বিদ্ধ
মালগাড়ী আসার খবর হওয়ায় রেলগেটে আটকে পড়েছিল অভিলাষ। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়েছিল সেই মালগাড়ী টাউনের জংশন স্টেশনের দিকে চলে যেতে।
গেট খুলতেই অভিলাষ গাড়ি, অটো, বাস, রিক্সার ফাঁকফোকর দিয়ে লাইনের ওপারে আসে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে ডান দিকে হাসপাতালের মোড়ের সামনে পৌঁছতেই দ্যাখে একটা ছোটোখাটো জটলা।
জটলার কারণ জানার জন্য ভেতরে ভেতরে প্রবল আগ্রহ বোধ করে অভিলাষ। দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। আশেপাশে ভিড় ক্রমশ বাড়ছিল। গাড়ির আওয়াজ এবং আরও অনেক কিছুর সশব্দ উপস্থিতি ছাপিয়ে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে জটলার ভেতর থেকে। যেন কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অবিচ্ছিন্ন এবং নিরন্তর সেই আওয়াজ।
অভিলাষ জটলার বলয়ে ঢুকে পড়ে দ্যাখে এক অল্পবয়সী ছেলে, কতই বা বয়স হবে? চৌদ্দ কি পনেরো। একজন ভদ্রমহিলার পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদে চলেছে অঝোরধারায়।
কিশোরটির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার ভেতর থেকে উৎসারিত হচ্ছে গভীর শোকের অভিব্যাক্তি। অমূল্য কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার অসহ্য যন্ত্রণা।
অভিলাষ সেই জটলার মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আর পাঁচজনের মত। পাশে দাঁড়ানো কেউ একজন বলল, আহা রে, মাকে হারিয়ে ফেলল গো এই বয়সে।
কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই চমকে ওঠে অভিলাষ। বুঝতে পারে হাসপাতালেই কিশোরটির মা চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে।
অজান্তেই একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অভিলাষের। কিশোরটির অবিচ্ছিন্ন কান্নার মধ্যে মাকে হারানোর গভীর দুঃখের ইঙ্গিত স্পষ্ট। ততক্ষণে তার মনেও এক পুরনো অনুভুতি মুহূর্তের জন্য হলেও স্পর্শ করে যায়।
জটলার বৃত্ত থেকে সরে আসে অভিলাষ। কাছেই তার আবাসন। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব নয়।
হাঁটতে হাঁটতে অভিলাষ ভাবে প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদের কথা। সেই বিচ্ছেদ যদি মৃত্যুর রূপ ধরে আছড়ে পড়ে জীবনে, তাহলে তার তাৎক্ষণিক অভিঘাত বড় অসহনীয়।
প্রায় দু’দশক আগে অভিলাষও তার মাকে হারিয়েছিল। এরকমই অপরিণত বয়সে। আজ হয়তো প্রতিদিনের ব্যস্ততায় সেই দুঃখ তেমনভাবে প্রকট হয়না কিন্তু এই হতভাগ্য কিশোরটির দিকে তাকিয়ে পুরনো স্মৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে তাকে।
সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান অতিক্রম করতে করতে অনেকগুলো বছর পিছিয়ে যায় অভিলাষ। মাকে হারানোর সেই দিনের শোক, দুঃসহ বেদনার প্রবল অভিঘাতে আবার বিদ্ধ হতে থাকে সেও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন