মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

সুবীর সরকার-এর ধারাবাহিক গদ্য : "ভবতারণের জোত"


 ভবতারণের জোত

১১।

ভবতারণের জোতে প্রবেশ করবার কিছু পরেই সুবল কাকার চায়ের দোকানে অনিমেষ সাবলীল প্রবেশ করে।

কুশল বিনিময় হয়

সুবল কাকার সাথে। পুরনো হাটের গল্প হয়।

একসময় বেঞ্চির আরামে ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ লিখতে থাকে তার ডায়েরি_

"লেখালেখি আসলে এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।একজন লেখক সবসময় লেখা বহন করেই বাঁচেন।তার যাপন

ঘিরে থাকে অদ্ভুত

এক ঘোর।তার মানে কিন্তু এই না যে সবসময় তাকে লিখতে হবে।আসলে মূল কথা,লেখক বা সৃষ্টিশীল

মানুষকে তার অভ্যন্তরের

উনুনটিকে সবসময় জ্বালিয়ে রাখতে হবে।এছাড়া আর বিকল্প নেই।আসলে একজন লেখক একজন সৃষ্টিশীল

মানুষ হলেন একজন

দণ্ডিত মানুষ।অভিশপ্ত মানুষ।সারাজীবন সৃজনের খিদে নিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে হয়।হবেই।

ব্যাক্তিগত জীবনের বহিরঙ্গে যেমনই হন বা যে জীবনই তিনি যাপন করে থাকুন,লেখা আর পড়বার জায়গায়

 চূড়ান্ত রকমের সৎ

 থাকতে হবে।

পড়াশোনা আমাদের পুষ্টি জোগায়।আমি এত বছরের লেখালেখির জীবনে কিছুই হয়তো লিখে উঠতে পারিনি।

কিন্তু সৎ থেকেছি

লেখায় পড়াশোনায়।ফাঁকি দিতে পারিনি।প্রতিটি সৎ গ্রন্থের কাছে প্রতিপল শিখেছি।শিখি আজও।এই

উত্তরের গঞ্জহাট

মেলাউৎসবে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি মানুষ আমার কাছে অপঠিত মহৎ গ্রন্থের মত।আমি আমার দেখা দিয়ে

খুব নিবিড় হয়ে

পড়তে শুরু করি তাদেরকে।নিজেকে খুশি ভবি আমি।বিষাদ আমার কাছে শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীত।ভালো আছি।

লেখা আর লিখে যাওয়া

 ছাড়া আমার আর কিছুই চাইবার নেই।লেখক জীবন মানেই কুয়াশায় মুড়ে যাওয়া একটা টানেল,একটা ট্রান্স!"

 

১২।

চা খাবার পর অনিমেষ ঝোলা কাধে বেরিয়ে আসে।তার সামনে কার্তিকের ভরা ফসলের ক্ষেত খামার।

অতিশয় ছোট পাখিদের

ওড়াউড়ি।

অনিমেষ ইয়াকুবের বিলের সেই ভূত পেত্নীর শ্যাওড়া গাছের নিচে বেশ গুছিয়েই বসে পড়ে।আর লিখতে

থাকে_

"

আমার একটা গঞ্জহাটের পৃথিবী আছে।আমার পৃথিবী জুড়ে অগণন সুপুরিগাছের সারি।আমার পৃথিবীতে ভরা

 নদীর ওপর ঝুঁকে

পড়া মায়াবৃক্ষ।ভুমিলগ্ন আবহমানের সব চিরায়ত সোনার বরণ মানুষজন।আমার একটা নাচঘেরা

বাজনাঘেরা অপরূপ

লোকপুরাণের দেশ রয়েছে।সেখানে 'ভইসা গাড়ির' নীচে কালিমাখা লণ্ঠন দোলে।আর ধু ধু পাথারবাড়ির

দিকে গান ছড়িয়ে

পড়ে-

'কুচবিহারত হামার বাড়ি

ঘাটাত দেখঙ ওরে ভইসা গাড়ি'

মানুষ যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,জীবন যেভাবে গল্পের পাকে পাকে জড়িয়ে যায়,আমিও সেভাবে

 এই লোকমানুষের

দিনদুনিয়ায় ডুবে গেছি।উত্তরের এই লোকজীবনের মায়া জাদু আমার চরম প্রাপ্তি।চরমতম শক্তি।

আমি যখনই অস্থির হয়ে পড়ি,আমি যখনই একা হয়ে যাই তখন এই লোকায়ত ভুবন,উত্তরের লোকগান

আমাকে ফিরিয়ে আনে

জীবনে।ফিরিয়ে আনে লড়াইয়ে।ফিরিয়ে আনে চূড়ান্ত স্বপ্নের ভেতর।

আমি আবার নুতন হয়ে উঠতে থাকি।আর গৌরীপুরের হাট থেকে মাধবডাঙ্গার গঞ্জ থেকে ঝাঁকুয়ারটাড়ি

থেকে দেখি ভেসে

আসে হাতিমাহুতের অন্তহীন যত গান-

' মোর গণেশ হাতির মাহুত রে

মোর মাকনা হাতির মাহুত রে

মোক ছাড়িযা কেমনে যাইবেন

তোমরা হস্তীর শিকারে'...

জীবন দুলে ওঠে।জীবন উৎসবে পরিণত হয়।

আর আমি প্রনাম করি আমার উত্তরের মাটিকে।

উত্তরের মানুষকে।

৩৫ বছর বাংলা কবিতার ভেতর ডুবে গিয়ে

সুপ্রচুর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।ভালো মন্দ সব মিলিয়েই।বারবার স্বপ্ন দেখি আমি।বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়

আমার।এটাও

একটা জার্নি।এই প্রান্তবেলায় এসেও আমি কিন্তু হাল ছাড়ছি না।বারবার স্বপ্নই দেখে যাবো আমি।

কারণ, আমি বিশ্বাস করি একজন কবির জীবন

আদতে অভিশাপের জীবন।সন্ন্যাসী সৈনিকের জীবন"




ক্রমশ...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন