বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১
কাজল সেন-এর কবিতা
অমৃতের সন্তান
মিস্টার সোম আপনি তো আমার বাড়ি বানিয়েছেন
সাজিয়েছেন এবং গছিয়েছেনও আমাকে
কিন্তু বলতে পারেন একবছর না যেতেই
কেন ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জল
দেওয়ালের প্যারিস কেন বেকুবের মতো পড়ছে ঝরে
অথচ আপনি তো পাশ করা সিভিল ইঞ্জিনীয়ার
যেদিন নিজের বাড়ির প্রয়োজন হবে আপনার
ভেবে দেখুন সেদিন সেই ছাদের নিচে
কতটা সুরক্ষিত থাকবে আপনার পরিবার
আর ছাদের ওপরে গামলায় টবে লাগাবেন যত গাছ
তারাই বা কতটা নিশ্চিন্তে জন্ম দেবে তাদের সন্তান
সৃষ্টির ক্ষমতা বা অধিকার নেই কারও
কেউ কিছুই সৃষ্টি করে না মিস্টার সোম
করে শুধুই নির্মাণ
সেই নির্মাণে এতটা বিচ্যুতি কেন আপনার
অথচ শুনেছি আমি আপনি সবাই নাকি অমৃতের সন্তান
কামাল হোসেন-এর কবিতা
ভাঙতে ভাঙতে
পৃথিবীর বুকে এতো হাঁটাহাঁটি করেও কিছু
জানা হলো না, চেনা হলো না, অপরিচিত
এক আকাশের নীচে শুধু জনহীন বসতি,
মেঘহীন, তীব্র রৌদ্রময়, দুঃখকষ্টের ধাক্কা
বস্তুত প্রতি-মুহূর্তে আমি ভেঙে যাচ্ছি,
আমার প্রতিটি দেহাবশেষ হাড়গোড় রক্ত আবর্জনা
ছিটকিয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে এই নির্জন মরুভূমিতে
ভাঙতে ভাঙতে আমি হারিয়ে যাচ্ছি
ধরিত্রীর দূরাগত আশ্রয়ে
উমাপদ কর-এর কবিতা
শিরোনাম থাকতে হবে এমন কোনও কথা নেই
৭
ফুল তুলতে কাঁটার ঘা। কাঁটার ক্ষত নিয়ে ফুল তোলা। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এই দুটো বাক্য নিয়ে ভাবতে থাকি।
ফুল ও কাঁটা সম্পর্কে থেকেও, দূরত্ব রাখে। হাত একটি চেনা বুঝদার মাধ্যম হয়ে এদের দূরত্ব ঘোচায়। আমাদের কোটের বুকে অর্ধেকটা বেরিয়ে থাকা ফুল হাতের আঁচড়ের দিকে কোনো খেয়ালই রাখে না। লোকের দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকায়। ফুল নিজের মৃত্যুটাকে র্যালিশ করে আরো কিছুটা বেঁচে নেয়। ফুল কাঁটাকেও মনে রাখে না। তারই মৃত্যু ঠেকাতে যে নাকি হাতকে আঘাত করেছিল। হাত মনে রাখতে বাধ্য হয় কাঁটাকে, অনেকটা সময়, যতক্ষণ না মলম ক্ষতকে নির্মূল।
কাঁটাটা কখনো মরে। কখনো মরো-মরো বেঁচে থাকে। জন্মদাত্রী গাছটা তখনও বেঁচে যে! জোর আঘাত করলে হাতের মাস-রক্তের সঙ্গে সে স্বর্গে যায়। আর অল্প আঘাতে নিজের হুলটা খতম করে নির্জীব বেঁচে থাকে। ফুলের জন্য দুঃখটা তার মরে না। আমৃত্যু একটা কষ্টবোধ তাকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। সবটাই অনুভব করে গাছ, কিন্তু বলে না কিছুই।
ফুলের পাপড়িগুলো খসে না-পড়া পর্যন্ত বুকের ফুল ফুলদানিতে বাস করে। আহ্লাদে তার ধরে না। যতদিন বাঁচে, আনন্দে বাঁচে। হাতের মাংসে জড়ানো কাঁটা আস্তাকুড়ে যায় কোনোরকম শোকসভা ছাড়া। গাছে অর্ধমৃত কাঁটা রিকেট হতে থাকে ঠিকমতো রসের যোগান না-পাওয়ায়। যতক্ষণ বা যতদিন বেঁচে থাকে, আনন্দে থাকতে পারে না।
দুজনেই নিজের কাজটা ঠিকঠাক সারে, এমনকি মধ্যমণি হাতটাও। তবু কেন যে ভাবতে ভাবতে আমি কাঁটার দিকেই ঝুঁকে পড়ি, ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না।
(এখানে শুধুমাত্র সেই ফুলগাছের কথা ভাবা হয়েছে, যার কাঁটা আর ফুল দুটোই আছে, আর ফুলগুলো মোহিনী। নয়তো হাত কেন ব্যস্ত হয়ে উঠবে!)
১৬-০৯-২০২০
অলোক বিশ্বাস-এর কবিতা
মগ্নতা কোথা হতে আসে
আগুনের পাশে বসে মগ্নতা কোথা হতে কিভাবে আসে। কিভাবে, সঘন মগ্ন তুমি, হৈচৈ হৈচৈ নিষিক্ত সীমানায়। শিকারি অস্ত্রের উৎসব লেগেছে যেকোনো উচ্চতায়। বন্ধুসম সমুদ্র আছড়ে পড়ছে সামান্য কুটিরে। হাওয়ায় হাত পা ছড়িয়ে ভাবছো আকাশ কিভাবে এতো নীল, সন্ত্রাস কবলিত গন্ধে। দুর্ঘটনাপ্রবণ ব্যবস্থা তোয়াক্কা না করে ছুটে যাচ্ছে কাঁপা হাতের সাইকেল। ভূমিকম্পের দাহ্য খবরে গানের বুক ফাটলেও যেভাবে মগ্ন আছো, দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে মগ্নতা কোথা হতে, কিরূপে আসে। রাতভর শব্দসন্ত্রাস, কিম্ভুতাকার সহবাস, চোখে চোখে দাঙ্গা, অপ্রাসঙ্গিক বিবস্ত্রামি শিয়রের কাছে। কিভাবে অস্থিরতায় বসে দেখছো শান্ত আকাশ। প্রবল ঘন্টা বাজাচ্ছে ধর্মের ফেরিওয়ালা। প্রশান্তিকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে বলা সন্ত্রাসভর্তি টুপি উড়ছে। একটা মগ্নতা থেকে অন্য মগ্নতায় পৌঁছনোর পূর্বেই হয়তো তোমার ঠিকানা হতে পারে গ্যাস চেম্বার...
ওবায়েদ আকাশ-এর কবিতা
সংশয়বাদিতা
সংশয়বাদিতা তোমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে
আর সত্যবাদিতা মগডালের আড়ালে বসে
চারদিকের আলু-পটলের চাষবাস নিয়ে
ঋতুকালীন ক্ষণ গণনায় উন্মাদপ্রায়
একদিন ঝড় এলো আর বাঁশফুলের ছেলেমেয়েগুলো
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাঁপাতে থাকল আর
তাদের দেখতে এলো সংশয়বাদের প্রতিবেশিগণ
যাদের ভাষা সকলে বোঝে না
আমি তালগাছের চূড়ায় বসে এই দৃশ্য
দেখতে দেখতে পড়ে যাচ্ছি বলে
তালগাছের ঠিক মাঝামাঝি এসে মধ্যাকর্ষণে ঝুলে যাই
অনেকে আমাকে সংশয়বাদের নিকটাত্মীয় বলে
গালি দেয় আর চিকন বাঁশের বর্শা বানিয়ে
অর্বাচীন গ্রেনেড বসিয়ে যার যার মতো খোঁচা মারে
ফলে আমার হাত আরো বেশি প্রসারিত করে
তালগাছের কণ্টকিত শাখা আঁকড়ে ধরতে গিয়ে
একদিন রক্তাক্ত হয়ে নিষপ্রাণ দেহে গোঙাতে গোঙাতে
তালগাছের শেকড়ে নেমে জড়িয়ে পড়ে থাকি
হাইকেল হাশমী-র কবিতা
স্পর্শহীন, অনুভূতিহীন পৃথিবীতে
আমরা এখন স্পর্শের স্বাদ ভুলে গেছি। আমরা এখন অনুভূতির অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত। এখন আমাদের জন্য অনুভবের উপলব্ধির দ্বার বন্ধ। এখন আমরা অদৃশ্য জগতে করছি বাস, নিজেদেরই সৃষ্টি করা অনুভূতিহীন পৃথিবীই আমাদের বাসস্থান। এটার নাম দিয়েছি আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জয়গান। এই পৃথিবীতে দৃষ্টি,স্পর্শ আর অনুভূতি,এসবের নেই কোন প্রয়োজন।
তোমার মনে আছে, আমাদের ছোট বেলায়, বই ছিল জ্ঞান আহরনের সব চেয়ে মোক্ষম উপায়। বই’এর মাঝে হারিয়ে যেতাম - গল্পে, বিজ্ঞানে, ইতিহাস আর ভ্রমণে। নতুন বই’এর ঘ্রাণে মুগদ্ধ হতো এই প্রাণ। বইকে করতে পারতাম স্পর্শ, দেখতে পারতাম অক্ষর, শব্দ, বাক্য। কখনো বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতাম, কখনো খোলা বই পড়ে থাকতো বুকের উপর, আর কখনো পৃষ্ঠা মুড়ে রেখে দিতাম বালিশের তলে। কোন মিষ্টি মানুষের সাথে বই’এর আদান প্রদান। তারপর খুঁজতাম কোন শুকনো ফুল, যদি পাওয়া যায় কোন সুবাসিত চিরকুটের সন্ধান। আজ হায়! “ই-বুক” আর “কিন্ডেল”, “ট্যাব” আর “ল্যাপটপ”, এই অনুভূতিহীন সব যান্ত্রিক সরঞ্জাম। এগুলোর মাঝে কি পাওয়া যাবে কোন চিঠি, কোন সুগন্ধি মাখা চিরকুট, শুকনো ফুল অথবা কারোর অশ্রুভেজা পত্রের সন্ধান?
আমাদের সময়, আমরা গান শুনতাম কিন্তু ওটা ছিল কলের গান। গানের “রেকর্ড”,“জ্যাকেট” থেকে বের করে ফু দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করে, রাখতাম “গ্রামোফোনের” “ডিস্কের” উপর। আবার গ্রামোফোনের “স্টাইলেসের” “হেডে” ফু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখতাম রেকর্ডের উপর। মধুর সুরে বেজে উঠতো গান আর সেই সাত সুর জাগিয়ে তুলতো সুপ্ত আবেগের জলপ্রপাতের মাঝে কলতান। যদি বলি “গ্রামোফোন”, “রেডিওগ্রাম”, “চেঞ্জার”, “টেপরেকর্ডার” এমন কি “সিডি” আর “ভিসিডি” সবই ছিল স্পর্শ আর অনুভূতির মাধ্যম। কিন্তু হায়! আজ “ক্লাউড” থেকে “ডাউনলোড” করে শোনা যায় গান – “রেকর্ড” বা “ক্যাসেটের জ্যাকেটের” গায়ে দেয়া গায়ক আর সুরকারের পরিচিতি, তাদের ছবি আর গানের শিরোনাম দেখে তৈরি হওয়া অনুভূতি, জানি এই “ডিজিটাল” পদ্ধতিতে পাওয়ার নেই কোন অবকাশ। ওটা ছিল স্পর্শ থেকে অনুভূতির গন্তব্যে পৌঁছানোর এক মনোরম ভ্রমণ।
এসব অনুভূতি হারাতে হারাতে আমরা এই মহামারীতে হারিয়েছি নিজের প্রিয়জনকে স্পর্শ করার অধিকার। দূর থেকে দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে না। তাকে ধরা যাবে না, আলিঙ্গন করা যাবে না। তাকে চুম্বন করা যাবে না এমন কি স্পর্শ পর্যন্ত করা যাবে না। এ কেমন একটি আতঙ্ক, আমার হাতে বিষ ভর্তি, আমার নিঃশ্বাসে বিষের মিশ্রণ। আমার চুম্বন তো নয় বরং একটি বিষাক্ত দংশন – আমি এখন মানুষ নই হয়েছি মরণঘাতী জীবাণুর গুদাম।
এখন আমাদের বাস এক স্পর্শহীন, অনুভূতিহীন পৃথিবীতে!