রসা কোলিয়ারি। এক সময় এই কোলিয়ারির খুব নাম ছিল, ভালো গ্রেডের কয়লার জন্য। বৃটিশ মালিকানা ছিল সে সময়। আমার এক পিসতুতো দাদা, ষষ্টীদা, এই কোলিয়ারিতে কাজ করতেন। খুব ছোটবেলায় একবার তার সঙ্গে আমি, বাবা, মা ডুলি করে অন্ধকার কুয়োতে কোলিয়ারির খাদে নেমেছিলাম। কি যে ভয় পেয়েছিলাম। মাথায় হেডল্যাম্প লাগানো টুপি পরিয়ে দিয়েছিল আমাকে। সেই ডুলি থেকে দেখা যাচ্ছিল শুধু কুয়োর ভেজা, স্যাঁতসেতে জলেভেজা দেয়াল। অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর কুয়োর আড়াআড়ি মাপ প্রায় ১০-১২ ফুটের হবে। সেই অন্ধকারময় কুয়োতে নামছি তো নামছি, শেষ আর হয় না। পরে খনিগর্ভে নেমে তবে শান্তি। কাছাকাছি কোথাও অভ্রখনিও থাকতে পারত। মাটিতে অভ্রের কণা, পুকুরের ঘাটেও তাই দেখা যায়। কিন্তু আমার ভূতাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়ে তো আর খনি খোঁড়া হবে না। আর তা হয়ও নি।
ম্যানেজারের বাংলো আর চিমনিকে ডানদিকে রেখে আমরা এসে পড়লাম রসাগ্রামের মুখে। বাঁ-দিকের পুরোটাতে ছড়িয়ে এই গ্রাম। ঘনবসতি। অলি-গলি তস্য গলি, দেবালয়। যেমন আর পাঁচটা গ্রাম হয় আর কি। তবে বড্ড শান্তিপ্রিয় সব লোকজন। রসার লোকেদের আমার খুব ভালো লাগে। বড় আপন-করা। ডানদিকে কোনো জনবসতি নেই। মাঠ-ঘাট আর পুকুর। এই গ্রামের ঘোষ পরিবারের প্রতিষ্ঠা করা লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির খুব সুন্দর। নিত্যসেবা ছাড়াও রোজ সন্ধারতি হয়। কীর্তন হয়। বছরে একবার ‘অন্নকূট’ উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। আমি যখন গ্রামে থাকতাম, পিসিমার সঙ্গে গরুর গাড়ি চেপে আসতাম। প্রচুর লোক সমাগম হত। একসঙ্গে তালপাতার বড়-বড় তালাইয়ে চূড়ো সাজিয়ে ভাত রাখা হত। একসঙ্গে এত ভাতের পাহাড় এর আগে কখনো দেখিনি। তাছাড়া ঢাউস-ঢাউস পেতলের হান্ডায় ডাল, সুক্তো, ভাজা, দু-রকম তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিস্টি- সে এক বিপুল আয়োজন। নিদেনপক্ষে চার-পাঁচশ আমন্ত্রিত অতথি ভোগ পেতেন। আমাদের চাষে তখন খুব কুমড়ো ও বেগুনের ফলন হতো। পিসিমা কিষাণদের দিয়ে অন্নকূটের ভোগের জন্য তা দান করতেন। পিসিমারা তিন বোন। তিনু-উমা-কনক। সবাই ছোট্টখাটো চেহারার। কিন্তু তিনজনেই ভারি ভালো মানুষ। প্রায় একরকম দেখতে।
এইসব গল্প করতে করতে রসার রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রাস্তার পাশে চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে চা-তেষ্টা পেয়ে গেল সবার। সেই কোন ভোরে বেরিয়েছি, এক কাপ চা না খেলেই নয়। তাই একটা ‘টি-ব্রেক’ ঘোষণা দাবি করল স্তুতি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধ্বনি ভোটে স্তুতির এই প্রস্তাব গৃহীত হয়ে গেল। সবার মুখে হাসি। বুঝলাম সবাই মনে মনে এটাই চাওয়া ছিল। মতিদা-কে বলতেই রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে দিল। নেমে গাড়ির আগে গিয়ে দাঁড়াল। বলদযুগলের ও একটু বিরতি দরকার। ওরা সব গাড়িতেই বসে রইল। তিন মহিলার শাড়ি সামলে নামা, আবার ওঠা, জোয়াঁল খুলে গাড়ি নামানো, বিস্তর ঝামেলার ব্যাপার। সময়টাও নষ্ট হবে অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে। তাই আমি নেমে দোকানিকে গিয়ে টাটকা চা বানিয়ে দেবার জন্য অনুরোধ করলাম। আমি দোকানে বসেই না হয় খেয়ে নেব, মতিদা তো বাইরেই। বাকি তিনজনের জন্য ‘অন-বোর্ড’ ডেলিভারি। দোকানি একটু মুচকি হাসল। মানুষটি বড্ড ভালোমানুষ গোছের। কি সুন্দর সারল্য-মাখানো এক অমল হাসি সর্বক্ষণ ঠোঁটে ঝুলে রয়েছে। চা-উনোনে চেপেছে। ঘুঁটে-কয়লার আগুন। ধোঁয়া তো একটু থাকবেই। আমি এই ফাঁকে দোকানির সঙ্গে গল্প করছি। খোঁজ-খবর নিচ্ছি তার পরিবারের। ষষ্টিদা আমার পিসতুতো দাদা শুনে আমার খাতিরদারি দ্বিগুণ হলো। আমাকে কোথায় বসাবে, টাটকা রসগোল্লা খাবো কি না, এসব জিজ্ঞেস করে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিল। ষষ্টীদা নাকি এই দোকানের রসগোল্লা খুব ভালোবাসত। এরপরেও আরেক চমক। সে নাকি আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছে যে আমিই সেই লোক যে দুর্গাপুর থেকে নামকরা সব খেলোয়াড়দের নিয়ে আসতাম এবং ওরা প্রকৃত পক্ষে উন্নত মানের ফুটবল দেখতে পেয়েছিল আমার কল্যাণে। এজন্য সেই সদানন্দ দোকানি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো। একথাও জানাতে ভুলল না যে আমার খেলা নাকি ওর খুব ভালো লেগেছিল আর আমার খেলা দেখে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছিল। আমি তো এইসব শুনে খুশিতে আত্মহারা। কারণ এই ফীডব্যাক তো আমার ' 'ডিউ' ছিল। আফশোষ হলো নববধূকে কেন যে গাড়িতে বসিয়ে রাখলাম। গ্রাম তল্লাটে প্রথমবার এসে নিজের কানে পতিদেবতার এমন নামডাক শুনত যদি, কি যে ভীষণ ‘ইম্প্রেসড’ হতো। আফশোষ, নিজের ভাবমূর্তি বাড়িয়ে নেবার এমন একটা ভালো মওকা মাঠে মারা গেল।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন