অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র লেখা একটি অনবদ্য মরমী কবিতা 'নির্বাসন'। কয়েকবছর আগে এই 'নির্বাসন' কবিতাটি নিয়ে হুগলি থেকে প্রকাশিত শারদীয়া ‘চিরাগ’ পত্রিকায় তাঁর আরো তিনটে কবিতার পর্যালোচনা করেছিলাম। এই কবিতাটির প্রসঙ্গটি হলো - কবিতাটিরমধ্যেঅন্তর্নিহিতগান্ধীজির। কবিতায় উল্লেখ না থাকলেও তাঁর অনিবার্য উপস্থিতি ছিল। আমি পর্যালোচনায় গান্ধীজির উপস্থিতির কথা বলেছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য ! কবি জয় গোস্বামী নিজে একজন এত বড় মাপের কবি এবং অলোকদার কবিতার একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। সেই সময় জয় গোস্বামী আনন্দবাজার গ্রুপ থেকে বেরিয়ে ‘প্রতিদিন’ সংবাদসংস্থায় চাকরি করেন। ‘প্রতিদিন’ পত্রিকার রবিবাসরীয় সাপ্লিমেন্টারি পত্রিকা ‘রোববার’-এ (শুধু কলকাতার সার্কুলেশন) তদানীন্তন জনপ্রিয় তাঁর নিজের সিন্ডিকেটেড কলাম – ‘গোঁসাইবাগান’–এ জয় গোস্বামী নামী-অনামী বিস্তর কবিতা নিয়ে পর্যালোচনা করতেন নিয়মিতভাবে। সে যার লেখাই হোক না কেন। এমনকি লিটল ম্যাগাজিনের কোন অখ্যাত কবিতা হলেও হবে। মোটমাট জয়গোস্বামীর ভালো-লাগা চাই। কলকাতার কবিতাপ্রেমী পাঠকের কাছে এই কলাম একটি আদরণীয় পাঠ্যবস্তু ছিল। সেই কলাম-এ একদিন শুরু-শুরুতে জয়গোস্বামী এই ‘নির্বাসন’ কবিতাটি পর্যালোচনাকালে নাকি তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকভাবেই বিশ্লেষণ করেছেন কিন্তু আশ্চর্য ! তাতে কোথাও গান্ধীজির উল্লেখ নেই ! চেন্নাই-এ কর্মরত এক প্রবাসী কবিতা-প্রেমী দীপংকর গুপ্ত-র ব্যাপারটি খুব অদ্ভুত লেগেছিল। এই মর্মে তিনি নাকি জয়গোস্বামীকে একটি চিঠিও লেখেন তাঁর বিস্ময়ের কথা জানিয়ে এই মর্মে যে পর্যালোচনায় গান্ধিজির প্রসঙ্গটি আসেনি কেন ? জয়গোস্বামীএইগোত্রহীনউড়োচিঠিকেখুবএকটাআমলদেননি।ফলেতানিয়েআরউচ্চবাচ্যহয়নি। তারবহুবছরপরজয়গোস্বামী ‘চিরাগ’-এ প্রকাশিতআমারআলোচ্যপ্রবন্ধটিপড়েস্তম্ভিতহয়েযান। তাঁর জবানীতে বলি- ‘তাইতো ! এদ্দিন পর এই কবিতার পর্যালোচনায় কোথাকার কোন নামগোত্রহীন অখ্যাত কবিতা-পর্যালোচক রন্তিদেব যা স্থাপনা করলেন হুবহু তাই তো দীপংকর গুপ্ত বেশ কয়েকবছর আগেই আঙুল তুলে বলতে চেয়েছিলেন। আমি তো তেমন আমলই দিইনি। তাহলে আমিই কি ভুল করছি’- ভেবেই আরেকবার এই কবিতাটি খুঁটিয়ে পড়ে হৃদয়ঙ্গম করলাম সেই সত্যটির। লজ্জিত বোধ করলাম।' অতএব সেই ভুল শুধরে আবার দ্বিতীয়বার তিনি তাঁর কলাম- ‘গোঁসাইবাগান’-এ ‘নির্বাসন’ কবিতাটির পুনঃপর্যালোচনা করার আগে আমার সঙ্গে অলোকদার বাড়িতেই দেখা হওয়াতে তিনি আমাকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি কি তাকে আমার নামটি ব্যবহার করার অনুমতি দেব কিনা। আমি তো রীতিমতো থতমত খেয়ে গেছি। মনে-মনে ভাবছি কবি জয়গোস্বামী রন্তিদেব সরকারের নামটি তাঁর কোন পর্যালোচনায় ব্যবহার করতে পারেন কিনা ? প্রথমত ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছিল না, যে কি এমন ঘটতে পারে যে জয়গোস্বামীকে তার আলোচনায় আমার নামোল্লেখ করার অনুমতি চাইতে হবে ! তারপর পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হবার পর আমার মুখ দিয়ে একটি শব্দ-বন্ধ স্বতঃনিসৃত হলো -‘ওহো ! এ তো আমার পরম সৌভাগ্য। আমি কৃতার্থ বোধ করছি।’ তারপর পরের রোববার ‘গোসাঁইবাগান’-এ তার সেই বিশেষ কলামে, আমাদের দুজনের নামোল্লেখ করে নিজের ভুল স্বীকার করে লিখলেন-“দীপংকর গুপ্ত এবং রন্তিদেব সরকার- এঁরাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র ‘নির্বাসন’ কবিতাটি সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পেয়েছেন যা আমি পাইনি, তাই কবিতাটির পুনরাবতারণা- কারণ ‘এখনো আমার অনেক শেখা বাকি এবং এমন সচেতন এবং বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে আজও আমি নিত্য শিখতে পারি।’’ এটা সত্যিই জয়গোস্বামীর উদার মানসিকতার, খোলামনের কথা প্রমাণ করে । একজন যশস্বী এবং প্রতিষ্ঠিত কবি হয়েও নিজের ভুল শুধরে নেবার, তাও আবার লিখিত আখরে, এমন সৎসাহস অবশ্যই প্রশংসার দাবি করে, বিশেষ করে তাঁর মত সেলেব্রিটি কবির। আমি তখন দুর্গাপুরে থাকি। তাই শুধুমাত্র কলকাতার মধ্যে সীমিত এই পত্রিকা আমি দেখতে পাবনা এই আন্দাজে আমাকে সেই রবিবার নিজেই ফোন করে জানিয়েছিলেন যে সেই রবিবারের সংখ্যায় ঐ 'সংশোধনী' লেখাটা বেরিয়েছে যেখানে আমার নামোল্লেখ রয়েছে এবং আমি যেন কোলকাতায় কাউকে বলে সংগ্রহ করে নিই। তাঁর এই সৌজন্যবোধেও আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
নির্বাসন
- অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
আমি যত গ্রাম দেখি
মনে হয়
মায়ের শৈশব
আমি যত গ্রামে যত মুক্তক পাহাড় শ্রেণী দেখি
মনে হয়
প্রিয়ার শৈশব।
পাহাড়ের হৃদয়ে যত নীলচে হলুদ ঝর্ণা দেখি
মনে হয়
প্রিয়ার শৈশব
ঝর্ণার পরেই নদী, নদীর শিয়রে
বাঁশের সাঁকোর অভিমান
যেই দেখি, মনে হয়
নোয়াখালি, শীর্ণসেতু, আর নাছোড় ভগবান।
Reminiscence
Whenever I see villages
they remind me of my mother’s childhood
Whenever I see stretch of hill ranges
Overlooking villages
They remind me of the childhood of my love
Whenever I see fountains
In bluish golden color
Within the fold of mountains
They remind me
Of the childhood days of my love
Whenever I see springs
With the tinge of bluish golden color
Within the cleavages of mountains
It remind me of
Each deported soul of the land
Beneath the fountain
Flows the river and
Whenever I see the bamboo bridge
This calls forth
The memory of Noakhali
The narrow bridge and the
Indomitable godly soul.
[কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
জন্ম- ৬ অক্টোবর ১৯৩৩
স্থান- বকুলবাগান, কলকাতা
প্রয়াণ – ১৭ নভেম্বর ২০২০
স্থান- হির্শবার্গ, জার্মানি
পিতা - বিভূতিরঞ্জন দাশগুপ্ত
মাতা - নীহারিকা দাশগুপ্ত
পড়াশোনাঃ
স্কুল শিক্ষা - পাঠভবন, বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতন, বীরভূম
IA স্তর- সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর - প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
কর্মজীবন- অধ্যাপনা -যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ও বাংলা বিভাগ, কলকাতা। পরে অধ্যাপনা করেন নব্য ভারততত্ত্ব নিয়ে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়-এ।
গবেষণা- বাংলা সাহিত্যে লিরিক রূপকল্পের বিবর্তন বিষয়ে পিএইচ ডি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হুমবোল্ট ফাউণ্ডেশন এর গবেষণাবৃত্তিও পেয়েছেন।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন