বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারী, ২০২৩

অমৃতেন্দু মণ্ডল-এর বিশেষ গদ্য

কবি নাসের হোসেন শ্রদ্ধাস্পদেষু 
এই বিশ্বসংসারে যতরকম কাজ আছে, যতরকম সম্পর্ক আছে,যতরকম শিল্প আছে ––– সবকিছুর মূলে রসের যোগান আসে ভালোবাসা থেকে।ভালোবাসা আসলে চালিকাশক্তি সবকিছুর আর এই ভালোবাসা আসে একাত্মতা থেকে, একাত্ম হতে পারলে তবেই ... । এই একাত্মভাবের জন্যে হৃদয়কে করজোড়ে দাঁড়াতে হয় অনুভবের কাছে, প্রথমেই দরকার তাকে। সে ঘুমভেঙে উঠে পাশে এসে দাঁড়ালে তবেই ...। একটি সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রাণের কবি শিল্পী নাসের হোসেন বলেছিলেন, "কবিতালেখা বা যে -কোনো  শিল্পসৃজন মানুষের জন্য। এই মানুষ কারা? যাঁরা কবিতাটা অনুভব করেন, শিল্পটা অনুভব করেন। আমি ইচ্ছে করেই 'বোঝেন' শব্দটা লিখলাম না। কেননা অনুভব করাটা প্রধান ব্যাপার। তো, কবিতা বা শিল্প হচ্ছে যাঁরা এটাকে অনুবভ করেন তাঁদের জন্য।"  একজন শুদ্ধচিও মানুষ –––তিনি কবি হোন বা না-হোন শিল্পী বা না-শিল্পী যাই হোন না কেন মানুষকে তিনি ভালোবাসেন।মানবতায় তাঁর দ্বিধাহীন আস্থা ও বিশ্বাস।সত্তার প্রতিটি বিন্দুতে নিহিত থাকে স্বপ্ন। কবি নাসের হোসেনের  স্বপ্নভাবনাই তাঁর কবিতাভাবনা এবং সেই স্বপ্নসমূহ যেহেতু মানবিক-বার্তাই বহন করে,ফলে তাঁর সঙ্গে, আমরা যারা তাঁর কবিতার পাঠক, বিশ্বাস করি তাঁর সব স্বপ্নই গঠিত হয়ে থাকে কবিতায় প্রকাশিত হওয়ার জন্যে। এই বিশ্বের তাবৎ কিছু সতত পরিবর্তনশীল ।কোনকিছু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না  শিল্পসাহিত্যের প্রবনতাও তদরূপ । পরিবর্তিত হয়ে নতুন রূপে নতুন বাঁক সৃষ্টি করতে করতে তার চলা।তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকেও পুনর্নবিকরণ করে নিতে হয়। স্বীয়সৃষ্টিকে নির্মাণ বিনির্মাণ করে উপস্থাপন করতে হয় বর্তমানকালের কাছে | কার্যত ভাবনা ও দৃষ্টিকোন বদলে যায় এবং তা প্রকাশের ধরণ বা স্টাইলস্টাইলও বদলে যেতে পারে কারও কারও ––– অন্তত আমার পর্যবেক্ষণে তাইই মনে হয় কবি নাসের হোসেনের ক্ষেত্রে৷ 
তিনি প্রধানত স্যুররিয়ালিজম ধারার কবি৷ পরের দিকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে তাঁর মধ্যে, তাঁর সৃজনপ্রক্রিয়ার মধ্যে এসে পড়লো পোস্টমডার্ন ভাবনা। এও বলা চলে উপরোক্ত দুটি ভাবনা একই সঙ্গে ক্রিয়াশীল থেকেছে তাঁর মধ্যে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। তার প্রতিফলন তাঁর কবিতায় দুর্লক্ষ্য নয় মোটেও। কিন্তু যেটি শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিত ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য হয়ে তাঁর মধ্যে থেকে গিয়েছে, তা অনেকটা হাওয়ার মতো অনুভববেদ্য। সহজ করে বলা, সহজ করে গভীর কথা বলা৷ তার মধ্যে থাকে নানা রকম স্তর, বহু বিচিত্র সেড তাঁর কবিতার মধ্যে, এমন কি একই শব্দ ও পংতির ভিতরেও থাকে বহুমাত্রিক আলোছায়ার মেধাবী কারুকাজ, মনোযোগী পাঠকের কাছে উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায় ৷  কবি নাসের হোসেনের  সৃষ্টির গায়ে সুরভির মতো জড়িয়ে বহমান এক বোধ, কখনো  স্পষ্টরূপে কখনো-বা পরোক্ষে আভাসে ইংগিতে তা হলো 'মঙ্গলবোধ', মঙ্গলকামনা। তিনি চান সবার ভালো হোক। সবকিছুর  মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত থাকে তাঁর অন্তরে। তিনি চান পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ সুখে থাকুক, শুধু মানুষ কেন ––– উদ্ভিদ মনুষ্যেতর প্রাণী পশু পাখি কেউ যেন কষ্ট না পায়।
বাস্তবত প্রত্যকটি মানুষ যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন,যেসব গাছ ,প্রাণী কুকুর বেড়াল পাখির সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে, কেউই তাঁর স্নেহ ভালোবাসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়নি।এসবের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর আকাশের মতো উদার ব্যাপ্ত,সমুদ্রের মতো গভীর রহস্যময় তাঁর জগৎ তাঁর সৃজনবিশ্ব।  একজন বড় মাপের মানুষ,সতত সৃষ্টিমুখর,মহৎ কবি নাসেরদার অতর্কিতে না-ফেরার দেশে চলে  যাওয়াটা (জন্ম: ২ জানুয়ারি ১৯৫৮ , মৃত্যু: ৯ ডিসেম্বর ২০২০) মন থেকে মেনে নিতে পারি না, কষ্ট হয়, চোখ ভিজে ওঠে।পাশাপাশি এও ভাবি ––– তিনি তো আমাদের মধ্যই আছেন, থাকবেন, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ৷

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন