মা তুমি আনন্দময়ী নাকি!
মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরি ছন্নছাড়া পাগল একটা।
খুব কাছে থেকে, মাঝামাঝি খুব দূর থেকে
আরতির উচ্চরোলে বা কখনো দুপুরের, দুপুর রাতের
মুহূর্তে নির্জন, নিরীক্ষণ করি মুখ। ওই মুখ
একই মুখ মা তোমার
মা তুমি আনন্দময়ী নাকি?
তাহলে এ ফুল দাও— ফুল পড়ে যায়
তাহলে এ সুখ নাও— সুখ ঝরে যায়
তাহলে এ আলো নাও — আলো নিভে যায়।
মা তুমি আনন্দময়ী তাই বুঝি মাটি রক্তে রাঙা
মা তুমি আনন্দময়ী তাই বুঝি পরিত্যক্ত ভাঙা
সব ঘর, প্রিয় মানুষেরা চিহ্নহীন !
মা তুমি আনন্দময়ী তাই সব ধূসর মলিন কাঙালিনী
ভিখারিনী অপমানে শোকে, চলেছে আনন্দলোকে
সারি বেঁধে পিঁপড়ের মতো মাটিতে আনত চোখ রেখে—
শুধু একজন থাকে বাকি।
সে শুধু মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে ছোটে—
মা তুমি আনন্দময়ী, মা তুমি আনন্দময়ী নাকি! (আনন্দময়ীর আগমনে, সুধেন্দু মল্লিক)
শাক্তকবি যখন গান করেন, ‘মা আমার আনন্দময়ী, আমি নিরানন্দে যাব কেনে’ তখন তার ভিতরে সংশয় ও বিশ্বাস দুই-ই ধ্বনিত হয়। শেষ পর্যন্ত শাক্তকবি মাতৃচরণতীর্থে আশ্রয় নেন। কিন্তু আধুনিক কালে এমন প্রত্যয়ভূমি কোথায়? রবীন্দ্রনাথ যখন দুর্গাপূজায় দেশব্যাপী মানুষের উচ্ছ্বাস, আনন্দ দেখেন, তখন তিনিও টের পান এই আনন্দ নিরঙ্কুশ নয়। তাই আনন্দময়ীর আগমনের উন্মাদনার মধ্যেও দেখেন, ‘ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।' অন্নবস্ত্রাভাবে যে নিরানন্দময়ী। যদি মা আনন্দময়ী সকলকে সত্যই সুখ-শান্তি-সচ্ছলতা দিতে পারতেন, তবে তাঁর ‘আনন্দময়ী’ নাম সার্থক হত। মরপৃথিবীতে মানুষ বড়ো দুঃখ জেনেছে, শুধু সুখ ও আনন্দে থাকা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের জন্য বরাদ্দ। বাকিরা অনাদৃত, উদ্বৃত্ত। পরাধীন ভারতবর্ষে দেশব্রতী বীর যুবকেরা যখন লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হয়, তখন কাজী নজরুল ইসলামও প্রতিকার চান এই মায়ের কাছে। বলেন, ‘ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’ অর্থাৎ আনন্দময়ী মা-কে ভালোবেসেও এই শূন্যতা ঘোচে না; আনন্দ অধরা থেকে যায়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, যদি এভাবেই বলি তো খুব অযৌক্তিক কথা হবে না। অষ্টাদশ শতক থেকে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত আমরা দেখেছি বাঙালি কবিরা শুধু ভক্তের চোখে নয়, সামাজিক বীক্ষায় মা আনন্দময়ীর আগমনের তাৎপর্য খুঁজেছেন। ঈষৎ বিস্মিত কবি সুধেন্দু মল্লিক (যিনি পঞ্চাশের কবি ও কুমুদরঞ্জন-পৌত্র) সেই মা আনন্দময়ীকে নিয়ে ভেবেছেন ও লিখেছেন। তাঁর “শুধু শব্দ, শুধু অপেক্ষা” কাব্যের (১৯৯৫) একটি কবিতার নাম ‘আনন্দময়ীর আগমনে'। দুটি স্তবকে বিন্যস্ত এই মিশ্ররীতির কবিতায় (যেহেতু গদ্যভঙ্গি নিয়েও মাঝে মাঝে মিত্রাক্ষর দিয়েছেন) কবি শুরুতেই বলেছেন, ‘মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরি ছন্নছাড়া পাগল একটা।’ এই ‘পাগল’ শব্দে বাঁধন ছেঁড়ার আভাস আছে; আছে স্বতন্ত্র হওয়ার চিহ্ন। ভিড়ের ভিতরেও একটা পাগল কীভাবে ‘স্বভাবত স্বতন্ত্র’ হয়ে যায়, সকলেরই জানা।
প্রথম স্তবকে কবি জানান, সবাই যখন মাতৃভাবে ও বন্দনায় মগ্ন, তখন সেই পাগল (অর্থাৎ কবি) নির্জন একক হয়ে যায়। দুপুরে বা রাতের ‘মুহূর্তে নির্জন, নিরীক্ষণ করি মুখ’। পূজার ছলে ধূপের ধোঁয়ায়, মন্ত্ররোলে ভুলে থাকা নয়। নিজেকে প্রদর্শন করাও নয়। নিভৃতে শুধু মুখোমুখি হওয়ার তন্ময়তা। তারপর তদ্গত হয়ে অঞ্জলি দান, কিন্তু এ কী? — ফুল পড়ে যায়; সুখ ঝরে যায়; আলো নিভে যায়! উৎসবমুখরা ‘মা তুমি আনন্দময়ী নাকি’? প্রশ্ন ও সংশয় জাগে। কেন তবে এমন অবসান আর অন্ধকার? মা আনন্দময়ীর এ কেমন অবিচার?
দ্বিতীয় স্তবকে কবি দেখেন, দেশ জুড়ে কোথাও শান্তি ও কল্যাণ নেই। ‘মা যার আনন্দময়ী’ তাকেই নিরানন্দে থাকতে হয়। দেখতে হয় ‘মাটি রক্তে রাঙা’। ভিটেমাটি-ঘরদোর ভাঙা। আর বিপুল শূন্যতা ও শোক— ‘প্রিয় মানুষেরা চিহ্নহীন।' দুঃখ, শ্লেষ জেগে ওঠে ‘বিশ্বাসপরায়ণ নাস্তিক’ কবির ওষ্ঠে, ‘মা তুমি আনন্দময়ী, তাই সব ধূসর মলিন কাঙালিনী / ভিখারিনী অপমানে শোকে, চলেছে আনন্দলোকে।' সত্যি কি আনন্দলোক, মঙ্গলালোকে যাওয়া যায় আর? এই রক্তাক্ত শতকে আস্থা রাখা যায় কারো প্রতি? মা কি বোঝেন সন্তানের যন্ত্রণা? আঠারো শতক থেকে একুশ শতকের দ্বারপ্রান্তে ধ্বনিত হয় আর্ত জিজ্ঞাসা— ‘মা তুমি আনন্দময়ী নাকি?’ উত্তর মেলে না।।
ঋণস্বীকার :
কবিতা মঞ্জুষা, সুধেন্দু মল্লিক, সারঙ্গ প্রকাশনী, জানুয়ারি ২০২৩
কবি সুধেন্দু মল্লিক : এক পতিত পৌত্তলিক, তরুণ মুখোপাধ্যায়, ভাষা ও সাহিত্য, ২০১০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন