ইংরেজি ডায়েরি শব্দের উৎসে যে ‘Diarium’ বা ‘Dies’ (দিন) রয়েছে, তার ভিত্তিতে ডায়েরির সর্বজনবোধ্য
একটি সংজ্ঞা হতে পারে এইরকম – প্রতিদিন যা ঘটে তার বিবরণ যদি কেউ লিখে রাখেন তবে তাকেই আমরা ডায়েরি বলতে পারি। সংরূপ বিচারে নোটবুক বা জার্নাল ডায়েরির সমধর্মী। বিশ্বের ইতিহাস ঘাঁটলে ১৬৬০ থেকে ১৬৬৯ সময়কালে লেখা স্যামুয়েল পেপিজের ডায়েরি কথা জানা যায়। এই ডায়েরিকে রঞ্জন অসাধু ব্যবসায়ীর লুকানো দ্বিতীয় হিসেবের খাতার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তবে সেই ডায়েরি যখন কবির, তখন তা হয়ে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসার নামান্তর। অনেকে বলতেই পারেন, গোপন ডায়েরিকে অনাবৃত করা কেন? রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলে গেছেন ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র আবার কবির কবিতার পাশাপাশি ব্যক্তিকেও জানাবোঝার উপদেশ দিয়েছিলেন। ডায়েরি আসলে আসলে সেই শিল্প যা একান্ত নিজের ও ব্যক্তির মনোলোকের চিহ্নবাহী। জীবনী বা আত্মজীবনী কিংবা চিঠিপত্রে যে সংযমের মুখোশ থাকে, ডায়েরিতে তাই থাকে না কখনো। স্বগত সংলাপে ভরা এসব ডায়েরি আসলে সেই কবির একান্ত উপলব্ধির ফসল বলেই তাঁর মৃত্যুর পর এর প্রকাশ মুখোশের আড়ালে থাকা প্রকৃত মুখটিকে চিনিয়ে দেয়। অতএব ডায়েরি কেবল দিনপঞ্জি হিসেবে বিচার্য হয় না আর। বিশ্বসাহিত্য থেকে বাংলা কবিতাজগৎ : বোদল্যার, সিলভিয়া প্ল্যাথ, ব্রেশ্ট্, কুসুমকুমারী দাশ, জীবনানন্দ দাশ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সমর সেন, বিনয় মজুমদার, ভাস্কর চক্রবর্তী, জয়দেব বসু প্রমুখ কবিদের ডায়েরি বা জার্নাল ইদানীং গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে তাঁদের জীবন ও সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে।
ডায়েরির ভাস্কর
ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৫-২০০৫) দশক বিচারে ষাটের কবি। নাগরিক চেতনা, বিষণ্ণতাবোধ, প্রেম ও মৃত্যু তাঁর কবিতার প্রধান কয়েকটি লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ এই পঙ্ক্তি তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। ভাস্করের ডায়েরি ১৯৮২ ও ১৯৮৩ এই দুই কালসীমায় লেখা হয়েছে, আছে পরবর্তীকালে লেখা ডায়েরি বা জার্নালধর্মী বই ‘শয়নযান’(১৯৯৮)। বাকি ডায়েরির সন্ধান আমরা সুমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বাসবী চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘গদ্যসমগ্র’তে পাই না। ‘শয়নযান’-এ তাঁর স্বীকারোক্তি ‘গরীব বাড়ির এক পাঠবিমুখ ছেলের কাছে কবিতা এসেছিল এক মুক্তির আশা নিয়ে’ – তাই কবিতা লিখতে এসেই আজীবন কবিতাই লিখে গেছেন ভাস্কর। দেখা যাচ্ছে, এই দুই কালপর্বের ডায়েরিতে ভাস্কর তিনটি কাব্যের কথা বলেছেন ‘এসো, সুসংবাদ এসো’, ‘রাস্তায় আবার’ ও ‘দেবতার সঙ্গে’। প্রথমটি ডায়েরি লেখার আগেই প্রকাশিত, অন্য দুটি তখন লিখছেন বা লেখার পরিকল্পনা করছেন। প্রথমটির বিক্রি, রয়ালটি, সমালোচনা ইত্যাদির কথা আছে ডায়েরিতে। দ্বিতীয় কাব্যের পাণ্ডুলিপির ক্রমশ হয়ে ওঠার খবর এখানে পাই, ১৯৮২তে কবি লেখেন ‘এই পনেরোটা কবিতার মধ্যে ৪/৫টা কবিতাও কি যথার্থ কবিতা হবে না?’। যদিও ১৯৮৩এর বইমেলায় প্রকাশিত এ-কাব্যের বিরূপ সমালোচনায় তাঁকে প্রভাবিত কবি বলা হলে সেই ক্ষোভ ও বেদনা ডায়েরিতে লিখেছেন। পরবর্তী কাব্য ‘দেবতার সঙ্গে’(১৯৮৬)-র লেখার সময়কাল ১৯৮২-৮৩, তাঁর প্রিয় এই কবিতাগুলি সম্পর্কে ডায়েরিতে লেখেন : ‘জীবনে হয়তো আমার গোপন খাতার ২১টা কবিতাই সম্বল’। এছাড়া ডায়েরি ‘আকাশ অংশত মেঘলা’ ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’ ইত্যাদি কাব্যের কবিতার কথাও আছে। বেশকিছু চিত্রকল্প ডায়েরি থেকে কবিতায় উঠে আসতে দেখা যায় (‘বকুল ফুলের মতো সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে’ – এই উপমা তিনি ব্যবহার করেছেন ‘শহরনামা’ কবিতায়)। ডায়েরিতে কবিতার প্রসঙ্গ ছাড়াও তাঁর দিদির কথা, প্রেমিকা ও পরবর্তীকালে সহধর্মিণী বাসবী দেবীর কথা, সিনেমা দেখা ও তার সমালোচনা করা, শঙ্খ ঘোষ-জয়-সুবোধ-মল্লিকার সঙ্গে আড্ডা এসব প্রসঙ্গ ও নানাজনকে লেখা অসংখ্য চিঠির কথা টুকরো টুকরো ভাবে ছড়িয়ে আছে। জার্নাল/ডায়েরির আলোকে আংশিকভাবে হলেও ভাস্করের ব্যক্তিজীবন ও সৃষ্টিকে এভাবেই জানা সম্ভব হতে পারে। কারো কাছে এই উন্মোচন অবাঞ্ছিত আর কেউ বা সত্য দর্শনের আয়নায় ভালোমন্দে মেশা সেই সাহিত্যস্রষ্টাকে নিবিড়ভাবে চিনে নিতে চান। ডায়েরি সাহিত্যের চেয়ে প্রকৃত ডায়েরি-পাঠ তাই অধিকতর মূল্যবান।
কবিতায় গড়া পৃথিবী
‘কবিতা লিখতে এসেছিলাম / কবিতা লিখে চলে যাব’ – এইভাবে ভাবেন যে-কবি, যাঁর চোখে সারা পৃথিবীটাই কবিতা দিয়ে গড়া, তিনি ছয়ের দশকের ভাস্কর চক্রবর্তী (১৯৪৬-২০০৫)। যদিও ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’র স্রষ্টা হিসেবেই তাঁকে সবথেকে বেশি চেনে বাংলার কবিতাপ্রিয় পাঠকসমাজ। জীবনের শেষপর্বে এসে ডায়েরিধর্মী ‘শয়নযান’ বইটিতে তিনি আমাদের জানান তাঁর কবি হয়ে উঠবার ভিতরের কথা :
‘ছেলেবেলা থেকেই জীবন আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করত। সকলেরই যেমন থাকে, আমার জীবনের পাশেও একটা আলো জ্বলত, মায়াবী এক আলো। আমার মোট গরীব বাড়ির এক পাঠবিমুখ ছেলের কাছে কবিতা এসেছিল এক মুক্তির আশা নিয়ে’।
নিজেকে কবিতাবাদী হিসেবেও দেখেছেন তিনি। মূলত কবিতা লিখলেও তাঁর কলমে গদ্যের দেখাও মিলেছে কখনো সখনো। সেই তালিকায় ‘শয়নযান’-এর পাশাপাশি ‘প্রিয় সুব্রত’ কিংবা ব্যক্তিগত ডায়েরিকে রাখা যায়। এয়াবৎ ভাস্করের কোনো প্রামাণ্য জীবনী লেখা নেই বলেই এই আপন মনের খেয়ালে লেখা দিনলিপি হয়ে উঠতে পারে তাঁকে নিবিড় ভাবে জানার জানালা। যদিও আমাদের হাতে এসেছে দুটি মাত্র ডায়েরি। কবিবন্ধু অধ্যাপক সুমন্ত মুখোপাধ্যায় ভাস্করের গদ্যসমগ্রর ‘শুরুর কথা’য় জানিয়েছেন এই ডায়েরি দুটি উদ্ধারের আশ্চর্য গল্প। ১৯৯৬ সালে তাঁর ডায়েরিগুলি খবরের কাগজের স্তূপের সঙ্গে, খাতাপত্রের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল কাগজওয়ালার দোকানে বিক্রির জন্য। পথে কয়েকটা ডায়েরি শুধু নেমে যায়। ১৯৮২ ও ১৯৮৩ – এই দুটি সালের ডায়েরি কেবল আমরা পাই। ভাস্করের জীবনে এই দুই সালের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, দীর্ঘ ডিপ্রেশেনের অসুখে ভোগার পর তিনি ১৯৮২ নাগাদ সুস্থ হন ও ডায়েরি লেখেন। তাই এইসময়ে হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত ভাস্করের বদলে এক প্রাণবন্ত, সমাজ-সংস্কৃতি সচেতন, পারিবারিক মানুষ ভাস্করকে। অন্যদিকে ’৮৩-এর ডায়েরিতে প্রেমিক ভাস্করের দেখা মেলে। ভাঙা টিনের মতো জীবন থেকে লাফ দিয়ে উঠে বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করা ভাস্করের মনোলিপি এখানে পাই।
কবিতা তাঁর কাছে ‘আলোয় ভর্তি এক পাহাড়, যে আলো শুধুই হাজার মোমবাতির। মোমবাতি গুলো সব জ্বলা আর পাহাড়টা আস্তে আস্তে ডানা ভাসিয়ে শূন্যে উড়ছে আর ভেসে যাচ্ছে’ (শয়নযান)। তাঁর দিনলিপিতে এই কবিতার কথা নানা বিভঙ্গে বারংবার এসেছে। সাল-তারিখের বিচারে ১৯৮২-৮৩-তে ডায়েরি লেখার আগেই তাঁর ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ (১৯৭১) এবং ‘ এসো সুসংবাদ এসো’ (১৯৮১) প্রকাশিত হয়ে গেছে; আর ‘রাস্তায় আবার’ (১৯৮২) কাব্যের প্রকাশ আসন্ন। এছাড়াও তাঁর অন্যতম প্রিয় কাব্য ‘দেবতার সঙ্গে’র কবিতাগুলি এই ৮২-৮৩ সময়পর্বেই রচিত। আবার ‘আকাশ অংশত মেঘলা’ (রচনা : ১৯৮১-৮৭) ও ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’ (রচনা : ১৯৮৬-৯২) – এই দুটি কাব্যের কয়েকটি কবিতার বীজও এই দুই ডায়েরিতে খুঁজে পাওয়া যায়। এবার কবিতার খোঁজে সরাসরি পৌঁছনো যেতে পারে তাঁর ডায়েরির পাতায় :
পয়লা জানুয়ারি ১৯৮২, ডায়েরির প্রথম পাতায় ভাস্কর লিখছেন : ‘১৯৮২ শুরু হলো – ‘অসুখের পর’ – নতুন কবিতা’। কবিতাই যাঁর জীবনসর্বস্ব, তেমন একজন মানুষের দিনলিপির সূচনা যে কবিতা দিয়েই হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই ডায়েরির এন্ট্রিতে ‘অসুখের পর’ ও ‘নতুন কবিতা’ শব্দদুটি ব্যাখ্যাযোগ্য। আমাদের মনে হতেই পারে বছরের শুরুর এই কবিতাটির নাম তিনি ‘অসুখের পর’ দিলেন কেন? ‘শয়নযান’ গ্রন্থে তিনি এ-সময়ের একটু বিবরণ দিয়েছেন :
‘চব্বিশ পঁচিশে আমাকে যা সবথেকে কাহিল করেছিল তা অসুস্থ হয়ে পড়ার এক ভয়। উন্মাদ হয়ে পড়ার ভয়। ভাবতাম বাকি জীবনটা হয়তো বা উন্মাদ হয়েই কোন পাগলা গারদে কাটাতে হবে।... শেষপর্যন্ত অসুস্থতা ঘিরে ধরল আমাকে। আমাকে ঘিরে ধরল অনিদ্রা। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ শুরু হল, শুরু হল ওষুধপত্র। কতশত রাত্তিরে মৃত্যুকে আমিও ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমুদ্রের স্রোতের মতো মৃত্যু আমাকে সকালবেলায় আবার ছুঁড়ে দিত ফুটপাথে, কোনো নিবিড় ঘরের চৌকাঠে অথবা কোনো বন্ধুর শান্ত নরম বিছানায়’।
কিন্তু এসবের পরেও অদম্য জীবনপিপাসা তাঁকে নতুন করে বাঁচার রসদ জুগিয়েছে। তাঁর কলম জন্ম দিয়েছে ‘অসুখের পর’-এর মতোই আরও অনেক কবিতার। আর ‘নতুন কবিতা’ বলতে নতুন এক মেজাজে কবিতাস্রোত তিনি অনুভব করেছিলেন ভাস্কর, সেকথাই এই এন্ট্রিতে বোঝাতে চেয়েছেন। তাছাড়াও অসুস্থ ভাস্করকে নিয়ে লেখা শঙ্খ ঘোষের ‘প্রহরজোড়া ত্রিতাল’ কবিতার একটি লাইন ‘আমাদের হেরে যাওয়া সাজে’ দিনলিপির শুরুর পাতাতেই লিখে রেখেছেন কবি, এ যেন তাঁর উজ্জীবনের মন্ত্র। আর এও জানিয়েছেন : ‘The poet is a deer with a dream in it’।
এরপর ভাস্করের ডায়েরিতে বেশ কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে ‘এসো সুসংবাদ এসো’, ‘রাস্তায় আবার’, ‘দেবতার সঙ্গে’ – এই তিনটি কাব্য নিয়ে নানা কথা। এরমধ্যে প্রথম দুটি কাব্য একই কালপর্বে লেখা, যদিও প্রকাশকাল ভিন্ন (১৯৭২-৭৮ / ১৯৭১-৮০)। ১৫ জানুয়ারির এন্ট্রিতে তিনি লিখছেন : “ ‘এসো সুসংবাদ এসো’ ১০ কপি” – অর্থাৎ বইটির কাটতি যেমন তিনি লিখে রেখেছেন, তেমনি রয়্যালটি বাবদ যে ১০০ টাকা পেয়েছেন তাও লিখে রাখতে ভোলেননি : ‘অরুণা প্রকাশনী (বিকাশবাবু) – 100.00’ এছাড়াও এ-কাব্য নিয়ে আরো দু-একটি প্রসঙ্গ রয়েছে, যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো : ‘পার্থপ্রতিম জানালেন, কালই ওনাকে নাকি একপাতা গদ্য লিখতে হয়েছে আমার জন্য। উদ্ধারিত হলাম’ (৪ অগাস্ট, ১৯৮২)। এখানে কবি ‘দেবী’ (১৯৭০) কাব্যখ্যাত পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (১৯৪৯-২০২০)-এর কথা বলা হয়েছে, এই কবি সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। সমালোচকের মতে, ‘ইতিহাস, ধর্ম ও পুরাণ ছুঁয়ে পার্থপ্রতিম এক নিজস্ব কাব্যভাষা সৃজন করেছেন; সেখানে সমাজ, রাজনীতি, আধ্যাত্মিকতা এক বৃন্তে মিশে যায়’। পার্থপ্রতিমের সেই গদ্যটি ‘আহ্বান’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। এই পত্রিকায় আরো চারজন কবিও ভাস্করের কাব্যটির পাঠ-অভিজ্ঞতা জানান, তাঁরা হলেন : প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামী, রণজিৎ দাশ, অমিতাভ গুপ্ত।
‘রাস্তায় আবার’ কাব্যে ভাস্কর ‘নিজস্ব রাস্তায়’ দাঁড়াতে চেয়েছেন। দিনলিপির পাতায় এ-কাব্যের পাণ্ডুলিপি থেকে প্রকাশ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে। যেমন, ১০ অগাস্ট ১৯৮২ পাতায় লেখা ‘রাস্তায় আবার শঙ্খবাবুর বাড়িতে, কথা মতো Manuscript-টা সুরজিৎ (প্রমা)-এর জন্য রেখে এলাম। ... এ-সম্পর্কে আর বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা নয়।’ কিন্তু দুর্ভাবনা কি সহজে পিছু ছাড়ে? কখনো ডায়েরির পাতায় এ-কাব্যের ছাপ্পান্নটি কবিতার মধ্যে ষোলটি কবিতার নাম লিখে রেখে সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, ‘এই পনেরোটা কবিতার মধ্যে ৪/৫টা কবিতাও কি যথার্থ হবে না?’ আবার কখনো কাব্যটি প্রেসে ছাপতে চলে যাওয়ার মাস খানেক পর তাঁর কণ্ঠে শোনা গেছে হতাশার সুর, দেখা গেছে দুশ্চিন্তা : ‘সুরজিৎকে phone করতে করতে কাহিল হলাম। কিছুতেই দেখা হচ্ছে না, কী যে করি, প্রুফ তো আমার দেখতে পাওয়া উচিত। কী হচ্ছে কে জানে।’ (১৯ জানুয়ারি ’৮৩) এরকম নানা টানাপোড়েন পার করে মাসখানেক পর বইমেলায় প্রমার স্টলে দেখা মিলেছিলো তাঁর ‘রাস্তায় আবার’ কাব্যের। বই দেখে খানিকটা স্বস্তি পেয়ে কবি জানাচ্ছেন ১১ ফেব্রুয়ারির এন্ট্রিতে : ‘প্রচ্ছদ খুবই সুন্দর লাগলো। এমনকি রংটাও। বইটাও প্রায় নির্ভুল ছাপা হবে মনে হচ্ছে’। অবশেষে তাঁর সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বইমেলাতেই সরস্বতী পুজোর দিনে হাতে পেলেন বইটি। যদিও অসম্ভব খুঁতখুঁতে কবির চোখে ছাপা ভুল যেমন চোখে পড়েছে, তেমনই কখনো মনে হয়েছে ‘বইটা ছাপিয়েই হয়তো ভুল হলো’ (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩), কেননা : ‘রাস্তায় আবার-এ ‘কিছু কথা’ কবিতাটা রাখা ঠিক হয়নি। কিছুতেই ঠিক হয়নি। দেখতে বাজে লাগছে, ভারী হয়ে গেছে পাতাটা’। সেই কবিতার দুটি পঙ্ক্তি ডায়েরির পাতায় লিখে তিনি বলছেন :
‘এখন তোমার কথা লিখে রাখি, তোমার বোনেদের লিখে রাখি –
কোথাও সদিচ্ছা নেই, শুধু যা টেবিল ল্যাম্পে আলো দেয় সারারাত জ্বলে’।
তাঁর মনে হয়েছে ‘কোথাও সদিচ্ছা নেই – একথা, এই বাজে কথাটাও তো ঠিক নয়। টেবিল ল্যাম্প কিছুটা বাঁচিয়েছে। - ভয়াবহ ভুল হলো’।
কলকাতা বইমেলা চলছে, ‘রাস্তায় আবার’ বিক্রিও হচ্ছে। তবু ভাস্করের মনে ক্ষোভ ‘শুধু লাঞ্ছনা আর অপমান, এই তবে আমার প্রাপ্য?’। যদিও ওরই মাঝে শঙ্খ ঘোষের প্রশংসা তাঁর হতাশাদীর্ণ মনকে কিছুটা উজ্জীবিত করেছে : ‘শঙ্খবাবু জানালেন, রাস্তায় আবার ভালো লাগছে’। তবুও সকলের কাছে সেইভাবে সমাদর না-পাওয়ায় কবির আবারও মনে হয়েছে ‘কেন কবিতাগুলো ভালো করে বাছলাম না? বইটা তো একটু ভালো হতে পারতো?’ (২ মার্চ, ১৯৮৩)। দিন পাঁচেক পর এ-কাব্য নিয়ে তাঁর ‘ভাবনা শেষ’, দিনলিপিতে এমন লিখলেও আবার মাস আটেক পরে তাঁর মনে হয়েছে, ঐ কাব্যদুটির সঠিক সমালোচনা হতে দেখা গেল না। এছাড়াও এমার্জেন্সি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা এসবের উল্টোদিকের বিষণ্ণতা, চাপা আয়রনি, প্রতিবাদ ‘এসো সুসংবাদ এসো’কে ছুঁয়ে গেলেও শঙ্খবাবু যখন শুধুমাত্র এতে ভালোবাসার কথা বলেন, তখন কবি আগ্রহ হারান। লেখেন :
‘রাস্তায় আবার-এর secret theme – malnutrition, social aggression আর self aggression-এর কথা এই বইতে বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে’। (৩ নভেম্বর, ১৯৮৩)
এই এন্ট্রির পর ডায়েরিতে ‘রাস্তায় আবার’ নিয়ে আর কিছু মন্তব্য পাওয়া যায় না। তবে পরবর্তীকালে এই ‘রাস্তায় আবার’ থেকেই কিন্তু ভাস্কর তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র জন্য তিরিশটা কবিতা বেছে নিয়েছিলেন।
‘দেবতা, বিরাশি সালে, আপনার সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল’ – এই দেবতার সঙ্গে কবির কথাবার্তার ফসলই তাঁর ‘দেবতার সঙ্গে’ কাব্যে ধরা রয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দেবতার সঙ্গে’ কাব্যটি তিনি উৎসর্গ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে আর প্রারম্ভিক পঙ্ক্তি-তে লিখে রেখেছেন দুটি ছত্র : ‘আমি দেবতার দেখা / হঠাৎ পেয়েছি কাল রাতে’। কিন্তু কে এই দেবতা? কোনো অতিলৌকিক শক্তির কাছে কি প্রণতি জানান কবি? অথচ ভাস্করের কবিতার মূল সুর বিষণ্ণতা, মৃত্যু আর বিরহবিধুর প্রেম। একদা তিনিই উচ্চারণ করেছিলেন সেই প্রবাদপ্রতিম পঙ্ক্তি : ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’। গবেষকের চোখে তাই ভাস্করের কবিতার কোনো গভীর আধ্যাত্মিক আয়তন ধরা পড়ে না, বরং ‘দেবতা যেন এক প্রতীকী অস্তিত্ব ভাস্করের কাছে। আর মানুষ ‘অবিশ্বাসের পাখি’... ভাস্করের দেবতাকে আমরা মানবিক রূপে দেখি, সম্প্রীতির সাদা পায়রাও হয়ে যান তিনি।’ তাঁর দুটি ডায়েরিতে তাঁর প্রিয় এ-কাব্যের ভিতরমহলের ছবি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮২-এর পাতায় তিনি লিখেছেন : ‘জীবনে হয়তো আমার গোপন খাতাটার ২১টা কবিতাই সম্বল’। এ-কাব্যের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন :
‘টাকা পয়সা নেই, প্রেমিকা নেই, বান্ধবী নেই এরকম চলছে। কিন্তু এত ভালো ছিলাম, কেন ভালো ছিলাম বুঝেছি, তখন আসলে আরেকটা আমি অর্থাৎ দ্বিতীয় আমি তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। ... এই যে ঈশ্বর ব্যাপারটা এখানে থেকেই এসেছে।’
সেই সঙ্গে তিনি এও জানিয়েছেন, ‘এটা মনে রাখা ভালো ঈশ্বর বলতে আমি দেবতাই বলেছি, কখনো ঈশ্বর বলিনি। কারণ দেবতা ও ঈশ্বরের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে, আমার মনে হয়... সে আমার বন্ধু’।
বিশেষভাবে লক্ষ করবার বিষয় হলো, ডায়েরির মতোই এই কাব্যের পঁচিশটা কবিতাই সাল-তারিখ যুক্ত। ১৯৮২ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি এই কাব্য নিয়ে প্রথম লেখেন ডায়েরির পাতায় এইভাবে : ‘[দেবতার সঙ্গে – ১৯৮২-১। দেবতা ১৯৮২-২। দেবতা ১৯৮২-৩]’ – তৃতীয় বন্ধনীর অন্তর্গত এই লাইনটি পরবর্তী সময়ে যেমন কেটে দেওয়া হয় তেমনি কবিতাগুলো বাতিলও করে দেন ভাস্কর। তবে কাব্যটির প্রাথমিক নামকল্পনার উৎস যে এই অংশটি, তা বেশ বোঝা যায়। তারপর ‘দেবতা ১৯৮২ (?)’ বলে আরেকটি কবিতার কথা ডায়েরিতে লিখে রাখলেও পরে জানিয়েছেন ‘ছিঁড়ে ফেলেছি’। তাই এই চারটি কবিতার পরবর্তীকালে কোনও হদিশ মেলেনি। ‘এমন হাসি আয়ত্তে আনতে হবে যা কোনোভাবে কোনোকিছুতেই ম্লান হবে না কোনদিন’ (১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২) – এই গোপন স্ট্র্যাটেজি ছিল এ-কাব্যে। আর এই ভাবনাসূত্র মাথায় নিয়ে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি লিখছেন : ’১২ দেবতা ১৯৮২-১’ অর্থাৎ অস্তিত্ব না মুছে দিয়ে তিনি এ-কবিতাটিকে কাব্যের প্রথম কবিতা হিসাবে স্থান দিয়েছেন। আর ৮২ সালে লেখা ১২ সংখ্যাক কবিতা হিসেবে ‘দেবতার সঙ্গে’র সূচনা-কবিতার জন্ম হওয়ায় নামের আগে ১২ সংখ্যাটি যোগ হয়েছে। এ-কাব্যের কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি যেন এক শান্ত, নির্জন আবহাওয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন। দিনলিপির পাতায় লিখে রাখছেন চমৎকার সব চিত্রকল্প। যেমন, ‘সাদা পায়রার ডানা ঝাপটানোর মতো মেয়েটির গলার স্বর / আজ সেই কতোদূরের দিন থেকে শুনতে পাচ্ছি’ (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২)। আর এই ভাবনার পরে যেন লেখা হয়ে যায় ২৬ তারিখের ৭সংখ্যাক কবিতাটি :
এবার ঘরের মধ্যে হে দেবতা আকাশ জেগেছে
ছবিগুলো ফুটে ওঠে পরিষ্কার এ কোন ক্যামেরা?
অর্থাৎ দুটো ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, দূরের জিনিস কাছে এসে স্পষ্টভাবে ধরা দেওয়ার ছবি। সেইসঙ্গে কবি আরো লিখেছেন :
একটা পথের দেখা হয়তো পেয়েছি আমি আজ
যে পথে সামান্য যাত্রী যে পথে সামান্য আলো জ্বলে।
কিংবা ১৪ সংখ্যক কবিতায় অন্যভাবে আসে পায়রার চিত্রকল্প ‘তুমি সাদা পায়রার মতো কেন সমস্ত এ পৃথিবীতে উড়তে পারো না’? এই কবিতাটিও যদিও কবির যুদ্ধবিরোধী মনের প্রকাশ। আর প্রেমের ছবি একেবারের প্রারম্ভিক কবিতায় আমাদের নন্দিত করে : ‘মেয়েটি আমাকে যদি ডেকে নেয় তবে আজ দেবতাকে খুঁজতে যাবো না’। আবার দিন পনেরো পর মার্চের ১০ তারিখে দিনলিপির পাতায় লেখেন : ‘তিন জ্যোতিষীর হিম হাসি / ২৫ দেবতা ১৯৮২-৯’ অর্থাৎ এই সালের ২৫ সংখ্যক কবিতা হিসেবে ‘দেবতার সঙ্গে’র ৯সংখ্যক কবিতার জন্ম হলো। কবির চোখে ঐ তিন জ্যোতিষী আসলে দারিদ্র্য, দুশ্চিন্তা আর বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, যাদের বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি তাঁকে সর্বদা ঘিরে রাখে, চোখে চোখে রাখে :
দারিদ্র্য, দুশ্চিন্তা আর বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, দেখ
আমাকে ঘিরেছে ঘরে, রাস্তা, রেস্তোরাঁয়!
যদিও তিনি চান সমস্ত জীবন জুড়ে ভালোবাসার গান গাইতে। এই গোপন খাতার কবিতাগুলি লেখার সময় তাঁর মনে হয়েছে যেন দুটো ডানা উপহার পেয়েছেন তিনি। কবির জবানিতে
‘বাস্তবিক, আমার ব্যক্তিগত গোপন কবিতাগুলোয় আমার কল্পনা আলোর মতো এদিক থেকে ওদিক যাতায়াত করছে... জীবনের কাছে আমি কত না কৃতজ্ঞ’ (২৬ জুন ১৯৮২)
এ-কাব্যের ১৩ ও ১৪ সংখ্যাক কবিতাদুটিতে ভাস্করের মনের এই গভীর গোপন চিহ্ন মুদ্রিত হয়েছে। প্রথম কবিতাটিতে কবি ও দেবতার মধ্যে দূরত্ব রচিত হওয়ার কথা রয়েছে আর দ্বিতীয়টিতে দুই বিশ্বযুদ্ধ ও দেবতার কাছে শান্তি প্রতিষ্ঠাত জন্য ব্যাকুল আর্তি খুঁজে পাওয়া যায়। কল্পনার এই ক্রমিক চলাচল আরো একাধিক কবিতাতেই দেখা গেছে। যেমন, ২৩ সংখ্যাক কবিতায় ভাস্কর লিখছেন ‘আমি ফের ঘায়েল হয়েছি – রাতদিন নিকোটিন টেনে নিই –’ আবার দেখা যাচ্ছে ডায়েরির পাতায় দেবতার প্রতি তাঁর অভিযোগ ‘ছেড়েছো আমার সঙ্গ আজকাল’ এই বলে। আর এই ২৩ সংখ্যাক কবিতার শেষে পাই ‘পুরনো কেল্লার পাশে বসে / আমিও আমার কাজ করে যাবো – তারপর মুছে দিয়ে যাব এই নাম’। । অর্থাৎ কবির আগের আনন্দ কিছুটা হলেও স্তিমিত। এই সূত্রেই ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩-র পাতায় তাঁকে লিখতে দেখি : ‘বিখ্যাত হওয়া আর বিখ্যাত হতে চাওয়া – দুটো থেকেই সমান দূরত্বে থাকতে হবে’ কারণ, ‘এর মধ্যে একটা অশ্লীলতা আছে’। তাঁর এই ভাবনার সঙ্গে আমরা আমেরিকার নির্জনতম কবি এমিলি ডিকিনসনের একটি কবিতার বিশেষ সাদৃশ্য পেয়ে যাই :
আমি তুচ্ছ লোক, তুমি কে?
তুমিও কি – তুচ্ছ মানুষ?
তবে এই তো আমাদের দুজনের জোড়া
বোলো না কিন্তু কাউকে! ওরা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেবে – জানো তো!
কি নিরানন্দ – হওয়া – কেউকেটা!
কি প্রকাশ্য – ব্যাঙের মতো –
নিজের নাম চিল্লানো – গোটা জুনমাস ধরে –
স্তাবক জলাভূমিকে ডেকে ডেকে! (I’m Nobody! Who are you? : ঊর্মিলা চক্রবর্তী অনূদিত)
১৯৮৩ সালের ডায়েরিতে আবার দেখা যায়, ‘ছুটির কোন আনন্দ নেই আগের মতো। ঘুম থেকে ওঠার পরই টেনশন’ (১১ অক্টোবর ১৯৮৩)। আর ‘দেবতার সঙ্গে’ কাব্যের শেষ কবিতাটি পড়লেও দেখা যাবে শুরুর সেই আনন্দ, উদ্যম অনেকটাই স্তিমিত :
যেরকম দিন যাচ্ছে আমার তেমনই দিন যাক
দু চারটে গরীব ইচ্ছে যদি ডুবে যায় জলে তবে তা ডুবুক –
ডায়েরির ভাবনার সঙ্গে এই অংশের মিল পাওয়া যাবে। যদিও এই কবিতার শেষে ‘হরিণের স্বপ্ন আর গাছেদের স্বপ্ন’ নোট করে নিয়ে প্রিয় মেয়েটিকে নিয়ে তিনি বেথুয়াডহরি যেতে চান। দেবতাকে বলে ‘তুমি জ্বালিয়ো না আর’। দেবতা নিয়ে পঁচিশটি কবিতা লিখলেও তাঁর প্রেমিক মন শেষে এসে সূচনা কবিতার সঙ্গে একসুরে বাঁধা পড়েছে। এছাড়াও ১৯৮৩ সালের ডায়েরিতে লেখা ‘বকুল ফুলের মতো সিগারেটের টুকরো পড়ে আছে জানালার নিচে’ এই ছবিটিই তাঁর ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’ কাব্যের ‘শহরনামা’ কবিতায় হুবহু ব্যবহৃত। আবার ‘আকাশ অংশৎ মেঘলা থাকবে’র ডায়েরিতে লেখা ‘সময়ের চেয়ার’ শব্দবন্ধর দেখা মেলে। এভাবেই কবি ভাস্করের অন্তরমহলের ছবি ডায়েরির দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়।
গদ্য আকারে কবিতা
ডায়েরিতে কবিতার প্রেক্ষাপট যেমন আমরা পাই, তেমনি কবিতার আঙ্গিক বা ফর্ম নিয়েও ভেবেছেন ভাস্কর। যেমন, ২১ অক্টোবর ১৯৮২-এর দিনলিপিতে ভাস্কর লিখেছেন : ‘মজা লাগছে দেখতে, তরুণতর বেশ কয়েকজন কবি এবার গদ্য ফর্মে কবিতা লিখছেন। অর্থাৎ তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, যে কবিরা একসময় তাঁর কবিতার গদ্য ফর্ম নিয়ে বিদ্রুপ করেছিলেন, তাঁরাই আবার তা অনুসরণ করছেন। একটি সাক্ষাৎকারে ভাস্কর জানিয়েছিলেন :
‘এসো, সুসংবাদ এসো’ যখন লিখছি তখন দেখলাম যে এরকম লেখাটা লিখতে চাইছি এবং একটা বেশ ভালো লাগছে। আমার মনে হয় এটা খুব ঝুঁকির কাজ। এরকম যে সম্পূর্ণ গদ্য আকারে কবিতা, আমাদের যে-কোন পাঠক, আমরাও, আমি পড়ব না। দেখেই একটা প্রতিক্রিয়া, একটা রিপালশন তৈরি হয়। তা সেটা একটা চ্যালেঞ্জের মতন’। (বোধশব্দ, ভাদ্র ১৪১৩)
সেসময় কুড়িটা গদ্য কবিতা লেখার কথা ভাস্কর আমাদের জানান, পরে আর তেমন লেখেননি। যদিও সেসময় এক তরুণ সমালোচক এ-কবিতাগুলি দেখে মন্তব্য করেছিলেন :
‘এ আর কী এমন ব্যাপার। ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’র কবিতাগুলো গদ্য করে দিলে তো একই হয়ে যায় আর এত সহজ কবিতা, এ কি কবিতা হচ্ছে নাকি?’ (কবিতাসমগ্র ১, পাতা : ২৪৩)
এর বাইরেও তাঁর কবিতার ফর্ম নিয়ে সমালোচক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, আবার এই ফর্মের ভুল ব্যাখ্যা করেন কবি জয় গোস্বামী। তিনি ‘তৃতীয় কবিতা’ নামের এক পত্রিকায় লিখেছিলেন :
‘একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় তিনি কবিতার ভেতরে মাঝে মাঝে অক্ষরবৃত্তের টুকরো ঢুকিয়ে দেন। আবার পরক্ষণেই তাকে ভেঙে নিয়ে আসেন সরাসরি গদ্যে’। (কবিতাসমগ্র ১, পাতা : ২৪৩)
তবে জয়ের এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ খারিজ করে ভাস্কর জানিয়েছিলেন :
‘না এখানে জয় একটু ভুল করেছিল। আমি এই কুড়িটা গদ্য কবিতার ক্ষেত্রে আমি সত্যিই চেয়েছিলাম যে, যদি অক্ষরবৃত্ত আসেও, তাকে তাড়িয়ে দেব। একদম শুধু গদ্যের ওপর সেই স্পন্দনটুকু নির্ভর করে লিখব। এই যে, কোনো মাত্রা নেই, আমার যা খুশি আমি লিখতে পারছি – এটাই আমার কাছে সব থেকে শক্ত মনে হয়েছিল’
(সাক্ষাৎকার, বোধশব্দ, ভাদ্র ১৪১৩, উৎস : কবিতাসমগ্র ১, পাতা : ২৪৪)
তবে সাক্ষাৎকারের বাইরেও ডায়েরির একাধিক পাতায় এ-নিয়ে মন্তব্য করেছেন ভাস্কর, যেমন :
‘আমি একটু খটখটে গদ্যের দিকে হাত তুলে লিখতে চাই কবিতা। আমি কবিতার চটকদার ছন্দ বর্জনের দিকে এই কারণে যে ছন্দের খাতিরে কবিতায় মাথার কথা আসতে পারে, কিন্তু প্রাণের কথা নয়। এক্ষেত্রে আমি বোধহয় কবিতার ইতিহাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছি। যা কিছু লিখতে চাই কবিতায়, চাই সেসব লেখার প্রত্যকটা লাইনে আমার প্রাণের স্পর্শ’। (২২ জানুয়ারি ১৯৮৩)
আবার মাসখানেক পর লিখেছেন :
‘গদ্যে ভর করে চলেছি কবিতায়, কবিতার উল্টোদিকের কবিতার কাছে। কবিতার ইতিহাসে সত্যিই একেবারে বিপরীত দিকে দাঁড়িয়ে আছি আমি। তবুও আমি কবিতাই লিখছি – এসব যদি কেউ কবিতা না বলে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হব না কোনদিন’। (২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) কারণ তিনি জানতেন, গদ্যকবিতার ফর্মটা দেখেই অনেকসময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় পাঠকের, অনেকে হয়তো পুরোটা পড়তেও পারেন না। কিন্তু এটাকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তিনি সফল হতে পেরেছিলেন। তাঁর গোপন বন্ধু ডায়েরিতে তিনি সে-কথা লিখেছেন এইভাবে :
‘মহৎ কবিতা না হতেও পারে, কিন্তু আমার কবিতা পড়ে সত্যি যদি কারো কারো কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়, তার থেকে বড় পুরস্কার আমার আর কী হতে পারে? (১ এপ্রিল ১৯৮৩)
সমিল কবিতা লেখা তাঁর কাছে ‘বাইরে বেড়াতে যাওয়ার মতো’ (২৬ মার্চ ’৮৩)। আসলে কবি মনে করতেন, তিনি যা বলতে চান, ছন্দের আশ্রয় নিলে সেটা বলা না হয়ে অন্য একটা শব্দ চলে আসতে পারে। এই শব্দটা কবিতাটাকে সুন্দর করে দিলেও আসল কথাটা অব্যক্ত থেকে যাবে।
কবিতায় সামাজিক ছবি
তবে শুধুই আঙ্গিক নয়, কবিতার বিষয় নিয়েও মাঝে মাঝে তাঁর ভাবনা ভাগ করে নিয়েছেন দিনলিপিতে। ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৩-এর এন্ট্রিতে তিনি স্পষ্টভাবেই লেখেন ‘আমার সময়ের সামাজিক ছবি আমার কবিতার মধ্যে অবশ্যই আছে’। কিন্তু কেমন সেই সামাজিক ছবি? ‘শয়নযান’ গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়ে অধ্যায়ে তিনি তাঁর কবিতার বিষয় ও কাব্যাদর্শ তুলে ধরেছেন, একটু দীর্ঘ হলেও উদ্ধৃতিটি অভিনবেশের দাবি রাখে :
সাধারণতাকে আমি ভালোবাসি। বাতিল অতি সাধারণ সামান্য সব কথা, দৃশ্য, ফেলে আসা দিনরাতগুলো আমাকে টোকা দিয়ে যায়। আর তাদের নতুন পোশাক পরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আমার। বিশাল কোন মজাকে আমি ধরতে চেয়েছিলাম আমার কবিতায়, ধরতে চেয়েছিলাম বিশাল কোন হাসির শব্দকে, বিষণ্ণতাকে আমি খুব একটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারিনি। তবে শুধু বিষণ্ণতা, শহর কেন্দ্রিকতা অথবা মনোহর চাটনিই আমার কবিতা নয়। চারপাশে যে জীবন দেখি আর যে জীবন যাপন করি প্রতিদিন, সেসবের মধ্যে থেকেই কখনো জেগে ওঠে ভাঁজ করা কাগজের নৌকার মতো একটা কিছু। নানা দিক থেকে উত্থাপন করাই হয়তো বা আমার কাজ। ভালোবাসার ব্যাপকতর রূপকেও যে আমি অনুভব করেছিলাম, সে কথাও লেখা থাকে এখানে।
প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কবিতা না লিখলেও তাঁর কবিতার ভিতরে রাজনীতি কি একেবারেই নেই? এসো, সুসংবাদ এসো, রাস্তায় আবার, দেবতার সঙ্গে-র কবিতাগুলি লেখার সময় দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা তো রয়েছেই, এমার্জেন্সি যার মধ্যে অন্যতম। তাই তিনি ১৯ মার্চ ১৯৮২-এর ডায়েরিতে যখন লেখেন : ‘স্বীকার করা উচিত যে আমি কোনদিনই রাজনৈতিক কবিতা লিখিনি, তবু কেউ যদি হঠাৎ কোনো কবিতাকে রাজনৈতিক বলেন, আমি বিস্মিত হবো না।’ এ-প্রসঙ্গে স্পার্ক বুক কোম্পানি প্রকাশিত ভাস্করের ‘কয়েকটি কবিতা’র ভূমিকায় দীপান্বিতা মৈত্র সঙ্গত ভাবেই দেখান, নকশাল আন্দোলনের আলোড়ন ভাস্করের মনেও সংগতভাবেই ছাপ রেখেছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন ‘কাটাকুটি’ (এসো, সুসংবাদ এসো), ‘ শীত ’৭২’, দেবতার সঙ্গে : ১৪ এইসব কবিতার কথা। কবিতায় সোচ্চার প্রতিবাদ না থাকলেও ধানখেতে ঘুমিয়ে পড়া রক্তাক্ত ছেলে কিংবা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আরো কোনো অঘটনের আশঙ্কায় লজ্জিত হয়ে থাকার কথা ভাস্করই তো বলেন। তাই ‘বিপুল কাঠের কান্না জেগে থাকে নক্ষত্র অবধি’ এই উচ্চারণ যাঁর, তিনি মায়াকোভস্কি বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় না-ই বা হলেন। তাই দীপান্বিতা তাঁর এই স্বতন্ত্র রাজনীতিবোধের দিকে তাকিয়ে বলেন :
তাঁর কবিতা ঘুরে ফিরে নানাভাবে নানা সময় ও ঘটনার সাক্ষ্য দেয়, অথচ নির্দিষ্ট কোনো প্রোপাগাণ্ডাকে তুলে ধরে না। তাই এই কবিকে মনে হয় দুঃস্থ এক শতাব্দীর ধ্বংসপ্রবণ বিপজ্জনক সমাজের শঙ্কিত অস্তিত্ব। যুদ্ধবাজ দাঙ্গাবিদ্ধস্ত যে শতাব্দীতে চলছে অরাজক ঈশ্বরের নষ্ট শাসনতন্ত্র’ : দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ আমাদেরই শতাব্দীতে ঘটে গেছে / বড়ো শঙ্কায় আছি, বড়ো লজ্জায় আছি দেবতা আমার। (২০১৯ : ১৫)
কবি-কথা
এসবের বাইরেও কবিদের নিয়ে নানা কথা লিখেছেন ভাস্কর তাঁর প্রিয় ডায়েরির পাতায়। ১৯৮২ সালের শুরুর দিকে চল্লিশের রোম্যান্টিক কবি অরুণকুমার সরকারের ‘তিরিশের কবিতা ও পরবর্তী’ বইটি পড়ার কথা যেমন ডায়েরিতে লেখেন, তেমনি ‘শব্দসম্পদে সুধীন্দ্রনাথ কুবের তুল্য’ (৩ মার্চ ’৮২) অরুণকুমারের এই মন্তব্যটি তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে বলেই সযত্নে লিখে রেখেছেন। কখনো বা বোদলেয়ার পড়ছেন কিংবা উৎপলকুমার বসুর কবিতাও। সিনেমা, রবীন্দ্রগান নিয়েও টুকরো ভাবনার দেলহা মেলে ডায়েরিতে। আবার ১৯৮২-এর ৬ ফেব্রুয়ারির এন্ট্রিতে ভাস্কর তাঁর বিগত আট-নয় মাসের কবিতা পড়ে শঙ্খবাবুর প্রতিক্রিয়ার কথা সাগ্রহে লিখেছেন : ‘সন্ধেবেলা, শঙ্খবাবুর বাড়ি। আমার ৮/৯ মাসের কবিতা পড়লেন শঙ্খ বাবু। প্রসঙ্গক্রমে রিলকের [গোপন, পবিত্র কবিতা] এলিজি রচনার কথা তাঁর মনে পড়েছিল।’ এই প্রশংসা শুনে খুশি হলেও, তিনি আশাবাদী হতে পারেননি তেমন (‘তবুও আমার কিছু আশা করা উচিত নয়’)। নিজের কাব্যের নাম নির্বাচন নিয়েও কখনো বা তিনি দ্বিধান্বিত, মরুপ্রদীপ বা নিঃসঙ্গ উৎসব – এই দুই নামের মধ্য থেকে শেষেরটি তাঁর পছন্দ। তাঁর এই নৈরাশ্যভাবনার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশকে মেলাতে চেয়েছেন তিনি। লিখেছেন :আমাদের দেশে সুকান্তকে সকলে চেনেন, জীবনানন্দের নামই শোনেননি অনেক শিক্ষিত জন। ভেবে বিস্মিত হলেও এটাই যথার্থ নিয়তি।’ (২৩ নভেম্বর ’৮২) সারাজীবন জীবনান্দের কপালে যে লাঞ্ছনা, অসম্মান জুটেছে তা ভেবে ভাস্কর লজ্জিত হন। তবে জীবনানন্দই যে উত্তর-রবীন্দ্রপর্বে নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন, সেকথা ঈষৎ লঘুচালে ভাস্কর লিখে গেছেন ডায়েরিতেই : ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাদের কফির ক্রীম জীবনানন্দ তা সযত্নে সরিয়ে দিয়েছেন’ (১৫ জানুয়ারি ১৯৮৩)। কখনো বা স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন এই গভীর প্রত্যয়ের কথা : ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ বছরের ছেলেটি (নজরুল নয়, জীবনানন্দ) এই শতাব্দীর শেষার্ধে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন।’ (১১ অগাস্ট, ১৯৮২)
ভাস্করের ডায়েরিতে প্রেম, রাজনীতি, সিনেমা, গান ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গকে ছাপিয়ে কবিতার মায়াবী আলোই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে দেখা যায়। এক শান্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখা ভাস্করের দিনলিপি তাই হয়ে ওঠে কবি ও কবিতার অন্তরমহলের চাবিকাঠি।।
ব্যবহৃত গ্রন্থপঞ্জি
আকর গ্রন্থ :
দীপান্বিতা মৈত্র সম্পাদিত (প্রথম প্রকাশ ২০১৯) কয়েকটি কবিতা, ভাস্কর চক্রবর্তী, স্পার্ক বুক কোম্পানি, কলকাতা
সুমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বাসবী চক্রবর্তী সম্পাদিত (প্রথম সংস্করণ, ২০১৩/ পুনর্মুদ্রণ ২০১৯) : ভাস্কর চক্রবর্তীর গদ্যসমগ্র, ভাষাবন্ধন, কলকাতা : ৯৫
সুমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত (প্রথম প্রকাশ ২০০৭) ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সমগ্র (প্রথম খণ্ড) : ভাষাবন্ধন, কলকাতা : ৯৫
সুমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত (প্রথম প্রকাশ ২০১০) ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড) : ভাষাবন্ধন, কলকাতা : ৯৫
সহায়ক গ্রন্থ / প্রবন্ধ :
ঊর্মিলা চক্রবর্তী (প্রথম প্রকাশ ২০১৮) এমিলি ডিকিনসন : অনন্য জীবন, ভিন্ন উচ্চারণ, এভানেল প্রেস, মেমারী
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়, স্বর্গ নেই স্যারিডন আছে, কবিতাবাসর : ভাস্কর চক্রবর্তী সংখ্যা (১৪২২), প্রভঞ্জন হালদার সম্পাদিত, কলকাতা
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতা : অনন্তের বিবেকতন্ত্রিতা, অনুপূর্ব (২০২০), কলকাতা
তরুণ মুখোপাধ্যায় (দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০২১) : কবি ভাস্কর চক্রবর্তী : নিঃসঙ্গ সিসিফাস, বার্ণিক, বর্ধমান
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন