সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

রন্তিদেব সরকার-এর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী "প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি"

প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি

গাড়ি তার নিজস্ব গতিতে চলছে। মতিদার তরফেও কোনো তাড়া নেই কারণ মতিদা জানে গরুর নিজস্ব আরামের চালে বেশি সতেজ থাকে। এবার আমাদের যাত্রাপথ পশ্চিমদিশা বদলে উত্তরমুখী হবে। পরের গ্রাম বড়ঢ়া ছেড়ে আমরা ডানদিকে ঘুরে আরেকটি বড় জনপদ বাবুইজোড়ে পৌঁছাল। গ্রামটিও মূলতঃ বাণিজ্য-প্রধান জায়গা। বেশ সমৃদ্ধ, দেখলেই বোঝা যায়। বহু প্রাচীন বনেদি অট্টালিকা দাঁড়িয়ে তার প্রমাণ দেয়। বাজার-ঘাট, বাস-টার্মিনাস সব রয়েছে। হাট বসেছে রাস্তার ধারেই। সবজির পশরা নিয়ে কালো-রঙএর মেহনতী মানুষের গায়ে দুধসাদা নতুন গেঞ্জি দারুণ খোলতাই হয়েছে। এখানে গাড়ি থামাতেই হবে কারণ ব্রেকফাস্ট-এর জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর হয় না। সময় আর জায়গা সঠিক জায়গায় এসে এক বিন্দুতে থেমেছে। আমাদের গাড়িও। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড়াতেই হর্ষ ঝুপ করে নেমে পড়ল। এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে বসে আছে সবাই। একবার পা-ছাড়াতেই হবে সবার।এখানে আলুর চপ ভালো পাওয়া যায়’ – মায়ের এই ঘোষণা আর পা-ছাড়াবার তাগিদে প্রথম সুযোগেই হর্ষ নেমে পড়েছে। সে গেল মায়ের আদেশে চপ আনার জন্য। মতিদা গাড়ির ছই নামিয়ে বলদযুগলের বাঁধন খুলে দু-আঁটি খড়ে গিঁট খুলে দুজনের সামনে মেলে ধরল মাটীতে। ওরা ওদের জলখাবার পেয়ে গেছে। সবুজাভ শালপাতার ঠোঙ্গায় গরমাগরম আলুর চপ আনতেই খিদীটা জোর চাগিয়ে উঠল। এখন সবে আটটা বাজে। গরম আলুর চপের সাথে শালপাতার ঠোঙায় মুড়ি আর কড়া মিষ্টির চা, অথবা ঘুগনি-মুড়ির শেষে আলুর চপ আর চা, বেশ জনপ্রিয় জলখাবার বীরভূমে। গাড়ির অন্দরমহলে এই প্রাতরাশ খেতে খেতে মা বলল- আরো কিছু চপ কিনে নে। কারণ পরে আর তেমন ভালো দোকান নেই। তাছাড়া এই গ্রামীন পথে কোনো ভাতের হোটেল নেই। তাই মধাহ্নভোজও চপ-মুড়ি দিয়েই সারতে হবে। সঙ্গে মেনুতে বৈচিত্র আনতে থাকবে খইনাড়ু, নারকেল নাড়ু, চোনার নাড়ু, কুঁচো নিমকি, সেউ ঝুরিভাজা আর ঘরের তৈরি বোঁদে। সবই অবশ্য ঘরের। কিছু মায়ের তৈরি কিছু ভিয়েন বসানো ময়রার। এমন মেনু শুনে গাড়ির সবাই যে উৎফুল্ল হয়েছিল, তেমন জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। বিশেষ করে দুই বিরোধী নির্দল প্রার্থী। আমার কাছে অবশ্য মেনু এক চিরন্তন স্বাদের। কোনো অরুচি নেই। নববধূকে শশ্রুমাতা খাবার সম্বন্ধে তার রায় জানার জন্য প্রশ্ন রাখতেই এমন একটা হাসি হাসল ঘাড় নত করে সেটা হর্ষের ব্যাখ্যায় – ‘সম্মতিএবংঅসম্মতিবোঝা দায়। বৌদি এই কথায় সবার দৃষ্টির আড়ালে কপট রাগে দেবরের উদ্দেশে ঘুষি পাকিয়ে বাতাসে ছুঁড়ল। হর্ষ সাফল্যের হাসি হাসল, মুখটি টিপে। আহারান্তে আমিই ছুটলাম দ্বিতীয় দফার চপের উদ্দেশে। আমি চপের ডালি মায়ের হেপাজতে দিয়ে গাড়িতে উঠতেই মতিদা গাড়ি ছেড়ে দিল।


মতিদা জানালো, ‘এখুনো তিনটে গাঁ পেরিতে হবেক। আম্বা, সটকি গড়শিমুলে আর আর দুটো নদী- হিংলো আর শাল নদী।মতিদা অভিজ্ঞ মানুষ। বুঝেছে, গরুর গাড়ি চেপে এই দীর্ঘ পথ জার্নি করা আমাদের কম্মো নয়। তাই আমরা যাতে অযথা ধৈর্য না হারাই এবং মানসিক প্রস্তুতিটা থাকে। স্তুতি বেচারা যে থেকে-থেকেই একটূ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে, তা ওর শরীরি ভাষা আর চোখে প্রকাশ পাচ্ছে। ঠিক ঠিক কতটার সময় যে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে সেই নিয়ে ওর দুশ্চিন্তার শেষ নাই। মতিদাই কান্ডারি, তাকেই সরাসরি আবার জিজ্ঞাসা করল

 

স্তুতি-   আর কতটা মতিদা ? স্তুতির গলায় অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট।

                  

মতিদাএখুনো এনেক রাস্তা, গুলিন। এখুনি হেঁসোড়ে (হাঁপিয়ে) গেলে? -  মতিদার গলায় 

           সরেস কৌতুকী।

স্তুতি -   কি মুস্কিল। এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকা যায়?

 

মতিদা-   তা আর কি করবে বল ? বলদগুলান আর উইত্তে (উড়তে) লারব্যেক!

 

মতিদার রসিকতায় আমরা সবাই একসাথে হেসে উঠি। স্তুতিও একটু অপ্রস্তুত হয়ে একটু বোকাবোকা হেসে আমাদের হাসিতে যোগদান করল। এবার দেবরজি বৌদির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আগেভাগে সম্ভাব্য প্রশ্নবাণের আঁচ করে বলে উঠল তড়িঘড়ি-‘ আমার তো জার্নিটা বেশ এক্সাইটিং লাগছে। কত কিচু দেখছি, যা আগে কোনোদিন দেখিনি, শিখছি, গ্রামবাংলার এই রূপ তো আগে কোনোদিন দেখার সুযোগ ঘটেনি’- একনিশ্বাসে বলে ফেলল।

 

          এবার আমরা হিংলো নদীর কোলে এসে পড়লাম। এই নদীই আমাদের গ্রামের কাছ ঘেঁষে বয়ে গেছে অজয় নদীতে মেশার আগে, আমাদের গ্রাম থেকে কিছুটা অববাহিকা পার হয়ে। নদীর এই আপাত শান্ত রূপ দেখলে কেউই কল্পনা করতে পারবে না যে বর্ষাকালে এই নদী কতটা বিধ্বংসী হতে পারে। আমাদের গ্রাম সেইরূপ দেখেছে। নাব্যতা নেই বললেই চলে। ফ্ল্যাট বেড। তার ফলে বিহারের উৎস-মুখে পাহাড়ী এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে পুরো জলটাই হয়ে ওঠে উদ্বৃত্ত অর্থাৎ বন্যার জল অপ্রতহিত গতিতে দুকূল ছাপিয়ে বন্যার বিভীষিকা ছড়ায়। কখনো কূল ভাঙ্গে। অথচ এখন প্রশান্ত চেহারায় এক স্নিগ্ধ শীতল রূপ। তিরতির করে শীর্ণ একটি ধারা নদীর একপাশ দিয়ে কি সঙ্কোচে বয়ে চলেছে। পরিষ্কার ঝকঝকে জল- স্বচ্ছতোয়া এবং ক্ষীণতোয়াও। হর্ষ একলাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ঝুপ করে। মা হাঁ-হাঁ করে উঠল- এমনি করে নামিস না, বলদে চেটিঞ দিলে বিপদ বাধাবি।হর্ষের মায়ের সাবধান বাণী থোড়াই কানে পৌঁছল, সরাসরি কুলকুল জলে গিয়ে দাঁড়াল। নির্মল বারিধারা হর্ষ- দুই-পা ধুয়ে যেন স্বাগত জানাল। দেখাদেখি আমিও দাঁড়ালাম তার পিছনে। আমাকে দেখে হর্ষ দিদি-বৌদিকে ডাকতে লাগল নদীর শীতল জল ছোঁয়ার অসাধারণ পরশ তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে। মতিদা ততক্ষণে গাড়িকে এক আমগাছের ছায়ায় ছই খুলে গাড়িকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আর ননদ-ভাজে জুড়ি বেঁধে প্রায় ছুটে এসে নদীর জলে নামল কৈশোর উচ্ছ্বাসে। সেই অভিঘাতে দুটি দুধসাদা বক উড়ে গেল পশ্চিম তেপান্তরের পানে। রাখাল বালকেরা, যারা গরু চড়াতে নিয়ে এসেছে নদীর পাড়ের সবুজ ঘাসে, নিবিষ্ট চোখে, আড়বাঁশি হাতে, নীরব দর্শক হয়ে দেখতে লাগল নাগরিক সভ্যদের এই নির্মল দামালপনা। জনে মিলে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিজেদের মধ্যে কিছু বিনিময় করে হেসে উঠছে বেদম মজায়। ওদের এরকম দৃশ্য খুব বেশি দেখার সুযোগ হয়েছে মনে হয় না। আর ওরা ? তখন নিজেদের ভুলেছে। এই বিস্তীর্ণ নদীপ্রান্তে এই রাখাল বালক কয়জন ছাড়া আশেপাশে কোনো নাই। শরতের নৈসর্গিক বাতাবরণ, প্রকৃতিমাতার এমন উদাসী-প্রশস্ত বদান্যতায় তাদের অন্তর্নিহিত রুদ্ধ কৈশোর সত্ত্বা, যেন জাদুকাঠির পরশে জেগে উঠেছে। কিছুদূরে আমগাছের প্রশান্ত ছায়ায় বলদযুগল খড় চিবুছে নিশ্চিন্ত আরামে। তাদের বাঁধন খুলে এনে মতিদা, নদীর ধারে এনে তাদের হিংলোর নদীর জলে পান করাল প্রাণভরে। দীর্ঘক্ষণ ধরে তাদের নদীর জলে মুখ লাগিয়ে জলপান দেখলে বোঝা যায়, কি ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছিল তাদের। দীর্ঘ গরুরগাড়ি যাত্রায় মাঝে মাঝে নদী পেরোনো যে কত জরুরি তা মতিদা আমাদের বোঝাচ্ছিল। আমরা তো নানাভাবেই জলপান করতে পারি, কিন্তু এদের পুকুর অথবা নদীর জল তাদের নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। মতিদার কথা শুনে আমাদের জ্ঞানচক্ষু খুলে গেল। মা এতক্ষণ গাড়িতেই বসে। তারও তো একবার মাটিতে নেমে পা-কোমর ছাড়ানো দরকার। মায়ের অবশ্য এমন অনেক দীর্ঘ গরুর-গাড়ির যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু মতিদা স্থিতধী মানুষ। আমাদের উদ্দেশ্যে হাঁক পাড়ল –‘ইবার গাড়ি ছাইত্তে হবেক, গুলা। নাইলে দেরি হঁয়ে যাবেক।





ক্রমশ...

1 টি মন্তব্য:

  1. খুব ছেলেবেলায় আমরাও গরুর গাড়িতে যাওয়া আসা করতাম।সেই বালক জীবনের অভিজ্ঞতা সজীব হয়ে উঠল।

    উত্তরমুছুন