বিনতা রায়চৌধুরীর গোয়েন্দা সাহিত্য : অন্ধকারের উৎস হতে...
গোয়েন্দা আসলে সত্যান্বেষী।কোনো অপরাধের পিছনে নিহিত সত্য বা অপরাধীকে চিহ্নিত করাই গোয়েন্দার প্রধান কাজ। তবে এই গোয়েন্দা কাহিনির জন্ম কবে ও কোথায়, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হলে আমাদের চলে যেতে হয় প্রাচীন কালে। চেস্টারটন তাঁর ‘গোয়েন্দা কাহিনির সপক্ষে’ প্রবন্ধে গোয়েন্দা কাহিনিকে ‘আদিতম এবং একমাত্র জনপ্রিয় সাহিত্য প্রকরণ’ রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। আর সেই আদিযুগের সন্ধান করতে গিয়েই আমাদের স্মৃতিতে চলে আসে সোফোক্লেসের বিখ্যাত ‘রাজা অয়দিপাউস’ নাটকের গল্প। এই গ্রিক ট্র্যাজেডিতে সর্বশক্তিমান রাজা মহামারী আক্রান্ত শহরের অধিবাসীদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য রাজশ্যালক ক্রেয়নকে অ্যাপোলোদেবের মন্দিরে পাঠান। সেখানে দৈববাণী জানিয়েছিল, এই মহামারীর পিছনে দায়ী ঐ রাজ্যে অপবিত্র এক মানুষের অবস্থান, সে নাকি পূর্বতন রাজারও হত্যাকারী। সেই অপরাধীর নির্বাসন বা মৃত্যুদণ্ডের ইচ্ছে নিয়েই রাজা অয়দিপাউস খুঁজতে শুরু করেন। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অন্ধ তাইরেসিয়াস রাজা তথা অনুসন্ধানকারীকেই অপরাধী বলে চিহ্নিত করলে রেগে ওঠেন তিনি। নানা ষড়যন্ত্র, অবিশ্বাস ও সংশয়ের উত্তেজনামুখর পথ পেরিয়ে ক্রমশ তিনি এক ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হন এবং নিজেকেই অপরাধী রূপে চিনতে পারেন। মা তথা রাণী যোকাস্তার অনুরোধেও তিনি সত্যের সমগ্র চেহারাটি খুঁজে নিতে বদ্ধ পরিকর দেখি আমরা – এ-সত্যানুসন্ধান নগরীর মঙ্গলকামনার পাশাপশি তাঁর নিজের জন্যও। যদিও পরিণামে যোকাস্তার আত্মহনন এবং রাজার অন্ধত্ব বরণ করে নিয়ে স্বেচ্ছা-নির্বাসনের দণ্ড নেমে আসে। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে নিয়তি মুখ্য হলেও, এ-ট্র্যাজেডি সত্যানুসন্ধানের আদিরূপ হিসেবে আমাদের মনোলোকে চিরস্থায়ী আসন লাভ করে। তবে এখানে অনুসন্ধানকারী ও অপরাধী একই ব্যক্তি। এই কাহিনিকে গোয়েন্দা সাহিত্যের আদিরূপ বলেন অনেকেই। যদিও বাইবেলের দানিয়েল বা কেইন কিংবা মহাভারতের ‘জতুগৃহ’ বা কীচক বধের মতো ঘটনার গায়েও রহস্যের গন্ধকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। এ-থেকে এটা স্পষ্ট, গোয়েন্দা কাহিনির মূল লক্ষ্য অপরাধ ও অপরাধীকে চিহ্নিত করা। সেই লক্ষ্যপূরণে গোয়েন্দাকে বহু রহস্য ও উত্তেজনা পার করতে হয় এবং শেষে মেলে সত্যের দেখা, ফিরে আসে নিয়ম ও শৃঙ্খলা। আর তাই ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা কাহিনির বীজমন্ত্র : সত্যান্বেষণ।
বাঙালি গোয়েন্দারা
বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ গোলাঘরে লুকিয়ে থাকা কালকেতুর খোঁজে আসা ভাঁড়ু দত্ত ও কোটালের গোয়েন্দাসুলভ তৎপরতার কথা আমাদের সুকুমার সেন মনে করান। এছাড়াও উনিশ শতকে সেই বাঁকাউল্লার দপ্তর, দারোগার দপ্তর, সেকালের দারোগার কাহিনি ইত্যাদির কথা আমরা মনে করতে পারি। রবীন্দ্রসাহিত্যেও অপরাধের প্রসঙ্গ বাদ যায় নি : সম্পত্তি সমর্পণ, কঙ্কাল, মহামায়া, নিশীথে, দিদি, সৎপাত্র এবং প্যারোডি গল্প ডিটেকটিভ উল্লেখযোগ্য। ‘ডিটেকটিভ’-কে বাদ দিলেই বাকি গল্পগুলিতে হত্যা, মৃত্যু, প্রতিহিংসা, আত্মহত্যার ঘটনা রয়েছে, যদিও কোনো ঘোষিত সত্যান্বেষী সেখানে নেই। রবীন্দ্রোত্তর পর্বে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের জগতে পাঁচকড়ি দে (দেবেন্দ্রবিজয়), শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (ব্যোমকেশ), সত্যজিৎ রায় (ফেলুদা), নীহারঞ্জন গুপ্ত (কিরীটী), সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (কর্ণেল), শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (শবর), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (কাকাবাবু), ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় (পাণ্ডব গোয়েন্দা), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (ভাদুড়ীমশাই), সমরেশ বসু (গোগোল) প্রমুখ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। মেয়ে গোয়েন্দার তালিকায় খ্যাতি পেয়েছে প্রভাবতী সরস্বতীর কৃষ্ণা, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গার্গী কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিনমাসি। কমিক্সের দুনিয়ায় নারায়ণ দেবনাথের গোয়েন্দা কৌশিক কিংবা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বঙ্গানুবাদে সাংবাদিক-গোয়েন্দা টিনটিন-কুট্টুস জুটি আমাদের ভীষণ প্রিয়। এছাড়াও রূপক সাহার সাংবাদিক-গোয়েন্দা কালকেতু, সায়ন্তনী পূততুণ্ডের অধিরাজ, স্মরণজিত চক্রবর্তীর অদম্য সেন আমাদের একুশ শতকে আলোচিত হয়েছেন নানাভাবে। কিন্তু এই অসম্পূর্ণ তালিকার পাশেই আমার মনে পড়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বিনতা রায়চৌধুরীর দুই গোয়েন্দা ঋষি ও তার সহকারিণী শ্রেয়ার রহস্যকাহিনি। নারীচেতনার মার্জিত উচ্চারণে তাঁর মূল ধারার কথাসাহিত্য আমাদের মনোহরণ করলেও ঈষৎ উপেক্ষিত এবং অনালোচিত তাঁর রহস্যকাহিনিগুলি, যা এখন গ্রন্থভুক্ত হয়ে চলেছে ক্রমশ। এই গবেষণা-নিবন্ধে একেবারে প্রথম দিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত তাঁর দুটি গোয়েন্দা কাহিনিকে আমি আলোচনার জন্য বেছে
নিলাম।
গোয়েন্দা কাহিনির মূলে প্রধানত দুটি প্রশ্ন থাকে : কে অপরাধী? আর কীভাবে ঘটেছে সেই অপরাধ? আর সেইসূত্রে অনিবার্যভাবে চলে আসে অপরাধের কারণ, সমকালীন সমাজের ছবি এবং অপরাধ-মনস্তত্ত্বের প্রসঙ্গও। ১৯২৮ সালে ভ্যান ডাইন (আসল নাম উইলার্ড হ্যারিংটন রাইট) একটি চমৎকার প্রবন্ধ লেখেন ‘টুয়েন্টি রুল্স্ অব রাইটিং ডিটেকটিভ স্টোরিজ’ নামে। সেখানে গোয়েন্দা কাহিনির কুড়িদফা নিয়মাবলীর সন্ধান পেয়ে যাই আমরা। যদিও দেশ-বিদেশের সার্থক গোয়েন্দা কাহিনিকারেরা নিখুঁতভাবে এই নিয়মাবলী মানেনি, স্বেচ্ছায় তা লঙ্ঘন করে নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছেন পাঠক-পাঠিকাদের। তবে একটি শর্ত সকলেই মেনেছেন যে, গোয়েন্দা নিজে কখনো অপরাধ করবে না। দেখে নেওয়া যাক সেই নীতিগুলিকে :
ক) রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে পাঠককেও গোয়েন্দার সমান সুযোগ দিতে হবে। পাঠকের চোখের সামনে সেইসব সূত্র থাকবে, যেগুলি গোয়েন্দাও দেখছেন।
খ) গোয়েন্দার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য অপরাধী যা যা করব, তার বাইরে কোনো ছলনা বা চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে লেখক পাঠকের বিভ্রান্তি বাড়াবেন না।
গ) কোনো প্রেমকাহিনি গোয়েন্দা সাহিত্যে কখনও প্রশ্রয় পাবে না।
ঘ) গোয়েন্দা বা তাঁর সমতুল কোনো রহ্যসানুসন্ধানী যেন কখনোই কাহিনি শেষে অপরাধী সাব্যস্ত না হন।
ঙ) রহস্য সমাধানের পদ্ধতি হবে যুক্তিনিষ্ঠ এবং ডিডাকশনের নিয়ম মেনে চলবে, কোনো কাকতালীয় বা দৈবাৎ ঘটে যাওয়া ব্যাপার থেকে অপারাধীকে চিহ্নিত করা যাবে না।
চ) রহস্য কাহিনিতে একজন গোয়েন্দা থাকবেন, তবে যতক্ষণ না তিনি রহস্যের সমাধান করছেন, ততক্ষণ তাঁকে গোয়েন্দা বলা যাবে না।
ছ) গোয়েন্দা কাহিনিতে খুন ও মৃতদেহ থাকা আবশ্যিক।
জ) কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার এ-জাতীয় কাহিনিতে প্রশ্রয় পাবে না (বিষয় ও রহস্যানুসন্ধানের পদ্ধতি উভয় ক্ষেত্রেই)।
ঝ) একটি গোয়েন্দা কাহিনিতে জনই প্রধান গোয়েন্দা থাকবে।
ঞ) কাহিনির শুরু থেকেই অপরাধীকে উপস্থিত থাকতে হবে, যাতে কাহিনিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাঠক-পাঠিকা বুঝতে পারেন অর্থাৎ নতুন কাউকে শেষের দিকে হাজির করে, তাকে অপরাধী বানানো চলবে না।
ট) বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকাদের অপরাধী বানিয়ে কাহিনি সৃজন বাঞ্ছনীয় নয়, কারণ এতে অপরাধের ওজন কমে যাবে।
ঠ) যতই খুন-খারাপি হোক না কেন মূল অপরাধী বা মূল চক্রী একজনই হবেন।
ড) গোপন সমিতি, মাফিয়া, রাজনৈতিক হত্যা ইত্যাদি বিষয় গোয়েন্দা কাহিনিতে একান্তই অপ্রয়োজনীয়।
ঢ) হত্যার উপায় ও রহস্যানুসন্ধানের পদ্ধতি – এ দুই ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিই গুরুত্ব পাবে, কল্পবিজ্ঞানের আশ্রয় নেওয়া যাবে না।
ণ) ভাল রহস্যকাহিনি তাকেই বলা যায়, যেখানে পাঠক-পাঠিকা নিজেই বুদ্ধি খাটিয়ে রহ্যসের সূত্র খুঁজে পান।
ত) গোয়েন্দা কাহিনিতে লম্বা বিবরণ বা ব্যাখ্যা, সাহিত্যিকের ভাষাসজ্জা, চরিত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, প্রকৃতি-বর্ণনা ইত্যাদি অপ্রয়োজনীয়।
থ) ভাল গোয়েন্দা কাহিনিতে সাধারণ ছিঁচকে চোর-ডাকাত বা ভাড়াটে খুনিকৃত অপরাধের গল্প স্থান পাবে না।
দ) গোয়েন্দা কাহিনির পরিণামে খুন শেষপর্যন্ত অ্যাক্সিডেন্ট বা আত্মহত্যায় পর্যবসিত হওয়া চলবে না।
ধ) অপরাধের উদ্দেশ্য বা মোটিভ সবসময় ব্যক্তিগত হবে।
ন) বহুল ব্যবহৃত উপাদান পরিহার করে চলা বাঞ্ছনীয়। যথা : অপরাধীর ফেলে যাওয়া সিগারেটের টুকরো দেখে তার পরিচয় নির্ণয়, ভুয়ো প্ল্যানচেটের ভয় দেখিয়ে অপরাধ কবুল করানো, নকল আঙুলের ছাপ, ডামির উপস্থিতি, কুকুরের না ডাকা থেকে চেনা মানুষকে অপরাধী বুঝে নেওয়া, নির্দোষ সন্দেহভাজন যমজ, হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জের ইঞ্জেকশন, সাংকেতিক ভাষার চিঠি, বন্ধ ঘরে খুন ইত্যাদি।
(তথ্যসূত্র : www.speedcitysistersincrime.org)
ভ্যান ডাইনের এই সূত্রাবলীর উপরে ভিত্তি করে গোয়েন্দা কাহিনির মেজাজ ও প্রবণতা নির্ণয় করা সহজ হয়। তাছাড়া সবকটি সূত্র একসঙ্গে না মানলেও মানুষের অপরাধপ্রবণতা এবং তার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সব গোয়েন্দার ভূমিকা দেশ-কাল ভেদে একরকম। শুরুতেই অয়দিপাউসের কথা কিংবা বাইবেল ও মহাভারতের উদাহরণ আমরা দিয়েছি। এছাড়াও সীতাহরণের পর তার ফেলে যাওয়া গয়না থেকে অপরাধীর যাত্রাপথ নির্ণয় কিংবা সংস্কৃত ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে পিঁপড়েদের গতিবিধি থেকে চন্দ্রগুপ্তের জন্য পাঠানো গুপ্তঘাতককে খুঁজে নেওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ ও অনুসন্ধানের চেনা কাঠামোই পাই আমরা। সেই তালিকায় বিনতা রায়চৌধুরীর গোয়েন্দা ঋষি ও তার সহকারিণী বোন শ্রেয়া কী নতুন কোনো ‘মেথড’ আমাদের সামনে আনে? নাকি নতুন ভাবে দেখার চোখ আর অপরাধের নতুনতাই তাঁর গোয়েন্দা কাহিনির মূল সুর? উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের এবার যেতেই হয় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত জোড়া কাহিনির কাছে। বিনতার প্রথম প্রকাশিত রহস্যোপন্যাস-গ্রন্থের নাম ‘ছকের বাইরে’ (২০০৬), প্রকাশক দে’জ পাবলিশিং।
[পরবর্তীকালে দে’জ থেকেই ‘পাঁচটি রহস্য উপন্যাস’ নাম দিয়ে আরেকটি বই প্রকাশ পেয়েছে লেখিকার, সেখানে ‘ছকের বাইরে’র কাহিনিদুটি ছাড়াও রয়েছে ‘গাড়িটা গেল কোথায়’, ‘চোখের আড়ালে’, ‘আঙুলে আততায়ীর নাম’ - এই তিনটি কাহিনি।]
ছকের বাইরে এবং
কাহিনি চুম্বক ১ :
‘এক টুকরো মেঘ’ অণু-উপন্যাসের শুরু গয়নার দোকানে হারিয়ে যাওয়া চুনীর ঘটনা দিয়ে। ঋষি আর শ্রেয়া পিসতুতো ভাই-বোন শখের গোয়েন্দা ও সহকারী হয়ে এক ক্লেপটোম্যানিয়াক ধনী মহিলাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে কাহিনির শেষে। গোটা গল্পটি জুড়েই কে অপরাধী আর কেনই বা সেই অপরাধ তা দেখিয়েছেন লেখিকা। সূচনায় দেখা যায় সোনার দোকানের ম্যানেজার ঋষির কাকাবাবু সমস্যায় পড়েছেন, কারণ তাঁর দোকান থেকে দু’লাখ টাকার চুনীটি চুরি কীভাবে হয়েছে, কে-ই বা করেছে, তা জানা যাচ্ছে না। এদিক মালিক পনেরোদিন সময় দিয়েছেন কর্মচারীদের, না পেলে তাদের ছাঁটাই অনিবার্য। কাকাবাবুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এসে ঋষি ও শ্রেয়া দোকানের সেদিনের সমস্ত ঘটনা জানতে চায়। ক্যাশিয়ার সুনীলবাবু সহ তিন সেলসম্যান (অভক, শিখাদি, মেঘা) এবং চারজন ক্রেতার উপস্থিতির কথা জানা যায়। এঁদের মধ্যে বাকিরা আংটি, মঙ্গলসূত্র ইত্যাদি দেখলেও এক বিত্তবান পরিবারের স্ত্রী সন্ধি চৌধুরীই ঐ চুনীটা
দেখছিলেন অভীকের কাছে। অভীক একটু ঝুঁকে একটা বাক্স বের করতে গিয়ে একবার চোখ সরায় এবং তারপরেই ট্রে সাজাতে গিয়ে মোড়কের চুনীটি পাওয়া যায় নি। এ-ঘটনার কথা জেনে নিয়ে ঋষি-শ্রেয়া সবাইকেই সন্দেহভাজন হিসেবে দেখে এবং ক্রমাগত জিজ্ঞাসাবাদের শেষে থেকে যায় তিনটি নাম : অভীক, শিখাদি এবং সন্ধি চৌধুরী। যদিও দেখা যায়, অভীকের মেয়ের বিয়ে ও শিখাদির ছেলের স্কুলে ভর্তির জন্য টাকা দরকার হলেও, সেসব প্রয়োজন নির্বিঘ্নে মিটে গেছে আগেই। তাহলে পড়ে থাকেন বিত্তবান পরিবারের সন্ধি দেবী। কিন্তু এত বিত্তবান পরিবারের মানুষ কেন চুরি করবেন, তিনি নিজেই তো এমন অনেক রত্ন কিনতে পারেন – এই খটকার মীমাংসা হয় না। তাছাড়া চুনীটা চুরি করে রাখা হলো কোথায়? উপস্থিত সকলের বডি সার্চ করে কিছুই তো পাওয়া যায়নি সেদিন। এই জটিল সমস্যায় যখন গোয়েন্দারা প্রশ্নাতুর, তখনি রুপোলি রেখার মতো ডাক্তার সিদ্ধার্থ সেনের দেখা মেলে এবং আসল উত্তর দেন তিনিই। তাঁর পেশেন্ট সন্ধি ম্যডামের ক্লেপ্টোম্যানিয়া বা অনিচ্ছুক চৌর্যবৃত্তির রোগের কথা শোনে তারা। আর তারপর এ-কথা সন্ধি চৌধুরীকে বলতেই তিনি মুখ কালো করে, দু-হাতে মুখ ঢেকে সোফায় বসে পড়ে বলেন “আমি ড. সেনের চিকিৎসায় ভালো হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন কি যে হল!”গোয়েন্দার কাজ অপরাধীকে ধরা, তা এখানে শেষ হলেও কীভাবে সেই অপরাধ ঘটলো, তা
আমাদের কৌতূহল জাগায়। রাস্তায় দেখা ভোজবাজির সঙ্গে মিলিয়ে ঋষি আমাদের জানিয়ে দেয় ঐ চুনী সন্ধিদেবী নিজের বড়ো খোঁপার
মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই রহস্যের সমাধান শেষে ঐ চুনী মালিককে ফেরত দেয় ঋষি ও শ্রেয়া, কাকাবাবুও চিন্তামুক্ত হন।
কাহিনি চুম্বক ২ :
‘ছকের বাইরে’ শিরোনামের দ্বিতীয় গোয়েন্দা কাহিনিটি একটি খুনের কিনারা, অভিযোগকারিনী কৃষ্ণা নিহত টোটনের প্রেমিকা। এখানেও ঋষি-শ্রেয়া জুটি জট ছাড়িয়েছে ধীরে ধীরে। কাহিনির সূচনা শ্রেয়ার বিউটি পার্লারে যাওয়া দিয়ে। সেখানে মনমরা কৃষ্ণাকে দেখে শ্রেয়া তাকে প্রশ্ন করে এবং জানতে পারে টোটনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা। পুলিশের চোখে আত্মহত্যা হলেও কৃষ্ণার কাছে এটা পরিকল্পিত খুন। গরিব মেয়েটির কাছে পারিশ্রমিকের আশা না করেই ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে ঋষি ও শ্রেয়া তার পাশে এসে দাঁড়ায়। সত্যানুসন্ধান করতে গিয়ে কৃষ্ণার কাছে তাদের আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতির তথ্য পায় এবং টোটনের অন্ধকার জগতে মেলামেশা সম্পর্কেও জানতে পারে। টোটনের এক দূর সম্পর্কের পিসি এবং তাঁর থেকেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু জিতের কথা উঠে আসে। কালুয়াদের ঠেকে টোটনের যাওয়া-আসার খবর যাচাই করতে বারংবার ঋষি সেখানে যায় এবং ক্রমশ রহস্যের গভীরে ঢোকে। অন্ধকার জগতের ছেলে ভিসুভিয়াস বলে এর পিছনে কোনও না কোনও বেইমানির কথা আর নেতা কালুয়া ‘এর মধ্যে একটা বিল্লি আছে’ এটুকু সূত্র দিয়ে দেয়। ঋষিদের সন্দেহের তালিকায় সকলে থাকলেও যুক্তি ও অঙ্ক কষে তার ক্রমশ অপরাধীর দিকে এগোতে থাকে। জানা যায়, হত্যাকারী টোটনের প্রিয়বন্ধু জিৎ। আর বিল্লি হলো জিতের প্রেমিকা শকুন্তলা। ভিসুভিয়াসের বলা সেই বেইমানীও এখানে রয়েছে। অকালে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ছোট্ট জিৎকে মুম্বই থেকে কলকাতায় নিয়ে আসে মজুমদার দম্পতি, যদিও ভদ্রলোক মেনে নেননি এই বাচ্চাটিকে। তাই শকুন্তলার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হলেও জিতের পরিচয় তাকে জানিয়ে দেন পালক পিতা অরিন্দম। শকুন্তলা তাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই রাগ ও প্রতিহিংসার বশে জিৎ টোটনকে দিয়ে পালক বাবা-মাকে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে হত্যা করায় এবং সেই প্রমাণ লোপাটের জন্য সে-রাতেই মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধকে টোটনকেও সরিয়ে দেয়। এরপর টোটনের প্রতিবেশীকে এক টাকার কয়েন চাওয়া এবং তা দিয়ে বুথ থেকে ফোন করা, মুখের উপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বিরক্ত জিৎকে ঋষির শনাক্তকরণ ইত্যাদি নানা প্রমাণ ও যুক্তি সাজিয়ে জানা যায় হত্যাকারীর পরিচয়।
দু’টি উপন্যাসেই আমরা দেখি, শুরুতেই অপরাধের পরিচয় পেলেও অপরাধীর পরিচয় এবং অপরাধের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি কাহিনির শেষের দিকে জানা গিয়েছে। উত্তেজনার পারদকে ঊর্ধ্বে চড়িয়ে রাখার কৌশল বিনতার করায়ত্ত। তবে ভ্যান ডাইনের সপ্তম সূত্রানুসারে যে-খুন ও মৃতদেহের কথা বলা হয়েছে, তা কিন্তু ‘এক টুকরো মেঘ’গল্পে নেই, সেখানে রত্ন চুরির রহস্যের কিনারা করেছে গোয়েন্দা ও তার সহকারিণী। অপরাধের কারণটিও সেখানে একটা মনের অসুখ। আর উভয় কাহিনির শেষে গোয়েন্দা ঋষির মুখে গল্পের আকারে সমস্ত অপরাধের ইতিবৃত্ত জানা হয়ে যায়। পূর্বজ ফেলুদার ভাই তোপসে বা মিতিন মাসির বোনঝি টুপুরের মতোই নিকট আত্মীয়কে সহকারী হিসেবে
নিয়েছে বিনতার গোয়েন্দা ঋষি। তবে লক্ষণীয়, সমলিঙ্গের সহকারীর জায়গায় রাজর্ষি-শ্রেয়া বিপরীত লিঙ্গের হলেও ভাই-বোনের সহজ সম্পর্কই বজায় রাখে; কোনো রোম্যান্টিক টানাপোড়েন লেখিকা দেখাতে আগ্রহী নন।
উৎসারিত আলো
এই গ্রন্থভুক্ত কাহিনি দুটির বাইরেও এই ঋষি-শ্রেয়াকে নিয়ে সম্প্রতি ‘সুখী গৃহকোণ’-এ (জুলাই ২০২১) তাঁর আরেকটি যে-উপন্যাস আমরা পড়ি, সেই ‘সাক্ষী ছিল না’-র কাহিনিতে সম্পত্তির জন্য এক বোনকে আরেক বোন হত্যা করতে পারে এমন আভাস আগাগোড়াই আমাদের সামনে থাকে। ম্যাডাম খুন হবেন এমন আভাস নিয়ে আতঙ্কিত ড্রাইভারের ইচ্ছেতেই ঋষি ও শ্রেয়া গোয়েন্দাগিরিতে নামে। এই উপন্যাস তুলনায় দীর্ঘ, অপরাধী কে হতে পারে তা অনুমান করা যায় বলেই হয়তো উত্তেজনার পারদ কিছুটা কম অনুভব করি আমরা। তবে কীভাবে সেই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো, মৃতদেহই বা কীভাবে সরিয়ে ফেলা হলো তা ঘটনার পারম্পর্য, প্রমাণ ও যুক্তি সাজিয়ে ধরে ফেলে ঋষিরা। যদিও কাহিনির শেষে পুরো গল্প শোনায় না আর। আগের দুটি গল্পের চেয়ে এ-কাহিনি একটু আলাদা এবং কম আকর্ষক। এছাড়াও তাঁর উপন্যাসে মধ্যে ‘নিঃশব্দ জলরব’ ক্রাইম থ্রিলারের মেজাজ নিয়ে আসে। কঠিনে কোমলে গড়া আপোষহীন নারী অনসূয়া অতীতের টুকরো টুকরো ছবি জোড়া দিয়ে একটা গল্প
শুনিয়েছেন আমাদের। তাঁর প্রিয়সখী একমাত্র কন্যা অকালমৃতা ঋতুর গল্প। ‘নিঃশব্দ জলরব’(২০০৮) উপন্যাসেও ফ্ল্যাশব্যাক এবং বর্তমান যাওয়া-আসা করে। এই কাহিনিতে প্রতিশোধ নিয়েছেন মা অনসূয়া খুনি জামাই বিশ্বামিত্রকে মেরে। তিনি নিজেই এখানে সত্যানুসন্ধানী, দণ্ডদাতা ও দণ্ডিতাও। এমনিতে তাঁর লেখায় ভিলেন বা খলনায়ক-নায়িকা তাই খুব কম। ‘নিঃশব্দ জলরব’-এর খুনী জামাই বিশ্বামিত্র বা গোয়েন্দাকাহিনির অপরাধী জিৎ-কে বাদ দিলে প্রায় সকলেই পরিস্থিতির শিকার কিংবা নানা কারণে বদলে যাওয়া চরিত্র। তাই বিনতা রায়চৌধুরীর কথাসাহিত্য প্রসঙ্গে সমালোচক বলেন, “সবকিছুকে এক পূর্ণতার বৃত্তে যেন ফেরাতে চান বিনতা। তাঁর সমস্ত কাহিনির ক্যাচলাইন হয়তো এই ‘আমাদের অনেক আলো দরকার। যে আলো একেবারে সোজা হৃদয়ের মাঝখানটায় পৌঁছে যাবে”। সেই বিনতা যখন গোয়েন্দা কাহিনি লেখেন, সেখানেও একটা স্পষ্ট পরিণাম আর স্থিতি এনে দেন তিনি। সে-কারণে তাঁর গোয়েন্দা কাহিনিতে অন্ধকার জগতের ছবির পাশাপাশি জিতের অস্তিত্বের সংকট, কৃষ্ণার নিঃশর্ত প্রেম, গোয়েন্দাদের মানবিক গুণ, বিশ্বস্ত ড্রাইভার কিংবা ধনী মহিলার চুরি করার অসুখের পরিণামে নিরপরাধ কর্মীদের চাকরি যাওয়ার হুমকির পরেও সব ফিরে পাওয়া - এসবের পরিচয় আমরা পাই। এভাবেই অন্ধকারের উৎস থেকে আলো এসে পড়ে তাঁর গোয়েন্দা সাহিত্যে। তাই পূর্বজদের পথে হেঁটেও কাহিনি বয়নের গুণে বিনতা রায়চৌধুরীকে অনায়াসে সফল গোয়েন্দা সাহিত্যস্রষ্টা
বলা চলে।।
ঋণস্বীকার
আকর গ্রন্থ
১) ছকের বাইরে, বিনতা রায়চৌধুরী, ডিসেম্বর ২০০৬, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
২) সাক্ষী ছিল না, সুখী গৃহকোণ (সম্পাদক : অন্বেষা দত্ত), ১ জুলাই ২০২১, বর্তমান প্রকাশনা, কলকাতা
৩) নিঃশব্দ জলরব, বিনতা রায়চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৮
সহায়ক পত্রিকা
১) দেশ , প্রচ্ছদকাহিনি ‘গোয়েন্দা কোথায়?’ (সম্পাদক : সুমন সেনগুপ্ত), ১৭ মার্চ ২০১৮
২) কোরক সাহিত্য পত্রিকা : বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য সংখ্যা (সম্পাদক : তাপস ভৌমিক), প্রাক্ শারদ ১৪২০
৩) বিনতা রায়চৌধুরীর উপন্যাস : স্বস্তি, কল্যাণ,আলো, ঋতম্ মুখোপাধ্যায়, অবকাশ সাহিত্যপত্র (বাংলা উপন্যাস ২১ শতক সংখ্যা), ISSN 2320-5835 , সিউড়ি, গ্রীষ্ম ২০১৪
সহায়ক ওয়েবসাইট
S.S.Van Dine’s Twenty Rules for Writing Detective Stories By S.S. Van Dine, September 1928 edition of The American Magazine (www.speedcitysistersincrime.org)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন