শত্রু
সুরঞ্জনার কথা মনে হলেই আমার মনে পড়ে যায় তৃণাঞ্জনার কথা। নামের মিল থাকলেও এটা ভাবা ভুল হবে যে, তারা দুই বোন। আবার তারা পরস্পরের বান্ধবী ভাবাও ঠিক হবে না। এক পাড়ায় বসবাস করলে বা একই কলেজে একই ক্লাসে পড়াশোনা করলে অথবা একসঙ্গে বড় হয়ে উঠলেও একথা কখনই বলা যেতে পারে না যে, তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ। তাহলে কি তারা পরস্পরের শত্রু? হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা তো করা যেতেই পারে!
আসলে ব্যাপারটা হয়েছে কি, আমি তখন সদ্য সদ্য চাকরিটা পেয়েছি জীবনবীমা অফিসে। কিন্তু চাকরিটা পেয়েও আমি খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি এবং তখনও হাফপ্যান্ট পরি আর অর্কপ্রভা ক্লাস এইটে পড়ে এবং ফ্রক পরে, আমরা একে অন্যের গালে চুমু খেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না। তার জন্য যদি প্রাণ দিতে হয়, তাই দেব। বস্তুত আমাদের এই প্রেম জেদ প্রতিজ্ঞা স্কুল পাশ করে বেরিয়ে যাবার পরেও পুরোপুরি ছিল। এবং শুধু তাই নয়, কলেজে যখন পড়ি, গালে চুমু খাওয়া তখন অতীত, আমরা দুজনে দুজনের ঠোঁটে চুমু খাই, তখনও আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা জেদ আর প্রেম এতটুকুও টসকায়নি। এবং আমরা দুজনেই যেহেতু ঢপবাজ ছিলাম না, তাই অদূর ভবিষ্যতেও আমাদের সম্পর্কটা অটুট থেকে যেত এবং আমরা বিয়েও ঠিক করতাম।
কিন্তু যা হয়, সব চিত্রনাট্যেই যেমন কোথা থেকে এক ভিলেনের উদয় হয়, এক্ষেত্রেও তাই হলো। আমি তখন গ্র্যাজুয়েশন করে সদ্য সদ্য জীবনবীমা অফিসে চাকরিতে যোগদান করেছি, অর্কপ্রভা আমাকে ফোন করে জানালো, তাকে না জানিয়েই তার বিয়ের কথা পাকা করে ফেলেছে তার বাবা। আমি তো হকচকিয়ে গেলাম। তাহলে কী উপায়? অর্কপ্রভা বলল, একটাই উপায়, চল আমরা পালাই! প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু বাস্তবটা তো অন্য। নতুন চাকরি, সবে উপার্জন করতে শুরু করেছি, এই অবস্থায় অর্কপ্রভাকে নিয়ে কোথায় যে পালাই! সত্যি সত্যিই খুব মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। আর ঠিক তখনই আমার জীবনের চিত্রনাট্যে অনুপ্রবেশ করেছিল সুরঞ্জনা ও তৃণাঞ্জনা। আমাকে নাকি ওদের দুজনেরই খুব ভালো লেগেছিল। জীবনবীমা অফিসেই সবাই চাকরি করতাম, প্রতিদিন মুখোমুখি টেবিলে বসে কাজ করতাম। একদিন আমাকে দুজনে পাকড়াও করল আমার জীবনের ট্র্যাজেডি শোনার জন্য। মনটা খুব দুর্বল ছিল। মনের কথা বলেই ফেললাম। ততদিনে অর্কপ্রভা তার বরের কাছা ধরে পাড়ি দিয়েছে ইউরোপে।
দিন কয়েক পরে সুরঞ্জনা ও তৃণাঞ্জনা আমাকে সরাসরি প্রস্তাব দিল, যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে পারো। এ তো মহা মুশকিল! আমি কাকে পছন্দ করি! একজনকে পছন্দ করলে অন্যজনকে অপছন্দ করতে হয়। আমি হাত তুলে বললাম, এটা তোমাদের ব্যাপার, আমার নয়। আর তখনই আন্দাজ করলাম তাদের মধ্যে শত্রুতা কতটা মারাত্মক! একদিকে সুরঞ্জনা আমার গলায় ঝোলাতে চায় তৃণাঞ্জনাকে। আর অন্যদিকে তৃণাঞ্জনা আমার গলায় লটকে দিতে চায় সুরঞ্জনাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন