স্পর্শহীন, অনুভূতিহীন পৃথিবীতে
আমরা এখন স্পর্শের স্বাদ ভুলে গেছি। আমরা এখন অনুভূতির অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত। এখন আমাদের জন্য অনুভবের উপলব্ধির দ্বার বন্ধ। এখন আমরা অদৃশ্য জগতে করছি বাস, নিজেদেরই সৃষ্টি করা অনুভূতিহীন পৃথিবীই আমাদের বাসস্থান। এটার নাম দিয়েছি আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জয়গান। এই পৃথিবীতে দৃষ্টি,স্পর্শ আর অনুভূতি,এসবের নেই কোন প্রয়োজন।
তোমার মনে আছে, আমাদের ছোট বেলায়, বই ছিল জ্ঞান আহরনের সব চেয়ে মোক্ষম উপায়। বই’এর মাঝে হারিয়ে যেতাম - গল্পে, বিজ্ঞানে, ইতিহাস আর ভ্রমণে। নতুন বই’এর ঘ্রাণে মুগদ্ধ হতো এই প্রাণ। বইকে করতে পারতাম স্পর্শ, দেখতে পারতাম অক্ষর, শব্দ, বাক্য। কখনো বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতাম, কখনো খোলা বই পড়ে থাকতো বুকের উপর, আর কখনো পৃষ্ঠা মুড়ে রেখে দিতাম বালিশের তলে। কোন মিষ্টি মানুষের সাথে বই’এর আদান প্রদান। তারপর খুঁজতাম কোন শুকনো ফুল, যদি পাওয়া যায় কোন সুবাসিত চিরকুটের সন্ধান। আজ হায়! “ই-বুক” আর “কিন্ডেল”, “ট্যাব” আর “ল্যাপটপ”, এই অনুভূতিহীন সব যান্ত্রিক সরঞ্জাম। এগুলোর মাঝে কি পাওয়া যাবে কোন চিঠি, কোন সুগন্ধি মাখা চিরকুট, শুকনো ফুল অথবা কারোর অশ্রুভেজা পত্রের সন্ধান?
আমাদের সময়, আমরা গান শুনতাম কিন্তু ওটা ছিল কলের গান। গানের “রেকর্ড”,“জ্যাকেট” থেকে বের করে ফু দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করে, রাখতাম “গ্রামোফোনের” “ডিস্কের” উপর। আবার গ্রামোফোনের “স্টাইলেসের” “হেডে” ফু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখতাম রেকর্ডের উপর। মধুর সুরে বেজে উঠতো গান আর সেই সাত সুর জাগিয়ে তুলতো সুপ্ত আবেগের জলপ্রপাতের মাঝে কলতান। যদি বলি “গ্রামোফোন”, “রেডিওগ্রাম”, “চেঞ্জার”, “টেপরেকর্ডার” এমন কি “সিডি” আর “ভিসিডি” সবই ছিল স্পর্শ আর অনুভূতির মাধ্যম। কিন্তু হায়! আজ “ক্লাউড” থেকে “ডাউনলোড” করে শোনা যায় গান – “রেকর্ড” বা “ক্যাসেটের জ্যাকেটের” গায়ে দেয়া গায়ক আর সুরকারের পরিচিতি, তাদের ছবি আর গানের শিরোনাম দেখে তৈরি হওয়া অনুভূতি, জানি এই “ডিজিটাল” পদ্ধতিতে পাওয়ার নেই কোন অবকাশ। ওটা ছিল স্পর্শ থেকে অনুভূতির গন্তব্যে পৌঁছানোর এক মনোরম ভ্রমণ।
এসব অনুভূতি হারাতে হারাতে আমরা এই মহামারীতে হারিয়েছি নিজের প্রিয়জনকে স্পর্শ করার অধিকার। দূর থেকে দেখা যাবে, ছোঁয়া যাবে না। তাকে ধরা যাবে না, আলিঙ্গন করা যাবে না। তাকে চুম্বন করা যাবে না এমন কি স্পর্শ পর্যন্ত করা যাবে না। এ কেমন একটি আতঙ্ক, আমার হাতে বিষ ভর্তি, আমার নিঃশ্বাসে বিষের মিশ্রণ। আমার চুম্বন তো নয় বরং একটি বিষাক্ত দংশন – আমি এখন মানুষ নই হয়েছি মরণঘাতী জীবাণুর গুদাম।
এখন আমাদের বাস এক স্পর্শহীন, অনুভূতিহীন পৃথিবীতে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন