সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

এসেছো কবিতা

গল্পের বই পড়া নিয়ে শিক্ষকদের পরামর্শও ছিল। মনে আছে কাজলদি বলেছিলেন জেন অস্টেনেরএম্মাআর এমিল জোলা-নানাপড়তে।এম্মাএক অদ্ভুত কাহিনি। বুদ্ধিমতী চৌকস মেয়ে এম্মা মনে করে যে সে সবকিছুই বেশ বুঝেসুঝে করতে পারে, সে অন্যের সমস্যা সমাধানে সর্বদা ব্যস্ত। কিন্তু নিজের মনের খবরটিই তার কাছে অজানা। কাকে সে ভালবাসে সেই কথাটাই সে জানেনা। পড়ে মনে হয়েছিল মানুষ নিজেকে কত কম জানে, কত কম বুঝতে পারে। তখনই মনে হয়েছিল যে নিজেকে বোঝার চেষ্টা, জানার চেষ্টা করতে হবে। মনে আছেনানাপড়ে সেইবয়সে সে কি বিচিত্র অনুভূতি। শরীরের আকর্ষণ কি, মানুষের নিম্ন প্রবৃত্তিগুলো্র লাগাম ছেড়ে দিলে সেগুলো মানুষকে কতদূর নিচে টেনে আনতে পারে সে তো বিশেষ করে এমিল জোলা পড়েই জানলাম। এসব আমাদের দেশে যতদূর সম্ভব চোখের আড়ালে রেখে দেওয়া হয়, এত কঠোর সত্য আমাদের দেশের সাহিত্যে খুব কম ক্ষেত্রেই এমনভাবে সামনে আসে। রবীন্দ্র-বঙ্কিম-শরতের উপন্যাসে মানুষের মনের এমন অন্ধকার দিক, প্রবৃত্তির তাড়না, এমন রূঢ় সত্য হয়ে দেখা দেয় না। নগেন্দ্র শেষপর্যন্ত মানুষ, এমনকি ভদ্রলোক থেকে যান, পশু হন না। মহেন্দ্র-বিনোদিনীর সম্পর্কের অন্ধকার দিকটুকুর উপর রবীন্দ্রনাথ তো পুরোপুরিই পর্দা টেনে রেখেছেন। মানুষের অন্তরের অন্ধকারটুকু তিনি সাহিত্যে প্রকাশ করতে চাননি, সে যে কারণেই হোক। কেবল অনেক পরিণত বয়সে তাঁর ছবিতে ধরা দিয়েছে সে অন্ধকার। নানা- মতো নারী আমাদের সাহিত্যে কোথায়? বিনোদিনী-চন্দ্রমুখীরাই তো আমাদের কল্পনাজগৎ অধিকার করে আছে। পরে অবশ্য দেখেছি বাংলা সাহিত্যেও সামান্য কিছু ছোটগল্পে মানবচরিত্রের অন্ধকার দিক প্রকাশ পেয়েছে। এমিল জোলার অন্যান্য অনেক উপন্যাসও পড়ে ফেললাম। তার সঙ্গেই এলেন বালজ্যাক। এঁদের উপন্যাসে মানবমনের মানুষের ব্যবহারের কড়া বাস্তব বিশ্লেষণ আমার কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। আজ মনে হয় এঁদের কিছু ছাপ আমার লেখায় পড়েছে নিশ্চয়ই, কারণ তা না হলে আমার লেখার আলোচনায় অনেকেই কেন বলবেন যে আমার কবিতায় জীবনের অন্ধকার দিক বড় বেশি তুলে প্রকট? আবার অন্য দিক থেকেও কথাটা ভাবা যায়। মানুষের চরিত্রের বিপরীত দিকের সঙ্গে খুব ছেলেবেলা থেকে অত্যন্ত গভীর পরিচয় হয়েছিল বলেই হয়তো এইসব লেখা আমাকে এত গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল। 


কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। সাহিত্য তো ছিলই কিন্তু তার সঙ্গে তালগোল পাকিয়ে গেল আরও অনেক কিছু। ফ্রয়েড তো তখন কলেজের ছাত্র ছাত্রীর অবশ্যপাঠ্য ছিল। আমার সেই প্রথম নিজের ভেতরে তাকানো, নিজেকে চেনার শুরু। তারই সঙ্গে মনস্তত্বের আরও অন্যসব বইতে আগ্রহ। পরে এম, পাশ করার পর কিছুদিন চাকরি না পেয়ে বাড়িতে বসে থাকবার সময় অস্বাভাবিক মনস্তত্বের উপরেও দু-চারটি বই পড়ে ফেলেছিলাম উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে। এর সঙ্গে যোগ হল অন্য এক মারাত্মক নেশা। দর্শন। এখন বুঝি সেই বয়সে কি দারুণ বদহজম হয়েছিল দর্শনের তত্বের  যে দুচারটি বই পড়েছিলাম তার। মনে আছে আমার সেই অল্পবয়সের পাকামি ইংরাজি সাহিত্যের আলোচনায় এতই ছাপ ফেলেছিল যে কাজলদি একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার পাস সাবজেক্ট ফিলসফি কিনা। আসলে বাড়ির অস্বাভাবিক শাসনে আমার একমাত্র আনন্দের জায়গা, মুক্তির জায়গা ছিল জ্ঞানের জগৎ। বিভিন্ন দার্শনিকের নানা ধরণের চিন্তার মধ্যে ঢুকতে পারলে বোঝা যায় মানুষের মন কত বিচিত্রভাবে পৃথিবীকে, মানবজীবন জগৎকে দেখতে পারে, বিশ্লেষণ করতে পারে। দর্শনের মধ্যেই যে খুঁজে পাওয়া যায় মানবমনের সীমাহীন মুক্তির ছবি। তখন শুধু গোগ্রাসে গিলেছি, কতটা বুঝছি কি বুঝছি না তাও ভাবিনি। মনের আনন্দে পড়ে গেছি, কেন পড়ছি সে প্রশ্নই মনে জাগেনি। কিন্তু আজ ফিরে দেখতে বসে বুঝতে পারছি কেন সেই কলেজে পড়া অপরিণত মনের মেয়েটি নিজস্ব বিষয় নয় জেনেও নেহাৎ ভালোবেসে দর্শনের বইগুলো ঘাঁটতো।


ব্যাপারটার পিছনে কারণ কি তা ঠিক জানা নেই কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি যারা পড়তে আসত তারা যেন ঠিক বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়ে ছিল না। বাংলা মিডিয়ামে পড়া মেয়ে কেবল আমিই ছিলাম, অন্যেরা সব নাম করা কনভেন্টে পড়া। বন্ধুরা সবাই অনেক বেশি বড়লোকের মেয়ে, তাদের সাজগোজ অন্যরকম, তাদের পয়সা খরচ করার ক্ষমতা অন্য মাপের। আমাদের বাড়ির সামর্থ্য কম ছিলনা, কিন্তু আমাকে এসব দেওয়া হত না। কেবল তাই নয়, নিজের শাড়ি-ব্লাউজ নিজের হাতে ইস্তিরি করতে গেলেও মা খুব বকাবকি করতেন। যেকোনও মানুষের পরিণত ব্যবহারের উপর তার অল্পবয়সের বেড়ে ওঠার দিনগুলোর ছাপ থাকেই। আমার ধারণা কলেজে অত বিচ্ছিরিভাবে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল বলেই আজও আমি এই বয়সেও বেশভূষার পারিপাট্য এতই ভালবাসি। কফি হাউসে গেলে অথবা কোনও ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে কলেজ ছাড়িয়ে দেওয়া হবে বলা হয়েছিল। তাই সবার সঙ্গে মেশা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু পড়াশুনা বেশি করতাম, আমার রেজাল্ট ভালো ছিল, আর আমার বন্ধুরা মন থেকে ছিল পরিষ্কার, তাই তাদের মধ্যেও পরে এমন বন্ধু হল যারা আমার কদর করত। মনে আছে আমি কফিহাউসে যেতে পারব না বলে ওরা দিনের পর দিন  স্যান্ডউইচ কিনে এনে কলেজের মাঠে বসে খেত। 


কলেজে গিয়ে জ্ঞানের জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমি অন্য এক দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিলাম। দিনে দিনে আমি অন্য একটা মেয়ে হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু বাড়িতে আমার এই মনের জগতের খবর কেউ রাখতে রাজি নয়, সেখানে একটাই কথা, ছেলের জন্য পড়াশুনা, মেয়ের জন্য বিয়ে। আমার সামনেই গুরুজনেরা আলোচনা করতেন, মেয়ে এত পড়াশুনায় ভালো হয়ে কি লাভ? ছেলেটা এমন ভালো হলে কত পড়াশুনা করতে পারত, তাকে বিদেশে পাঠানো হত। মেয়ের তো বিয়েই হয়ে যাবে। কলেজে পড়বার সময় কোনওভাবে বিয়েটা রোখা গেল, কিন্তু এম, পরীক্ষার আগেই বিয়ে করতে বাধ্য হলাম মায়ের প্রচন্ড চাপে। 

 

ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন