যতদিন স্কুলে যাইনি ততদিন আমার যদ্দূর মনে পড়ে আমার নিজের লেখালেখি শুরুই হয়নি, যদিও দশবছর তার পক্ষে অনেকটা বয়স। তার কারণ প্রধানতঃ এই যে আমি তো বাংলা ঠিকমত শিখলাম স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হবার সময় আর স্কুলে গিয়ে। সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলে গিয়েই ভাল ছাত্রী বলে নাম হল, আর ওমনি স্কুল-ম্যাগাজিনে লেখার তাগাদা এল শিক্ষকদের কাছ থেকে। সেই শুরু। সমানে গল্প, আর ছড়া লেখা শুরু করলাম। গল্প মোটামুটি লিখতাম সেই সময়, যদিও তখনও ভাষা তেমন ঝরঝরে হয়নি। কিন্তু ছোটবেলার ছন্দের দোলা মনে গেঁথে গেছিল। ছন্দের হাত মোটামুটি ভাল ছিল বলে ছড়া বেশ সহজেই উৎরে যেত। লেখার উৎসাহও ছিল খুব। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে আমার এক মাসতুতো দাদার বিয়ে হয়েছিল। আমি ক্ষেপে উঠেছিলাম বিয়ের ছড়া লিখব বলে। মনে আছে কবিগুরুর ‘উতর বায় কারে জাগায় /কে বোঝে তার বাণী’ কবিতাটির ছন্দ নকল করে দাদার বিয়ের ছড়া লিখেছিলাম। সেটা আমার মাসির উৎসাহে ছাপিয়ে সবার মধ্যে বিলানো হয়েছিল। স্কুল ম্যাগাজিনের বাইরে সেই আমার প্রথম ছাপানো কবিতা। স্কুলে দুজন লেখক বান্ধবী জুটল, তাদের সঙ্গে টেক্কা দেবার খেলা শুরু হল। তাদের মধ্যে একজন আজ আর নেই, আর অন্যজন কেবলই ফিজিক্সের অধ্যাপক হয়ে জীবন কাটিয়েছে। আমি একাই আজও ছেলেমানুষের মতো কথা আর ছবি নিয়ে খেলা করবার বয়সটা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
এখানে আমার মায়ের ভূমিকাটুকু বলতেই হয়। তিনি আমাকে লেখার জন্য প্রচুর উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি নিজে স্কুলে পড়ার সময় কিছু লেখালেখি করেন, তাঁর মনে সাহিত্যের প্রতি এক গভীর টান ছিল। ছোটবেলায় তাঁকে দেখেছি সারাদুপুর শেক্সপীয়রের মূল নাটক পড়ে কাটিয়ে দিতে। আমাদের বাড়িতে ব্রাউনিং টেনিসনের কাব্যসংগ্রহ আমার অল্পবয়সের সঙ্গী ছিল। তিনি নিজে ভালো ইংরেজি জানতেন, আর আমাদের প্রথম শিক্ষার সময় ইংরেজি শিক্ষার উপর এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যে আগেই বলেছি, বাংলা বেশ বড় হয়ে কষ্ট করে শিখতে হয়েছে। মায়ের কাছেই প্রথম লেখক হবার প্রেরণা পাই। কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল যা শুধু অদ্ভুত নয় আমার পক্ষে মর্মান্তিক। আমি তখন ক্লাস এইটে উঠেছি, স্কুল ম্যাগাজিন-এর জন্য খুব জোরসে লেখালেখি চলছে, উৎসাহের ঘাটতি নেই। স্কুল ম্যাগাজিন-এর জন্য আমি একটা গল্প লিখলাম সেবার। এদিকে আমি লিখছি দেখে মাও হঠাৎ গল্প লেখা শুরু করলেন। তিনিও তো অল্প বয়সে লিখতেন কখনও কখনও, যদিও স্কুল ম্যাগাজিন-এ ছাড়া তাঁর লেখা ছাপা হয়নি কোনওদিন। তাঁর মনে আবার সেই বাসনা জেগে উঠল। আমার লেখাটা যেদিন দিদিমণিকে দেব ভাবলাম, সেদিন মা আমাকে তাঁর লেখা গল্পটা দিয়ে বললেন, এইটা কপি করে দিদিমণিকে এটাও দে, তিনি যেটা ছাপবেন। আমার বুকটা যেন ভেঙ্গে গেল, কিন্তু মাকে না বলব, সে সাহস তো নেই। যা বললেন তাই করলাম। আমার মনে হয়েছিল যে এটা দারুণ মিথ্যাচার, কিন্তু সেকথা বলার সাহস কোথায়? দিদিমণি দুটো লেখা দেখে বললেন, দুটোই ভাল, কোনটা ছাপব? আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম আমারটা ছাপতে। কিন্তু উনি পরে মত পালটে আমার মায়ের লেখাটাই ছেপেছিলেন। সেই আমার লেখক জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক আশাভঙ্গ।
এর-ই মধ্যে আবার আমার সেই দুই ক্লাসমেট-এর সঙ্গে মিলে আমাদের ক্লাসের নিজস্ব একটা দেয়াল পত্রিকা করা হয়েছে, তাতে আমার লেখা ছাপা হয়েছে। বড় হয়ে লেখক হব এটা মোটামুটি ঠিকই হয়ে গেছিল। কিন্তু এরপর ক্লাস নাইনে উঠে লেখায় ভাঁটা পড়ল স্বাভাবিকভাবেই। তখন ইলেভেন-ক্লাস হায়ার সেকেন্ডারি শুরু হয়েছে, পড়াশুনার চাপ ওই কোর্সে এতই বেশি ছিল যে সেই কোর্স কবছরের মধ্যেই বাদ দিয়ে বারো ক্লাসের হায়ার সেকেন্ডারি হল। যাই হোক, হায়ার সেকেন্ডারিতে কলাবিভাগে প্রথম হয়ে ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি পড়তে গেলাম। রেজাল্ট করে অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হতে পারিনি, রীতিমত পরীক্ষা দিয়েই ভর্তি হতে হয়েছিল। মনে আছে, প্রিয় বই-এর উপর রচনা লিখতে গিয়ে ‘ম্যাকবেথ’-এর উপর রচনা লিখেছিলাম। প্রেসিডেন্সির জাঁহাবাজ মাস্টারমশাইরা সেই অর্বাচীনের শেক্সপীয়র আলোচনা দেখে কতটা হেসেছিলেন আজ ভালই আন্দাজ করতে পারি। তবে এই প্রেসিডেন্সিতে পড়তে যাওয়া আমার জীবনের বড় একটা যুদ্ধজয়। কো-এডুকেশনে পড়তে দেওয়া হবে না, তাই মা জেদ ধরেছিলেন যোগমায়া দেবী কলেজে পড়তে হবে। সে যে কি যুদ্ধ কাউকে বোঝাতে পারব না। এটুকু মনে আছে যে সারারাত কেঁদেছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে না যেতে পারলে আমি অন্য কেউ হতাম, আজকের মানুষটি
হতাম না।
কলেজে পড়ার সময় আমি পুরোমাত্রায় লেখালেখির কাজে সমর্পিতপ্রাণ। এতবড় মেয়ে ঘরের কাজ যথেষ্ট না করে পড়াশুনা নিয়ে থাকি, সমানে বৃটিশ কাউন্সিল, ন্যাশন্যাল লাইব্রেরিতে যাই, এ নিয়ে বাড়িতে সমস্যা বা বকাবকির অন্ত ছিল না। তার থেকেও খারাপ ব্যাপার ছিল তখন ছেলেবয়সের উৎসাহে জীবন সম্বন্ধে, নারীর অধিকার সম্বন্ধে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে নানা নতুন চিন্তা মাথায় আসত। সেগুলো নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বললেই মা ভয় পেয়ে যেতেন যে এ মেয়ের আর বিয়ে হবে না, আর বিয়ে হলেও কোনওদিন ঘরসংসার করতে পারবে না। কদিন আগে দেখলাম আজকের এক আফ্রিকান লেখক চিমামান্দা এনগোসি আদিচি (Chimamanda Ngozi Adichie) এক সভায় বলছেন কিভাবে অল্পবয়সে তাঁর মতামত শুনে এক ভাই বেশ অপছন্দ করে তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলেছিলেন। ভাই নাকি কথাটি প্রায় গালাগালি হিসাবেই ব্যবহার করেছিলেন। নব্বুইয়ের দশকে নাইজিরিয়াতে মানুষজন এই শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন,তাই আদিচির ভাই ‘নারীবাদী’ শব্দটি ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই সুদূর ষাটের দশকে আমার মা অত কঠিন নতুন শব্দটি জানতেন না, তাই তিনি এই গালাগালি দিতে পারেননি। কিন্তু তাঁর মনের ভাব একই ছিল। পুরুষশাসিত সমাজের গতানুগতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আমার মনে যে ক্ষোভ জন্মেছিল, তার বহিঃপ্রকাশে মা প্রায় ভয় পেয়ে যেতেন। মনে আছে মা দিনের পর দিন আমার সম্বন্ধে একটা কথা বলতেন, ‘আ ম্যান’স হেড অন আ উওম্যান’স বডি’। আজ বুঝি কি বীভৎস লিঙ্গবাদ এই উক্তির মধ্যে নিহিত ছিল। মেয়েরা নিজে চিন্তা করবে না, তাদের যা বলা হবে নীরবে তারা তা করবে, এই তো অনুশাসন। চিন্তা করবার মতো মাথা একান্তই পুরুষের অধিকার। এই অবস্থার মধ্যে লেখার জন্য সময় বের করা কঠিন ছিল, বিশেষ করে আমাকে আলিপুর থেকে দুই বাসে কলেজ যেতে হত, অনেক সময় নষ্ট হত তাতে। কিন্তু কি ভাবে যে সময় বের করে নিতাম তা এখন বুঝতেও পারিনা। বড় বড় খাতা ভরে যেত নানা গল্পে। কবিতা সম্বন্ধে এমন এক গভীর ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর সমীহের ভাব ছিল যে আমার মত অকিঞ্চিৎকর মানুষ কবিতা লিখতে পারবে এমন কথা কোনওদিন ভাবতে পারিনি, তাই স্কুলে থাকতে কিছু পদ্য লিখলেও কলেজে
ওঠার পর কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন