কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ?
সুন্দর পদ্মের পাপড়ি কি কেউ ছিঁড়ে ফেলে? উত্তর অবশ্যই না। প্রশ্নের ভঙ্গিতেই উত্তর জানিয়ে রাখার এই দৃষ্টান্তটি স্মরণীয় প্রবচনের মর্যাদা পেয়েছে যেমন, তেমনই অলংকার চন্দ্রিকায় কাকু বক্রোক্তির উজ্জ্বল উদাহরণ ‘কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ?’। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের উত্তরজাতক মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কাব্যসাহিত্যে প্রথম আধুনিক যুগের আনুষ্ঠানিক সূচনা করলেও উক্ত দুই পূর্বসূরীর মতো প্রবচন হয়ে ওঠার মতো পঙ্ক্তি সৃজন করতে পেরেছিলেন। এই প্রয়াস সচেতন এবং ভারতীয় উত্তরাধিকারকে বাঙালি পাঠকের কাছে নতুন তাৎপর্যে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টায় যে মধুকবি সফল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। ন’টি সর্গ সম্বলিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) মন দিয়ে পড়তে গেলে এমন অসংখ্য প্রবচন আমাদের চোখে পড়বেই। কিন্তু লক্ষ করবার মতো ব্যাপার হল এই, অধিকাংশ প্রবচনে মধুসূদন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন কিংবা প্রকৃতির প্রেক্ষাপটেই ফুটে উঠেছে সেইসব স্মরণীয় সূক্তি।
২।
ভারতীয় দর্শনে যা পঞ্চমহাভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম : মাটি,জল,আগুন,বাতাস, আকাশ) একালের বিজ্ঞানের চোখে তা হয়েছে ‘ইকোলজিক্যাল এলিমেন্টস্’। মাইকেল মধুসূদনের এই মহাকাব্যে যার উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। একালের সবুজ-সচেতন সাহিত্যিকদের মতো তাঁর কাব্যে প্রকৃতির ব্যবহার পরিবেশ সচেতনতার সদর্থক প্রচেষ্টা না হলেও প্রকৃতি ও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক-কে যথার্থ কবির মতোই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মহাকাব্যটিতে আধুনিক মহাকবির স্মৃতিতে বাল্মীকি বেদব্যাসের মতোই থাকেন ভবভূতি ও কালিদাস। তাই দেশ-বিদেশের মহাকাব্য মন্থন করে যে অতুলনীয় সাহিত্যিক বয়ানটি তিনি নির্মাণ করলেন সেখানে প্রকৃতিও চরিত্র হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। শুধুমাত্র গীতিকাব্যিক ‘চতুর্থ সর্গ’ নয়, প্রতিটি সর্গেই রয়েছে প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানে চিত্ররূপময়তা আর প্রবচন বা সূক্তির সার্থক সৃজন। প্রারম্ভিক দৃষ্টান্তটি যদিও চতুর্থ সর্গের, কিন্তু এখানে আমরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্গ থেকে আরো কয়েকটি সমতুল উদাহরণ চয়ন করছি,
প্রথম সর্গ
১) তোমার পরশে
সুচন্দন বৃক্ষশোভা বিষবৃক্ষ ধরে।
২) - তুমিও আইস, দেবি, তুমি মধুকরী
কল্পনা! কবির চিত্ত-ফুলবন-মধু
লয়ে রচ মধুচক্র...
৩) ফুলদল দিয়া
কাটিলা কি বিধাতা শাল্মলী তরুবরে?
৪) অভ্রভেদী চূড়া যদি যায় গুঁড়া হয়ে
বজ্রাঘাতে, কভু নহে ভূধর অধীর
সে পীড়নে।
৫) কি সুন্দর মালা আজি পড়িয়াছ গলে
প্রচেতঃ।
৬) অশ্রুময় আঁখি, নিশার শিশির-
পূর্ণ পদ্মপূর্ণ যেন।
৭) বামন হইয়া / কে চাহে ধরিতে চাঁদে?
৮) দিন দিন হীনবীর্য্য রাবণ-দুর্ম্মতি,
যাদঃপতি-রোধঃ যথা চলোর্ম্মি-আঘাতে!
দ্বিতীয় সর্গ
১) অস্তে গেলা দিনমণি; আইলা গোধূলি,
একটি রতন ভালে।
২) হেরিলা শশাঙ্কে পুনঃ তারাদল সহ
হাসিল কনকলঙ্কা।
তৃতীয় সর্গ
১) কে না জানে ফুলকুল বিরসবদনা
মধুর বিরহে যবে তাপে বনস্থলী?
২) পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
৩) দলিব বিপক্ষ দলে, মাতঙ্গিনী যথা
নলবন। তোমরা লো বিদ্যুৎ-আকৃতি,
বিদ্যুতের গতি চল পড়ি অরি মাঝে!
নাদিল দানববালা হুহুঙ্কার রবে,
মাতঙ্গিনী-যূথ যথা – মত্ত মধু-কালে!
৪) ক্ষণপ্রভা সম বিভা খেলেছি কিরীটে।
৫) ধন্য বীর মেঘনাদ, যে মেঘের পাশে
প্রেম-পাশে সদা হেন সৌদামিনী!
৬) যে বিদ্যুৎছটা
রমে আঁখি মরে নর তাহার পরশে।
৭) নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?
৮) কভু নাহি দেখি
কভু নাহি শুনি হেন এ তিনভুবনে!
নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?
৯) লঙ্কার পঙ্কজ-রবি যাবে অস্তাচলে।
১০) তেঁই সে আইনু
নিত্য নিত্য মন যারে চাহে তাঁর কাছে!
পশিল সাগরে আসি রঙ্গে তরঙ্গিণী।
লক্ষণীয়, প্রকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে ফুল, গাছ, নদী, সমুদ্র,পাহাড়, দিন-সন্ধ্যা-রাত্রি, বসন্তকাল, বিদ্যুৎ, মেঘ, সূর্য, চন্দ্র ইত্যাদি। এই যে পরিবেশ ও প্রাণী সব নিয়ে ইকোস্ফিয়ার তৈরি হয় মহাকাব্যে সে-প্রসঙ্গে পরিবেশবীক্ষার বিখ্যাত সংজ্ঞাটি স্মরণ করতে পারি : ‘ecocriticism is the study of the relationship between literature and the physical environment….takes an earth-centered approach to literary studies’। প্রায় প্রতিটি পঙ্ক্তিই অলংকৃত বাক্যের দৃষ্টান্ত। অভিষেক, অস্ত্রলাভ এবং সমাগম তীব্রগতির ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এই সৌন্দর্যসৃজন তাঁর কবিপ্রতিভার চিহ্ন। পাশাপাশি বঙ্গদেশের প্রকৃতির যে ছবি কবিমনে উজ্জ্বল তাকেই তিনি এই নবরামায়ণে দেবলোক ও মানবলোকের বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন।
৩।
চতুর্থ সর্গ –এর নাম ‘অশোকবন’। এই অংশের লিরিক্যাল মেজাজ-এর কারণ সীতা-সরমার আলাপচারিতা, স্মৃতিচারণ আর প্রকৃতির নরম নিবিড় অনুষঙ্গ। এই সর্গের শুরুতেই সমস্ত পূর্বজ মহাকবিদের বন্দনা করে মধুকবি বলেছেন :
- হে পিতঃ
কেমনে কবিতা-রসের সরে রাজহংস-কুলে
মিলি করি কেলি আমি, না শিখালে তুমি?
গাঁথিব নূতন মালা, তুলি সযতনে
তব কাব্যোদ্যানে ফুল, ইচ্ছা সাজাতে
বিবিধ ভূষণে ভাষা, কিন্তু কোথা পাব
(দীন আমি!) রত্নরাজী, তুমি নাহি দিলে,
রত্নাকর? কৃপা, প্রভু, কর আকিঞ্চনে।
এই সর্গে সীতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে। একাকিনী সীতাকে ফুটিয়ে তুলতে সূর্যকান্তমণি আর অন্ধকার খনির বৈপরীত্য কিংবা আরণ্যক হরিণী ও বাঘিনীর তুলনা। সীতার দুঃখের প্রতিফলন নীরব প্রকৃতিতে, নদী চলেছে সমুদ্রের দিকে সেই দুঃখের সংবাদ দিতে। কবির প্রশ্ন :
ফোটে কি কমল কভু সমল সলিলে?
তবু উজ্জ্বল বন ও অপূর্ব রূপে।
আর এই পদ্মতুল্য সীতা সাক্ষাৎ লক্ষ্মীপ্রতিমা যেন, যার সৌন্দর্য রাবণের পরুষ হাতে পড়ে ছিন্নপাপড়ি পদ্মের মতো। তাই সরমা বলে : কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ? এও তো একভাবে প্রকৃতিকে অসুন্দর করা। সরমার সীতাকে সিঁদুর দানের উপমা ও পদতলে বসার ছবিটিও স্মরণীয় :
১) সিন্দুর-বিন্দু শোভিল ললাটে,
গোধূলি ললাটে, আহা! তারা রত্ন যথা!
২) আহা মরি, সুবর্ণ-দেউটী
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল, উজলি
দশদিশ!
তুলসীতলায় প্রদীপের তুলনাটি বাঙালিয়ানার প্রত্যক্ষ ছবি এবং চিরন্তন। অতীত কাহিনি বলতে গিয়ে সীতা শুরুতেই এনেছেন বৃক্ষবাসী কপোত-কপোতীর ইমেজ আর রামের বিরহ প্রসঙ্গেও নিজেকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : আশার সরসে রাজীব। এই নরম পুষ্পল উপমা কিন্তু রাবণের আবির্ভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আরেকটি প্রাকৃতিক উপাদান আগুন এসেছে বারবার। রাবণের ছদ্মবেশ ‘যোগী বৈশ্বানর সম / তেজস্বী’ এবং সীতা-হরণের বর্ণনায় বাঘের হরিণ শিকারের উপমা, যে বাঘ ‘ইরম্মদাকৃতি’ তথা বিদ্যুৎসম। একদা যে বাঘ-কে রাম তাঁর শরানলে দগ্ধ করেছিলেন, সেই বাঘ এখন অরক্ষিতা সীতাকে ধরেছে। এখানেও একটি চমৎকার প্রবাদপ্রতিম উচ্চারণ :
কিন্তু বৃথা সে ক্রন্দন! হুতাশন-তেজে
গলে লৌহ; বারি ধারা দমে কি তাহারে?
অশ্রু-বিন্দু মানে কি লো কঠিন যে হিয়া?
ইকোসিস্টেম বা বাস্তুবিদ্যার ভিতরে খাদ্যশৃঙ্খল এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মধুসূদন বাঘ-হরিণ শিকারের ছবি, পাখির বাসা বাঁধা কিংবা সাপের ব্যাঙ বা পাখির ছানা খেয়ে ফেলায় সেই প্রসঙ্গ এনেছেন। প্রথম সর্গে চিত্রাঙ্গদার শোকাকুলা ছবিটিতে সেই শাবকহারা মায়ের ছবি আছে এবং কালসর্পের কথাও :
১)বিহঙ্গিনী যথা, / যবে গ্রাসে কাল ফণী কুলায়ে পশিয়া / শাবকে।
২) কাকোদর সদা
নম্রশিরঃ; কিন্তু তারে প্রহারয়ে যদি
কেহ, ঊর্ধ্ব-ফণা ফণী দংশে প্রহারকে।
তৃতীয় সর্গে রয়েছে এই সাপের মুখে ভেকের কথা :
চালাইল রথ রথী। কাল-সর্প-মুখে
কাঁদে যথা ভেকী, আমি কাঁদিনু, সুভগে,
বৃথা।
খনিগর্ভে মণি সীতার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা আর তারপর স্বপ্ন ভেঙে দুচোখে আঁধার দেখার বর্ণনা প্রদীপ নেভা ঘরের সঙ্গে তুলিত হয়েছে। প্রিয়ভাষিণী সরমাকে এই রৌদ্রময় লঙ্কাপুরীতে সুশীতল ছায়া, পঙ্কিল জলে পদ্ম এবং সাপের মাথার মণি বলেছেন সীতা। এ-প্রসঙ্গে আরেকটি সূক্তি :
কাঙ্গালিনী সীতা,
তুমি লো মহার্হ রত্ন! দরিদ্র, পাইলে
রতন, কভু কি তারে অযতনে, ধনি?
চতুর্থ অধ্যায়ের সমাপ্তিসূচক ছবিটি দুটি তুলনা টেনে এনেছে এবং তা অবশ্যি প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে :
আতঙ্কে কুরঙ্গী যথা, গেলা দ্রুতগামী
সরমা; রহিলা দেবী সে বিজন বনে,
একটি কুসুম মাত্র অরণ্যে যেমতি।
নিঃসঙ্গ ফুলের ছবিটি প্রবচন না হলেও ত্রস্তা হরিণের মতো ছুটে যাওয়া প্রবচন। আরেকটু বুঝিয়ে বললে, লোকব্যবহার্য বহুপ্রচলিত তুলনা। যদিও দুটি বর্ণনাই চিত্রৈশ্বর্যময়। এখানেও জীবজগৎ ও প্রকৃতির সম্মিলন।
৪।
পঞ্চম সর্গ ‘উদ্যোগ’, ষষ্ঠ সর্গ : ‘বধ’, সপ্তম সর্গ ‘প্রেতপুরী’ এবং নবম সর্গ ‘সংস্ক্রিয়া’-তে একাধিক প্রবচন ও বাঙালিসমাজে প্রচলিত লোক বিশ্বাসের ব্যবহার রয়েছে, যেমন : ‘কে কবে মঙ্গলঘট ভাঙে পদাঘাতে?’ কিংবা ‘চণ্ডালে বসাও আনি রাজা আলয়ে’, ‘প্রাক্তনের গতি, হায়, কার সাধ্য রোধে?’‘কে বুঝে মায়ার মায়া এ মায়া-সংসারে?। কিন্তু আমাদের অন্বিষ্ট কেবল প্রকৃতির প্রেক্ষাপট বা উপাদান ব্যবহার করে তৈরি প্রবচন ও চিরস্মরণীয় পঙ্ক্তিগুলি।
পঞ্চম সর্গ
১) সূর্য্যকান্তমণি
সম এ পরান, কান্তে; তুমি রবিচ্ছবি;-
তেজোহীন আমি তুমি মুদিলে নয়ন।
ভাগ্য-বৃক্ষে ফলোত্তম তুমি হে জগতে
আমার! নয়ন-তারা! মহার্হ রতন।
উঠি দেখ, শশিমুখি কেমনে ফুটিছে
চুরি করি কান্তি তব মঞ্জু কুঞ্জবনে
কুসুম!
২) নগর তোরণে অরি; কি সুখ ভুঞ্জিব,
যত দিন নাহি তারে সংহারি সংগ্রামে!
আক্রমিলে হুতাশন কে ঘুমায় ঘরে?
৩) যে ব্রততী সদা, সতি, তোমারি আশ্রিত,
জীবন তাহার জীবে ওই তরুরাজে!
ষষ্ঠ সর্গ
১) সহসা, শার্দূলাক্রমে আক্রমি রাক্ষসে,
নাশ্ তারে।
২) কমলিনী কভু ফোটে কি সলিলে
পঙ্কিল? জীমাতুবৃত গগনে কে কবে
হেরে তারা?
৩) অহিসহ যুজিছে অম্বরে / শিখী।
৪) তারা দলে লয়ে সঙ্গে, ঊষার ললাটে
শোভিল একটি তারা, শত-তারা তেজে!
ফুটিল কুন্তলে ফুল, নব-তারাবলী!
৫) চলিলা পশ্চিম দ্বারে কেশববাসনা –
সুরমা, প্রফুল্ল ফুল প্রত্যুষে যেমতি
শিশির-আসারে ধৌত!
৬) কুসুম-রাশিতে অহি পশিল কৌশলে!
৭) যথা পথে সহসা হেরিলে
ঊর্ধ্বফণা ফণীশ্বরে, ত্রাসে হীনগতি
পথিক, চাহিলা বলী লক্ষ্মণের পানে।
সভয় হইল আজি ভয়শূন্য হিয়া!
প্রচন্ড উত্তাপে পিণ্ড, হায় রে, গলিল!
গ্রাসিল মিহিরে রাহু সহসা আঁধারি
তেজঃপুঞ্জ। অম্বুনাথে নিদাঘ শুষিল!
পশিল কৌশলে কলি নলের শরীরে!
৮) মাটি কাটি দংশে সর্প আয়ুহীন জনে!
৯) আনায় মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু
ছাড়ে কি কিরাত তারে? বধিব এখনি,
অবোধ, তেমতি তোরে! জন্ম রক্ষঃকুলে
তোর, ক্ষাত্রধর্ম্ম পাপি, কি হেতু পালিব
তোর সঙ্গে? মারি অরি পারি যে কৌশলে।
১০) স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে;
পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি
ধূলায়?
১১) পাপপূর্ণ লঙ্কাপুরী; প্রলয়ে যেমতি
বসুধা, ডুবিছে লঙ্কা এ কালসলিলে!
রাঘবের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী
তেঁই আমি? পরদোষে কে চাহে মজিতে?
১২) হায় রে, রুধির-ধারা (ভূধর-শরীরে
বহে বরিষার কালে জলস্রোতঃ যথা)
বহিলা, তিতিয়া বস্ত্র, তিতিয়া মেদিনী
১৩) হায় রে মরি, কলাধর যথা
রাহুগ্রাসে; কিম্বা সিংহ আনায় মাঝারে!
১৪) নির্ব্বাণ পাবক যথা, কিম্বা ত্বিষাম্পতি
শান্তরশ্মি, মহাবল রহিলা ভূতলে।
সপ্তম সর্গ
১) কাঁপিল কনক-লঙ্কা, বৃক্ষশাখা যথা
পক্ষীন্দ্র গরুড় বৃক্ষে পড়ে উড়ি যবে।
২) পশি যজ্ঞাগারে শূর দেখিলা ভূতলে
বীরেন্দ্রে! প্রফুল্ল, হায় কিংশুক যেমতি
বনমাঝে ভূপতিত প্রভঞ্জন বলে।
৩) দূতবেশে বীরভদ্র, ভস্মরাশি মাঝে
গুপ্ত বিভাবসু, তেজোহীন এবে।
৪) যাও ফিরি, কেন নিবাইবে
এ রোষাগ্নি অশ্রুনীরে, রাণি মন্দোদরি?
বনসুশোভন শাল ভূপতিত আজি;
চূর্ণ তুঙ্গতম শৃঙ্গ গিরিবর শিরে;
গগনরতন শশী চিররাহুগ্রাসে!
৫) কীর্তিবৃক্ষ রোপিনু জগতে
বৃথা! নিদারুণ বিধি, এত দিনে এবে
বামতম মম প্রতি, তেঁই শুখাইল
জলপূর্ণ আলবাল অকাল নিদাঘে।
৬) ভূকম্পনে পড়িল ভূতলে
অট্টালিকা, তরুরাজী, জীবন ত্যাজিল
উচ্চকাঁদি জীবকুল, প্রলয়ে যেমতি।
৭) টঙ্কারি ধনুঃ, তীক্ষ্ণতর শরে
মুহূর্তে ভেদিলা ব্যূহ বীরেন্দ্র-কেশরী,
সহজে প্লাবন যথা ভাঙে ভীমাঘাতে
বালিবন্ধ!
৮) সপন্নগ গিরিসম পড়িলা সুমতি।
অষ্টম সর্গ
১) ‘খনির গর্ভে’ উত্তরিলা বালী,
‘জনমে সহস্র মণি, রাঘব; কিরণে
নহে সমতুল সবে, কহিনু তোমারে
তবু আভাহীন কেবা, কহ, রঘুমণি?’
২) প্রাণাধিক ছায়া মাত্র! কেমনে ছুঁইবে
এ ছায়া, শরীরী তুমি? দর্পণে যেমতি
প্রতিবিম্ব, কিম্বা জলে, এ শরীর মম।
নবম সর্গ
১) গ্রাসিলে কুরঙ্গে সিংহ ছাড়ে কি হে কভু / তাহায়?
২) রাহুগ্রাসে হেরি সূর্য্যে কার না বিদরে
হৃদয়? যে তরুরাজ জ্বলে তাঁর তেজে
অরণ্যে, মলিনমুখ সেও হে সেকালে।
৩) কে ছিঁড়িয়া আনিল হেথা এ স্বর্ণব্রততী,
বঞ্চিয়া রসালরাজে? কে আনিল তুলি
রাঘব-মানস-পদ্ম এ রাক্ষসদেশে?
নিজ কর্ম্মদোষে মজে লঙ্কা অধিপতি।
৪) বাহিরিলা পদব্রজে রক্ষঃকুলরাজা
রাবণ; - বিশদবস্ত্র, বিশদ উত্তরী,
ধুতুরার মালা যেন ধূর্জটির গলে; -
৫) করি স্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষোদল এবে
ফিরিলা লঙ্কার পানে, আর্দ্র অশ্রুনীরে –
বিসর্জ্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে
সপ্তদিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।।
নির্বাচিত বত্রিশটি দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। মেঘনাদবধ কাব্যের দীক্ষিত পাঠক মাত্রেই এর অর্থোদ্ধার করতে পারবেন। কিন্তু দেখা গেল, এই দৃষ্টান্তগুলিতে লোকপ্রচলিত উক্তি, বিশ্বাস এবং স্মরণীয় পঙ্ক্তি নির্মাণে কবি প্রকৃতির প্রেক্ষাপটকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন। নিছক সৌন্দর্যবর্ণনার কারণে প্রকৃতির উপস্থিতি এই মহাকাব্যে বহুবার দেখা গেলেও, ঐ বিশেষ ক্ষেত্রেও প্রকৃতি ও পৃথিবীর মানবেতর প্রাণীরা ফ্রেম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে কাহিনিকে বিশ্বাসযোগ্য ও উপভোগ্য করেছে।
৫।
রামায়ণ অনুসারে বসুন্ধরা-কন্যা সীতা। রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নে সীতা কৃষিসভ্যতার প্রতীক লাঙলের ফলা। যদিও মধুকবি সেই গভীর তাৎপর্য নিয়ে না ভেবে, পুরাণকাহিনিকেই বজায় রেখেছেন এক্ষেত্রে। দ্বিতীয় সর্গে বসুন্ধরা-কে ক্রন্দনাতুরা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রাবণের কুললক্ষ্মী দেবরাজকে জানায় সে কথা পিতা মহাদেব-কে বলার জন্য। রাবণের পাপের ভার অসহনীয় হওয়ায় : ‘না হলে নির্ম্মূল সমূলে / রক্ষঃপতি, ভবতল রসাতলে যাবে’। চতুর্থ সর্গে, রাবণের হাতে বন্দী সীতা পুষ্পক রথে যেতে যেতে মাতা বসুন্ধরাকে দ্বিধা হতে বলে। তারপর স্বপ্নে সীতা দেখা পায় মায়ের। জানতে পারে, বিধির বিধানেই রাবণ-ধ্বংসের কারণে সীতাহরণ ঘটছে। তাকে ভবিষ্যতে রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং রাবণের হত্যাও স্বপ্নে দেখান মাতা বসুন্ধরা। যে বসুন্ধরা রাক্ষসদের ভবিষ্যৎ-দুখে কাতর সীতাকে এই বলে আশ্বাস দেন :
‘লো রঘুবধূ, সত্য যা দেখিলি!
লণ্ডভণ্ড করি লঙ্কা দণ্ডিবে রাবণে
পতি তোর।’
চতুর্থ সর্গে খনিগর্ভমণি হিসেবে সীতাকে দেখানোতেও ঐ বসুন্ধরার রেফারেন্স পাওয়া যায়। সপ্তম সর্গে কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষভাবে মাতা বসুন্ধরাকে নারায়ণের কাছে যুদ্ধভয়ে কাতর ও প্রার্থনারতা দেখি। রাম-রাবণ ও দেবকুলের যুদ্ধোন্মত্ততায় যন্ত্রণার্ত ‘মহাভয়ে
ভীতা মহী’-র ছবিটি কল্পিত হলেও বাস্তব। পৃথিবীর প্রাণময়ী সত্তা যে-কোনো প্রাণঘাতী যুদ্ধে কাতর হবেই, মধুকবির মহাকাব্যে সেই ছবিই পুরাণাশ্রয়ে আঁকা হয়েছে : ‘মদকল করিত্রয় আয়াসে দাসীরে’। আরো একটি ব্যাপার রয়েছে এখানে, শরণার্থী বসুন্ধরা কিন্তু বিষ্ণুর কাছেই গেছে কেবল। এর আগে অবধি লক্ষ্মী মারফত তাঁর রাবণের পাপে পীড়ন-কথা পৌঁছেছিল হর-পার্বতীর কাছে। কিন্তু শিব রাবণের পক্ষে এখন, ফলত স্থিতি ও পালনের প্রভু বিষ্ণুর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই তাঁর। হোমরের আদি মহাকাব্য থেকে দেবতাদের ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ-বর্ণনার আদল নিয়েছিলেন মধুসূদন। এখানে সেই দেবতাদের রাজনীতির ছবিই স্পষ্ট। তাই পৃথিবীর ভয় কমাতে দেবতাদের বীরত্ব হ্রাস করবে গরুড়। দেবরাজ ইন্দ্র ও পার্বতী রামের পক্ষে কিন্তু শিব রাবণের সহায়ক। বিষ্ণু-র নির্দেশে গরুড় কিন্তু মহাদেবকেই সাহায্য করলেন, স্বয়ং বসুমতীর প্রার্থনায় সেই পথ প্রশস্ত হল। একদিকে সৃষ্টিকে রক্ষা করা হবে, অন্যদিকে শৈব রাবণ-কেও সাময়িক জয়ের সু্যোগ দিয়ে আবার তা কেড়ে নেওয়া হবে। বোঝা যায়, চতুর্থ সর্গে ‘ধরিনু রে গর্ভে তোরে লঙ্কা বিনাশিতে’ কন্যা সীতার উদ্দেশে করা বসুন্ধরার এই উক্তিকে সফল করার জন্যই এই দিব্য-রাজনীতি। এছাড়া ষষ্ঠ সর্গে মুমূর্ষু মেঘনাদের অন্তিমশয্যা গ্রহণের ছবিতেও এসেছে পৃথিবীর কথা : ‘লোহ সহ মিশি অশ্রুধারা, / অনর্গল বহি, হায়, আর্দ্রিল মহীরে।’ তথাকথিত পরিবেশ-সচেতন না হলেও পৃথিবীকে রক্ষার কথা পুরাণের প্রেক্ষাপটে লিখেছেন মধুসূদন। সপ্তম সর্গে এসেছে পৃথিবী রক্ষাকারী কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন – বিষ্ণুর প্রথম চার অবতারের কথাও। ভূমি, জলস্তর,বায়ুস্তর, জীবস্তর - এসবের কথাই রয়েছে এখানে। তাই একে আমরা ‘earth-centered approach’ বললে ক্ষতি কি?
৬।
প্রবচনের ভিতরে নিহিত রয়েছে ভাষণগৌরব বা প্রকৃষ্ট বাচনের ইশারা। অথচ প্রবাদ মূলত লোকপরম্পরায় প্রচলিত লোকশ্রুতি। মধুসূদন তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’(১৮৬১) উলট-পুরাণ নির্মাণ করেছেন। পরাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে তাঁর ব্যাখ্যায় স্বর্ণলঙ্কায় দেবানুগৃহীত রাম অনুপ্রবেশকারী শত্রু। রাবণ ও মেঘনাদ স্বদেশপ্রেমিক বীর আর বিভীষণ বিশ্বাসঘাতক। যদিও বিদেশি মহাকাব্যের ছায়ায় তিনি এর অনেকাংশ নির্মাণ করেছেন, কিন্তু ভারতীয়ত্ব এবং বিশেষভাবে বাঙালিয়ানার কমতি নেই কোথাও। ফলত শস্যশ্যামল বঙ্গভূমির লোকশ্রুতি হিসেবে চলে আসা বিশ্বাস, প্রবাদ তাঁর মহাকাব্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। শুধু গ্রিক নিয়তিবাদ নয় ভারতীয় বিশ্বাসে যে কর্মফল, জন্মান্তর এবং বিধির বিধান মেনে নেওয়া রয়েছে, তিনি তার অনুকীর্তন করেছেন। তাই তাঁর ‘গ্র্যাণ্ড ফেলো’ রাবণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে পারেন : ‘গ্রহদোষে দোষী জনে কে নিন্দে, সুন্দরী?’ কিংবা ‘বিধির বিধি কে পারে খণ্ডাতে?’। তাঁর কবিপ্রতিভার স্পর্শে এই অভিনব রামকথায় ভাষণগৌরব ও স্মরণীয় বর্ণনাগুলি বাংলাদেশের প্রকৃতির ছায়ায় লালিত। কিন্তু এ-কাব্যে বিচিত্র রসের ভিতরেও উজ্জ্বল হয়ে থাকে বীররস। যা কিছু মহৎ ও বীরোচিত তাও তো সুন্দর। সীতাকে হরণ করে রাবণ ঘটিয়েছিল সুন্দরের অসম্মান, ধরিত্রীর বেদনা। তাই সেই বীরসুন্দরের চোখে জল দিয়ে সমাপ্ত হয় এই আধুনিক মহাকাব্য। মহাকবির ‘চিত্ত-ফুলবন-মধু’ পান করে যুগপৎ মুগ্ধ ও বিষণ্ণ হয় পাঠক : ‘কে ছেঁড়ে পদ্মের পর্ণ’?
ঋণস্বীকার :
১) মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (গদ্যরূপ সহ)/ সম্পাদনা : কৃষ্ণগোপাল রায় / বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ।
২) মেঘনাদবধ কাব্যচর্চা / উজ্জ্বলকুমার মজুমদার সম্পাদিত / সোনার তরী।
৩) বাস্তুরীতি এবং সংরক্ষণ / জীবন বিজ্ঞান পরিচয় / সলিলকুমার চৌধুরী, কেদার নাথ ভট্টাচার্য ও দুলালচন্দ্র সাঁতরা / প্রান্তিক।
৪) দর্শন অভিধান / উমা সেনাপতি / বাক্প্রতিমা।
৫) The Questions Posed by Ecocriticism / [from Introduction to The Ecocriticism Reader, Cheryl Glotfelty and Harold Fromm, editors] – ইন্টারনেটসূত্রে প্রাপ্ত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন