সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

রন্তিদেব সরকার-এর ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী "প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি"

 

প্রথম পাড়ি গরুর গাড়ি

চারিদিক নিঝুম। মাঝে মধ্যে বলদযুগলের সঙ্গে মতিদার এক ‘ওয়ান-ওয়ে-কমিঊনিকেশন’ ভোরের শীতল  নৈঃশব্দ ভেঙ্গে দিচ্ছে। ‘অ! রেতের ঘুর এখোনু যেছে নাই’, ‘চলন দ্যাকো, খাবি দু-বাড়ি ?’ ‘গতর যেনে লড়ছে নাই’ বা ‘দ্যাকো দিখিনি, ই গরু কি বলতে হয়’ ইত্যকার একতরফা বাখান মতিদার গলায় শোনা যাচ্ছে, কিছু বিরতির   পরপর। বলদ-যুগল থোড়াই কেয়ার করছে। তাদের গলায় বাঁধা ছোট-ছোট ঘন্টাগুলির সম্মিলিত শব্দের মিস্টি সুর যেন মতিদার বাখানের সুমিস্ট জবাব তাদের তরফে। ধীর এবং নিশ্চিত লয়ে ভোরের আলোর আভা ক্রমশ পূবের আকাশে প্রকাশমান হচ্ছে। আমাদের যাত্রার অভিমুখ এখন পশ্চিমে। পিছনে এক আশ্চর্য রঙ্গীন আকাশ; তার ঘন লালিমা ঢেকে রেখেছে সূর্যের প্রবেশ পথ। এত সুন্দর এক প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রকৃতিমাতা প্রতিদিন নিয়ম করে দেন আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য অথচ দুঃখের বিষয়, এই ঊষালগ্নের রঙ আমাদের দেখার অবসর নেই  অথবা বিছানায় কাটে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির থেকে কতদূরে চলে গেছে।   

          ঘনলাল আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। এক নিঃশব্দ জগত ক্রমশঃ শব্দমান হচ্ছে ঘুমভাঙ্গা পাখিদের কূজনে। ফিঙ্গে, দোয়েল, ছাতার, বুলবুলিরা ঘুমভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে জুড়েছে কলতান। সকাল থেকে কত যে ব্যস্ততা তাদের, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কেউ চুপ করে গাছের ডালে থির হয়ে বসে নেই, সবার যেন কিছু বলার আছে। অথচ কি আশ্চর্য, তাদের কোরাস কলতান কখনো বেসুর বাজছে না কানে। এই ‘পাখি সব করে রব’-ও যেন এক মধুর কল্লোল। কানের আরাম।  এ ডাল থেকে সে ডাল- একটি পরিপূর্ণ কর্মব্যস্ততার ছবি। পরক্ষণেই সটান মাটীতে নেমে শিশির-সজ্জিত ঘাসের উপর দিয়ে পার হয়ে সিক্ত পায়ে খাদ্যাণ্বেষণ। অদূরেই গাড়ির মেঠোপথে কয়েকটা ছাতার পাখি ‘ধূলা-স্নান সেরে নিচ্ছে।  

          এখন রাস্তার দু-পাশারি ধানমাঠের মধ্যিখান আমাদের সরাণ, আমাদের চলার পথ। আমাদের গাড়ি  ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে। সবুজ পূর্ণশষ্য মাঠগুলি ক্রমশ ভোরের রুপোলি আলোয় ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। ধানের শীষগুলির ডগায়, পাতায়, মুক্তোর লাবণ্যে শিশিরের বিন্দুগুলি স্থির হয়ে আছে, যেন কারোর আসার প্রতীক্ষায়। শিশিরের বিন্দুগুলির প্রকৃত রঙ ঠিক ঠিক বর্ণনা করা খুব মুস্কিল। হঠাতই নবারুণের প্রথম রশ্মির আলো যখন ধানমাঠগুলিতে এসে পৌঁছালো, সহস্র-সহস্র ছোট-ছোট সূর্য একসাথে জ্বলে উঠলো ধানশীর্ষে, ঘাসের ডগায়, গাছের পাতায় পাতায়। সেই মুহূর্তে মনে হলো, যেন আনুষ্ঠানিকভাবে ভোরের আগমন ঘোষিত হলো। আমাদের কয়েকজন যাত্রীদের চোখেও যেন পরিপূর্ণভাবে ঘুমঘোর কেটে গেলো। সবার মুখাবয়ব যথেষ্ট উজ্জ্বল দেখাচ্ছে এখন। এরকম মনোরম সকাল ক”টাই বা দেখেছে ওরা ? আমার শৈশব এই গ্রামেই কেটেছে এবং এই জনপদ, এই শ্যামলিম, সান্দ্র সকাল আমার খুব পরিচিত। গ্রামের প্রতিটি ইঞ্চি আমার হাতের তালুর মত চেনা। যেমন মতিদাও সেই দাবি আরো বেশি করে করতে পারে অবশ্যই কিন্তু ক্রমাগত জীবনযুদ্ধের মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত মন, এ সৌন্দর্য দেখার, তাকে উপভোগ করার ফোকাসটাই কবে হারিয়ে ফেলেছে। মতিদার কাছে কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা, ‘পূর্ণিমার চাঁদ এখন তার কাছে এক ঝলসানো রুটি মাত্র।  

          স্তুতির চোখমুখ এখন কিছুটা স্বাভাবিক। ছোটভাই হর্ষ প্রকৃতিপ্রেমী। ওকে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। তবে স্বভাবগতভাবে এক অন্তর্মুখী চরিত্র। স্তুতি আবার ঠিক বিপরীত। ও কথা বলতে খুব ভালোবাসে। এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলার জন্য উন্মুখ। হঠাত মুখ বাড়িয়ে মতিদাকে মিস্টি সম্বোধনে বললে-

স্তুতি -             -‘মতিদা, ঘুম ছাড়লো ?’

                      মতিদা পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল স্তুতিকে, আমাকেও। ভ্রূ-যুগল সামান্য কুঞ্চিত।

মতিদা- (হেসে)-  ‘আমরা যে এই সুময়েই উঠি ‘গুলিন’(মালকিন), রাইত থাকতে। আমরা আবার ঘুম ছাড়াতে  

                                                                                      

                   যাব ক্যানে ? ‘সাট্টার টেন’ (সাতটার ট্রেন) পাশ হঁই গেলে চাট্টি ব্যাঁতে দিঁয়ে শুতে যাই। 

                    ইবার হিসেব করো ক্যানে। কত ঘুমোবো ?

 

স্তুতি -             তোমাদের তো অনেক খাটতে হয়। কিন্তু তোমরা বিশ্রাম নাও না কেনো ?  

 

মতিদা-           আ, গুলিন, আনখাই কথা বলছো। আমাদের আবার ‘বিশ্বাম’। সেই কি বলে না তাই। ঐ যে

                    সারাদিন খেটে আলামারা হঁয়ে রেতের বিলায় শুতে গেলেই, ঘুমে অচেতন। আর এক ঘুমেই

                     রাইত (রাত) কাবার। আপুনি ঘুম ভাঙ্গে সেই ‘ভুলকো’  শুকতারা) দেখে। আমাদের মত

                     ছুটুনুকদের উটোই ‘বিশ্বাম’। ই সব তুমাদের জন্যে।‘  – মতিদার অকপট জীবনদর্শন।

 

স্তুতি-               না, মানে, এই যে যখন-তখন, বলা মাত্র রাত থাকতে ঘুম থেকে উঠে আমাদের গাড়ি জুড়ে

                     নিয়ে যেতে হয়, এইসব করতে তোমার ভালো লাগে ?’

 

মতিদা-            ইটো কি বলছ গুলিন ! বড় গুলিন (মা) ত গাড়িতেই রইছে, শুদোও ক্যানে। সেই কবে থেক্যে 

                     তুমাদের ঘরে বহালি হঁইছি। যিখানেই আমাকে যেতে বলেছে, সিখানকেই গেইছি গাড়ি জুতে।

                     কুনু কথা কুনুদিন শুদোই নাই। বলুক বড় গুলিন ? ইগুলাই ত আমাদের মুনিষের কাজ বটে      

                     যে। শুদু দু-আঁটি ধান পুঁতলেই হঁঅই যাবেক ? কি যে বলো গুলিন। দৃশ্যতই মতিদা 

                     আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মা কে দেখা গেল, তার বক্তব্যের সমর্থনে মাথা নাড়াতে।

 

আমরা সবাই, মতিদার এহেন আন্তরিক কমিটমেন্ট শুনে আপ্লুত হই। বিশ্বস্ততা, দায়বদ্ধতা, আনুগত্য, আন্তরিকতা- সব মিশিয়ে এক ‘প্যাকেজ’- ইংরেজি Loyal শব্দটির খুব গা-ঘেঁষে হেঁটে যায়।

 

এখন গাড়ি হিংলো নদীর উত্তর কোল ছুঁয়ে চলেছে। যদিও এই রাস্তা থেকে সরাসরি হিংলো দৃশ্যমান নয় তবু দক্ষিণ পার বরাবর সার-সার প্রবীণ গাছগুলির মাথার সারির স্কাইলাইন এখান থেকে বেশ দেখা যাচ্ছে এবং নদীটির চলার পথ বেশ বোঝা যাচ্ছে। যেহেতু চেনা-পরিচিত নদী, আমরা জানি, ক্ষীণতোয়া সে নদীর একপাশ ঘেঁষে কুলকুল সলজ্জ বয়ে যাওয়াটা বেশ অনুভব করতে পারছি দূর থেকেই, মানসচক্ষে। এই মাত্র দু-দিন আগেই তো ওখানেই মা দুর্গার প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলো প্রথানুযায়ী। তারও দিন-তিনেক আগে, মহাসপ্তমীর দিন সকালে, কলা-বৌ স্নান করিয়ে বরণ করে দোলায় নিয়ে গিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হলো, গাঁ পরিক্রমা করে, ঢাক-ঢোল- কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে। হিংলো তো শুধুমাত্র এক নদী নয়, দু-পারের গ্রামগুলির কাছে বহমান জীবনের আবহমান প্রতীক। শরীরে শোণিতধারার মতো, গ্রামগুলির শরীরে বয়ে চলেছে নিরন্তর তার জলধারা। মায়ের স্নেহে দু-হাত ভরে উজাড় করে দিয়ে যাচ্ছে। 





ক্রমশ...

1 টি মন্তব্য:

  1. তোর. Camera দিয়ে তোলা ছবি যত সুন্দর তোর এই লেখনী দিয়ে বর্ণিত ছবি যেন আরও বেশি সুন্দর আরও বেশি স্বচ্ছ। Portrayed very beautifully. Bravo. !

    উত্তরমুছুন