সোমবার, ১ নভেম্বর, ২০২১

তথাগত চট্টোপাধ্যায়-এর ঝুরোগল্প


 বিনিময়

পবনকুমারের ঘোড়া তুফান ছুটছিল দুরন্ত গতিতে। দুপাশে পেরিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী ঝর্না, বনভূমি। কোথাও আবার সেই ঝর্না নদীতে গিয়ে মিশেছে। নদীর পাড় বরাবর যাবার সময় পবনকুমারের মনে হচ্ছিল সে বুঝি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে উড়ে চলেছেএমনই দ্রুততায় তুফান টগবগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আগামীকাল সকালের মধ্যেই পৌছে যেতে হবে তাকে। কুসুমের কাছে পবনকুমার অঙ্গীকারবদ্ধ। এই তো আর কয়েকঘন্টা মাত্র। তারপরই আসবে বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই দিন। প্রিয়তমা কুসুমকে সে নিজের কাছে নিয়ে আসবে সারা জীবনের জন্য। তাই নিজের প্রাণাধিক প্রিয় তুফানকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে সে ছুটে চলেছে নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে। জমিদার প্রদীপনারায়ণের কাছে সংবাদ পৌঁছলে পবনকুমার জানে তার কি পরিণতি হবে। তাই সবার অলক্ষ্যে, অজান্তে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে কুসুমকে। তারপর মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে তাকে বরণ করে নেবে নিজের সহধর্মিণী রূপে। কিন্তু পথ যে আরও অনেকটাই। পবনকুমার আকাশের দিকে তাকাল। অন্ধকার দ্রুত ঘন হয়ে আসছে। সে কি পারবে সঠিক সময়ে তার অভীষ্ট জায়গায় পৌঁছোতে? একমাত্র ভরসা এই তুফান। পবনকুমার ভাবল, কুসুমও কি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে করে তার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে? সেও কি মনে মনে সেই শুভক্ষণের প্রত্যাশায় কাতর?

 চাঁদের এমন আলো পবনকুমার বহুদিন দেখেনি। আকাশের এধার থেকে ওধার ছড়িয়ে আছে কত তারা। চুইয়ে পড়া জ্যোৎস্নার আলোয় সামনের পথ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সর্পিল সেই পথ কখনও এগিয়ে গেছে পাহাড়ি উপত্যকা ধরে, কখনও বা জঙ্গলের পাশ দিয়ে সমতল বরাবর। রাতেরও যে এক অনাবিল সৌন্দর্য আছে পবনকুমার আগে তা বুঝতে পারেনি। আজ সেই অভিজ্ঞতায় সে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তুফানের গতি রুদ্ধ হয়ে এল। যে ক্ষিপ্রতায় তুফান ছুটে চলেছিল, আচমকাই হ্রেস্বাধ্বনি ছড়িয়ে থেমে গেল সেই গতি। পবনকুমার গভীর বিস্ময়ে দেখল একদল লোক ইতিমধ্যেই ঘিরে ধরেছে তাকে। তারাও ঘোড়ায় সওয়ারি। জ্যোৎস্নার আলোয় তাদের হাতের অস্ত্র ঝিলিক মেরে যাচ্ছে মুহুর্মুহু।

     তুফান সহ পবনকুমার বন্দী হল তাদের হাতে। রাতের অন্ধকারে পবনকুমারকে অচেনা পথ ধরে নিয়ে আসা হল কোনও এক জঙ্গলের কাছে। এর মধ্যেই পবনকুমার জেনেছে সে কাদের হাতে পড়েছেএরা আর কেউ নয়, জমিদার প্রদীপনারায়ণের রক্ষীবাহিনী। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত পবনকুমার অথৈ জলে পড়ল। সে বলল, কেন বন্দী করলে আমায়? ছেড়ে দাও। ভোরের আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে শহরে। তোমরা জাননা কত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে আমি যাচ্ছি। আমাকে বিরত কোরোনা সেই কাজ থেকে। পবনকুমারের কথায় অট্টহাস্যে হেসে উঠল রক্ষীদল। একজন বলল, নিশ্চয়ই ছেড়ে দেব। কিন্তু তার আগে শুনে রাখো একটি কথাজমিদার প্রদীপনারায়ণের স্পষ্ট নির্দেশ, বিনিময়ে তোমার সাদা ঘোড়াটি আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আর কিচ্ছু না। তাহলেই তোমার ছুটি।  

     পবনকুমার চমকে তাকাল তুফানের দিকে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন