সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

গালিব উদ্দিন মণ্ডল-এর প্রবন্ধ


তরুণ
 মুখোপাধ্যায়ের কবিতা

​'​গাণিতিক অনুপাতে ঝরে গভীর শূন্যতা​'​ 

একটা পুরনো পৃথিবীর বেড়ে চলা বয়সের হিসেব কষে সত্তর দশকের কবি তরুণ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন এই পুরনো পৃথিবীতে “গাছনদী  চাঁদের গল্প শোনে না কেউ’’ (মুখোপাধ্যায়ঃ১৯৭৭১৩) সেই না-শোনা-গল্পের মেহফিলে ঢুকে পড়লাম আমরা

 

     পুরনো পৃথিবী আর নতুন যাপনের নকশা বিপরীত মেরুতে হেঁটে যাচ্ছে পৃথিবীর বয়সের গাছ-পাথর সিসিফাসের মতো বয়ে নিয়ে চলেছে আধুনিক মানুষ এই সিসিফাসের শীৎকার  শিহরণ বিশেষভাবে অনুভূত হয় তরুণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে পড়তে সেই যে অসমান পাহাড়ের উপর গড়িয়ে তোলা পাথরপিণ্ডের ছবিটা মিথ হয়ে গেছে , তার দিকে ফিরে যায় ক্যানভাস রঙ তুলি ইজেল

 

      চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে ভোগের উপকরণ পচে গেছে আদিম নদীর জল মানুষের শরীরেও ক্ষয় পৃথিবী তার খোলনলচে পাল্টে ফেলছে এখানেই অস্তিত্ব সংকটের সার্কাস প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ধরা পড়ে বিচ্ছিন্নতার সুর “যে নিঃসঙ্গতায় আমি আত্মঘাতী ‘—কবির প্রথম বইটি যেকোনো আধুনিক মানুষের কার্ডিওগ্রাফ তুলে ধরে  ইসিজির রেখাগুলোকে যেন কবি বাঁকিয়ে অক্ষর করে তুলছেন কবিতার জীবনের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এসে পড়েছেন শূন্যতার শতদল ঝরনায়


 

কবির বাড়ি অতটা গুরুত্ব না পেলেও , তাঁর মনের বাড়িটি অযোধ্যার থেকেও সত্য –--

 তো আজ প্রবাদ তরুণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে পড়তে সেই মনের বাড়ির উঠোনটিতে দু-দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যাক

 

       তরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম  বইয়ের উৎসর্গের পংক্তিটি এক আত্মিক উদ্বোধনের দ্যোতক কবির ‘বিষণ্ণবিধুর আত্মাকে উৎসর্গ করা হচ্ছে এই বইটি  কবিতার বই তাই এক আত্মিক উৎসারণের কথা ভাবিয়ে তোলে আমাদেরশরীরের খোল থেকে বেরিয়ে আত্মা কথা বলবে জিভের কথা নয় কথা বলবে অনুভবে উপলব্ধিতে  

 

       শব্দকে সত্তায় ধারণ করা সহজ নয় অথচ সত্তার ব্রেইলে সেই নিঃসঙ্গতার বয়ান তুলে চলেছেন কবি এই বিশুদ্ধ শূন্যতাকে অভিবাদন জানাতেই হয় কারণ সামাজিক স্খলনকে এই শূন্যতা সমর্থন করে না প্রশ্ন তোলে হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করেনতা বলতে কলমে বাধে না দিনের আলোর মত স্পষ্ট কথা অন্ধকার ভেদ করে ফুটে ওঠে



 

সবার থাকে না কারো কারো থাকে --- ‘ নিজস্ব দর্পণ

    এই দর্পণের সামনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দাঁড়ানো যায় সেখানে যাপনের মুখোশ ছিঁড়ে পড়ে অভিনয় খুলে পড়ে হাতের মুদ্রায় কোথাও বাঘনখ থাকে না

      পরম শূন্যতাই পূর্ণতার পূর্ণিমা ফুটিয়ে তোলে এই নিজস্ব দর্পণের সামনে  দাঁড়িয়ে মানুষ স্থিত হতে শেখে সীমার মধ্যে থেকে অসীমকে ছুঁতে পারে বলতে পারেআসলে যুদ্ধ তো নিজের সঙ্গে প্রতিদিন , প্রতিরাত্রি  / তারপর একাকী দ্বৈপায়নে ফিরে যাওয়া  ‘(মুখোপাধ্যায়ঃ ১৯৮৩, ০৬)

    নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে যে বুকের পাটা লাগে, তা সবার থাকে না নিজের ভিতর ডুবে অরূপ রতন খুঁজে আনার  রিটার্ন টিকিট একটি কবিতা এনে দিতে পারে বেলাশেষে, খেলাশেষে এই নিজস্ব দর্পণের মুখোমুখি হওয়াটাই জীবনের সার্থকতা

 

 

 

নদীর একটি স্রোত দুবার স্নানের ফরমান দেয় না  জীবনও এই স্নানের ব্যাকরণ সবক্ষেত্রে শিখে ওঠে না যথার্থ স্নানের বার্তাটি ধরা দেয় কবিতায়  ---

 

জীবন মানুষের একটাই আর তাতে বড় স্রোত!

সবাই কি স্নানের নিয়ম জানে?’

                                      (মুখোপাধ্যায়ঃ ১৯৮৩, ১৬)

এই স্নানের রূপকটি বিশেষ ভাবে ভাববার বলে মনে হয় জীবনের স্খলন,পতন ত্রুটির মধ্যে স্নানের প্রহরটির কাছে কবিতা পৌঁছে দেয় স্নান এখানে আত্মদর্শন শরীরের সাবান তো বটেই, এই স্নান, আত্মারও আবেজমজম

 

 

গ্রন্থঋণ

মুখোপাধ্যায় তরুণ (১৯৭৭) : যে নিঃসঙ্গতায় আমি আত্মঘাতী : বহরমপুর

মুখোপাধ্যায় তরুণ উদয়কুমার চক্রবর্তী (১৯৮৩): নিজস্ব দর্পণে দুজন সারস্বত লাইব্রেরী কলকাতা   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন