মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

কাজল সেন-এর ঝুরোগল্প

নিহত গোলাপ

 

সাত খুন মাফকথাটা বিশ্বম্ভর সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে, বিশেষত সে জন্মমুহূর্তেই তার মাকে খুন করেছিল অথচ সেই খুনের জন্য তাকে কোনো  শাস্তি পেতে হয়নি। অর্থাৎ তার প্রথম খুন মাফ হয়ে গেছিল। এখন ইচ্ছে করলে  হিসেব অনুযায়ী সে আরও টা খুন করতে পারে, যে খুনগুলোর জন্যও তাকে কোনো শাস্তি পেতে হবে না, মানে মাফ করে দেওয়া হবে। 

বিশ্বম্ভর অবশ্য তার প্রথম খুনের দায় সরাসরি নিজের ওপর চাপাতে চায় না। সে যখন জন্মেছিল, তখন সে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কনিষ্ঠ মহামূর্খ নির্লোভ ধান্দাবাজহীন এক নির্মল পবিত্র মনের মানবসন্তান। সে আদৌ কোনো কুমতলব নিয়ে মায়ের অন্ধকার গর্ভ থেকে চরম দূষিত আলোর জগতে আসেনি। তাছাড়া তার এই আসার জন্য সে একেবারেই কোনো ষড়যন্ত্র করেনি, বরং যদি  কেউ করে থাকে, নিশ্চিতভাবে তারা হচ্ছে তার মা-বাবা। আর তাই তার ওপর যতই মাতৃহত্যার দায় চাপানো হোক না কেন, বিশ্বম্ভর নিশ্চিত, প্রসবকালীন সময়ে তার মায়ের এতটাই শারীরিক জটিলতা ছিল যে, সন্তানকে জন্মদান করেই মা নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।

বিশ্বম্ভর দ্বিতীয় যে খুনটা করেছিল, তার ধারণাও ছিল না যে, এটা একটা খুন বা হত্যাকান্ড। বিশ্বম্ভর তখন সদ্য যুবক, পাড়ার মেয়ে সদ্য যুবতী মায়াবতীকে সবেমাত্র ভালোবাসতে শুরু করেছে। তা সেদিন হয়েছিল কী, মায়াবতীকে অনেক  বুঝিয়ে লেকের ধারে নির্জনে তারা বসেছিল। মায়াবতীর হাত বিশ্বম্ভরের মুঠোয় আটকে ছিল। হঠাৎ বিশ্বম্ভর লক্ষ্য করেছিল, একটু দূরেই কয়েকটা ফুলগাছ। এবং   কী আশ্চর্য, তার মধ্যে একটা গোলাপগাছে গোলাপ ফুটে আছে। টকটকে লাল গোলাপ। বিশ্বম্ভরের হৃদয়টা চলকে উঠেছিল। সে দৌড়ে গিয়ে গাছ থেকে এক  হ্যাঁচকায় ফুলটা ছিঁড়ে এনে মায়াবতীর দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে তাকে নিবেদন করেছিল। কিন্তু একী কিচাইন! মায়াবতী হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।  

-তুমি একী করলে বিশু? তুমি একটা গোলাপকে খুন করলে? তুমি কী নিষ্ঠুর গো!

রীতিমতো হকচকিয়ে গেছিল বিশ্বম্ভর। তার মস্তিষ্ক কাজ করছিল না ঠিকমতো। 

-তার মানে? আমি খুন করেছি? কাকে?

-হ্যাঁ, করেছ তো! আমাকে খুশি করার জন্য তুমি গোলাপকে খুন করেছে। আমি তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারব না বিশু! কখনই নয়!

 

বিশ্বম্ভর অনেক ঝুলোঝুলি করেছিল মায়াবতীর কান্না থামাতে। সে কী করুণ অবস্থা বিশ্বম্ভরের! পরে একদিন মায়াবতী ইউ টিউব খুলে বিশ্বম্ভরকে মান্না দে একটা গান শুনিয়েছিল।মানুষ খুন হলে পরে, মানুষই তার বিচার করে, নেই তো খুনির মাফ, তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ, বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া নিহত গোলাপ?’

মায়াবতী বিশ্বম্ভরকে শেষপর্যন্ত মাফ করেছিল কিনা, বিশ্বম্ভর ঠিক জানে না। কিন্তু বিশ্বম্ভরের সঙ্গে মায়াবতীর বিয়েটা হয়নি। মায়াবতীর মা-বাবা সম্বন্ধ করে  মায়াবতীকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল এক ইঞ্জিনিয়ারের গলায়। এই অন্যায় অবিচার মেনে নিতে পারেনি বিশ্বম্ভর। সে মনে মনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। আর তার পরিণতিতে নির্মমভাবে খুন করেছিল মায়াবতীর প্রতি তার দুর্বলতা এবং  ভালোবাসাকে।
 

৩টি মন্তব্য: