সোমবার, ১ আগস্ট, ২০২২

ঊর্মিলা চক্রবর্তী-র ধারাবাহিক গদ্য : "এসেছো কবিতা"

 

এসেছো কবিতা

উপক্রমণিকার বহর দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এই সাধারণ মেয়ের জীবনে বলবার মতো কথা কত কম। কিছু ঘটলে তবে তো মানুষ বলবেতবু বন্ধুবান্ধবের শখ মেটাতে লিখতে বসা। কেমন করে লিখলামকেন লিখলাম, কিভাবে শুরু হলএইটুকুই তো বলবার। কিন্তু তার সঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে যাচ্ছে  অন্য এক প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গ নারী,  প্রসঙ্গ মেয়েসন্তান। আমাদের সময়ে রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেরা যে মুক্তিটুকু পেতেনমেয়েরা তো তার কণামাত্র পেতেন  না।আমার ভাই যত সহজে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘু্রে বেড়াতবহুক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকতে পারতএকটু বড় হলে নানা জায়গায় যেতে পারতআমার তো সে স্বাধীনতা ছিল না।সিনেমাথিয়েটারগানের ফাংশনএসবও বলতে গেলে ছিলনা। ঘর আর স্কুল বা কলেজএর বাইরে কোনও জীবন ছিল না। সংসারের কাজে কম মন দিয়ে কেন এত পড়াশুনা করি এটাও অপরাধ বলেই গণ্য হতো কট্টর পুরুষতান্ত্রিক   চিন্তাধারার বাড়িতে। এতে নিশ্চয়ই মনের মুক্তির পথে যথেষ্ট বাধা আসেচিন্তায় স্বচ্ছতা আসতে চায় না। তাই কটু ফিরে দেখতেই হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ একদিনের একটি ঘটনা কথা বলিআমার পক্ষে বেশ স্মরণীয় অভিজ্ঞতা

আলোচনা সভা বসেছিল মেয়েদের নিয়ে। আমাদের সমাজে মেয়েদের স্থানতাদের বেড়ে ওঠালেখাপড়া শেখালেখালেখিএসবই আলোচ্য বিষয় ছিল। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রী শিবনারায়ণ রায় তখন বেঁচে। মেয়েদের সমস্যাগুলো তিনি দরদ দিয়ে বুঝেছেনসেগুলি নিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তিনি নিজেই লিখেছিলেন যে তাঁর দিদি তাঁর চেয়ে মেধাবিনী ছিলেন। তবে তাঁর নাম আমরা জানিনা কেন প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আমাদের সমাজই দেবে। হয়তো সেই কারণেই শিবনারায়ণবাবু মেয়েদের এগিয়ে দেবার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর কাগজ ‘জিজ্ঞাসা’- উদ্যোগেই সেদিনের সেই আলোচনাসভা বসেছিল। সেখানে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সকলেই  কৃতী মহিলা। সভার শুরুতে তাঁদের নিজের নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলা হলে একজন মহিলা উঠে তাঁর নিজের সম্বন্ধে যা বললেন তার মোদ্দা কথা হল যে তিনি দারুণ আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছেনজীবনে শিক্ষাক্ষেত্রে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্রে কোনও বাধা পাননি। যিনি বলছেন তিনি সকল অর্থেই সমাজের সর্বোচ্চস্তরের মহিলা। তিনি যথেষ্ট গর্ব করেই কথাগুলি বললেনএবং একথা মানতেই হবে যে গর্ব তিনি করতেই পারেন। আমাদেরই যুগে আমাদেরই মতো বাঙালি পরিবারের মেয়ে হয়েও তিনি সর্ব অর্থে পুরুষের সঙ্গে সমান সুযোগ   সুবিধা পেয়েছেন জেনে আমারও খুব ভালো লেগেছিল। কিন্তু সবাই মানলেন না। একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মহিলার কন্ঠে অন্য সুর বাজল। শ্রদ্ধেয় মনস্বিনী শ্রীমতী মানসী দাশগুপ্ত উঠে বললেনএত সহজে হলে হয়না। তিনি বললেনএদেশের  লক্ষ লক্ষ মেয়েকে ন্যূনতম অধিকারলাভের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। আর যুদ্ধ করে জিতে নেবার মধ্যে দিয়ে অন্য এক বোধ জন্ম নেয়। যুদ্ধ করে জিতে নিতে হয় যাদের তাদের মধ্যে সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় অনন্য এক শক্তি। সেই শক্তিই মেয়েদের আসল শক্তি।

 

আমি তখনও লেখালেখির জগতে নতুন। ভাবলামকথাটা তো দারুণ বলেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলামকথাটা দারুণভাবে সত্যও। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হলএখানেই তো এক কূটাভাসে সূচনা। মেয়েরা পুরোপুরি তাদের ন্যায্য অধিকার পেলে কি তাদের শক্তি ফুরিয়ে যাবেজোর করতে হলে জোর কমেনা বাড়েআর উলটো পক্ষের জোর যদি তেমন বেশি হয় তবে এপক্ষের জোরের তো কোনও দামই থাকে না। কেবলই যদি স্রোতের বিরুদ্ধে চলতে  তবে  কতদূর যাওয়া সম্ভবযুদ্ধ করতেই যদি সময় আর শক্তি ক্ষয় 

করতে হয় তবে এগুনো যাবে কেমন করেভার্জিনিয়া উলফ তাঁর ‘ রুম অফ ওয়ানস ওন’- তাঁর সমান প্রতিভাসম্পন্ন শেক্সপিয়রের কোনও বোন থাকলে তার যে ভয়াবহ পরিণতির কাল্পনিক ছবি 

এঁকেছেন সে তো প্রায় সকলেরই জানা। মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেল। মনে হল অনেক জটিল ব্যাপার।  সমস্যার সমাধান এত সহজ নয়।

 

এখান থেকেই বোধ​হ​ রক্ষণশীল পরিবারের এক অবাঞ্ছিত মেয়ের লেখালেখির কথা শুরু করা যায়। মেয়ে জন্মানো যাঁদের কাছে ভয়ঙ্কর অভিশাপ এমন মা-বাবার সংযোগে যখন একটা মেয়ে জন্মায় তখন তার বেড়ে ওঠা ঠিক কেমন হতে পারে তা সেই মেয়েটি ছাড়া কারও পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। সে আলোচনা আজকের নয়। কিন্তু সে মেয়ে যখন বাবা মায়ের তাচ্ছিল্য পেরিয়ে যেতে চায়হাতে কলম ধরে পড়াশুনায় নিজেকে যোগ্য করে তুলতে চায়নিজে সাহিত্যসৃষ্টি করে নিজের কথা বলার সাহস করে তখন সেই কাহিনীর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই সংগ্রামের ইতিবৃত্ত যে সংগ্রামের কথা সেদিন সেই বর্ষীয়ান মহিলা বলেছিলেন।  তাই তার আভাটুকু এই লেখায় পাওয়া অনিবার্য। 


আজকের হিসেবমতো আমি পুরোপুরি কলকাতার মেয়ে কারণ জ্ঞান হবার পর থেকেই আমি বেহালায়। কিন্তু আমার ছোট্টবেলার জগ গড়ে উঠেছিল একটা বিশাল বাগানের গাছ-মাটি-পুকুর ঘিরে। সেই বাগানে একা একা ঘুরে বেড়ানো আমার প্রথম স্পষ্ট স্মৃতি। আমার জন্মের পরে পরেই পুব-বাংলা থেকে আমার মা-বাবা কলকাতায় চলে আসেন। রেফ্যুজি হয়েসর্বস্ব খুইয়ে। সেই সময়টা সব রেফ্যুজির মতো তাঁদেরও যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছে নতুন জীবন গড়ে নেবার জন্য। শিক্ষার মান উচ্চ ছিল বলে অপেক্ষাকৃত সহজে বাবা চাকরি পানতাই রেফ্যুজি কলোনি বা ক্যাম্পের ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয়নি। প্রথম এইদেশে এসে আমরা বেহালায় একটা ভাড়া বাড়িতে উঠি। প্রথম বাসার কথা শুনে শুনে মনে আছেআর তারপর প্রথম স্মৃতি  বাড়িরই কাছে অন্য একটা একতলা 

আলাদা বাড়িতে ভাড়া থাকা। সেই বাড়ির সামনে সরু গলি পেরিয়ে ছিল একটা ঘেরা বাগান আর একটা বড় পুকুরআর বাড়ির পিছনে ছিল অন্য একটা ছোট বাগান আর একটা ছোট্ট পুকুর এছাড়া খুব মনে আছে বাড়ি থেকে একটু দূরে গলি পেরিয়ে প্রথম মোড়টায় একটা শিবমন্দির ছিল। সেই মন্দির ঘিরে অনেকটা পোড়ো জমিতে আগাছার সঙ্গে কিছু বড় গাছ। এখনও শিবমন্দিরটা আছেকিন্তু সেই যে অত জমি ছিল তাকে গ্রাস করে নিয়েছে গজিয়ে ওঠা বাড়িগুলো।  বেহালা তখন মোটামুটি গ্রামের মতোই ছিল। মনে আছে পাড়ার লোকজন বলতেন আজ আমরা কলকাতায় যাব ঠাকুর দেখতে। সে কবেকার কথাআজ ভাবলে হাসি পায়।



ক্রমশ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন