তথাগত চট্টোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
তথাগত চট্টোপাধ্যায় লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

তথাগত চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প

আকস্মিক

দুপুর একটা চল্লিশের ঘণ্টা পড়তেই ক্লাসরুম জুড়ে হইহই। টিফিনটাইম। একটু পরেই স্কুলমাঠে শুরু হয়ে যাবে 

ছোটাছুটি। দুটো দশের ঘন্টা পড়ার মুহূর্ত অবধি সবাই মেতে থাকবে খেলায়, টিফিন খাওয়ায়। অথচ বাবলু 

নিঃস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসের এককোণে। অন্যান্য দিন সে-ও এইসময় ছুটে বেরিয়ে যায় সহপাঠীদের সঙ্গে 

– স্কুলের মাঠে দৌড়োদৌড়ি কিংবা নিছক গল্পগুজব করে মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে। ফোর্থ পিরিয়ডে 

হেডমাস্টারমশাই প্রবোধবাবু ক্লাসে এসেছিলেন। বলেছেন – আগামী আঠাশ তারিখ স্কুলের পুরষ্কারপ্রদান 

অনুষ্ঠানে সকলকে উপস্থিত থাকতে হবে। প্রতিটি ক্লাসের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারি এবং বার্ষিক 

ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জয়ী ছাত্রদের পুরস্কৃত করা হবে।

এছাড়া আছে আরও একটি বিশেষ পুরষ্কার। গত দুবছর ধরে এই পুরস্কারটি দেওয়া শুরু হয়েছে 

প্রবোধবাবুর উদ্যোগে। যে ছাত্র স্কুলে সারা বছর উপস্থিত থাকবে সে – ও পাবে একটি পুরষ্কার।

            বাবলু স্কুল অন্ত প্রাণ। একটা দিনও সে কামাই করার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু দুবছর আগে প্রবল 

জ্বরে পড়ায় বেশ কিছুদিন ছুটি নিতে বাধ্য হয়েছিল সে। হাতছাড়া হয়েছিল মেডেল। কিন্তু গত বছর শরীর একদম 

ঠিকঠাক থাকায় বাবলু একপ্রকার নিশ্চিত ছিল ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় না হতে পারলেও অন্তত সারা বছর 

স্কুলে উপস্থিত থাকার পুরষ্কার সে পাবেই পাবে। স্কুলের নাম খোদাই করা ঐ গোল, সোনালি রঙের মেডেলটা

বাবলুকে খুব আকর্ষণ করে।

            অক্টোবর মাস পর্যন্ত সবই ঠিকমতো চলেছিল। কিন্তু নভেম্বর মাসে বাবলুকে লম্বা ছুটি নিতেই হল।

            নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পিতৃহারা হল বাবলু। আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ভোররাতে ঘুমের 

মধ্যেই বাবার সেরিব্রাল অ্যাটাক।

            স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাতেও প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পায়নি বাবলু।

 

শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২

তথাগত চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প

 

অপ্রত্যাশিত

গল্পকার বারান্দায় রাখা চেয়ারে এসে বসলেন। ঘরের বাতি নিভিয়েছেন অনেকক্ষণ আগেই। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। বাড়ির সামনেই ল্যাম্পপোষ্টের আলো বেশ কয়েকদিন ধরেই জ্বলছে না।

            মধ্যবয়সী গল্পকার তাঁর নতুন গল্পের প্লটটি সংহত করতে চেষ্টা করছেন। এখন তিনি বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। তাঁর স্ত্রী একমাত্র শিশুপুত্রকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ঠিক এরকমই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন গল্পকার। সংসারের নানাবিধ চাপে লেখায় কিছুতেই মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। খুঁজছিলেন নির্জনতা। মনের মধ্যে অনবরত ছুটতে থাকা বাক্যসমূহ কেন্দ্রীভূত করে তিনি নিয়ে আসতে চান কলমের ডগায়।

            অনেক লেখা বাকি রয়ে গেছে গল্পকারের। কয়েকজন সম্পাদককে কথা দিয়ে রেখেছেন তিনি অমুক সময়ের মধ্যে লেখা অবশ্যই পৌঁছে যাবে পত্রিকার দপ্তরে। কিন্তু উদ্দিষ্ট গল্পগুলি কিছুতেই লিখে উঠতে পারছেন না গল্পকার। আসছে না সেই কাঙ্ক্ষিত একাগ্রতা।

            সেদিন স্ত্রীর সঙ্গে একচোট কথা কাটাকাটি হতেই গল্পকার আরও যেন হারিয়ে ফেললেন নিজের লেখকসত্ত্বা। বাধ্য হয়েই বলে ফেলেছিলেন, আঃ, আমায় একটু একা থাকতে দেবে? সংসারের যাতাকলে পিষতে পিষতে হারিয়ে ফেলছি আমাকে। যাও না, ছেলেকে নিয়ে নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে এলেই তো পার কটাদিন। আমি একটু শান্তিতে লিখি।

            স্ত্রী বলেছিলেন, পারবে তো? সবদিক সামলে?

-         পারব, পারব।

ঠিক এইসময়টা রোজই বারান্দায় চেয়ারে এসে বসেন গল্পকার। যে নির্জনতা তাঁর কলমকে আবার গতিময় করে তুলবে বলে ভেবেছিলেন তিনি, তা পেয়ে গেছেন দিন দুয়েক আগেই। শহরের দ্বিতল বাড়িতে তিনি এখন সম্পুর্ন একা।

            কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও লেখার সেই স্বাচ্ছন্দ্য আসছে না তাঁর। ভরিয়ে তুলতে পারছেন না পাতার পর পাতা। যে প্রার্থিত একাকীত্বে নিশ্চিত সাফল্য আসবে বলে ভেবেছিলেন তিনি, তা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। শুধু ঘুরেফিরে মনে আসছে শিশুপুত্রের মুখখানি এবং তার এলোমেলো আধো আধো অর্থহীন কথার অনুরণন। প্রতিদিনের সাংসারিক ব্যস্ততার দিনলিপির চিত্র কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে দিতে পারছেন না তিনি। প্রত্যাশিত নির্জনতায় গল্পকার যেন আরও একাকী আরও অসহায় বোধ করছেন।

মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

তথাগত চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প

বিদ্ধ

মালগাড়ী আসার খবর হওয়ায় রেলগেটে আটকে পড়েছিল অভিলাষ। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়েছিল সেই মালগাড়ী টাউনের জংশন স্টেশনের দিকে চলে যেতে।

    গেট খুলতেই অভিলাষ গাড়িঅটোবাসরিক্সার ফাঁকফোকর দিয়ে লাইনের ওপারে আসে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে হাসপাতালের মোড়ের সামনে পৌঁছতেই দ্যাখে একটা ছোটোখাটো জটলা।

    জটলার কারণ জানার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রবল আগ্রহ বোধ করে অভিলাষ। দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। আশেপাশে ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। গাড়ির আওয়াজ এবং আরও অনেক কিছুর সশব্দ উপস্থিতি ছাপিয়ে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে জটলার ভেতর থেকে। যেন কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অবিচ্ছিন্ন এবং নিরন্তর সেই আওয়াজ।

    অভিলাষ জটলার বলয়ে ঢুকে পড়ে দ্যাখে এক অল্পবয়সী ছেলেকতই বা বয়স হবেচৌদ্দ কি পনেরো। একজন ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছে অঝোরধারায়।  

    কিশোরটির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ভেতর থেকে উৎসারিত হচ্ছে গভীর শোকের অভিব্যাক্তি। অমূল্য কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার অসহ্য যন্ত্রণা।

    অভিলাষ সেই জটলার মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আর পাঁচজনের মত। পাশে দাঁড়ানো কেউ একজন বললআহা রেমাকে হারিয়ে ফেলল গো এই বয়সে।

    কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই চমকে ওঠে অভিলাষ। বুঝতে পারে হাসপাতালেই কিশোরটির মা চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। 

অজান্তেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অভিলাষের। কিশোরটির অবিচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে মাকে হারানোর গভীর দুঃখের ইঙ্গিত স্পষ্ট। ততক্ষণে তার মনেও এক পুরনো অনুভুতি মুহূর্তের জন্য হলেও স্পর্শ করে যায়।

জটলার বৃত্ত থেকে সরে আসে অভিলাষ। কাছেই তার আবাসন। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব নয়।

হাঁটতে হাঁটতে অভিলাষ ভাবে প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা। সেই বিচ্ছেদ যদি মৃত্যুর রূপ ধরে আছড়ে পড়ে জীবনেতাহলে তার তাৎক্ষণিক অভিঘাত বড় অসহনীয়।

প্রায় দুদশক আগে অভিলাষও তার মাকে হারিয়েছিল। এরকমই অপরিণত বয়সে। আজ হয়তো প্রতিদিনের ব্যস্ততায় সেই দুঃখ তেমনভাবে প্রকট হয়না কিন্তু এই হতভাগ্য কিশোরটির দিকে তাকিয়ে পুরনো স্মৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে তাকে।

সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান অতিক্রম করতে করতে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে যায় অভিলাষ। মাকে হারানোর সেই দিনের শোকদুঃসহ বেদনার প্রবল অভিঘাতে আবার বিদ্ধ হতে থাকে সেও। 

সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

তথাগত চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প


 বিনিময়

পবনকুমারের ঘোড়া তুফান ছুটছিল দুরন্ত গতিতে। দুপাশে পেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী ঝর্না, বনভূমি। কোথাও আবার সেই ঝর্না নদীতে গিয়ে মিশেছে। নদীর পাড় বরাবর যাবার সময় পবনকুমারের মনে হচ্ছিল সে বুঝি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে উড়ে চলেছেএমনই দ্রুততায় তুফান টগবগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আগামীকাল সকালের মধ্যেই পৌছে যেতে হবে তাকে। কুসুমের কাছে পবনকুমার অঙ্গীকারবদ্ধ। এই তো আর কয়েকঘন্টা মাত্র। তারপরই আসবে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই দিন। প্রিয়তমা কুসুমকে সে নিজের কাছে নিয়ে আসবে সারা জীবনের জন্য। তাই নিজের প্রাণাধিক প্রিয় তুফানকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে সে ছুটে চলেছে নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে। জমিদার প্রদীপনারায়ণের কাছে সংবাদ পৌঁছলে পবনকুমার জানে তার কি পরিণতি হবে। তাই সবার অলক্ষ্যে, অজান্তে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে কুসুমকে। তারপর মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে তাকে বরণ করে নেবে নিজের সহধর্মিণী রূপে। কিন্তু পথ যে আরও অনেকটাই। পবনকুমার আকাশের দিকে তাকাল। অন্ধকার দ্রুত ঘন হয়ে আসছে। সে কি পারবে সঠিক সময়ে তার অভীষ্ট জায়গায় পৌঁছোতে? একমাত্র ভরসা এই তুফান। পবনকুমার ভাবল, কুসুমও কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে করে তার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে? সেও কি মনে মনে সেই শুভক্ষণের প্রত্যাশায় কাতর?

 চাঁদের এমন আলো পবনকুমার বহুদিন দেখেনি। আকাশের এধার থেকে ওধার ছড়িয়ে আছে কত তারা। চুইয়ে পড়া জ্যোৎস্নার আলোয় সামনের পথ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সর্পিল সেই পথ কখনও এগিয়ে গেছে পাহাড়ি উপত্যকা ধরে, কখনও বা জঙ্গলের পাশ দিয়ে সমতল বরাবর। রাতেরও যে এক অনাবিল সৌন্দর্য আছে পবনকুমার আগে তা বুঝতে পারেনি। আজ সেই অভিজ্ঞতায় সে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তুফানের গতি রুদ্ধ হয়ে এল। যে ক্ষিপ্রতায় তুফান ছুটে চলেছিল, আচমকাই হ্রেস্বাধ্বনি ছড়িয়ে থেমে গেল সেই গতি। পবনকুমার গভীর বিস্ময়ে দেখল একদল লোক ইতিমধ্যেই ঘিরে ধরেছে তাকে। তারাও ঘোড়ায় সওয়ারি। জ্যোৎস্নার আলোয় তাদের হাতের অস্ত্র ঝিলিক মেরে যাচ্ছে মুহুর্মুহু।

     তুফান সহ পবনকুমার বন্দী হল তাদের হাতে। রাতের অন্ধকারে পবনকুমারকে অচেনা পথ ধরে নিয়ে আসা হল কোনও এক জঙ্গলের কাছে। এর মধ্যেই পবনকুমার জেনেছে সে কাদের হাতে পড়েছেএরা আর কেউ নয়, জমিদার প্রদীপনারায়ণের রক্ষীবাহিনী। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত পবনকুমার অথৈ জলে পড়ল। সে বলল, কেন বন্দী করলে আমায়? ছেড়ে দাও। ভোরের আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে শহরে। তোমরা জাননা কত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে আমি যাচ্ছি। আমাকে বিরত কোরোনা সেই কাজ থেকে। পবনকুমারের কথায় অট্টহাস্যে হেসে উঠল রক্ষীদল। একজন বলল, নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে শুনে রাখো একটি কথাজমিদার প্রদীপনারায়ণের স্পষ্ট নির্দেশ, বিনিময়ে তোমার সাদা ঘোড়াটি আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আর কিচ্ছু না। তাহলেই তোমার ছুটি।  

     পবনকুমার চমকে তাকাল তুফানের দিকে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব!