সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

 

এসেছো কবিতা

বড়দাদার প্রসঙ্গ যখন এল তখন একটা কথা বলা দরকার। বাড়িতে মেয়ে বলে যতই অনাদর থাক আমার মামাবাড়িতে আমার দারুণ আদর ছিল। সব মামামামীমাসিভাইবোনেরা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।​ ​মা একদিন ক্ষোভ প্রকাশ অরেছিলেনআমার একটাই ছেলেআর তোকেই সবাই ভালোবাসে। আমার জন্মদিন পালন হতে পারে এমন কথা ভাবাও হয়তো যেত নাকিন্তু আমার জন্মদিনে মামা মাসীদের মধ্যে কেউ কেউ আগে জানান দিয়েঅথবা না বলে  চলে আসতেন। কিছু ভালো রান্নাবাড়ি করতেই হতো। সবাই এসে এত হৈ হৈ করতেন যে আমার মনে থাকত না যে একটা নতুন জামাও পাইনি। আর আমি খুব ভালোবাসা পেয়েছিলাম আমার সেজমামার কাছে। ফুট চার ইঞ্চি লম্বা বিশাল চড়া বুকের মালিক মানুষটার মন খুব নরম ছিল। জীবনের অনেকটা সময় তিনি আমাদের বাড়িতেই কাটিয়েছিলেন। বড় ফুটবল প্লেয়ার ছিলেনকিন্তু দেশবিভাগের পর খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন ভেঙে যায়। অকৃতদার সেজমামার কাছে আমি আর আমার ভাই সন্তানস্নেহই পেয়েছিলাম।  বেশিদিন বাঁচেননি তিনি। দেশের জীবনকে হারিয়ে এখানে এসে হয়তো সুখী ছিলেন না। ১৯৭৭ সালে মাত্র ঊনষাট বছর বয়সে তিনি চলে যান। সেই আমার প্রথম পিতৃবিয়োগ।একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত ছিল। বেশ বেশি বয়স পর্যন্ত আমাদের স্কুলে ভর্তি করা হয়নি। যা পড়াশুনা তা বাড়িতেই। ভাই ছোটওর অতটা সমস্যা ছিল নাকিন্তু আমি মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি ব্যাপারটা নিয়ে। কেমন একটা হীনম্মন্যতা জন্ম নিয়েছিল মনে। পড়াশুনায় অনেকটা দূর এগিয়ে গেছি বাড়িতেকিন্তু অতবড় মেয়েপাড়ার মেয়েরা সব আঙুল তুলে দেখাত তো পড়াশুনাই করে নাস্কুলেই পড়ে না। স্কুলে গেলে বন্ধু হয় নতুনআমার কোনও বন্ধু নেইএটাও খুব কষ্ট দিত। তাছাড়া মা তো বাড়িতেই থাকতেন নাতিনি চাকরি করতেন। একা একা ভাইয়ের সঙ্গে সারাদিন টি,ভি তো দূরের কথারেডিও  তো কত পরে এসেছে।  পড়াশুনা্র টাস্ক যা দিয়ে যেতেন শেষ করে বাড়িতে যা বই আছে তাই ঘাঁটা। আর তো কিছু করার ছিল না। এত একা মনে হত। তবে মা-বাবার কাছে নালিশ করার কথা কোনওদিন মনেও হয় নি। সে সাহস আমাদের ছিল নাআমাদের সময় কারও ছিল কি না সন্দেহ। এখন তো বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের সম্পর্ক একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেছে।  শেষপর্যন্ত দশবছর বয়সে স্কুলে গেলাম। ভর্তি হলাম বেশ কিছুটা এগিয়েক্লাস সেভেন-এ। আমার ভাইকেও তখনই স্কুলে দেওয়া হলওর তখন আট। প্রথমে ছিল বাড়ির কাছে চেতলা গার্লস স্কুল। সেখানে বেশিদিন পড়িনি। পরের বছর এক ক্লাস নামিয়ে একই ক্লাসে আবার ভর্তি হলাম সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে। মনে আছে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের ক্লাস সেভেন এর অ্যাডমিশন টেস্টে ভূগোলের পরীক্ষা দিতে হততাই পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে আমাকে একটা ক্লাস সিক্সের ভূগোল বই কিনে মুখস্ত করতে দেওয়া হয়েছিল। চেতলা গার্লস স্কুলে মোটে সামান্য কদিন পড়েছিলাম তাই ওখানে ইতিহাস-ভূগোলের কি হল তা কিছু মনে নেই।

সাখাওয়াৎ মেমোরিয়ালে এসে হঠা বাড়ির সেই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে কি অসীম মুক্তিআমার অবস্থাটা কি হল সে আমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। যার কোনও বন্ধু ছিলনা বলতে গেলেসে এত এত বন্ধু পেয়ে গেলআমার চিরদিন হাসিরোগকিন্তু মামাতো-মাসতুতো ভাইবোনের সাহচর্যে ছাড়া হাসবার সুযোগই তো হত না।

বাড়িতে ওসবের বালাই ছিলনা। স্কুলে এই রোগটা এমন বাড়ল যে এক্কেবারে বিতিকিচ্ছি কান্ড। টিফিন পিরিয়ড তো সব স্কুলেই হাসির জন্যই রাখা হয়। আমি সেটা বেশ ভালো করে বুঝে গেলাম। তাছাড়াও ছিল। সেলাই তো করতাম না কোনওদিনভালোই লাগত না। কিন্তু থিওরী ক্লাসে তার জন্য খাতা নিয়ে না যাবার তো কোনো সঙ্গত কারণ নেই। খাতা না নিয়ে গেলেই টিচার বলতেনটেবিলের নিচে ঢোক। হয়ত একাধিক মেয়েকেই বলতেনকিন্তু আমি হলাম গিয়ে কমন ফ্যাক্টর। এদিকে ছোট্ট টেবিলের নিচে কজন বিচ্ছু মেয়ের নীরব হাসিতে গড়াগড়ি দেখে ক্লাসের অন্য মেয়েদের অবস্থা খারাপতারা মরত বকা খেয়ে। এদিকে সেলাইয়ের দিদিমণি চিকার করছেন, ‘এতবড় বড় ধেড়ে মেয়েতাদের টেবিলের নিচে ঢোকানো হয়েছেতাও লজ্জা নেইতার পরেও হাসি?’ এই শাস্তি অবশ্য কেবল সেলাইয়ের দিদিমণির ক্লাসে। অন্য কোনও ক্লাসে কিন্তু আমি যথেষ্ট দুষ্টুমি করেক্লাসে অকারণে হেসে এবং সবাইকে হাসিয়েও ছাড়া পেয়ে যেতাম। একদিন একজন টিচার আমাকে উপদেশ দিলেন, ‘যখন খুব হাসি পাবে তখন কোনও একটা দুঃখের কথা মনে করবে এরপর কারণে অকারণে এইকথা মনে করলেই হাসি পেয়ে যেত। বাড়ির বদলে স্কুলেই আমি মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলাম। আসলে স্কুলে আমি বেশ বাড়াবাড়ি রকমের আহ্লাদ পেতাম টিচারদের কাছেনেহা পড়াশুনায় ভালো বলে।  

 

শরীর তো বটেইহৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার সম্বন্ধে আমার জ্ঞান কিছু কমই ছিল এই বয়সে। সেটা যে কোনো মেয়ের পক্ষেই খুব স্বাভাবিক।  কিন্তু সেই দশবছরে চেতলা গার্লস স্কুলে পড়তে যাবার পর থেকেই এমন একটা ব্যাপার ঘটল যেটার সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল।  আমি তো বেশ কমবয়সেই  স্কুলে ভর্তি হলামদেখতেও রোগাপটকা ছোট্টখাট্টো। মনে আছে একদিন একটু দেরি করে ক্লাসে ঢুকলে টীচার জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি  ক্লাসে পড়ি বলাতে অবাক হয়েছিলেন। নামী দামী স্কুল নালোক্যাল মেয়েরাই ওখানে পড়তআর তারা অধিকাংশই আমার থেকে বেশ বড় ছিল। তাই এখানে তেমন কোনো বন্ধুও হয়নি। যাই হোকএই স্কুলেই আমার সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার শুরু। একটি মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ত। তার নাম শান্তিমালা।  স্কুল অনুপাতেও তার বয়স কিছু বোধহয় বেশিই ছিল। সবসময় শাড়ি পড়ত। বেশ বড় বড় ভাবও ছিল। সেই শান্তির কেন জানি না আমার উপর একটা অস্বাভাবিক টান জন্মে গেছিল। স্কুল ছেড়ে দেবার পরেও আমাকে সে ছাড়েনি। বাড়িতে আসতনতুন স্কুলে পর্যন্ত গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করত। তার চাউনিকথাবার্তার মধ্যে যে প্রচন্ড আবেগ প্রকাশ পেত তা আমার কাছে সেই বয়সে অস্বাভাবিক ঠেকত। ওর আবেগের তীব্রতায় আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে যেতাম। আমি যেমন করে পারি তাকে যদ্দূর সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। এখন সবটাই বুঝিআর এও বুঝি যে আমার পক্ষে ওকে এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে শান্তিমালার জীবন শেষ হয়ে যায়। এক বিরল ধরণের ক্যান্সারে তার জীবনাবসান হয়। তার আগে তাকে দেখে এসেছিলামআর  বয়সে সেই আমার প্রথম ব্যক্তিগত শোকের অভিজ্ঞতা।  তখন অতটা বুঝিনি কিন্তু আজ ভাবি  কিশোরীবয়সে এই অস্বাভাবিক প্রেম তাকে কতটা কষ্ট দিয়েছিল। ওর বাবা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কাজ করতেন বলে সে থাকত আলিপুরের বেলভেডিয়ারে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কোয়ার্টারে।  আলিপুরে রাজা সন্তোষ রোডে আমার বাবার বাড়ি ছিল বলে বেশ কাছেই থাকত। লাইব্রেরির ক্যাম্পাসে অনেক বকুল গাছ ছিল। বছরের পর বছর সে অজস্র ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে আমাকে বাড়ি বয়ে এনে উপহার দিয়ে গেছে। সেইসময় সাখাওয়াতের বিল্ডিং তৈরি হচ্ছিল বলে হেস্টিংস হাউসে আমাদের স্কুল কিছুদিনের জন্য উঠে এসেছিল। স্কুলে গিয়েও সে আমার সঙ্গে দেখা করত। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় আমার দশবছর বয়সেআর  চলে গেল যখন তখন আমি ষোল।  পিছন ফিরে তাকিয়ে এই এতটা বয়সেও আমি বুঝতে পারি না ওকে এড়িয়ে যাওয়া  ছাড়া আর কি করতে পারত সেই বালিকা বা কিশোরী।

 


ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন