পুরুষ, দিয়েছো, তুমি আরো কিছু দিয়ো;
দিকে দিকে আজ ঘরামিরা সক্রিয়;
অনীহ শিল্পী, ম’রে যায় টেরাকোটা :
কাজ আছে কিছু, মন্দিরে বেড়ে ওঠা
কাঠের পুতলি... উদ্যান ভালোবাসে :
ফুল ফুটেছিলো স্বপ্নের অভ্যাসে;
ফুল ফুটেছিলো কী ঘরোয়া বিশ্বাসে;
মাঠ-কোঠা ঘেরা বাহির না অপ্রিয় :
নারী, কী দিয়েছো, তুমি আরও কিছু দিয়ো। (তুমি কিছু)
নিজের কাছে নিজেকে নিয়ত স্পষ্ট করার জন্যই তিনি কবিতা লিখতেন। সেসব কবিতায় শব্দের অমোঘ মায়ার ভিতরেও মিশে যেত যুক্তি আর বুদ্ধির নির্যাস। সাতের দশকের আলোড়িত সময়েও তাঁর কবিতা সমকালের রক্তচিহ্নকে বহন করেনি, বরং ঐতিহ্যকে ছুঁয়ে তিনি ক্রমাগত পৌঁছতে চেয়েছিলেন প্রাত্যহিকতা থেকে অসীমতার দিকে। তাঁর ভাষায় : ‘কোথাও একটা পৌঁছনোর সতত বিস্মিত শিল্প আয়াস আমার কবিতা’ (আমি কেন লিখি)। সত্তরের মেধাবী কবি বীতশোক ভট্টাচার্য (১৯৫১-২০১২) তাঁর কবিতা লেখার গরজ বোঝাতে গিয়ে এসব কথাই বারবার বলেছেন আমাদের। বীতশোকের কবিতায় পূর্বজ কবিতা, দেশ-বিদেশের দর্শন, চিত্রকলা কিংবা চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ অনায়াসে মিশে যায়, তাঁর কবিতার পরিধি বিস্তৃত হয় ক্রমশ। সেই পরমার ‘তিনজন কবি’(১৯৭৪) থেকে ‘জলের তিলক’(২০০৩) অথবা সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ (২০২০) যতবার খুলে পড়ি, বীতশোকের মেধাকীর্ণ উচ্চারণ, ঐতিহ্যময়তাকে সসম্ভ্রমে স্মরণে রেখেও তাঁর প্রেমিক সত্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে বারবার। গবেষণার সূত্রে তাঁর কবিতার ঈশ্বর-ভাবনা নিয়ে চর্চা করেছিলাম একদা, তা নিয়ে কবির অকালমৃত্যুর পর লিখেছিলাম দীর্ঘ গদ্যও। তবু আজ নতুন করে বীতশোককে পড়তে গিয়ে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে তাঁর রোম্যান্টিক উচ্চারণের দিকেই। প্রথম যৌবনে ‘দীপান্তর’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন :
দূরে দূরে ছাতে দীপাবলী জ্বলে ওঠে;
ছাতেরও উপরে জ্বলে উঠেছিল তারা;
তবু, নেমে এসো, অন্ধ, সময়হারা;
কোনো কথা নেই; শুধু কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে;
কতোদিন আছো, কতোকাল ঘরছাড়া!
আর তুমি নিজে কতোকাল সংবৃত?
উঠে আলো জ্বালো, আজ এই নীল রাতে
বাড়ে ব্যবধান, দুটি হাত পোড়েনি তো
অবিকল এক – আমরণ সঙ্ঘাতে
জানু কেঁপে ছোঁয়; দীপাবলি দূর, ছাতে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় তাঁর আরেকটি কবিতার কথাও : ‘গাছের পুষ্পিত জঙ্ঘা ভরে ওঠে তোমাদের নীলাভ সন্ত্রাস’। পরিণত বয়সে এসেও সেই রোম্যান্টিক মন হারিয়ে যায় না বলেই লিখতে পারেন ‘তোমাকে’র মতো কবিতা :
তোমার আছে একটু শুধু হাসি :
নীলাভ-শাদা একটি দীপ-শিখা।
সে আলো দেখে ঘুমের থেকে জাগি,
স্বপ্নে যেন সে আভা থাকে লেখা।
দীনের শেষে এটুকু উপহার।
নেভে না যেন আমার ভালোবাসা :
এ আশা নিয়ে আড়াল করি আলো।
বাইরে হাওয়া, উঠুক যত ঝড় –
হোক না দু'হাত নোংরা কাদা-মাখা;
করতলের ভিতরে জ্বলে আলো।
কেউ বলে না মন্দিরের শিখর –
নেভে না, কাঁপে ভেতরে নীল শিখা।
তবে এই কবিতায় মন্দিরের ইমেজে প্রেমের পবিত্রতাকে চিত্রিত করেছেন কবি। ‘তোমাকে : অনির্বাণ ভালোবাসা’ নিবন্ধে সমালোচক তরুণ মুখোপাধ্যায় দেখেছেন, ভীরু ভালোবাসা ‘ঈষৎ শঙ্কার ছায়ায় সে নীল; কম্পমান’ (এবং মুশায়েরা, ২০১২ : ২৮৮), তাঁর চোখে সেই হাসিমাখা মুখই কবির স্বপনচারিণী। ‘দীপান্তর’এর নীলাভ শরীরী উচ্চারণ এখানে দেহাতীত প্রেমে স্থিত হয়েছে। ‘নীল রাত’-এর সংরাগদীপ্তির অনির্বাণ ‘নীল শিখা’য় রূপান্তরের ভিতর দিয়ে কবির প্রেমভাবনার পরিণতি ও উপলব্ধির গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সন্তত বর্ষার গান
দেখতে দেখতে কেটে গেলো ন’বছর। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই তাঁর অকালপ্রয়াণ মেনে নিতে চায় না মন। আশৈশব মায়ের কাছে শুনে আসা তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের স্মৃতি, কিছু কবিতার অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি নিয়েই বীতশোক আমার কাছে চেনা হয়েছিলেন। পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অতিথি অধ্যাপক রূপে ছাত্র হিসেবে তাঁর ক্লাস করেছি, তাঁর কবিতায় ঈশ্বর-ভাবনা নিয়ে গবেষণার সূত্রে কথা বলেছি বহুবার। স্নেহশীল শিক্ষক ও কবি নানা সময়ে দূরভাষে, মুখোমুখি উৎসাহ দিয়ে গেছেন আমাকে। উপহার দিয়েছেন ‘কবিতাসংগ্রহ’ ও ‘জলের তিলক’বই দুটি, বাবাকেও দিয়েছেন কিছু বই। তাঁর প্রবন্ধের ভাষা ও যুক্তিবিন্যাস নিয়ে মতান্তর থাকলেও কবি বীতশোকের স্বাতন্ত্র্য ও প্রতিভা প্রশ্নাতীত। তবে ‘অন্যযুগের সখা’-র কবি যেভাবে বলতেন : ‘আমের বউল তবে কেন এনে দেওয়া ছিল মাঘের দুপুরে?’ সেই মেদুর উচ্চারণ ক্রমশ মেধাকীর্ণ হয়েছে। জটিল হয়েছে তাঁর কবিতার ভাবজগৎ। হয়তো দুরূহও। তাই জনপ্রিয় কবি হতে পারেননি তিনি। যদিও পেয়েছেন দীক্ষিত বাঙালি কবিতাপাঠকের সসম্ভ্রম ভালোবাসা। স্মরণীয় পঙ্ক্তি-নির্মাণ যদি হয় জনপ্রিয় কবি হওয়ার অন্যতম শর্ত, তাহলে বীতশোক আমার অন্যতম প্রিয় কবি। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-বিষ্ণু দে-রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ঘরানার কবি তিনি। স্মরণীয় পঙ্ক্তির মতো হয়ে আছে : দূরে দূরে ছাতে দীপাবলি জ্বলে ওঠে; ভালোবাসার যোগ্য তুমি হয়ে উঠেছিলে হয়তো প্রবাল; আমের বউল তবে কেন এনে দেওয়া ছিল মাঘের দুপুরে? কিংবা সুষুপ্ত, একাকী, শান্ত; তুমি যেন পোকাটিকে বিরক্ত কোরো না, চুন হলুদের নিচে শুয়ে আছে তোমার বেদনা, মানমন্দিরের ঊর্ধ্বে ঐ ওই জেগে থাকা আমার হৃদয়; / সে একা একটি তারা ইত্যাদি উচ্চারণ। তাই তাঁর ‘জলের তিলক’ হাতে তুলে নিয়ে আমার মন খুঁজে নেয় সেই প্রেমিক কবিকেই, যিনি জলের অক্ষরে লিখেছেন প্রেমের কবিতা। সন্তত বর্ষার গানে তিনি স্বপ্ন বোনেন, বর্ষা নামের শ্যামশ্রী মেয়েটির কাছে খুঁজে পান বর্ণবান ভাষা, প্রশ্ন রাখেন ‘চুম্বন কি এ গানের নাম’। ‘ছড়া’ কবিতায় বৃষ্টি তাঁকে শোনায় উজ্জীবনের মন্ত্র, ‘বাংলা বিভক্তির মতো এখানে তির্যক / বৃষ্টি পড়ে’ – এই উপমায় কবি বৃষ্টিকে অর্থময় করে তোলেন, যেমন শব্দ বিভক্তি যোগে বাক্যের উপযোগী হয়। এ-কবিতার শেষে তাঁর অনুভব :
সন্তত বর্ষার গান নামে :
স্বপ্নে বোনা হয়েছিল, রোয়া হল ভিড়ে। জয় আছে
অপেক্ষায়, আশা তারও পরীক্ষা রয়েছে। শিশুর বাসনালোক হতে
এসো বৃষ্টি, বার হয়ে এসো।
‘আরোহী’ কবিতাতেও এমনই প্রকৃত বৃষ্টির জন্য কবির আর্তি টের পাই ‘কালো পথ ভাঙে তাই বন্য হাহাকারে’ বলেন। কখনও বা কীর্তনের সুরে বেজে ওঠে বৃষ্টির পদাবলী। তাঁর বুদ্ধ-ভাবনাতেও ঝরে পড়ে শ্রাবণের জলধারা :
সব ভুল হয় শ্রমণের।
সব দোষ তোমার শ্রমণ।
এ প্রদোষে তুমি পাও টের :
আজ সবে দোসরা শ্রাবণ। (জলঘড়ি)
জলে দাগ বসে না, জলের তিলকও তাই মিলিয়ে যায়; রেখে যায় সিক্ত অনুভবের স্মৃতি। তাই লিখতে পারেন :
দিন শুরু হলে তুমি স্বপ্নের ঘোরে
শাদা পদ্মের মতো বেসিনের কাছে
নামিয়ে এনেছ শাদা পদ্মের মুখ।
ঘুমে ভরা তুমি নেমে এসে খুব ভোরে
শাদা পদ্মের মতন দু’হাতে ঐ
শ্বেত পদ্মটি সাজিয়েছ যেই ভাসে
পদ্মটি নেই। আজ থেকে জল নেই।
তুলে ধরো ঘামে কান্নায় ভেজা মুখ। (খরা)
শ্বেত পদ্মের উপমায় নারীটির পবিত্রতা যেমন দ্যোতিত, তেমনি সেই পদ্ম ও জল সরে গিয়ে ঘামে-কান্নায় ভেজা মুখের আদলে ফুটে ওঠে কবিমানসীর ছবি।
আরতিশিখা জ্বলে
ভারতীয় ঐতিহ্য ও হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন ধর্মদর্শন-কে স্বীকরণ করে নিয়ে তাঁর কবিতা আমাদের এক নিজস্ব ঈশ্বরের কথা শোনায় :
কবিতা সর্বত্র আছে। কবিতা দেখার
মতো চোখ
তোমার এখন নেই। এইখানে নেই
তোমার হাতটি কবিতা লেখার।
দেখার / লেখার।
মিল তাই পড়ে আছে বিষম একাকী।
আছে গাছ, পাখি আছে, আকাশ রয়েছে।
শূন্যতাও সমর্থ, বিরাট।
দত্তাপহারক
রবীন্দ্রনাথের ভগবান। আর তোমার ঈশ্বর
ক্রমে ছবি, গান ক্রমাগত দিয়ে দিয়ে নিঃস্ব; তবু
অফুরান কার সে-প্রস্বর, বলে :
আরও নুয়ে পড়ো, আরওই জোরালো করো গার্হস্থ্য কনুই। (চিহ্ন / জলের তিলক )
বীতশোকের ঈশ্বর তাঁকে কবিতার জগতে বিচরণের স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। একইসঙ্গে বিনতিস্বীকার ও প্রতিবাদের ভারসাম্যে এই কবি ঈশ্বরের কথা বলেন : আরও নুয়ে পড়ো, আরওই জোরালো করো গার্হ্যস্থ্য কনুই। ব্যাপ্ত মহাবিশ্বের মাঝখানে খুঁজে নিতে চান কবিতার মিল, জানেন শূন্যতাও বাঙ্ময়। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ঈশ্বরের অভিশাপ আর আশীর্বাদ পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলেছিল, তাই তাঁর ভগবান ‘দত্তাপহারক’, দিয়েও যে কেড়ে নেয়। সত্তরের কবি বীতশোকও জানেন দুঃখের মূল্যে জীবনকে উপলব্ধি করতে হয় : ‘শুধু রাত্রিদিন ভাঙে দিনরাত্রি দুঃখের দেবতা’ (দিনরাত্রি দুঃখের দেবতা / অন্যযুগের সখা )। নাগরিক কবি শৃঙ্খলিত অস্তিত্বের মুক্তি চেয়ে জ্যোতির্ময় ডানা মেলে আসা স্বর্ণাভ পাখিদের অপেক্ষায় থাকেন। আসলে যে-কোনো বড়মাপের কবির মতোই ধ্রুপদিয়ানা আর রোম্যান্টিক অনুভব দুই-ই মিলেছে তাঁর কবিতায়। তাই বীতশোকের আধুনিক কবিমন আচারবিবর্জিত ঐশীতাকে ফুটিয়ে তোলে :
দূর থেকে কাছে এসে আরোই নিভৃতে
চলে যেতে গিয়ে খালি গর্ভগৃহে দাঁড়িয়েছি, তাকিয়েছি ফিরে
এ ওর চোখের দিকে... দেবীর মুখের দিকে আয়না ধরে দিতে
পুরোহিত ভুলে গেছে : আসলে পূজারি নেই; প্রতিমাও ধীরে
অন্তর্হিত হয়ে গেছে; আমদেরো পুজো নেই। মন্দিরের ইঁটে
উৎকীর্ণ জীবনশিল্প অমরতা হয়ে আছে আমাদের ঘিরে। (কোজাগরী / নীল এক পাতা )
সবকিছু যদি নেই হয়, তাহলে কি আছে আর? জীবনশিল্প বলতে কি বুঝিয়েছেন কবি? আসলে মানবজীবনের অস্তিত্বকেই অমর বলছেন তিনি। আর সেই অস্তিত্বে নারীই ঈশ্বরী :
আরতিশিখা জ্বলে এ রাতে পিত্তলে।
নারীর দুই হাতে ও তার কটিদেশে
আকূতি কৃশ স্বরে ‘আমারে লহো’ বলে।
আমিও ধীরে তুলি আদরে ভালোবেসে
তরুণী দীপতরু, আলোয় গান শুনি :
হৃদয়, কই তার, পাষাণ। ফুলগুলি
জানু ও জঙ্ঘায় অযথা। অঙ্গুলি –
ছড়ানো পুরোহিত অথচ কাছে এসে
শীতে ও জ্বরে জ্ব’লে রক্তে ফাল্গুনী
ভেবেছে এনেছিল। সে হিম পদতলে
আজও সে হাত রাখে; কী করে তবে ভুলি :
আরতিশিখা জ্বলে এ রাতে পিত্তলে... (আরতি / অন্যযুগের সখা )
একেই বোধহয় রতির আরতি বলবো আমরা। তাকে ঘিরে এই কামনামদির বন্দনা চলে, কবি হয়ে ওঠেন সেই প্রেমযজ্ঞের পুরোহিত। যে প্রেম-প্রতিমার বন্দনা করেন তিনি, তাকে হৃদয়ে ধারণ করে বলতে পারেন :
কোথায় নিশ্ছিদ্রশয্যা বিচ্ছিন্ন জীবনে
ভেসে যায়, আর ওই বউডোবা দিঘিটির শীতল ভিতরে
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে অসমাপ্ত সৃষ্টিগুলি, মৃণ্ময়ী মহিমা;
তুমি কী ওখানে এসে তৃপ্ত হয়ে শুয়ে আছ, ঈশ্বরী, প্রতিমা। (তুমি কী হৃদয়ে এসে / ঐ)
বর্ষার মেদুর আবহে রোম্যান্টিক কবি মন যে প্রিয়ার কথা ভাবে, তার ভেজা চোখে অনৃতের আভা। তবু রচিত হয় বর্ষার কবিতা :
বিকেল ফুরিয়ে গেল, অনিঃশেষ হয়ে আছে বৃষ্টিধোয়া দিন;
ঈশ্বরের দিকে গিয়ে ঘুরে ফিরে চলে আসছে একটা চিলপাখি;
আমি ইতস্তত করি বর্ষাকেও স্থান দিতে এই কবিতায়। (কাকে বেশি ভালো লাগবে / এসেছি জলের কাছে )
ঈশ্বর এখানে একটা লব্জের মতো ব্যবহৃত হয়েছে, একই রকমভাবে ‘শিল্প’ কাব্যেও শুনি :
জ্যোৎস্নায় জরতী রেণু ছুঁড়ে দেয় আমাদের আবদ্ধ দেয়াল
রাণির দুঃখের চাপে পিষ্ট হ’তে আসি :
হা ঈশ্বর, আমাদের ফল
বিলুপ্ত স্মৃতির তাপে ফেটে যায়, ঝরে আজ গলিত ধাতুর
এই রস, শিলাজতু, সমস্তই তাঁর;
ছিন্নাণ্ড মেষের দল ওই জ্যোৎস্না মেঘে নড়ে-চড়ে
তাঁর হাত, একমাত্র নীলাভ নির্দেশ। (রাণি ও প্রহরী / শিল্প )
ইতিহাসের আভা মাখা এই কবিতা কামনা-রক্তিম। নীল রঙে এখানে বৈষ্ণবীয় আভা মেশে। হিন্দু মন্দিরের পবিত্রতা, বৌদ্ধ-ধর্মের প্রশান্তি তাঁর কবিতায় বারংবার ফিরে এসেছে। তাই তাঁর কবিতায় গৌতমবুদ্ধ বলেন :
তবু একথা মিথ্যে নয় :
সুজাতার হাতে পায়েস খেয়ে বেঁচেছিলাম আমি।
তাই ভিক্ষুরা, আজ তোমাদের দেব অমৃত। (বোধি / প্রদোষের নীল ছায়া )
এই অমৃত হলো ভালোবাসা। যে ভালোবাসা নারীর কাছে পাওয়া যায়। যে প্রেম এক থেকে অনেকের দিকে আমাদের অগ্রসর করে দেয়। সব সমর্পণ করে চলে আসা যায় সেই ভালোবাসার জনের কাছে। কিন্তু প্রেমই আবার ব্যথা দেয়, ফেলে যায় একা, শীতার্ত করে হৃদয়কে। তাহলে উদ্ধার কোথায় পান কবি? স্বগতোক্তির মতো বলেন,
আজ জ্যোৎস্নারাতে
বসন্তের সমীরে মাতাল
সকলেই বনে গেছে; ইচ্ছাশক্তিহীন এক সন্ন্যাসী অসুখ
তার পাশে বসে আছে। এইখানে। ঈশ্বর, ঈশ্বর,
সময় হয়েছে আজ রজনীতে, বসন্তের চেয়ে আরো বেশি
ঘোর শীতে নির্বাসিত করেছ তো, তবু
তাকে তুমি কেন মারো পাপের পাথরে। (সংক্রান্তি / অগ্রন্থিত কবিতা )
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ঝড়ের খেয়া কবিতায় : ‘এ তোমার এ আমার পাপ’। এই পাপ মানবসভ্যতার স্রষ্টার কাছে। তবু তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাননি। আর আধুনিক কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘পাপ বলে কিছু নেই, অপরাধ আছে’ (অপরাধ)। আসলে পালটে যাওয়া সময়ে মূল্যবোধের সংজ্ঞা, নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ড আলাদা। এই সময়ের বিচ্ছিন্নতা আর একাকিত্বের অসুখে বীতশোক আক্রান্ত। তাই নারীকে সারারাত শরীরী আশ্লেষে আলিঙ্গন করেও শান্তি পান না : ‘আমি সারারাত গেয়েছি ব্যর্থ প্রেমের গান’। দেখেন,
নাম বলো, নাম বলো, ভোরবেলা বাগানে এসে নাম ডাকলেন ঈশ্বর
আর ফুলের মধ্যে লাফিয়ে এল
শাদা বেরাল, ঝুলির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল হলুদ
এইসব শরীর ভালোবেসেছিলে তোমরা, কান্না করেছিলে এইসব শরীরের জন্য
আজ নির্জন খাঁচার মতো ঘুরে গেল আমার বাড়ি তোমাদের রোদের দিকে... (আমাকে তোমরা /ঐ)
তবু প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আকুতি কবির। বলেন :
ছিলে সে একদিন শোধ কী তারই দেনা
দুচোখে দুটো চোখ দুহাতে দুটো হাত
হৃদয়ে জড়ানো তো এখনো সেই ঋণ
আবার দিন যাক আবার হোক রাত
থাকুক ঈশ্বর এটুকু স্বরাঘাত
যদিও ফিরবে না ফিরুক সেইদিন। (তোমাকে : নতুন বছরের কবিতা )
বীতশোকের ঈশ্বর-দর্শনে তাঁর ভারতীয় ঐতিহ্যানুসরণ আছে। তাই ধর্মপ্রচারক মহাবীর, বুদ্ধ এঁরা তাঁর কবিতায় উদ্ভাসিত হয়েছেন। লোকায়ত ধর্মের সারল্য তাঁকে উৎসাহিত করে। চর্যার সহজিয়া গানে কবি মুক্তি খুঁজে নেন। যেখানে আছে শবর-শবরীর প্রেম আর দেহমধু পান করে সহজসুখে আনন্দিত হওয়া :
আমি কী নির্বাণ চাই? তা নয়, সহজ সুখ আমার বিশ্বাস।
বিশ্বাস সহজ দুঃখ। এইভাবে মুক্ত হওয়া আমার অভ্যাস।
বধ্যভূমে শিলাখণ্ড সমুত্থ শরীরী ছায়া শবরীর দান;
মেয়েটি দূরত্বে যায়, প্রায় সমসাময়িক গায়ের বাতাস। (সহজ / অগ্রন্থিত কবিতা )
পঞ্চাশতম চর্যাতেও (গঅণত গঅণত তই্লা বাড্হী হেঞ্চে কুরাহী) আমরা পাই এমনই এক মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত শবরের ছবি। আপাত অর্থে সমকালীন সমাজের প্রতাপ আর প্রতীকী তাৎপর্যে দেহসাধনার চূড়ান্ত স্তর এই পদে প্রকাশিত হয়েছে : মায়ামোহ ত্যাগ করে, প্রকৃতিদোষ খণ্ডন করে নৈরাত্মারূপিণী শূন্যতানারীকে সম্ভোগচক্রে ধারণ করে শবর মহাসুখে বিলাস করছেন। একটি প্রবন্ধে বীতশোক ভট্টাচার্য চর্যার বৃক্ষ আর্কিটাইপ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে এই পদটির ব্যাখ্যা করেছেন, যা উদ্ধৃত কবিতা প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে :নিষ্পাপ শবরের এই শাস্তি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে : হয়তো এই বহিরাগত কুঠারের শাণিত যন্ত্রণা তার সহজ বিশুদ্ধ অস্তিত্বকে নগ্ন উদ্ঘাটিত করে। (কবিতার ভাষা, কবিতায় ভাষা, ২০০৪ : ১১)
জীবন ও দর্শনের মেলবন্ধনে যে-চর্যাগান গহন, জটিল, বহুমুখী ও ব্যঞ্জনামুখর সেই দেহবাদী সাধনার প্রতি আধুনিক কবির অনুরাগ লক্ষিত হয়। করুণা ও প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে যেভাবে একজন বৌদ্ধ সঙ্ঘে ফিরে যায়, তিনিও চান তাঁর কবিতা সেভাবেই সমাজ ও মানুষের কাছে ফিরে যাক, এই তাঁর বাসনা।
আছে ফুলের ভাষা
তাঁর উত্তরকালের কবিতার মধ্য থেকে বেছে নেওয়া আমার প্রিয় কবিতাটিতেও মেধা ও যুক্তির আড়ালে প্রেমিক মনেরই সংহত প্রকাশ ঘটেছে দেখি :
গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা :
এই গান শুরু হলে সুর নয়, কথা
মনে এল একে একে, আমি দিশাহারা :
গগন ঢেকেছে মেঘে, মেঘে ঢাকা কারা?
কে কাকে আড়াল করে? এই গোপনতা
বোঝার আগেই গান হয়ে গেল সারা।
মনে হল গান নয়, যুক্তিজ্ঞান ওটা :
গগন, মেঘ ও তারা চিহ্ন হয়ে ওঠা
মানবিক সাংকেতিক বোধ হলো ঠিক;
বোধ হয় এই ভাবে ভাবা উচিত না;
হয়তো ওদের কাছে আমিও প্রতীক
গগন, মেঘ ও তারা করে গবেষণা –
গবেষণা ভুল হয়। ছুঁই স্বাভাবিক
তোমার ও চুলে জুঁই, মুখে জলকণা। (পাঠ / নতুন কবিতা : ১৯৯২)
রিসেপশন্ থিয়োরি তথা পাঠকের অভ্যর্থনা বলে, যে-কোনো টেক্সট পড়তে পড়তে চলতে থাকে তুলনা পূর্বের পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে। বীতশোক তাঁর এই সনেটের অষ্টকে ‘গোধূলি গগনে মেঘে’ রবীন্দ্রগানের চিহ্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে রত হতে চান এবং সিদ্ধান্ত নেন ঐ গান আসলে যুক্তিজ্ঞান এবং একাধিক চিহ্নের সমাহার। তাঁর পূর্বের শ্রবণাভিজ্ঞতাকে তিনি নতুন করে ব্যাখ্যা করতে চান। অথচ ষট্ক-তে এসে তিনি ভাবেন, কবিতাই যেন মূর্তিমতী নারী তাই গগন, মেঘ ও তারার চোখে কবি নিজেকেই প্রতীক ভাবেন। কিন্তু কিসের প্রতীক? অবশ্যই প্রেমের। কবি ও রমণীর সম্পর্কের ভিতরে মেধা নয়, বৃষ্টিসজল মুহূর্ত রচিত হয়। জুঁই ফুল জড়ানো কেশদাম আর জলকণাখচিত মুখশ্রী স্পর্শের মধ্য দিয়েই মূল গানের বিরহলীন অনুভব-কে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। এ-কবিতায় প্রকৃতি, মানুষ ও প্রেম একবৃন্তে ফুটে ওঠে। পরিবেশবীক্ষায় আগ্রহী পাঠকও দেখেন প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে কিভাবে না-বলা বাণীর ঘন রজনী নেমে আসে। জল ও যৌনতার নিগূঢ় যোগসূত্রটিও একমুহূর্তে উন্মোচিত হয়ে যায়। তাঁর স্বপ্নের উদ্যানে ফোটে ভালোবাসার ফুল, আরেকটি কবিতায় লেখেন ‘কথা বলা হয় না আমাদের, / আমাদের আছে ফুলের ভাষা।’ (ফুলের ভাষা)
ঋণস্বীকার :
১) তিনজন কবি, পরমা, ১৯৭৪
২) কবিতা সংগ্রহ, বীতশোক ভট্টাচার্য, এবং মুশায়েরা, ২০০১
৩) জলের তিলক, ঐ, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৩
৪) অগ্রন্থিত কবিতা, ঐ, আদম, ২০২০
৫) এবং মুশায়েরা (বীতশোক ভট্টাচার্য), জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২
৬) কৃতি : ত্রয়োদশ সংকলন, ২২ শ্রাবণ ১৪১৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন