রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

 

এসেছো কবিতা

কলেজে ওঠার পর অন্য এক ব্যক্তিগত সমস্যা খাড়া হল। স্কুলের বন্ধুরা উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েতাদের সবারই বাঙালি কালচার। প্রেসিডেন্সিতে যারা পড়ত তাদের মধ্যে কেবল কিছু বাংলা আর দর্শনের ছেলেমেয়ে ছাড়া প্রায় সকলেই ছিল 

আমরা যাকে বলি ট্যাঁশ কালচার বা ফিরিঙ্গি কালচার, সেই দলের। তাদের চলা ফেরা কথাবার্তাআচার-ব্যবহারসাজগোজসব এতই আলাদা যে আমি একেবারে অথৈ জলে পড়লাম। এর উপরে ছিল বাড়ির শাসন। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলা যাবে নাকফি-হাউসে যাওয়া যাবে নাবন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়া যাবে নাইত্যাদি। মেয়ে পরীক্ষায় বাড়াবাড়ি রকম ভালো ফল করাতে তাকে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে কো-এড কলেজে পড়তে পাঠিয়ে বাবা-মার মনে শান্তি ছিল না একটুও। কলেজে এসে তাই আমি প্রথমেই একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ বা সেন্স অফ এলিয়েনেনের শিকার হয়ে পড়ি। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম  সময়টাযদিও কিছুদিনের মধ্যেই সেই তাদের মধ্যে থেকেও বন্ধু হল। ওরা আমাকে একেবারে অন্যরকম জেনেও আপন করে নিয়েছিলদলে টেনে নিয়েছিল।

 

এইসময় আমার এক মামাতো ভাই মাঝেমাঝে ঝোড়ো হাওয়ার মতো এসে হাজির হত। সঙ্গে করে নিয়ে আসত একমুঠো আকাশ।  এলেই যে কি মুক্তিআমি বোঝাতে পারব না।  সে এমন এক গুণী ছেলে যার মতো কাউকে আমি আর দেখিনি। সে নিজে আমার থেকে সামান্য বড় ছিল তাই সে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই,এসসি পাশ করে বেরিয়ে আই,আই,টি খড়গপুর- ভর্তি হওয়ার পর আমি কলেজে ঢুকেছিলাম। সেই ছেলে আজ বেঁচে থাকলে কত বড় এক মানুষ হত জানিনাতবে মোটে তেতাল্লিশ বছর বেঁচেই সে নিজের 

নাম অনেকের কাছেই স্মরণীয় করে রেখে গেছে। ‘এই দ্বীপএই নির্বাসন’-এর লেখকদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত অজস্র গল্পের লেখক মনোজ ভৌমিককে আজও বহু সাহিত্যিক  

সাহিত্যপ্রেমিক মনে রেখেছেন। কলেজজীবন থেকেই সে নাটকে খুবই উৎসাহী ছিলনিজে নাটক করত। মনে আছে ‘চলচিত্ত চঞ্চরী’ করেছিলদেখতে গেছিলাম। সেই অভিনয়ের ব্যাপারে একটা গল্প বললে সবাই আমাদের সেই যুগটা কিছুটা বুঝতে পারবেন। মনোজের একটা সীন- সিগারেট মুখে নিয়ে স্টেজে আসবার কথাকিন্তু কলেজের ছেলেঅনেক গুরুজন থিয়েটার করা দেখতে এসেছেনসুতরাং সিগারেট খাওয়া যাবে না। তো বেচারা করে কি।  মুখের সামনে হাত মুঠো করে তাতে সিগারেট ধরে রাখল। ঠোঁটে সিগারেট যেভাবে ধরে সেটা সম্ভব হল না। তবু কত জল্পনা গুরুজনদের মধ্যেসিগারেটে টান না দিলে  যে  সামান্য একটু ধোঁয়া উঠলতা কি উঠতএখন তাই ভাবি কাদের মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠা। সে এক এমন যুগ আর গোষ্ঠী ছিল যে ‘পাবনাই’ গোষ্ঠীর কিছু উদারমন সদস্য তৃপ্তি মিত্রকে সম্বর্ধনা দিতে চেয়েছিলেনকিন্তু অধিকাংশ সদস্যের অমতে সেটা সম্ভব হয় নি। আমি সেই ছোটবেলায়ই শুনেছিলাম যে একটা থিয়েটার করা মেয়েকে নাকি সম্বর্ধনা দেওয়া যায় না কোনওমতেই। মাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কিমা তো এদের মধ্যেই জীবন কাটিয়েছেন।

 

মনোজ কিন্তু  বয়সেই প্রচুর পড়াশুনাও করত নতুন ধারার নাটক নিয়ে। সেটা ষাটের দশকতখন নান্দীকারে অজিতেশমায়া ঘোষরুদ্রপ্রসাদ তুফান তুলছেননতুন ধারার নাটক করছেন বাদল সরকার। এবং ইন্দ্রজিৎ’ তো হুলুস্থুল বাধিয়ে দিয়েছিল। হাঠাৎ একদিন মনে আছে সেই মনোজ (বা আমার মামাতো দাদা প্রলয়দাএসে বললকি রেঅ্যাবসার্ড ড্রামা কি জানিসসেটা তো ষাটের দশকের গোড়ার কথা। এখন জানিতখন সবেমাত্র এক দশক হল ইয়োরোপে অ্যাবসার্ড ড্রামা শুরু হয়েছে।  কতটা সময়ের সঙ্গে তাল রাখত সেটা তখন তো কিছুই বুঝিনি। আমার মনে হয় যে কেবল ছাত্র পড়িয়ে জীবন কাটাব নাকিছু একটা কাজ করতে হবে জীবনে এই সংকল্প 

অনেকাংশেই প্রলয়দার প্রভাবেই আমার মনে জেগেছিল। মনে আছে  শেষবার যেবার আমেরিকা থেকে দেশে এসেছিল সেবার আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম। আমি পিএইচডি করছিকবিতা লেখা শুরু করেছি জেনে ওর সে কি আনন্দ! ওর বৌয়ের কাছে শুনেছি যে 

ওদেশে ফিরে আমার কথা নাকি বলেছিল যে দেশে সবাই একটা করে চাকরি করছেআর ওই একজনই একটা 

কিছু করার চেষ্টা করছে। তখন ওর সংকল্প ছিল পরের বছর থেকে  দেশে আটমাস থেকে লিখবে আর মোটে চারমাস বিদেশে থেকে কনসালট্যান্সি করবে। সেই যে গেলআর ফিরল না।  ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।

 

যাকআবার আমার কথায় ফিরে আসি। মোটামুটি  এই সময়ঠিক কোন ইয়ারে মনে নেইএমন এক ধাক্কা এল যে আমার লেখালেখি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। আমার উঠতি বয়সের আসল সমস্যা ছিল যে নিজের বলতে কোনও জায়গা ছিল নামানে মায়ের উপস্থিতি 

সর্বব্যাপী ছিল। অসাধারণ নিপুণতায় তিনি আমার মনের কথা টেনে আনতেন বাইরে। আমার ঘর কেননিজের বলতে একটা টেবিলও ছিল না। আমার চিঠি পড়ার অধিকার তিনি কেমন করে যেন পেয়ে গিয়েছিলেন। মার ডায়েরি লেখার খুব ইচ্ছে হতকিন্তু লেখার সাহস পাইনি কারণ মা তো সেই ডায়েরি পড়বেনই। তাঁর কথা ছিল যে আমার মেয়ে আমি তার সব কিছু জানবসে অধিকার আমার আছে। উঠতি বয়সে এটা একটা বিশাল সমস্যা একথা সকলেই মানবেন। আমার একমাত্র মুক্তির জায়গা ছিল আমার পড়াশুনা আর লেখার জগৎ। তার মধ্যে লেখার জগতের মুক্তির স্বাদই আলাদা। পাতার পর পাতা লিখে ভরিয়ে ফেলতামসে যে কি আনন্দ। সেখানে আমার একার জায়গাআমার অন্তরলোকের আলোয় ভরাঅন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। মানে এমনটাই মনে হত। কিন্তু সেটুকু নিজস্ব জায়গা আমার জন্য থাকল না। 

মেয়ে-সন্তানের এত বিলাস সইল না।

 



ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন