রিটায়ারমেন্টের পরদিন বিকাশ বাবু ভেবেছিলেন আজ থেকে আর তাড়া নেই—সকাল ন’টার আগে বিছানা ছাড়বেন না। পৌনে আটটায় এক কাপ চা হাতে বড় ভাইপো-বউ সুনীতাকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখে একটু অবাক হলেন ।
অবিবাহিত বিকাশ বাবুর জীবন কেটে গেল চাকুরি করে আর অকালমৃত দাদাবৌদির ছোট ছোট তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করে। মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন সুপাত্রে। দুই ছেলের একজন ইঞ্জিনিয়ার অন্যজন ব্যাঙ্কে কর্মরত। ওদের স্ত্রীরাও চাকুরি করায় দু’জন কাজের মেয়ের ওপর সংসার। চা তো এনে দেয় তারাই। আজ হঠাৎ…। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই সুনীতা বলে—ওরা দুই ভাই আপনার সঙ্গে একটু দেখা করে যাবে অফিস যাওয়ার আগে। আর দাঁড়ায় না সে।
আধঘণ্টার মধ্যে তাঁর আদরের কৃতি দুই ভাইপো দরজায় এসে দাঁড়াল। ‘আয়’ –সাদর আহ্বান জানালেন বিকাশ বাবু। দেখে বুঝলেন দু’জনেই অফিস যাওয়ার জন্য রেডি। মুখ খুলল প্রথমে ছোটজন—সুরজিৎ, ‘বলছিলাম কি ছোটকা, আমরা দু‘ভাই ঠিক করেছি একটা ব্যবসা শুরু করব। মানে চাকরির আর কটা পয়সা! আমাদের দুজনের ছেলেমেয়ে বড় হয়ে উঠছে, ওদের জন্য প্রচুর খরচ। তারপর ওদের কেরিয়ারটাও ভাবতে হবে, তাই এখন থেকে অল্টারনেটিভ একটা রোজগারের পথ তো বার করতে হবে। বিকাশ বাবু সুরজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন যে, ঠিক কী সে বলতে চায়। এবার কথা বলে বড়জন, অঞ্জন—‘আসলে কী জানো, আমরা তো আর ইট কাঠের ব্যবসা করতে পারব না। আর, সফ্ট অয়ার কেনা বেচার ব্যবসায় ইনভেস্টমেন্টটা বেশ বেশি। তাই বলছিলাম তুমি তো রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট মোটা টাকা পাবে। খরচও তোমার তেমন কিছু নেই। তাই বলি টাকাটা আমাদের ব্যবসায় ইনভেস্ট করে দাও। তুমিও অংশীদার হিসেবে লাভের হিস্যা পাবে।’
স্মিত হেসে বিকাশ বাবু বললেন, আরে তোরা মনে মনে এতকিছু ভেবে রেখেছিস সেটা আগে বলবি তো! আমি তো সব টাকা ; মানে পি এফ, গ্রাচুইটির সব কিছু এক জায়গায় চুক্তির ভিত্তিতে দিয়ে দিয়েছি। যতই হোক সরকারি চাকরির টাকা তো মার যাবেনা। সেজন্য বৃদ্ধাবাস কর্তৃপক্ষ সাগ্রহে তাতে সিলমোহর দিয়ে দিয়েছে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে ওদের অ্যাকাউন্ট যোগ করেও দিয়েছি।’
দৃশ্যত স্তম্ভিত দুই ভাই। সুরজিৎ শুধু প্রশ্ন করল, এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের একবার জানালে না! বিকাশ বাবু হেসে জবাব দিলেন, ‘এই বাড়ির ওপর অধিকার আমি ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছি। তোরা ভাগ করে নিস।’
বেজার মুখে দুই ভাই বেরিয়ে গেল। মনে পড়ল বিকাশ বাবুর সেই দিনটির কথা যেদিন স্বাতীকে বলে দিয়েছিলেন, ঈশ্বর চান না আমরা ঘর বাঁধি। মনে পড়ল,বাইক অ্যাক্সিডেন্টে দাদা-বৌদির মর্মান্তিক মৃত্যুর পর নাবালক শিশুগুলিকে দেখিয়ে তাঁর মা বলেছিলেন, ‘কথা দে, বিয়ে করবি না। এরা ভেসে যাবে।’
স্বাতীও আর বিয়ে করেনি। গত বছর যেদিন জেনেছিলেন জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বাতী এখন বৃদ্ধাবাসে, সেদিনই শেষের এই সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন। আর তা স্বাতীর সম্মতিতেই। ইহজীবনে আর তাঁদের যোগাযোগ ছিন্ন হবেনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন