১৪ জুলাই, ২০২৩ – শ্রাবণী মধ্যাহ্নে বাংলা কবিতাজগৎ হারালো এক উদারমনা নিভৃতচারী কবিকে। কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ’ জার্নালে ‘কৃত্তিবাস’-এর ত্রয়োবিংশ সংখ্যায় পঞ্চাশের কবি সুধেন্দু মল্লিক (১৯৩৫-২০২৩)-এর ‘স্নিগ্ধ’ কবিতাগুচ্ছের দুইভাগে প্রকাশ করার কাহিনি শোনান আমাদের, যা তাঁর মতে কৃত্তিবাসী সমাদরের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সেই সূত্রেই আজ অনেকেরই জানা, দুই পর্যয়ে আঠারোটি কবিতা নিয়ে সেই সংখ্যার প্রধান কবি ছিলেন সুধেন্দু, সম্পাদক অবশ্য শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় (যদিও কবি তাঁর সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এবং শরৎকুমারের লেখা থেকেও জানা যায় – এই ঘটনায় মূল সম্পাদক সুনীল খুব খুশি হননি আর শঙ্খ ঘোষ সরাসরি এ-ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না কখনো) আবার ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’-এ দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে হয় : ‘সুধেন্দু মল্লিক, যাঁর শান্ত ও সাত্ত্বিক কবিতাতে ফুটেছিল স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম’। পরবর্তীকালে কবিবন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মতবিরোধের কারণেই হয়তো বা ‘কৃত্তিবাস’ ও ‘দেশ’ পত্রিকা থেকে ক্রমশ মুছে যান তিনি। তবে সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত দেশ কবিতা সুবর্ণজয়ন্তী সংকলনে তাঁর দুটি কবিতা (শূন্যতাই কি রাজা, বোন) আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে। যদিও তাঁর কবিতা নিয়ে চর্চা সীমিত, তবু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে এসেছিলেন তিনি। এছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু প্রবন্ধ, সমালোচনা সাক্ষাৎকার এবং তরুণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম পুস্তিকা (কবি সুধেন্দু মল্লিক : এক পতিত পৌত্তলিক, ২০১০) ও গৌরশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি সংকলন (ঐশী ভাবনায় সুধেন্দু মল্লিক, ২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে বিগত কয়েক বছরে আর ২০২২-এ সাতকর্ণী ঘোষ সম্পাদিত ‘কলকাতার যীশু’ পত্রিকার সুধেন্দু মল্লিক সংখ্যার পরিবর্ধিত রূপ ‘সঙ্গে প্রসঙ্গে সুধেন্দু মল্লিক’ সংকলন। মৃত্যুর আগেই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর গদ্যসংগ্রহ ও কবিতাসমগ্র-ও। রয়েছে শেষবেলায় ২০২৩-এর জানুয়ারিতে ‘লুব্ধক’ পত্রিকায় দেশভাগ ও স্বাধীনতা-৭৫ নিয়ে এক মনোজ্ঞ সাক্ষাৎকার।
২০২৩-এর শূরুর দিকে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর নির্বাচিত কবিতার এক প্রামাণ্য সংকলন ‘কবিতা মঞ্জুষা’, আর সেই বইকেই যেন সামনে রেখে আজীবন কবিকৃতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমি তাঁকে দিয়েছে ২০২৩-এর ‘জীবনানন্দ দাশ সম্মান’। ‘হিরণ্ময় অন্ধকার’ (১৯৬৩) থেকে ‘সঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’ (১৯৭৯) পেরিয়ে ‘দেরী হবে রে...তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ’ (২০২২) এবং ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০১৭) ও ‘কবিতা মঞ্জুষা’ (২০২৩) –এ-পর্যন্ত তেরোটি কাব্যের কবি অকৃতদার সুধেন্দু মল্লিক পঞ্চাশের সমুজ্জ্বল কবিকুলের অন্যতম; স্বভাবত স্বতন্ত্র, মৃদুকণ্ঠ এই কবি রক্তে বহন করেছেন কবিতার উত্তরাধিকার। পিতামহ পদ্মশ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিক, পিতা জ্যোৎস্নানাথ। কয়েকবছর কাটোয়া কলেজে অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনার পর বিচারকের পেশাকেই গ্রহণ করেছিলেন। কখনো তিনি ‘বিশ্বাসপরায়ণ নাস্তিক’ কখনো বা ‘পতিত পৌত্তলিক’। বাংলা কবিতার মনস্ক পাঠকের কাছে তাঁর ‘সঙ্গে আমার বালককৃষ্ণ’(১৯৭৯) কাব্যটি আধুনিক মনের ঈশ্বরভাবনার এক অনন্য নিদর্শন। তবে কেবল আস্তিক্যচেতনা নয়, প্রেম-সমাজ এবং শোককবিতার বৃত্তেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। প্রিয় কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে লেখেন ‘স্বর্গে বাউণ্ডুলে’, অরুণকুমার সরকারের মৃত্যুতে ‘কবির মৃত্যু’, সত্যপ্রিয় ঘোষের স্মরণে ‘জরা’ কিংবা বোনের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু তাঁকে লিখিয়ে নেয় ‘বোন’ নামের এক অসামান্য এলিজি : ‘আগুনের বসন পরে কোন্সংসারের দিকে ফিরে গেলি বোন’। আবার ‘সামনে মহান বিচারপতি’, ‘নীরব গর্দভ’, ‘ধর্মের কল’, ‘যাজক গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টেইনস্এর রক্ততিলক’, ‘আমিও হত্যাকারী’ – ইত্যাদি কবিতার লেখকও তিনিই। ইন্দিরা গান্ধি তাঁর কাছে দেশজননীর প্রতিভূ। একদা ‘ধর্মের কাহিনি আজ চোরারাই শুনুক’ – এই উচ্চারণ যাঁর, তিনি-ই একালে করোনার আবহে লেখেন ‘ব্যাধ’-এর মতো এক চমৎকার কবিতা। তাই কবিবন্ধু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর কবিতায় খুঁজে পেয়েছিলেন ‘সময়বিবেকী কবিতাবলীর অন্তর্লীন মাহাত্ম্য’। ১৯৯০ সালে পেয়েছিলেন ভারত সরকার নির্বাচিত জাতীয় কবির সম্মান। ২০২০ সালের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের শেষ বাছাইয়ে উঠে এসেছিল তাঁর কাব্য ‘পুষ্পিত ধিক্কার’-এর নাম। বেসরকারি উদ্যোগে পেয়েছেন আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন সুবর্ণপদক, ঝড়ো হাওয়া পত্রিকার মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় সম্মান, সারঙ্গ পত্রিকার কবি দিনেশ দাস স্মারক সম্মান, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার, দীনেশ-রবীন্দ্র পত্র সম্মান ইত্যাদি। তবে ৮৮ বছর বয়সে অকৃতদার কবির প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক পরিবারের চার পুরুষের কবিতাচর্চার ধারায় একরকম ছেদ পড়ে গেলো। আমাদের রঙিন ক্যানভাসে তাঁর একাধিক কবিতা প্রকাশ পায়। অক্টোবর ২০২১ সংখ্যার প্রধান কবি ছিলেন তিনি-ই। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চারটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ করা হলো :
সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ
ঘুরছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার
বালক কৃষ্ণ।
থামছি আমি তোমার জন্যে সঙ্গে আমার
বালক কৃষ্ণ।
তোমার জন্যে হাত করি জোড়
ভালোবাসার বকুল প্রহর
তোমার নামে ভাসাই জলে সঙ্গে আমার
বালক কৃষ্ণ। (সঙ্গে আমার বালক কৃষ্ণ, ১৯৭৯)
নদী
ছোটবেলায় আমারো এক নদীর
সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
এপার ওপার বিস্ময়। বলেছিলাম,
নদী, তুমি কোথা হইতে আসিতেছো?
নদী হাসলো। বললো, বালক –
রবীন্দ্রনাথের হৃদয় হইতে।
বলেছিলাম, নদী তুমি কোথায় ফিরিবে?
নদী হাসলো। বললো, বালক –
রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে।
আমাকে নেবে?
এসো! ভয় পেয়ো না।
আমার প্রতিটি তরঙ্গে রবীন্দ্রনাথ। (পুষ্পিত ধিক্কার, ২০১৬)
সাক্ষাৎ
ভাবিনি এমন হবে। শুধু না দেখে না দেখে
না পেয়ে না পেয়ে
ঘটনাদুর্লভ দিন কেটে গেছে অবসাদে
অবিরামে।
আজ কেন এমন হলো যে।
তুমি যাচ্ছো একেবারে সামনে রাস্তায়
দু’পায়ের ছন্দে জোড়া শালিখের আসন্ন মঙ্গল
পৃথিবীর চিত্রিত কুশল।
আর আমি সেই রাজার নর্তক
উচ্ছল ভ্রূক্ষেপহীন
যেন সে সময় নেই বলবো তোমাকে
একটু দাঁড়াও
অজন্তার গুহাগৃহে অবলুপ্ত অপরূপ
মোহ। (পুষ্পিত ধিক্কার, ২০১৬)
বছর কুড়ি বাইশ
(কবি ঋতম্ মুখোপাধ্যায়কে)
দরজাটা বাজছে। দাঁড়িয়ে আছে এক
কুড়ি বাইশ বছরের তরুণ মহিমা
হাতে তার ফুল নয় –
বিস্তৃত উদ্যান।
মুখে প্রথম আলোর স্থিতি।
যেন এক উদ্গত আশ্চর্য দেশ
যেন প্রথম দিগন্তের তোড়া বাঁধা হাত।
এসো অপেক্ষা
এসো মধুবাতা
এসো বোধন। (দেরী হবে রে...তোর গায়ে এখনো সংসারের গন্ধ, ২০২৩)
তথ্য সংকলন ও ছবি : ঋতম্ মুখোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন