছে। গতকাল বইমেলা থেকে বেশ কিছু বই কিনেছিল। কোথায় রেখেছে! বালিশের এক পাশে থাকার কথা নতুন ঘ্রাণের বইগুলোর। মুশতাক আহমেদের ঝিনুক নীরবে সহো বইটার পাতা ওল্টানোই হলো না।

এখন কি সন্ধ্যা? মাথায় কি সন্ধ্যার বাতাসের দোলা? চিন্তাটাকে ঘুড়ির মতো গোত্তা খাওয়াল। নিজেই চিন্তাটার সুতো ছেড়ে দিচ্ছে। মুহূর্তে চিন্তারাম দারোগা বাবু পেটের কাছে বুট ঘষে সটান থামল। স্যালুট করে জানাল খিদে উঁকি দিচ্ছে। মারা যাবার আগে খিদে পায় কারো?

রান্না ঘরে কি খাবার আছে কোনো মুখরোচক? অন্যসময় তার রান্নার খুঁটিনাটি মনে থাকে। রান্নাটা তার কাছে সঙ্গমের মতো মনোযোগ দাবী করে। এক লেখক বলেছেন রান্না সঙ্গমে পূর্ণ মন দিতে হয়। লেবু পাতা মিশিয়ে ছোট মাছ রান্না করার ধোঁয়া ওড়ানো দৃশ্য, টাটকা রান্নার গরম ঘ্রাণ তিরতির করে খেলে যায়।

চারপাশে কোনো ঘড়ি নেই। সে বুঝতে পারছে না এখন সকাল নাকি সন্ধ্যা। তার স্ত্রী তাকে হাত ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। সময় তাকে হাতে বেঁধে রাখবে সে মানতে পারেনি। ঘড়িটা ফেলে দিয়েছে। তার কষ্ট হচ্ছে না কেন কোথাও? কষ্ট হচ্ছে না তারপরও তার মাথায় তাহলে মৃত্যু কথা উড়ে এলো কেন? স্ত্রীকে ডাকবে?

আলো আঁধারি ঘরের মাঝে সে একটা খসখস শব্দ শুনতে পেল।

চোখের পাতায় যে আবেশ লেগেছিল সেটা কেটে যাচ্ছে। সেই যে ঠাস করে শব্দের উৎপত্তি স্থল সেখানে আবছায়া দেখা যাচ্ছে একজন হালকা ফ্রক-মূর্তি। বালিকা।

এবার সে পরিস্কার অনুভব করল তার মেয়েটা দাঁড়িয়ে, ওর হাতে খেলনা পিস্তল, বাবার দিকেই তাক করা..