পৃথিবীর স্বপ্ন আছে
(সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ডায়েরিতে তৎকালীন ভারতবর্ষের ছবি)
যুদ্ধের জন্ম হল
অন্ধকারে-
শস্যহীন প্রান্তরে
ক্ষুধিতের আগ্নেয় জঠরে। (যুদ্ধ) (১)
এই যে শস্যশ্যামলা ভারতবর্ষের করুণ চিত্র যার লেখনীতে ফুটে উঠেছে, যার কবিতার বিষয় হিসাবে বারবার স্থান করে নিয়েছে পরাধীন ভারতবর্ষের গ্লানি তিনি আর কেউ নন, তিরিশের কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৬৪)। তবে শুধু কবি নয়, বাংলা সাহিত্যের নব্যমনের দিশারী,
‘পূর্বাশা’ পত্রিকার ব্রতনিষ্ঠ সম্পাদক হিসাবেও তাঁর ছিল উজ্জ্বল অবস্থান। তেষট্টি বছরের জীবনপর্বে সঞ্জয়ের এই দুটি পরিচয় তাঁর বাকি সব পরিচয়কে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার সাহিত্যকর্মের নিপুণ বিশ্লেষণে দেখা যায় গ্রন্থাকারে ছাপা ও নানা পত্রপত্রিকায় ছাপা অথচ গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত এমন সাইঁত্রিশটি উপন্যাস, তিনটি গল্প, দশটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, একটি কিশোর পাঠ্য কাহিনী, তিনটি নাটক এবং পূর্বাশা ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ইতিহাস, ধর্ম পুরাণ ও সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক অসংখ্য অগ্রন্থিত প্রবন্ধ বর্তমান। এসবের স্রষ্টা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথা যেমন স্বল্পবিদিত, তেমনই প্রায় একেবারে অজানা তিরিশের এই কবির ব্যক্তিজীবন, তাঁর রাজনৈতিক মনোভাব, তাঁর জীবনদর্শন, বিদেশি সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর অগাধ বিচরণ। একমাত্র কবির স্বহস্ত লিখিত দিনলিপিই এ ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট ধারণা দেয়, আমাদের মনে এঁকে দেয় অন্তর্মুখী এই মানুষটির স্পষ্ট ছবি। দিনলিপি যেমন এক ‘ভিন্ন মানুষ’ সঞ্জয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরে, তেমনই তুলে ধরে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষের চিত্র। তবে শুধু কি রাজনৈতিক, সামাজিক সেই অস্থির পরিবেশ চাক্ষুষ করা ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেই তিনি ক্ষান্ত থেকেছেন? উত্তর : একেবারেই না। সেই ঘটনাগুলো সঞ্জয়ের মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে তিনি তাঁর একান্ত আপন এই বন্ধুটিকে ( অর্থাৎ দিনলিপিকে) জানিয়েছিলেন তাঁর অনুভব। এইসব ঘটনার ফলস্বরূপ তার কবিমন জন্ম দিয়েছিল একের পর এক কবিতার। এসবের খবর আমরা পাবো সঞ্জয়ের দিনলিপি ‘স্মরণী ও সরণি’-তে। ৪ বছর ৭ মাসের এই ডায়েরি, সময়কাল : নভেম্বর ১৯৪৫ - জুন ১৯৫০। তবে দিনলিপি নিয়ে আলোচনায় প্রবেশের আগে কবির জীবন বৃত্তান্তের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক।
কবিজীবনী
ত্রিপুরার পশ্চিম প্রান্তবর্তী মেঘনা তীরস্থ শ্যামগ্রামে ১৯০৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন ছোট্ট সঞ্জয়। পিতা রাজকুমার ভট্টাচার্য ও মাতা শশীমুখী দেবীর তৃতীয় সন্তান তিনি। ভাগবত ধর্মাবলম্বী পিতৃকূলের প্রভাব যে তার নামকরণে বেশ ছায়া রেখেছিল তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন ––– “আমার নামকরণের মধ্যে মহাভারতের ঐতিহ্য এভাবেই এসেছে।” (২) যাইহোক ভট্টাচার্য বংশের কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় পিতার নবাবী এস্টেটে ম্যানেজারের কারণে জন্মের পর থেকেই থাকতে শুরু করেন। কুমিল্লায় সেখানে পাঠশালায় প্রথম পাঠ গ্রহণের পর বিদ্যালয় গেলেও বিদ্যালয়ে শিক্ষাকালটা ছিল বেশ খানিকটা দীর্ঘ। তবে দিনের শুরু যেমন বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে, ঠিক তেমনি বরাবর স্কুলে প্রথম হওয়া এই ছেলেটির মাধ্যমিকের ফলাফলই যেন জানান দিয়েছিল তার জীবনের ঝোঁকটা ঠিক কোন দিকে। ৪টি বিষয়ে লেটার সহ ১৯২৬ এ ম্যাট্রিক ও ১৯২৮ এ ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ সহ আই এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাশকোর্স নিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। এরপর ঢাকাতে বিএস.সি পড়তে গেলেও মন না বসায় পুনরায় ফিরে আসেন কুমিল্লায়। এরপর হঠাৎ মেধাবী এই ছাত্রটির পড়াশোনার সঙ্গে ঘটে যায় দীর্ঘ বিচ্ছেদ। দেশাত্মবোধের প্রেরণায় পিতা এস্টেটের ম্যানেজার চাকরিতে ইস্তফা দিলে সংসারের সচ্ছলতার ভিতটা যেন মুহূর্তেই নড়ে ওঠে। এদিকে তখন চলছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাও ‘যার ফলে বাবার হোটেলের বাসিন্দে সব শিক্ষিত বেকার’। (৩) বেকারত্বের জ্বালায় অতিষ্ট কবিও তাই মানিয়ে নিয়েছিলেন 'তখন ইচ্ছে করেই এম.এ পড়িনি,পড়েছিলাম অনেক পরে এবং অন্য বিষয়ে।'(৪) এর প্রায় ১১ বছর পর ‘Ancient Indian History & Culture’-এ প্রাইভেটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন। তবে এসবের মাঝে শুরু হয়ে গেছে তাঁর জীবনের একটি নতুন অধ্যায়। ১৩৩৯ এর (১৯৩২) এর বৈশাখে তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে শুরু করেন সাহিত্যপত্র ‘পূর্বাশা’। সেই সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘সম্পাদক সঞ্জয়’ হিসাবে। এরপর ‘পূর্বশাকে’ ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে উত্থান ও পতন। যেহেতু মানুষ হিসাবে তিনি অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন ও দেশের সে মুহূর্তের বিদেশি শাসন তাঁকে অনবরত বিব্রত বিচলিত করত তাই পূর্ব ও পরবর্তী জটিল পরিস্থিতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন হিটলার বিরোধী লেখা সবই জায়গা করে নিয়েছিল এই ‘পূর্বাশা’য়। আর এসব কারণে পত্রিকাটি মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে গেলেও ১৯৫০ পর্যন্ত প্রায় নিয়মিতই প্রকাশ পেয়েছিল এটি। এই সালের ডিসেম্বরে ব্যাঙ্কগুলির Amalgamation এর ফলে পত্রিকাটির ছাপাখানার অবস্থান সঙ্গীন হয়ে পড়ে আর এর ফলস্বরূপ পূর্ববাশা অন্তপ্রাণ সঞ্জয় ১৯৫১-এর ১২ জুলাই আত্মহননের পথ বেছে নেন। তবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আবার ‘পূর্বাশা’র সম্পাদনা শুরু করেন। তবে ১৯৫৫তে পত্রিকাটির একেবারে অবলুপ্তি ঘটলে সম্পাদক আবারও স্নায়ুবৈকল্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দীর্ঘ ১৪ বছর মানষিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৬৯ এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যু হয়। শুধু জানা যায়নি, সঞ্জয়ের মৃত্যুক্ষণটা তার জন্মক্ষণকে ছুঁয়ে গিয়েছিল কিনা। কবির মৃত্যুর পর প্রাণের বন্ধু সত্যপ্রসন্ন আর একটিমাত্র সংখ্যাই প্রকাশ করতে পেরেছিলেন বলে জানা যায়।
ডায়েরি প্রসঙ্গ
এবার আসা যাক মূল প্রসঙ্গে অর্থাৎ সঞ্জয়ের ডায়েরি ‘স্মরণী ও সরণি’ (প্রথম প্রকাশ : ২০১৭) লেখাকালীন ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। ডায়েরিটি খুব স্পষ্ট ভাবে দু ভাগে বিভক্ত। এই দিনলিপি জুড়ে শুধু কি এই কথায় আছে না তার সঙ্গে এসেছে নানা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ, প্রেম ভালোবাসার কথা, পূর্বাশার কথা, মডেল ফার্মের প্রসঙ্গ, বিদেশি সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অগাধ বিচরণের ইতিবৃত্ত। আর যে-প্রসঙ্গটির কথা না বললেই না, তা হল 'কবি' সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কথা। সেই প্রেমিকার মৃত্যু যন্ত্রণাই হোক, কি দেশের উত্তাল পরিস্থিতিই হোক সমস্ত রকম অভিব্যক্তিই তিনি প্রকাশ করেছিলেন দিনলিপির পাতায় একের পর এক কবিতা লিখে।
‘স্মরণী ও সরণি’ প্রথম পাতার প্রথম লাইন ‘কলকাতার রুদ্ধ আবেগে, ব্যথিত আত্মা, ফুলে ফুঁসে গর্জে উঠেছিল এ তিনদিন।'(৫) (২১,২২,২৩ নভেম্বর ১৯৪৫) যে মানুষের ডায়েরির সূচনা এরকম একটা লাইন দিয়ে হতে পারে তার ডায়েরির সর্বত্র যে সমাজ ও রাজনীতি প্রসঙ্গে নানা আলোচনা থাকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালি জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের রক্তক্ষরণ ধরে রেখেছেন কবি এই গোপন আধারটিতে। এক অর্থে এটিও হয়ে উঠেছে দেশভাগ ও তার অভিঘাতেরএকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি। দেশে তৎকালীন যেসব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলি হল--
১) আজাদ হিন্দ্ বাহিনীর সেনানায়কদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হলে তার প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে বিক্ষোভ। ২) নৌ বিদ্রোহ ৩) মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন। ৪) দেশের এরকম উত্তাল পরিস্থিতিতে গান্ধীজীর ভূমিকা। ৫) ইন্টারিম গভর্নমেন্ট নির্মাণ ৬) ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ। ৭) আততায়ীর গুলির আঘাতে গান্ধীজীর মৃত্যু, -এ সমস্ত ঘটনাগুলির দ্বারা স্বাধীনতার পূর্ব ও স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের খানিক আঁচ পাওয়া গেলেও ঘটনাগুলির বিশদ বিবরণ ছাড়া তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মনোভাব অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
গণআন্দোলন, শাহনাওয়াজ ও শরৎবাবু
কবির ডায়েরির শুরুতেই রয়েছে অধুনা বিস্মৃত একটি গণ আন্দোলনের বিবরণ। আজাদ হিন্দ ফৌজের তিনজন সেনানায়ক শাহনাওয়াজ, প্রেমকুমার সহগান ও গুরুবক্স সিংধিঙ্গ এর সামরিক আদালতে বিচার আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয় ৫ ই নভেম্বর ১৯৪৫ এ দিল্লির লালকেল্লায় আর এই তারিখ থেকেই ডায়েরি লেখা শুরু করেন কবি। এর প্রতিবাদে পরাধীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহর প্রধানত অমৃতসর, করাচি কলকাতার রাজনৈতিক পরিবেশ পথসভা, মিছিল ধর্মঘটে উত্তাল হয়ে ওঠে। কলকাতার দুটি ছাত্র সংগঠন যথাক্রমে ধর্মীয় ছাত্র ফেডারেশন ( ১৮ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীট শাখা ) এবং ধর্মীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেসের উদ্যোগে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে একটি ধর্মীয় প্রাদেশিক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হয়। নিরস্ত্র ছাত্রদের মিছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ার সংলগ্ন ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে ধর্মতলা মোড়ের দিকে এগোয়। ধর্মতলা স্ট্রিট ও ম্যাডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ মিছিলের গতিরোধ করে। কারণ ছাত্রদের গন্তব্য যে ডালহৌসি স্কোযার সেখানে তাদের যাবার অনুমতি ছিল না। প্রতিবাদী ছাত্ররা সেখানে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে এবং পরিস্থিতি দ্রুত উভয়পক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কারণ, ঠিক এই সময় ১৯ বছর বয়সের তরুণ রামেশ্বর গুলিবিদ্ধ হন। এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। সেই সঙ্গে বহু ছাত্র, পথচারী, স্থানীয় বাসিন্দা পুলিশের গুলিতে ছত্রভঙ্গ হয় ও লাঠির আঘাতে আহত হন।
পরের দিন অর্থাৎ ২২ নভেম্বর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এ শরৎবাবুর এ ঘটনায় দুঃখ পাবার দীর্ঘ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। যা পড়ে সঞ্জয়বাবুর মনে হয়েছিল যে এ ঘটনায় যদি শরৎবাবু এতই বিচলিত হবেন তবে শোভাযাত্রা শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালনা করার দায়িত্ব কেন তিনি নিলেন না। ঘটনার দিন রাত্রে ছেলের দল তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি দেখা করেননি। ‘...গুজব ছিল গুলির ভয় শরৎবাবু ছাত্রদের সঙ্গে এসে দেখা করেননি।’(৬)
যাইহোক এই রামেশ্বরের মৃত্যু কিন্তু আন্দোলনের গতিপথকে বেশ খানিকটা পাল্টে দিয়েছিল। কবি জানাচ্ছেন ছাত্ররা ২২ তারিখ সকালে আবার মিটিংয়ে বসে, তবে সে মিটিং অভূতপূর্ব..., সমস্ত পতাকা পাশাপাশি উড়ছে সেখানে। কংগ্রেস, হিন্দুলীগ, খাকসার।' (৭)
এমনকী কমিউনিস্টও পাশে সরে নেই। এই মহামিলন দেখে ‘কী যে একটা আনন্দের ধাক্কা লাগল এসে বুকে বলতে পারব না।' (৮)
ডায়েরির পাতায় জানালেন সঞ্জয়, সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেন-' বাংলার কেউ নেতা নেই' (৯)বলে যে অপবাদ এতদিন শুনতে হয়েছিল বাংলার মানুষকে তা যেন অপসৃত হল। এই মিটিং বুঝিয়ে দিল ' ছাত্ররাই বাংলাদেশের নেতা '। (১০)
তবে এ মিটিং এর পর রামেশ্বরের মৃত্যুর প্রতিবাদে আবার মিছিল হলে তাতে আবার পুলিশের গুলি চলে। আর এ গুলিতে আবারও প্রাণ দেয় এক দেশসেবিকা, এক খাকসার যুবক। কংগ্রেস নেতা শরৎবাবু এ আন্দোলনে নাকি ' spice and agent provocaterus" (১১) এর গন্ধ পেয়েছেন, বলে জানিয়েছেন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডকে। তবে এ কথার প্রতিবাদ করে ডায়েরির পাতায় সঞ্জয়বাবু লিখেছেন, ছাত্রদের এই বিক্ষোভ ঠিকমতো সামাল দিতে না পারায় তাদের সঙ্গে কোনরকম সহযোগিতা না করায় যে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল শরৎবাবুর দিকে তা ঢাকতেই যে তিনি এরূপ মন্তব্য করেছেন তা অনায়াসেই বুঝতে পেরেছেন ডায়েরি লেখক। আর তাই তিনি শরৎবাবুর মতো নেতাদের কটাক্ষ করে লিখেছেন,' সময় ও অবস্থা বুঝে নেতাদের বাণী তৈরী করতে হয় - অতীতে গান্ধীজি কখন কি করেছেন বা বলেছেন আজকের দিনে তা হুবহু করে বা বলে আর যাই হোক নেতা হওয়া যায় না। শরৎবাবু একবারও ভেবে দেখতে পারলেন না যে ছাত্ররা হুবহু গান্ধীজীর অনুগামী, পূর্ণ সত্যাগ্রহী। (১২) তবে এখানেই শেষ নয় শরৎবাবুকে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন যে পৃথিবীর কটি দেশ তিনি দেখাতে পারবেন যেখানে ছাত্ররা অহিংস শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে 'ঝান্ডা উঁচা রেখে বুক পেতে গুলি নিয়েছে।' (১৩) এখানে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো শরৎবাবুর বক্তব্য সমর্থন করে সমস্ত প্রতিবেদনই বেরিয়েছিল ' হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড' এ। ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪৫ এর পাতায় এ ঘটনার কারণ স্পষ্ট করে দিয়েছেন দিনলিপি লেখক- কয়েকদিন ধরেই আনন্দবাজার শরৎবাবুর কাছে আত্মবিক্রয় করেছে।' (১৪) বলা বাহুল্য হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ছিল আনন্দবাজার গোষ্ঠীরই একটি ইংরাজি সংবাদপত্র।
বেসামাল শরৎবাবুকে সামাল দিতে বাংলায় দিন সাতেকের মধ্যেই উপস্থিত হলেন জওহরলাল নেহেরু, সর্দার বল্লভভাই পটেল, আজাদ, কৃপালিনী প্রমুখ কংগ্রেসের তাবড় সব নেতারা। দিনলিপিতে সঞ্জয় বাবু জানিয়েছেন, এ সমস্ত নেতারা দু-দিন আগেই ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী কথা বলেছিলেন আর ৮ তারিখে দেশপ্রিয় পার্কের সভায় তাদের সুর হয়ে গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তীব্র রাজনীতি সচেতন মানুষ সঞ্জয়বাবুর কাছে দেশের নেতাদের এহেন রং বদল যেমন দৃষ্টি এড়ায়নি, তেমনি তাঁর সমালোচনা থেকে পার পায়নি দেশের নেতাদের বেঁফাস মন্তব্য। একটি ছাত্রসভায় আচার্য কৃপালিনী ঘোষণা করেছিলেন ‘মার্কসবাদ মরে গেছে।.... সত্যিকারের কমিউনিজম সেবাগ্রামে বিরাজ করছে।’ (১৫) কৃপালিনীর এহেন কথায় হতচকিত সঞ্জয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন যে এই তাবড় নেতাটির মার্কসবাদ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। অথবা তিনি হয়তো ভেবেছেন মার্কসবাদকে হত্যা না করলে গান্ধীবাদ নিশ্চিত ভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। রাজনীতির নিপুণ বিশ্লেষক হিসাবে তাঁর মনে হয়েছে যে কংগ্রেস নেতার এ ধারণা সম্পূর্ণই ভ্রান্ত, যে মার্কসবাদ এর মূল কথা 'Guide to Action'- যে মার্কসকল্পিত সমাজব্যবস্থা গান্ধীজীর সেবা গ্রামের মূল ভিত্তি তা মরে কি করে আর কি করেই বা সেটার অবলুপ্তির সঙ্গে গান্ধীজীর প্রতিষ্ঠা জড়িয়ে থাকবে - এ জিজ্ঞাসা তাঁর কৃপালিনীর কাছে।
নেতাদের এসমস্ত বক্তব্যের চাপান উতোর দূরে সরিয়ে রেখে দেশের উত্তাল পরিস্থিতির দিকে এবার একটু তাকানো যাক। ছাত্র আন্দোলনের কাছে মাথা নোয়াতে হল সরকারকে, রদ হলো আজাদ হিন্দ বন্দিনীর সেনা নায়ক শাহনাওয়াজের মৃত্যুদণ্ডাদেশ। মুক্তি পেয়ে তিনি কলকাতায় এলে সঞ্জয়বাবু লক্ষ্য করলেন তাঁর হাবভাব নিতান্তই নেতা গোছের, তাকে দেখতে কলকাতার বিপুল জনতা টিকিট কেটে এক সভায় হাজির হলেও তিনি এসব কিছুকে পরোয়া না করে সভার খানিক বিশৃঙ্খলার কারণে সকলকে হতাশ করে সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। 'শাহনাওয়াজকে দেখে তার মধ্যে থেকে নেতৃপ্রতিভার কোন ঔজ্জ্বল্য আবিষ্কার করতে পারিনি। তাঁর অসীম সাহসী কীর্তিকলাপের সঙ্গে তাঁর চেহারাটি জড়িত করেও ভেবেছি তাকে খুব বেশি বড় মনে হল না।'(১৬) - এই অকপট স্বীকারোক্তি ২৬ জানুয়ারি ১৯৪৬ এর পাতায় ডায়েরি লেখকের। তবে সরকার একবার হার মেনেও থামতে চাইল না। দ্বিতীয় দফায় বাহিনীর আরও চারজনের বিরুদ্ধে মামলা রজু করা হল। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন রশিদের মৃত্যুর দাবিতে মুসলমান ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিল শুরু হলেও আস্তে আস্তে তাতে কমিউনিস্ট, বিশুদ্ধ লেনিন পার্টির লোকেরা (তখন ট্রটস্কিপন্থী ) সকলে যোগ দিতে থাকে। বাংলার এই উত্তাল পরিস্থিতি সামাল দিতে লাটসাহেব কেসী ১৯৪৬-এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি মিলিটারির হাতে কলকাতার শাসনভার তুলে দেন।
নৌ বিদ্রোহ
কলকাতার আবহাওয়া একটু শান্ত হতেই বোম্বে ও করাচিতে দ্বিতীয় সিপাহী বিদ্রোহ সূচিত হয়েছে, (১৭) বলে জানা যায় ডায়েরি থেকে। এখানে সিপাহী বিদ্রোহ বলতে ১৯৩৬ এর নৌ বিদ্রোহকেই বোঝানো হয়েছে। ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান’ নেভির ভারতীয় অফিসার নাবিক-লস্করদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হতো তার একটা প্রতিকারের চেষ্টায় চারদিনব্যাপী, কিন্তু অভিঘাতের দিক থেকে সুদূরপ্রসারী এই আন্দোলন শুরু হয়। দ্রুত তা কলকাতা,করাচি, বিশাখাপত্তনামের বন্দর গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। দাবী আদায়ের আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও দ্রুত সেটি চরিত্র পাল্টে আজাদ হিন্দ বাহিনীর বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবির আন্দোলনে পরিণত হয়। জাহাজে জাহাজে জাতীয় পতাকা তোলা হয়। এ বিপ্লব যেন আরো একবার স্মরণ করিয়ে দেয় রুশবিপ্লবকে। এ পরিস্থিতিতে সরকারও নড়েচড়ে বসে। সরকার সর্দার বল্লভভাইকে যেমন অনুরোধ করে বিবাদ মেটাতে, তেমনি বায়ুসেনাকে দিয়েও বিমান আক্রমণ করতে ছাড়েনা তারা। এর ফলে নৌ বাহিনীর ওপর আবার সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
নৌ বিদ্রোহের এ ঘটনা কারোরই অজানা নয়, তবে এ নিয়ে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ ও দিনলিপিতে সেই পর্যবেক্ষণের লিখিত রূপ আমাদের সে সময়ের রাজনীতির অন্দরমহলের খবর দেয়। তিনি জানান ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালেও বাকি অনেকে বিশেষত কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বিদ্রোহীদের বিপক্ষে যুক্তি দেয়। এমনকি গান্ধীজিও বিরোধিতা করতে ছাড়েন নি। তবে এসবের পেছনে কারণ একটাই - ততদিনে একদিকে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আর বিপরীতে ইংরেজ সরকারের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা শুরু হয়ে গেছে। এ সময় সম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে বেজে ওঠা বিদ্রোহের দামামা সংশ্লিষ্ট অনেককেই বিব্রত করেছিলেন।
Direct Action Day বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস
এরপর সঞ্জয়বাবুর রোজনামচায় স্থান করে নিয়েছে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস বা Direct Action Day-এর ঘটনাটি। কি এই সংগ্রাম দিবস সেটা সবার আগে স্পষ্ট করা যাক। ১৯৪৬-এ ক্যাবিনেট মিশন প্রথমে (১৬ই মে ) যে প্রস্তাবটি দেয় সেটি হল দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের এবং সেই সঙ্গে তারা জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করেন। সর্বভারতীয় স্তরে গঠিত গণপরিষদে জাতীয় কংগ্রেস তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তাদের বিরোধিতা করে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে 'Direct Action Day' নামে একটি হরতালের ডাক দেন মহম্মদ আলিজিন্না। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের নিয়মানুসারে বাংলার প্রশাসন তখন মুসলিম লীগের হাতে। ফলত এই সংগ্রাম দিবস আক্ষরিক অর্থে পালন করার কোন অন্তরায় ছিল না। সংক্ষেপে এটিই ১৯৪৬এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপট। ১৬-১৭-১৮ অগাস্টের ডায়েরির পাতা আমাদের জানাচ্ছে সে কারণ। ১৬ই আগস্ট সংগ্রাম দিবস পালনের আগেই স্যার নাজিমুদ্দিন (অর্থাৎ নাজিম সাহেব) ঘোষণা করেছিলেন যে লীগ অহিংস সংগ্রাম করবে না। হিংসা মারামারির ভয়ে আগে থেকেই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। দুপুরের দিকে একটা শোভাযাত্রা বেরোলেও তা তেমন উত্তাল হয়ে ওঠে নি। কিন্ত মিছিল গণেশ এভিন্যু দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কয়েকজন হিন্দু দু-জন মুসলিমকে সাইকেল থেকে নামিয়ে কিল-ঘুঁসি মারতে থাকে। আর গোল বাঁধে তখনই। অর্থাৎ ঘটনার সূচনা হয় এর থেকেই আর যার সমাপ্তি ১৯৪৬-এ গোটা দেশব্যাপী হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায়। তবে শুধু দেশ নয় এ দাঙ্গা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশেও। ‘এই দুঃখ এই ব্যথার জন্য কয়েকটি লোকের পদমর্যাদার মোহই কি দায়ী নয় ' (১৮) - কবিমনের এই জিজ্ঞাসা শুধু তাঁর একার নয়, এ যেন দেশের সব সাধারণ মানুষেরই।
ইন্টারিম্ গভর্নমেন্ট গঠন
সমগ্র দেশের হিন্দু মুসলমান যখন পরস্পরকে হত্যার নিষ্ঠুর খেলায় মগ্ন, এখন এরই মধ্যে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৬-এ জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ৬-৫-৩ সূত্রে অন্তবর্তী সরকার অর্থাৎ ইন্টারিম সরকার গঠিত হয়।( তফসিলী জাতির ১জন প্রতিনিধি সহ কংগ্রেসের মোট ৬জন, মুসলিম লীগের ৫জন, ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাদে অন্য তিনটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে মোট তিনজন সদস্য) তবে সরকার গঠন হলেও মন যেন আনন্দ পায়নি তাঁর। ডায়েরিতে সঞ্জয়ের আক্ষেপের সুর –‘১৯০৫ সন থেকে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য কত আন্দোলন, কত ত্যাগ আমরা সবাই করলাম’। আজ যখন জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করার দিন এলো দাঙ্গা আর গুলির আতঙ্ক নিয়ে এল সেদিন। আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই সন্দেহের বিষবাষ্পে ভরা আবহাওয়া।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ
দিনলিপিতে রাজনীতি বিষয়ক পরবর্তী এন্ট্রি পরের বছর ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট, স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগের দিন। 'কাল আমরা স্বাধীন হব, আজ থেকেই ত্রিবর্ণ পতাকার ছড়াছড়ি। লরি বোঝাই লোক হিন্দু মুসলিম এক হোক, ভাই ভাই এক হোক, জয়হিন্দ্ বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে রাস্তায়।' - সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জবানিতে এই ছিল সেদিনের চিত্র। তবে হিন্দু মুসলিমের দাঙ্গা তখনও থামেনি। প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রিসভা যেমন দাঙ্গা থামাতে পারেনি কলকাতায় তেমনি যশোরেও নাজিম সাহেবের লোক সাহরওয়ার্দির লোকেদের বিপদে ফেলে ক্ষমতা দখলের জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে দাঙ্গা বহাল রেখেছিল। এই জটিল পরিস্থিতিকে সাক্ষী রেখে সেদিনই আবার ঘোষিত হল বাউন্ডারি কমিশানের ফলাফল অর্থাৎ নির্ধারিত হল পাকিস্তানের সীমারেখা। ১৪ ই আগস্ট ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক রাত ১২ টা, স্বাধীনতা পেল ভারতবর্ষ। চারিদিকে জয়োল্লাস দেখে গান্ধীজীর মনে হয়েছিল যে, কলকাতার স্বাধীনতা সার্থক, তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অনুভূতিটা কিছুটা অন্যরকম- ‘ কিছুতেই নিজেকে আনন্দিত ভাবতে পারছি না। নিজেকে একা মনে হচ্ছে- একা থাকতে ইচ্ছা করছে- মনটা অসুস্থ’।(২১) কিন্তু অসুস্থ মনের দোহাই দিলেও তাঁর নিরুৎসাহের পেছনে ছিল দেশের চরম বিপদের আশঙ্কা। কখনো বলেছিল – ‘ভয় হয় হয়তো এ মিলন ঠুনকো।’ (২২) আবার কখনো পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার প্রতি আস্থা হারিয়ে জানাচ্ছেন -‘.... উচ্চপদ যাঁর মনুষ্যত্বকে টলাতে পারে না তেমন মানুষকেই ভারত রাষ্ট্রের কর্মী হিসাবে আমরা পেতে চাই, কংগ্রেসের কর্মীরা তেমন মানুষ কিনা আমার সন্দেহ আছে।’(২৩)
‘গান্ধীজী’ : ‘তোমার স্বপ্নের আলো’
এবার রাজনীতি সচেতন এই মানুষটির চোখে দেখা অভিজ্ঞতায় জানা গান্ধীজি সম্পর্কে কিছু কথা বলে এ প্রসঙ্গের ইতি টানব। ১৯৪২-এ অক্ষশক্তির শরিক জাপানের বোমারু বিমানের আক্রমণের ভয়ে কলকাতা ছেড়ে আরও অনেকের মতো সঞ্জয়ও চলে যান নিজের দেশ কুমিল্লায়। ১৯৪৫-এ পরিস্থিতি শান্ত হলে কলকাতায় ফিরে কবি নিজেকে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত করে তোলেন। ১৯৪৫-এর এই যে সঞ্জয়, তিনি এক ভিন্ন মানুষ। আর যার অনুপ্রেরণায় জীবনের এ পরিবর্তন তিনি হলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯৪৫ এর ২রা ডিসেম্বরের পাতায় দেখা যায় জাতির জনকের প্রতি তাঁর মুগ্ধ দৃষ্টি। বোঝা যায় কি ভীষণভাবে তিনি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন মানুষটিতে। এরপর প্রায় ১ বছর (৬ই নভেম্বর ১৯৪৬ পর্যন্ত ) বাপুজী ছিলেন সোদপুরের খাদি প্রতিষ্ঠানে। সোদপুরে থাকার সময় তাঁর অগণিত ভক্ত একটি বার তাকে দেখার জন্য ভিড় করতেন যেমন তেমনি দিনের নানা সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁর সাক্ষাৎকারও নিতে আসত। এই অগণিত ভক্তবৃন্দের মধ্যে একটি যে কবি নিজেই যে ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। গান্ধীজির সঙ্গে দেখা করতে খাদি আশ্রমে যাওয়া ও তার সারাদিনের কাজকর্ম নিখুঁতভাবে লিখে রেখেছিলেন ডায়েরির পাতায় তিনি। - 'কানুজী আমাকে সঙ্গে করে বাপুজীর কাছে নিয়ে চললেন। উবু হয়ে সামান্য তিনটি ফল গান্ধীজীর কাছে তুলে ধরলাম। তিনি হাত বাড়িয়ে তা গ্রহণ করলেন।' (২৪) - সমস্ত ব্যাপারটি যেন একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিল ডায়েরি লেখকের। তার জীবনের আদর্শ যে গান্ধীজি, তাঁর সঙ্গে যে কোনদিনও সাক্ষাৎ হবে, পকেটে থাকা কয়েকটি কমলালেবু ও আপেল তিনি তাঁকে দিতে পারবেন তা কোনদিন ভাবতেও পারিনি তরুণ সঞ্জয়।
দেশের রাজনীতি, দাঙ্গা প্রভৃতি নানা প্রসঙ্গে ডায়েরিতে বারবার এসেছে বাপুজির কথা। আর জীবনের এই আদর্শ গান্ধীজিকে নিয়ে সমস্ত কথার শেষ ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ এর পাতায়। আততায়ীর গুলির আঘাতে এদিন ভারতবর্ষের রাজনীতির প্রাঙ্গণ শূন্য করে বিদায় নিলেন জাতির জনক। খবর শোনা মাত্র বাপুজীর একান্ত এই অনুরাগীর প্রতিক্রিয়া তাঁর নিজের জবানিতেই তুলে ধরা হল-' গান্ধীজিকে হত্যা করা হল। Shot dead? Shot dead? বারবার জিজ্ঞাসা করলাম। মনে হল এবার ভারতবর্ষের সর্বনাশ, মনে হল এ দেশে থেকে আর লাভ কি? একটি মনের মৃত্যু হল। (২৫) সাক্ষাৎকালে চোখের তারার ঘোলাটে নীলাভায় যে মানুষটির মনে বাপুজী বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল বলে ভয় হয়েছিল, ভয় হয়েছিল এই ভেবে যে, গান্ধীজী ছাড়া আর এমন কেউ নেই যিনি বা যাঁরা চল্লিশ কোটি মানুষকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে বাঁচাতে পারবে। জাতির জনকের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ সেই মানুষটির এহেন প্রতিক্রিয়া আমাদের খুব বেশি অবাক করতে পারে না।
তবে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া কি ডায়েরির পাতায় লিখে রাখা এই তিন চারটি লাইন? না কখনো তা নয়, যে মানুষটির নামের সঙ্গে কবি শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার আনন্দ-দুঃখ-বেদনা সমস্ত রকম অভিব্যক্তির প্রকাশ যে কবিতা হবে তা বলাই বাহুল্য। বাপুজীর অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্রই তিনি লিখে ফেললেন একটি কবিতা :
একটি মনের মৃত্যু হল।
যে মন সূর্যের মতো শ্বেত স্বপ্ন দিয়েছিল রাত্রির আকাশে
******
আর সেই মন নেই।
হয়তো এ অরণ্যের, মৃত্তিকার, পৃথিবীরও নেই আর মানে।'(২৬)
(৩০শে জানুয়ারী, রাত্রি ৭টা,১৯৪৮)
তবে এখানেই শেষ নয়, এপ্রিল ১৯৪৮ এর দিনলিপির পাতাটি ঠিক এরূপ-' গান্ধীজী সম্বন্ধে লিখতে হল- লিখেছি চারটি কবিতা, গান্ধীজীকে কবিতার বিষয় ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না আমার। পূর্বাশায় একটি শান্তির অভিবাদনে একটি, দিনেশ মাতৃভূমির জন্য একটি নিয়েছে, একটি ছাপা হয়নি। এখানে লিখে রাখছি।'(২৭)
এরপরই তিনি 'গান্ধীজী' নামক কবিতাটি ডায়েরির পাতায় সম্পূর্ণ লিখে রেখেছেন -
" তোমার স্বপ্নের আলো কতদূর নক্ষত্রের ঘ্রাণ
কতো নীল তোমার আকাশ।"(২৮)
পরবর্তী সময়ে জানা যায় চারটি নয়, গান্ধীজিকে নিয়ে সঞ্জয়ের লেখা কবিতার সংখ্যা পাঁচ। তাঁর সমকালে জীবনানন্দ ও প্রেমেন্দ্র মিত্র গান্ধীজিকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবিতা (মহাত্মা গান্ধী, তিনটি গুলি) লিখেছেন, তাঁর মৃত্যুতে ব্যথিতও হয়েছেন। কিন্তু বামপন্থায় বিশ্বাসী হয়েও সঞ্জয়ের গান্ধী-মুগ্ধতা এঁদের তুলনায় গভীরতর বলেই মনে হয় যেন।
অনুকথন : ‘ভুলিনি সবুজ দিন’
সমাজও রাজনীতি সচেতন এই কবি দেশের যেকোন বিশৃঙ্খল অবস্থা, অসন্তোষ বা দেশের নেতা মন্ত্রীদের বেগতিক চাল সবকিছু নিয়েই তাঁর মত প্রকাশের হাতিয়ার করেছেন লেখনীকে। জন্ম দিয়েছেন একের পর এক কবিতা। কয়েকটি প্রসঙ্গে এখানে বলা যেতে পারে :
(১) আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানায়ক শাহনাওয়াজ কলকাতায় এসে সামান্য বিশৃঙ্খলার কারণে যখন বিপুল জনতাকে হতাশ করে সভা ছেড়ে চলে গেলে হতাশ কবি বাড়ি ফিরে ডায়েরিকে জানান," জাতীয় সেবকদের নিয়ে একটি কবিতা লিখবার ইচ্ছা অনুভব করছি।" এর এই ইচ্ছা থেকেই জন্ম নিল - "একটু সময় দিও, হৃদয়ের খানিক সময়।"(২৯) কবিতাটি। যা ১৯৪৭ এ 'নতুন দিন' পুস্তিকায় '২৬শে জানুয়ারী' নামে প্রকাশ পায়।
১৬ই আগস্ট ১৯৪৬ এ Direct Action Day পালন ও তা নিয়ে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিল আরও একটি কবিতা। দেশের তাবড় নেতাদের কটাক্ষ করে কবি লিখলেন - 'তোমার নীড়ে লাগেনি দোলা/অনেক উঁচুর নীড়/ সেখানে তারার তোরণ তোলা নীল আকাশের ভিড়।'(৩০) --এই কবিতাটি।
সৃষ্টিতে মগ্ন সঞ্জয় ডায়েরির একটি পাতায় নিজের বা দেশের সম্পর্কে কিছু না বলে শুধুমাত্র 'পুরোনো পরিচয়' নামে একটি কবিতা লিখে রেখেছেন। হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত কবি পুরোনো পৃথিবীর 'সবুজ দিনের' এক অপরূপ রূপ একেছেন এ কবিতায়-" ভুলিনি সবুজ দিন - ভুলিনি নরম আলো / আছে মনে পরিচ্ছন্ন প্রভাতের কথা। "(৩১)
তবে সামাজিক এই অসন্তোষ বা অশান্তি সত্ত্বেও রাজনীতি সচেতন এই কবি সঞ্জয় স্বপ্ন দেখেন নতুন পৃথিবী গড়ার। সব গ্লানি ভুলে নতুন করে বাঁচার আশায় আবারও লেখেন :
পৃথিবীর স্বপ্ন আছে,
তার মৃত্যু নাই
জীবনের পরমাণু বেঁচে থাকে তাই। (তারপর) (৩২)
সঞ্জয়ের ডায়েরির সূত্রে এভাবেই সমকালীন ভারতের সমাজ-রাজনীতি ও তাঁর কবিমন আমাদের কাছে আলো-আঁধারের ছবি এঁকে দেয়। যে-অন্ধকারের গায়ে লেগে থাকে অপূর্ণ স্বপ্নের আভা।।
উল্লেখপঞ্জি
১. সঞ্জয় ভট্টাচার্য, 'সঞ্জয় ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা,' কলকাতা ভাববি। ২০০১, পৃ ৫৭
২. সরোজ দত্ত, ' জীবনী ও গ্রন্থপঞ্জী ' কলকাতা। বাগার্থ, ১৯৭২ পৃ ১১
৩. তদেব পৃ ১৩
৪. তদেব
৫. গৌতম বসু (সম্পা), স্মরণী ও সরণি : সঞ্জয় ভট্টাচার্য : কলকাতা, ধানসিড়ি ২০১৭, পৃ ১১
৬. তদেব পৃ ১১
৭. তদেব পৃ ১২
৮ তদেব
৯. তদেব
১০. তদেব
১১. তদেব, পৃ ১৫
১২. তদেব
১৩. তদেব
১৪. তদেব, পৃ ২২
১৫. তদেব, পৃ ২১
১৬. তদেব, পৃ ২৭
১৭. তদেব, পৃ ৩২
১৮. তদেব, পৃ ৪১
১৯. তদেব, পৃ ৪৩
২০. তদেব, পৃ ৫৭
২১. তদেব, পৃ ৫৮
২২. তদেব
২৩. তদেব, পৃ ৫৯
২৪. তদেব, পৃ ১৯
২৫. তদেব, পৃ ৬০
২৬. তদেব, পৃ ৬১
২৭."
২৮. তদেব
২৯. তদেব, পৃ ২৭
৩০. তদেব, পৃ ৪২
৩১. তদেব, পৃ ৪৮
৩২. সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা', কলকাতা, ভারবি, ২০০১, পৃ ৬৯
টীকা
নজিম সাহেব : স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪) ঢাকার নবাব বংশোদ্ভুত এবং ইংল্যান্ড ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলিম লীগের অতি রক্ষণশীল নেতা। এ. কে. ফজলুল হকের পর নাজিমুদ্দিন অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। দেশভাগের পর স্বাধীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির গুপ্ত হত্যার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
শরৎ বাবু : শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) পেশায় ব্যারিস্টার এবং জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতা। তাঁর আরো একটি পরিচয় তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ।
সোহরওয়ার্দি : হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দি (১৮৯২-১৯৬৩) অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী।
ট্রটস্কি (১৮৭৯-১৯৪০) : লিওন ট্রটস্কি ছিলেন একজন কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক এবং রুশ বিপ্লবের অন্যতম নেতা, কমরেড লেনিনের ভাবশিষ্য। লাল ফৌজ গঠনে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিলো। লেনিনের আমলে তিনি সোভিয়েত কমিশনারের দায়িত্ব সামলান। যদিও পরবর্তীকালে স্তালিনের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয়, মেক্সিকোতে তিনি আশ্রয় নেন। স্তালিন রাশিয়ার সর্বময় কর্তা হয়ে বসে। তাঁর হত্যার পিছনেও স্তালিনের ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে করা হয়। স্তালিন তাঁর ক্ষমতা লাভের পথ যেমন নিষ্কণ্টক রাখতে চেয়েছিলেন, তেমনই ট্রটস্কিপন্থীদের প্রায় নির্মূল করতেও পেরেছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন