প্রতি সপ্তাহে আলাদা আলাদা শিফটে কাজ করতে হয় বুধন হাঁসদাকে। তার গ্রামের বাসাবাড়ি থেকে বিস্তর দূরে কারখানা। এ-শিফট থাকলে সেই প্রায় মাঝরাতে উঠে পড়তে হয় বুধনকে। তার সঙ্গেই উঠে পড়ে তার বৌ মঙ্গলা। বুধন ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাতকৃত্য সারতে আর মঙ্গলা তড়িঘড়ি রান্না বসায় চুলাতে। ভোর চারটে নাগাদ বুধনকে রওয়ানা দিতে হয় কারখানার উদ্দেশ্যে। ছ’টার আগে টিকিট পাঞ্চ করে ঢুকে পড়তে হয়। দীর্ঘ পথ সাইকেল চালিয়ে আসতে আসতে কখন যে ছ’টা বেজে যায়!
কারখানাটা টাটার হলেও বুধন টাটার কর্মী নয়। বরং এক ঠিকাদার সংস্থার অধীনে গ্যাস-ওয়েল্ডারের চাকরি করে। কোলিগরা তাকে প্রায়ই বোঝায়, এতটা রাস্তা সাইকেল ঠেঙিয়ে আসার কোনো মানে হয়? একটা বাইক বা নিদেন একটা মোপেড তো কিনতে পারিস! বি-শিফট ডিউটি করে তোর ঘরে পৌঁছতে তো রাত বারোটা বেজে যায়! কিন্তু বুধন রাজী হয়নি। কেন যে রাজী হয়নি! আবার সহকর্মীরা তাকে অন্য পরামর্শও দিয়েছে, চাকরিটা যখন তোকে শহরেই করতে হবে, তখন শুধু শুধু গ্রামে থাকার দরকার কী? কারখানার কাছাকাছি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে পারিস! বুধনের কাছে এই পরামর্শটা অবশ্য ঠিকই মনে হয়েছিল। মঙ্গলাকে বলেওছিল। কিন্তু মঙ্গলা রাজী হয়নি। বলেছিল, তুমি যদি শহরে থাকতে চাও, থাকতে পারো। কিন্তু আমি গ্রামেই থাকব। তুমি না হয় ছুটির দিনে এসে দেখা করে যেও। বুধন জানত, মঙ্গলা এই কথাই বলবে।
আবার সামর্থ থাকা সত্ত্বেও বুধন কেন বাইক বা মোপেড কিনতে রাজী হয় না, কেন সে প্রতিদিন রীতিমতো কষ্ট করে সাইকেলে প্যাডেল মারতে মারতে ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে কারখানায় যাতায়াত করে, তাও মঙ্গলার জানা ছিল। আসলে বুধন পালিয়ে পালিয়ে থাকতে চায় মঙ্গলার সান্নিধ্য থেকে। এ-শিফট ডিউটি থাকলে ভোর চারটে থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত বুধন ঘরের বাইরে থাকে। বি-শিফট থাকলে দুপুর বারোটা থেকে রাত বারোটা। আর সি-শিফট থাকলে রাত আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা।
একই গ্রামের মেয়ে মঙ্গলাকে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছিল বুধন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তারা একই ক্লাসের সহপাঠী ছিল। পরে পড়াশোনার জন্য বুধন শহরের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু মঙ্গলার পড়াশোনার সেখানেই ইতি ঘটেছিল।
তাদের বিয়েটা যে প্রেমজ নয়, বরং দুই বাড়ির লোকেরাই ঠিক করেছিল, মঙ্গলার বাড়ির লোকেরা অন্তত তাই মনে করত। বুধন বিয়ের আগে এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলা রাজি হয়নি। বলেছিল তাদের গোপন প্রেমের কথাটা চেপে যেতে।
বুধন জানে, সে যতটা সময় ঘর থেকে বাইরে থাকতে পারবে, ততটা সময় মঙ্গলা ঘনিষ্ট সান্নিধ্য পাবে সুবোধ সোরেনের। সুবোধও একই গ্রামে থাকে। বুধনের কাছাকাছি তার ঘর। বিয়ে করেনি। মঙ্গলার জন্যই করেনি। মঙ্গলার অবশ্য সুবোধের প্রয়োজন হতো না, যদি বুধন তাকে তার চাহিদার সবটুকু মিটিয়ে দিতে পারত। বিয়ের পরে বুধন যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু কী আর করা যায়! যৌবন যে ফুরিয়ে যায়!
দুর্দান্ত লেখকের চরিত্র নির্মাণ সমাজ এবং স্পর্ধার ইঙ্গিত দেয়। শেষ পর্যন্ত প্রেম অপ্রেম আমাদের জীবনের যাত্রাপথ নিয়ন্ত্রণ করে। আরও গল্প ঝরুক কলম থেকে।
উত্তরমুছুন