মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০২২

কামাল হোসেন-এর ঝুরোগল্প

এব্রাহিম ভিলা

তারপর চরাচরে নেমে এলো নীলাভ কুয়াশা। ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়েছি। মধ্য ষাটে পৌঁছে ডাক্তারদের পরামর্শে লাইফস্টাইল পাল্টাতে হয়। প্রেসার সুগার কোলেস্টেরলের কল্যাণে খাওয়া দাওয়ার ডায়েট চার্ট ফলো করে সব কিছু প্রিয় খাদ্যকে ত্যাগ করেছি।

সুতরাং রোজ সকালবেলায় ময়দানে অজস্র পুরুষ নারীর সঙ্গে নিয়মিত হাঁটতে থাকি।

আজকে এতো বেশি কুয়াশার ঢেউ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে, দু'হাত  দূরের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।

হঠাৎ চোখের সামনে পাথরে বাঁধানো একটা আলোকিত পথ ভেসে উঠলো। ময়দানের সবুজ ঘাসের মধ্যে রাস্তা কীভাবে আবির্ভূত হলো, বুঝতে পারছি না।

ধীরে ধীরে টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক বিশাল গেটের সামনে। ভেতরে ওপাশে সবুজ ঘাসের লন আর ফুলের বাগান। একটা ছোটো টেবিলের চারপাশে কয়েকটা চেয়ার। মাঝখানে একটা রঙিন ছাতা।

মাঝবয়েসী সৌম্য চেহারার পুরুষ একটি চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন।

আমাকে গেটের সামনে দেখে  হাত নেড়ে ডাকলেন।

আমি ভীরু পদক্ষেপে তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

তুমি কোথা থেকে উদয় হলে বাপু ?

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ময়দানে হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক ভুতুড়ে কুয়াশায় পথ হারিয়ে এখানে চলে এলাম। আমার কথার মধ্যে অসহায়তার রেশ অনুভব করে তিনি আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন।

আমি ধপ করে বসে পড়লাম। ওপাশে তাকিয়ে দেখলাম, পুরোনো স্থাপত্যের বিশাল বাড়ি। ওপর দিকে বড়ো বড়ো অক্ষরে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা 'এব্রাহিম ভিলা'

আমার মনে হলো, এই বাড়ি আমার খুব চেনা।কবে যেন কোথায় দেখেছি।

হঠাৎ দেখলাম, বাড়ির ভেতর থেকে এক সুন্দরী বয়স্কা মহিলা ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন। আভিজাত্যপূর্ণ মহিলাকে দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। মৃদু স্বরে বললাম, দাদিমা !

মিষ্টি হেসে তিনি বললেন, কতোদিন বাদে তোকে দেখলাম রাজু।

আমি  অভিমানী গলায় বললাম, আমার ছেলেবেলায় কোথায় হারিয়ে গেছলে তুমি।

সামনে বসা মানুষটিকে দেখিয়ে বললেন, তোর দাদাভাই।তুই কখনো দেখিসনি। তোর বাপের ছেলেবেলায় হারিয়ে গেছলেন।

দাদাভাইয়ের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজিজে ছেলে। আমাদের নাতি।

আমি দুজনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দাদাভাই। কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করলেন দাদিমা। কতোকাল আমি অপেক্ষা করছিলাম এই সব পবিত্র স্পর্শের।

দুজনের হাত ধরে বিশাল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িটা তো অনেক দিন আগে বড়োচাচার ছেলে কাউকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শুনেছি, বাড়িটা ভেঙে অন্য কিছু তৈরী হয়েছে।

আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাদাভাই বললেন, আসলে মানুষ বা স্থাপত্য কোথাও কিছু কখনো হারিয়ে যায় না। প্রকৃতির অন্য কোনো ডাইমেনশনে সব কিছু বেঁচে বর্তে থাকে।

তারপর আমাকে অনেক আদর করে হাত নাড়তে নাড়তে দুজনে এব্রাহিম ভিলার দিকে এগিয়ে চললেন।

দাদিমা ফিশ ফিশ করে বললেন, খুব শিগগিরই আবার দেখা হবে রাজু।

আমি মাথা নাড়লাম।

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন