রবিবার, ১ মে, ২০২২

কামাল হোসেন-এর ঝুরোগল্প

মানি প্ল্যান্ট

 

রোজকার মতো সকালে বাজারে গেছলাম।পথে চেনা জানা মানুষজনের সাথে দাঁড়িয়ে সামান্য কথাবার্তা, গল্পগুজব, কুশল বিনিময়, খবরের কাগজের খবর নিয়ে সামান্য মধ্যবিত্ত মার্কা আলোচনা এরকম যেমন হয় আর কি !

রোজকার মতো সেই বৃদ্ধ টবে কিছু ফুলের গাছ নিয়ে বাজারের এক কোণে বসেছিল। বেশিরভাগ মরশুমী ফুলের গাছ।আর একটা মানি প্ল্যান্ট। আর একটা নিঃসঙ্গ মানি প্ল্যান্ট। হঠাৎ ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের সাবিত্রী মাসী বলতো, মানি প্ল্যান্ট সবার কপালে সয় না।

কী রকম একটা ছেলেমানুষী লোভ চেপে বসলো ঘাড়ে। দাম-দর করে গাছটা কিনেই ফেললাম। সামান্যই দাম।

বাড়িতে টব হাতে নিয়ে ঢোকার পর স্বাভাবিকভাবেই আমার বউ প্রতিমা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। বিয়ের পর থেকে তার মুখে আমি নিয়মিত শুনে আসছি, আমার মতো বেআক্কেলে আর বোকা পুরুষ মানুষ সারা পৃথিবীতে নেই।

আমি একটু রোমান্টিক গলায় বললাম, জানো প্রতিমা, ছেলেবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল একটা মানি প্ল্যান্ট বাড়িতে লাগাবো।

তুমি যেমন মাল, তেমনি তোমার স্বপ্ন! একটা মিষ্টি সুগন্ধি ছড়ানো রঙিন ফুল গাছের কথা কখনো মনে পড়েনি। 

শেষ পর্যন্ত গৃহিণীর অবহেলা আর উপেক্ষা অগ্রাহ্য করে গাছটা থেকে গেল। ঠাঁই হলো আমাদের পুরোনো ভাড়া বাড়ির সরু বারান্দার এক কোণে।

আমি প্রতিদিন সকালে টবে জল দিই। আর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। একটা দুটো করে নতুন পাতা গজায়, আমি মনে মনে উত্তেজিত হই, আমার এই ভাঙাচোরা ব্যর্থ জীবনে একটু নতুনত্বের ছোঁয়া খোঁজার চেষ্টা।

প্রতিমার মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠলো। হয় ওর বাপের বাড়ির কেউ, না হলে রচনা। আমাদের একমাত্র সন্তান। নিজের পছন্দের সৌম্যকে বিয়ে করার পর এখন বাঙ্গালোর থাকে। বছর-দুবছরে যখন সকলে এখানে আসে, ওদের চেহারার চাকচিক্য দেখে আন্দাজ করি, সুখে আছে ওরা। আমাদের নাতি শুভ খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। ক্লাসে নিয়মিত ফার্স্ট হয়।

হাসিমুখে প্রতিমা এসে মোবাইলটা হাতে দিয়ে বললো, দারুণ খবর দিল রচনা। সৌম্য আমেরিকায় চাকরি পেয়েছে। মাসখানেকের  মধ্যে ওরা রওনা দেবে। 

মোবাইলটা কানে ধরে আবেগে আমার গলাটা কেঁপে উঠলো। কোনোরকমে নিজেকে সামলিয়ে বললাম, রচনা মা

বাপি , মায়ের কাছে শুনেছ খবরটা

শুনলাম। অনেক দূরে চলে যাচ্ছিস। যাওয়ার আগে তোরা সবাই মিলে এখানে একবার আয় মা। কতোদিন তোদের দেখিনি।

এবারে হবে না বাপি। আর মাস খানেকের মধ্যে সব গুছিয়ে নিতে হবে। একটা সংসার গুছিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার অনেক হ্যাপা। ওসব তুমি বুঝবে না।

ও।

দুঃখ পেওনা বাপি। নিয়মিত তোমাদের ভিডিও কল করবো। দেখতে পাবে। আর সৌম্য তো বলেই দিয়েছে, আমরা ওখানে একটু সেটল করি, তারপর তোমাদের আমেরিকা যাওয়ার টিকিট পাঠিয়ে দেবে। দুজনে ঘুরে আসবে।

কেন জানি না, আমার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে জমা হচ্ছিলো। কথা বলতে পারছিলাম না। 

প্রতিমার হাতে মোবাইলটা দিলাম।

পাশের ঘরে গর্বিত প্রতিমা গল্প করতে বসলো।

ধীরে ধীরে মানি প্ল্যান্ট গাছটার কাছে এসে বসলাম। এরমধ্যে রীতিমতো পল্লবিত হয়ে বারান্দার পুরোনো গ্রিল ধরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। রোজকার মতো ওর সাথে গল্প করতে করতে মেয়ের জীবনের এই  নতুন খবর শোনাতে বসলাম।

 

1 টি মন্তব্য: