সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"

শাক্ত পদাবলী  একালের পাঠক 

প্রেম-বিরহের সন্দীপন নেই কিংবা শরীরী উন্মাদনা, আছে কেবল বিবাহিতা কন্যাকে কেন্দ্র করে বাবা-মায়ের উদ্বেগ, সাংসারিক জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা আর ভক্তের মাতৃপ্রীতিতাহলে একুশ শতকের পাঠক কোন গুণে শাক্ত পদাবলীকে গ্রহণ করবে? আগমনী-বিজয়ার ভিতরে যে বাঙালি ঘরের চিরকালীন ছবি তাকে অস্বীকার করা যায় না যেমন, তেমনি ভক্তের আকূতিতে দুঃখের ভাষাচিত্রও যথেষ্ট মুন্সিয়ানায় রচিত। তবু বৈষ্ণব পদাবলীর মতো সার্বজনীন আবেদন কই? রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত কিংবা দাশরথি রায় কি চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-জ্ঞানদাস-গোবিন্দ দাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই? অবশ্যই। একালের ভাষায় বললে, বৈষ্ণব পদাবলীগান চিরকালের সুপারহিট। জ্ঞানদাসের সেই বিখ্যাত উচ্চারণে তো চিরকালীন প্রেমের চিত্র : 

রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর

প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে

পরান পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে। 

কিংবা চণ্ডীদাস যখন লেখেনঅকথন বেয়াধি কহন না যায়’, তারই পাশে মিলিয়ে পড়ি একালের শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরভালোবাসা তার কাছে ক্রমাগত ভীষণ অসুখ বিদ্যাপতিরমাথুর’-এর বিরহ-যন্ত্রণা তুলনাহীন। অথচ অষ্টাদশ শতকের শাক্ত পদাবলী সাহিত্যের ছাত্র-ছাত্রী বা গবেষক ছাড়া সেই পাঠযোগ্যতা পায় না। তবু ওরই মাঝে পান্নালাল ভট্টাচার্যের কণ্ঠে উন্মনা করে তোলে: ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়কিংবামায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন’, ‘আমার সাধ না মিটিল, আশা না পূরিলইত্যাদি নির্বাচিত কিছু গান। সেই গানের শ্রোতাও বেশ কম, তাছাড়া ওই ভক্তি আর বৈরাগ্যবোধ এই ভোগবাদী বিশ্বে যথেষ্ট দুর্লভ। বরং শাড়ির বিজ্ঞাপনেবসন পর মাগানটিকে চমকপ্রদভাবে ব্যবহার করা কিংবা মোবাইলে অনলাইন পুষ্পাঞ্জলিতেই এই সাইবার দুনিয়া অভ্যস্ত। 

২।।

বাংলা অনার্সের পর অষ্টাদশ শতকের ইতিহাস পড়া পড়ানো ছাড়া আলাদা করে আমাকেও শাক্ত পদাবলী চর্চা করতে হয় নি। কাব্যমূল্য বা সাহিত্যমূল্য বলতে প্রশ্নোত্তরে যা বোঝাতো তার সমর্থনে রবীন্দ্রনাথেরলোকসাহিত্যআর দীনেশচন্দ্র সেন-এরবঙ্গভাষা সাহিত্য’-কে হাজির করলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে যে-কয়েকটি স্মরণীয় উক্তি মনে পড়ছে, তা এইরকম :

] আশ্বিন মাসে ঝরা শিউলিফুলের মত এই যে মাতৃমিলনের প্রত্যাশায় বালিকা বধূদের চক্ষুজল দিনরাত্রি ঝরিত, এই সকল আগমনী গান সেই সকল অশ্রুর দ্বারা রচিত হার, উহা তৎকালিক বঙ্গজীবনের জীবন্ত বিচ্ছেদরসে পুষ্ট। (দীনেশচন্দ্র সেন)

] শাক্তকবিরা দুঃখকে ভাঙাইয়া ভক্তির স্বর্ণমুদ্রা গড়াইয়াছেন। ()

] আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তর্বেদনা আছেমেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেইজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল করুণ দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। সেই সকরুণ কাতর স্নেহ বাংলার শারদোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ, ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া লইয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ইহা বাঙালির অম্বিকাপূজা এবং বাঙালির কন্যাপূজাও বটে। আগমনী এবং বিজয়া বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।  (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


শাক্ত পদাবলীর এই সার্বজনীনতা আমরা মেনে নিই। কিন্তু সে তো পর্যন্তই। তারপর? এছাড়া শশিভূষণ দাশগুপ্তেরভারতের শক্তিসাধনা শাক্ত সাহিত্যপাঠে আমরা অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ তথ্য, তত্ত্ব ব্যাখ্যার সন্ধান পাব। রয়েছে জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী, অরুণকুমার বসু, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্যের গুরুত্বপূর্ণ বইগুলি। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত-কে নিয়েও কিছু গ্রন্থাবলী আছে। একাধিক সাহিত্যের ইতিহাস তো রয়েছেই। বৈষ্ণব-শাক্ত এই দুই মতের বিরোধিতার প্রকাশ এবং সমন্বয়ের ছবি এই সব পদাবলীতে ফুটে উঠেছে। আজু গোঁসাই এবং রামপ্রসাদের বিরোধের কাহিনি আমরা সবাই জানি। রামপ্রসাদের এই পদটি স্মরণ করতে পারা যায়, 

যশোদা নাচাত গো মা বলে নীলমণি

সে বেশ লুকালে কোথা করালবদনী

একবার নাচো গো শ্যামা

হাসি বাঁশি মিশাইয়ে মুণ্ডমালা ছেড়ে বনমালা পরে... 

লক্ষণীয়, পুরুষ-দেবতার প্রাধান্য থেকে অষ্টাদশ শতকে মাতৃপ্রতিমার প্রতি এই আসক্তির পিছনে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট কাজ করেছিল। শ্যামের মোহন মূর্তির বদলে ক্রমশ অসহায়, নিরন্ন বাংলায় বরাভয়দাত্রী কালিকামূর্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। মনে রাখা প্রয়োজন, এই অষ্টাদশ শতকেই ঘটেছিল ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৭৬৫-এর দেওয়ানী লাভ এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের মতো ঘটনা। যতই ভক্তিমার্গের পথিক হোন না কেন, শাক্ত-কবিদের কলম এই অস্থিরতাপূর্ণ সামাজিক প্রেক্ষাপটের প্রতি উদাসীন হতে পারেনি।  তারা/দুর্গা/উমা/কালীযে রূপেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, নারীশক্তির উদ্বোধন শাক্তপদাবলীর প্রধান সুর।  অভিযোগ, প্রতিবাদ, ক্ষোভ সবই মাতৃপদমূলে নিবেদিত হয়েছিল। কমলাকান্তের এই রূপকাত্মক পদটি -প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য :

শুকনো তরু মুঞ্জরে না ভয় লাগে মা ভাঙে পাছে

পবন-বলে সদাই দোলে প্রাণ কাঁপে মা থাকতে গাছে।

বড়ো আশা ছিল মনে ফল পাব মা এই তরুতে

মুঞ্জরে না শুকায় শাখা ছটা আগুন বিগুণ আছে।

কমলাকান্তের কাছে ইহার একটি উপায় আছে

জন্ম-জরা-মৃত্যুহরা তারা নামে ছেঁচলে বাঁচে। 

এছাড়াও শাক্ত পদাবলীতে সমাজচিত্রের সঙ্গে যোগসাধনা তন্ত্রোক্ত মাতৃবন্দনার গূঢ় তাৎপর্য  নিহিত রয়েছে, একথা আমরা জানি। কখনো তার সঙ্গে মিশেছে লোকায়ত সাধনার ধারা। এককথায় সর্বধর্মসমন্বয়ের একটা চিত্র পাওয়া যায়। 


৩।।

বাৎসল্যরস আর প্রতিবাৎসল্যএই দুই নিয়ে শাক্তপদাবলী বাংলা সাহিত্য নিজস্বতা বজায় রেখেছে। লীলাসঙ্গীত সাধনসঙ্গীতের যে তফাৎ আমরা জানি, সেখানে উমা-মেনকা-গিরিরাজ-কে নিয়ে তৈরী হওয়া লীলাগুলিই বেশি আকর্ষণীয়। সাহিত্যমূল্য বিচারের ক্ষেত্রে যে ছন্দ-অলংকার আর ভাষিক বৈশিষ্ট্য খোঁজা হয়, তার নিরিখে দেখলে বৈষ্ণবপদাবলী পাঠ্যমূল্য শাক্তগীতির নেই। কারণ এগুলি মূলত গান হিসেবেই রচিত গীত। কিন্তু একালের পাঠকের কাছে পারিবারিক চিত্র এবং দুঃখ-যন্ত্রণার কথা অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ার কথা নয়। যোগ্যের বঞ্চনা আর অযোগ্যের স্বীকৃতির যে অভিজ্ঞতা একালে আমরা পাই, সেকালেও রামপ্রসাদ-কে গান বাঁধতে হয় : ‘ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণ পান্তি তারে দিলে মা জমিদারী দুঃখের ডিক্রী জারির যে অনুযোগ ফুটে ওঠে শাক্তগানে তাও তো বাস্তব চিত্র। তবে একথাও  সত্য, সাধনসঙ্গীতগুলির নিহিত বক্তব্য অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এরপাশে লীলাসঙ্গীতের মধ্যে যে ঘরোয়া ছবিটি প্রধান হয়ে ওঠে, সেখানেও নিহিত তাৎপর্য আড়ালে থেকে যায়। বিশেষত, রামপ্রসাদের পদে। শিশু উমার বড়ো হওয়া থেকে বিবাহ এবং কুলীন স্বামীর ঘর করার সমস্যা, বাবার দারিদ্র্য-উদাসীনতা এবং সর্বোপরি মা মেয়ের পারস্পরিক আকুলতা হৃদয়গ্রাহী, সন্দেহ নেই। শ্রদ্ধেয় শশিভূষণ দাশগুপ্ত মেনকার স্বপ্নদর্শন যশোদার স্বপ্নদর্শনের তুলনা টানলেও, মেনকাকে আমাদের অনেক প্রাণবন্ত মনে হয়। শারদপ্রাতেশেফালিকা এল উমার বর্ণ মাখিএই কবি কল্পনার তুলনা মেলা ভার। বাঙালি ঘরে বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার এই চিত্র চিরকালীন। গোবিন্দ চৌধুরীরগিরি, গৌরী আমার এল কৈএমনই এক বেদনা-বিধুর গার্হস্থ্য-নাটক রচনা করে। 


৪।।

রূপক বা অ্যালেগোরির গুরুত্ব এই, সেখানে যা বলতে চাওয়া হয় তাকে আড়ালে রাখার জন্য একটা আবরণের ব্যবহার করা হয়। শাক্তগীতিতেও এমন অসংখ্য রূপকের ব্যবহার করা হয়েছে। তবিলদারি, মামলা-মোকদ্দমা, কুয়োর ঘড়া, কুয়ো, ঘুড়ি ওড়ানো, কাপড় কাচা, নৌকা, মদ তৈরি, দাবা খেলা, ডুবুরি ইত্যাদি বিচিত্র রূপক। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

] মন রে কৃষি-কাজ জান না।

এমন মানব-জমিন রইল পতিত

আবাদ করলে ফলত সোনা।

] ষড় রিপু হল কোদণ্ডস্বরূপ

পুণ্যক্ষেত্র মাঝে কাটিলাম কূপ।

] শ্যামা মা উড়াচ্ছে ঘুড়ি, ভব-সংসার-বাজারের মাঝে।

] আয় মন বেড়াতে যাবি।

কালী কল্পতরু তলে গিয়া চারি ফল কুড়ায়ে পাবি।

] আমায় দেও মা তবিলদারী,

আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।

] মা আমায় ঘুরাবে কত চোখ ঢাকা কলুর বলদের মত।   ইত্যাদি

অধিকাংশ আলোচক এইসব উদাহরণগুলি উদ্ধৃতি হিসেবে চয়ন করে সাহিত্যমূল্য খুঁজে বের করতে চান। অলংকার বা সাহিত্যিক উপাদান হিসেবে এগুলির গুরুত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু আধুনিক পাঠক এর দ্বারা কতটা আলোড়িত হবেন, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে আধুনিক কবিতায় এই শাক্ত-সুরের উত্তরাধিকার বর্তেছে। যেমন, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল কিংবা রঞ্জিত সিংহের কবিতা (ঋণ স্বীকার : আমার প্রেসিডেন্সিবেলার প্রয়াত অধ্যাপক অনন্ত সাহা) কয়েকটি উদাহরণ : 

] তোমার রক্তবর্ণ আনন ফেরাও, হে দারুণা

 তুমি খড়্গ তোল

 অস্ত্র উপাচারে তুমি পূজা করো রোগগ্রস্ত মানুষের। (দেবী / পার্থপ্রতিম)

]  জন্মে জন্মে এমন ডাকাত হইবেন মা স্মরণে রেখো

 পরজন্মে ডাকাত সেজে জগদ্ধাত্রী দেখার ইচ্ছে

আবার জল কশার বনে।  (ইষ্ট দর্শন / রঞ্জিত)

] হও কালী হও প্রখরা / চাই না শরীর বখরা / আমি শব (স্তোত্র / তরুণ মুখোপাধ্যায় / সূত্র : বাজবে গো মহেশের বুকে)

এইসব কবিতায় আধুনিক যুগের যন্ত্রণা অপ্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে দেবীবন্দনা পুনরায় একটা আশ্রয়ের মতো হয়ে ওঠে। বরাভয় খোঁজে কবিমন। কোনোটি বা সৃষ্টি ধ্বংস-কে এনে প্রেমের কবিতা লেখা হয়। আবার অরুণকুমার সরকারেরঅঙ্গে আমারকবিতায় বৈষ্ণবপদাবলী আর শাক্তগীতি মিশে গিয়ে চমৎকার রোমান্টিক লিরিক নির্মাণ করেছে :

অঙ্গে আমার যৌবনভার

কত আর আমি বইতে পারি।

নিজ তনু আধা গুণবতী রাধা

আপনি পুরুষ আপনি নারী।  


স্বপ্নগমনে আত্মরমণে

তৃপ্তি সোনার পাথরবাটি।

জ্বলে দীপাবলী নগরে নগরে

আমি যে তিমিরে সাঁতার কাটি।।  [উৎস : ‘কালী হলি মা আমার রাসবিহারীরামপ্রসাদের পদ।]

এইসব দৃষ্টান্তগুলি দেওয়ার কারণ আধুনিক মানসে শাক্তগীতির প্রভাব-কে বুঝিয়ে দেওয়া। শাক্তগীতিতে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা এবং অস্তিত্বের সংকট থাকলেও আমরা পাই মাতৃনামের বারিসিঞ্চনে অপার শান্তির সন্ধান। মার্ক্সবাদী পাঠক যদিও একে ধর্মের আফিমে দুঃখকে হালকা করার অপচেষ্টা ভাবতে পারেন। কিন্তু তত্ত্বের বিতণ্ডায় না গিয়ে আমরা এটুকু বুঝতে পারি, শাক্তগীতির মহিমা উপলব্ধি করতে হলে শ্যামাসংগীত শোনাটা বিশেষ জরুরি। এই সুরের ভিতরে এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না / পৃথিবী ভালো বাসিতে জানে না / যেথা আছে যত ভালোবাসা বাসি / সেথা যেতে মন চায় মা’ – এই কথাগুলি সুরে সুরে শোনার মন যদি কারো থাকে তার স্বভাবের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন আসতে বাধ্য। কিন্তু শোনে কতজন, আর শুনলেও ভালো লাগে কাদের, সেটাও একটা সমস্যা! এখন এসব গান নিছকই বয়স্কদের বৈরাগ্যের গান বলেই বিবেচিত এবং কথা সুরের বৈচিত্র্য না থাকা শাক্তগীতির ত্রুটি বলে গণ্য হয়। 


৫।।

শাক্ত পদাবলী সম্পর্কে আলোচনার শেষ কথা বলতে গেলে এই প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে, আধুনিক মানুষ যেখানে মূলত এক নিরীশ্বর ভুবনের বাসিন্দা, ঈশ্বর শিল্পিত অস্তিত্ব নিয়েই সেখানে বিরাজমান। এই প্রেক্ষিতে, শাক্তগানে আগমনী-বিজয়ার গার্হস্থ্য নাটকের একটাট্র্যাডিশনাল ভ্যালুনিশ্চয় আছে, কিন্তু গতিশীল কমিউনিকেশনের যুগে বিশ্ব এখন ভুবনগ্রাম। বাবা-মার সঙ্গে বিবাহিত প্রবাসী মেয়ের ভিডিও চ্যাট বদলে দিচ্ছে দূরত্বের সংজ্ঞা। এছাড়া চিঠির জায়গায় অনেক দিন আগেই এসে গেছে টেলিফোন আর ইদানীং মোবাইল। যদিও পতিগৃহ পিত্রালয়ের আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে বৈষম্য এখনও রয়েছে, বিবাহোত্তর জীবনে পারিবারিক জট গুলোও পাল্টায়নি তেমন। অষ্টাদশ শতকের চিত্র গ্রামীণ জীবনে অংশত সত্য হলেও, নাগরিক পরিবেশে অনেকটা কম। অন্যদিকে উপাস্যতত্ত্বের পদ তথা ভক্তের আকূতি, মনোদীক্ষা ইত্যাদির গুরুত্ব অনেকাংশে ঐতিহাসিক। তাছাড়া আজকের তত্ত্ববিশ্বে উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম শর্তই হল উৎসে ফেরা, সেখানে শাক্তগান অন্যঅ্যাকাডেমিক মাত্রাপেয়ে যায়। তবু যখন শাক্তকবিরা গেয়ে ওঠেন :

চাই মা আমি বড় তে।

আমি আর পারি না থাকতে বাঁধা আমার অহং-শৃঙ্খলেতে... 

কিংবা

দিন দুই তিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে

সেই কর্তারে দেবে ঠেলে কালাকালের কর্তা এলে...  

তখন নিহিত তত্ত্বকথা যাই হোক, আপাত অর্থের চূড়ান্ত সত্যটি এই আত্মসর্বস্ব, ক্ষমতাপ্রিয়, ভোগবাদী দুনিয়ায় ভেবে দেখা একান্ত জরুরি। শাক্তপদের এই সরল সত্যগুলি আজও পুরনো হওয়ার নয়, প্রকাশভঙ্গি যতই সেকেলে হোক না কেন! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন