‘মালিনী’ লেখার পরের বছর ১৮৯৭ সালে কাব্যকাহিনীগুলির মধ্যে বিশেষ একটি কাহিনী ‘সতী’ লেখা হয়। এখানে দুই নারীর সংঘাত, মা ও মেয়ের ভাবনা ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, ভয়ঙ্কর যার পরিণাম। এই কাব্যনাট্যে কবি তাঁর চিরায়ত নারীভাবনাই প্রকাশ করেছেন, নারীর মধ্যে কেবল হৃদয়বৃত্তি ও তারই ফলে একদিকে অন্ধ বিশ্বাস, অন্যদিকে সুগভীর প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার কাহিনি রচনা করেছেন। মুসলমান রাজা কন্যাকে অপহরণ করায় রমাবাঈ মেয়েকে তার বাগদত্ত হিন্দু স্বামীর চিতায় তুলতে চান, বলেন,
তার আগে করিব ছেদন
আমার সংসার হাতে পাপের অঙ্কুর
যতগুলি জন্মিয়াছে। করি যাব দূর
আমার গর্ভের লজ্জা। কন্যার কুযশে
মাতার সতীত্বে যেন কলঙ্ক পরশে।
অনলে অঙ্গারসম সে কলঙ্ককালি
তুলিব উজ্জ্বল করি চিতানল জ্বালি।
সতীখ্যাতি রটাইব দুহিতার নামে,
সতীমঠ উঠাইব এ শ্মশানধামে
কন্যার ভস্মের 'পরে।
মেয়ে অমাবাঈ বারবার বলেন যে তিনি তাঁর মুসলমান অপহরণকারীকে স্বামী হিসেবে বরণ করেছেন, তাঁকে তিনি ভালবেসে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, ধর্মের বাধা তাঁর কাছে ভেসে গেছে প্রেমের প্রবাহে। কিন্তু একদিকে অন্ধ ধর্মবোধ, অন্যদিকে মিথ্যা যশোস্পৃহা মায়ের মনকে কঠিন করে তোলে। এই একটা ব্যাপার রবীন্দ্রনাথের নারীচরিত্রগুলির মধ্যে বারবার ফিরে ফিরে আসে। ধর্মীয় কুসংস্কারকে মেয়েরাই যেন বেশি করে আত্মস্থ করেন তাঁর রচনায়। এখানেও রমাবাঈ-এর বাবা চান মেয়েকে নিয়ে কোথাও তীর্থস্থানে চলে যেতে, কিন্তু তাঁর মায়ের মনে কন্যাস্নেহের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ধর্মীয় গোঁড়ামি, যার ফল হয় ভয়ানক।
নারী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অনেকসময়ই সাদা-কালো দ্বিত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। তার বোধ করি প্রকৃষ্টতম উদাহরণ ‘সতী’। ‘নিষ্কৃতি’ কবিতার বাবা চরিত্রটি যেমন নিজের সুবিধার্থে পুরুষতন্ত্রের সব বিধিনিষেধকে ব্যবহার করে, তেমন অনেক জায়গায় দেখা যায় যে পুরুষ যদিও বা কখনও কখনও অন্যায় বিধিনিষেধের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে পারে, নারী এই বিধিনিষেধের নিগড়ে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকে যে সে তার রমনীধর্ম, তার স্নেহ-প্রেমের বাঁধন সহজেই খুলে ফেলতে পারে। ‘সতী’ কাহিনি কবিতায় হিন্দুঘরের মেয়ে অমাবাইকে তার বিয়ের রাতে তুলে নিয়ে গিয়ে বিধর্মী যবন তাকে বিয়ে করে। তার হিন্দু বাগদত্ত পতি জীবাজির সঙ্গে মিলে তার বাবা বিনায়ক রাও ও মা রমাবাই তার মুসলমান স্বামীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে, কিন্তু যুদ্ধে জীবাজি এবং অমাবাই-এর মুসলমান স্বামী দুজনেই মারা যায়। অমাবাইয়ের বাবা মায়ের মতে জীবাজি-ই অমাবাইয়ের প্রকৃত স্বামী, কিন্তু অমাবাই যবনের স্ত্রী হিসাবে তার সন্তানের জননী, সে তার স্বামীকে ভালবাসে। কাহিনির পরিণতি বড় ভয়ানক। অমাবাই জীবাজিকে স্বামী বলে মানবে না জেনে বাবা নরম হন, তাঁর স্নেহ ধর্মের বাঁধনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু মা রমাবাই ধর্মের নিয়মের কাছে নিজের স্নেহ, মায়া, দয়া সব বিসর্জন দিয়ে ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠেন। তিনি চান অমাবাইয়ের স্বামীর বদলে তার বাগদত্ত হিন্দু স্বামী জীবাজির সঙ্গে জীবন্ত চিতায় আরোহণ করে তাঁর মেয়ে সতী হয়। এতে তাঁর নিজের মহিমা বাড়বে, সমাজে তাঁর মেয়ে পুণ্যবতী বলে খ্যাত হবেঃ
করি যাব দূর
আমার গর্ভের লজ্জা। কন্যার কুযশে
মাতার সতীত্বে যেন কলঙ্ক পরশে।
অনলে অঙ্গারসম সে কলঙ্ককালি
তুলিব উজ্জ্বল করি চিতানল জ্বালি।
সতীখ্যাতি রটাইব দুহিতার নামে,
সতীমঠ উঠাইব এ শ্মশানধামে
কন্যার ভস্মের 'পরে।
কিন্তু অমাবাই তার যবন স্বামীকে কায়মনোবাক্যে স্বীকার করেছে। লৌকিক ধর্মের চেয়ে নিত্যধর্ম, প্রেমবন্ধন তার কাছে শ্রেয়তর। সে মাকে বোঝায়,
সতী আমি। ঘৃণা যদি করে মোরে লোকে
তবু সতী আমি। পরপুরুষের সনে
মাতা হয়ে বাঁধ যদি মৃত্যুর মিলনে
নির্দোষ কন্যারে, লোকে তোরে ধন্য কবে,
কিন্তু, মাতঃ, নিত্যকাল অপরাধী রবে
শ্মশানের অধীশ্বর-পদে।
তার কথায় মায়ের মন গলে না, কিন্তু তার বাবা বিনায়ক রাও বোঝেন তার কথা, তাই তিনি বলেন,
আয় বৎসে! বৃথা আচার বিচার।
পুত্রে লয়ে মোর সাথে আয় মোর মেয়ে
আমার আপন ধন। সমাজের চেয়ে
হৃদয়ের নিত্যধর্ম সত্য চিরদিন।
পিতৃস্নেহ নির্বিচার বিকারবিহীন
দেবতার বৃষ্টিসম, আমার কন্যারে
সেই শুভ স্নেহ হতে কে বঞ্চিতে পারে--
কোন্ শাস্ত্র, কোন্ লোক, কোন্ সমাজের
মিথ্যা বিধি, তুচ্ছ ভয়?
কিন্তু হিন্দুধর্মের তুচ্ছ আচার বিচারের নিগড়ে বাঁধা রমাবাইয়ের কাছে এসব কথা অর্থহীন। স্নেহ মায়া তিনি ভুলেছেন। ধর্মীয় মৌলবাদের বীভৎসতম মুখ যেন আমরা রমাবাইয়ের মধ্যে দেখতে পাই। তাঁর অন্তরে বিচারের স্রোতঃপথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে ‘তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি’। অমাবাই তার যবন স্বামীকে কায়মনোবাক্যে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, আর ক্রোধে অন্ধ মূঢ় রমাবাই সৈন্যদের আদেশ দেয় তার স্বামী বিনায়ক রাওকে বেঁধে রেখে মেয়ে অমাবাইকে জীবাজির সঙ্গে এক চিতায় তুলে দিতে। ধর্মের নামে এই নারকীয় ঘটনা একজন নারী হয়ে, মা হয়ে সে সংঘটিত করে; সামান্য বিবেকদংশনও তাকে মুহূর্তের জন্য পীড়া দেয় না। রবীন্দ্রনাথের অজস্র নারীচরিত্রের মধ্যে রমাবাই বীভৎসতম, হিংস্রতায় অনন্য।
এমন নারকীয় ঘটনা ঘটানোর মতো নৃশংসতা নয়, কিন্তু এমনিভাবেই কুসংস্কারের বলি হয় ‘বিসর্জন’ কবিতার মল্লিকার শিশুপুত্র, যাকে মা গঙ্গা ফিরিয়ে দেবেন এই আশায় সে গঙ্গার জলে বিসর্জন দেয়। এখানে কবি বৈধব্যের যন্ত্রণাকেও তুলে ধরতে ভোলেন নি। মল্লিকা বলে, ‘এ জন্মের তরে আর পুত্র আশা নেই’। মল্লিকাকে তার ব্রাহ্মণ পরামর্শদাতাই সন্তানকে গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দেবার প্রাচীন কাহিনি বলেন। কিন্তু তিনি হয়তো ভাবতেও পারেন নি যে নারীসুলভ অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের বশে সত্যিই মল্লিকা শিশুটিকে গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দেবে। আমাদের হয়তো বা মনে পড়ে অনেকবছর পরে লেখা ‘গোরা’ উপন্যাসের কুসংস্কারে ভরা ক্ষুদ্রচিত্ত নারী হরিমোহিনী বা ‘ঘরে বাইরে’-র বিমলার জায়েদের কথা। হিন্দুসমাজের মেয়েরা বহু শতাব্দীর অশিক্ষার দায় বহন করে প্রকৃতপক্ষে এমনই ক্ষুদ্রচিত্ত ও কুসংস্কারে অন্ধ হয়ে ছিলেন, এবং রবীন্দ্রনাথ অনেকটাই বেদনার সঙ্গে তাঁদের সেই ক্ষুদ্রতাকে তুলে ধরেছেন।
‘সতী’ কবিতায় কিন্তু অন্য এক চিন্তার ছায়া পড়ে গভীর হয়ে। কবিতার নামকরণেই তার আভাস। এই বহু-সমাদৃত ‘সতী’-র ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ অন্য কিছু লেখায়ও সমালোচনা করেছেন, কিন্তু এখানে এই ভাবনার এক জঘন্য, কলুষিত রূপের উন্মোচন। রমাবাঈ-এর মন সম্পূর্ণ অধিকার করে আছে একটাই চিন্তা, নিজের ও মেয়ে অমাবাঈ-এর সতীত্ব। তাঁর সতীত্বের ধারণা বড়ই অদ্ভুত। মেয়ে যাকে ভালোবেসে পতিত্বে বরণ করেছে, যার ঘর করেছে, যার সন্তানের সে মা, কেবল বিধর্মী বলেই তাকে তিনি তার স্বামী বলে মানতে রাজি নন। তিনি নিজের বিচার কন্যার সব যুক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেন কেন, না তাঁর বিশ্বাস,
কন্যার কুযশে
মাতার সতীত্বে যেন কলঙ্ক পরশে।
মেয়েকে তিনি জিজ্ঞাসা করলে সে জোর দিয়ে বলে যে সে সতী,
উচ্চ বিপ্রকুলে জন্মি তবুও যবনে
ঘৃণা করি নাই আমি, কায়বাক্যে মনে
পূজিয়াছি পতি বলি; মোরে করে ঘৃণা
এমন কে সতী আছে? নাহি আমি হীনা
জননী তোমার চেয়ে-- হবে মোর গতি
সতীস্বর্গলোকে।
কিন্তু মা তো অন্ধ। তিনি জাতি-ধর্মের বন্ধনকে স্নেহ, প্রেমের বন্ধনের চেয়ে অনেক বড় করে দেখেন। প্রকৃত সতীত্বের কোনো বোধই তাঁর নেই। তাই তিনি নির্দ্বিধায় সৈন্যদের আদেশ দেন তাঁর নিজের স্বামীকে বেঁধে রাখতে, ‘বাঁধো বৃদ্ধ বিনায়কে’ কথাগুলি যেন তাঁর সতীত্বের ধারণাকেই ব্যঙ্গ করে। মেয়ে সতী হলে তাঁর যশবৃদ্ধি হবে এও তাঁর মনে স্নেহের চেয়ে বড় স্থান অধিকার করে থাকে। নারী যখন তাঁর স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি হারিয়ে ফেলেন তখন তিনি যেন এমনই নৃশংস হয়ে ওঠেন। এমন নারী যে আছেন এই কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনে করিয়ে দেন। এখানে নারীর হৃদয়বৃত্তি ছাপিয়ে ওঠে তার অন্ধ কুসংস্কারের বাঁধনের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানস্নেহের চেয়েও বড় যশোস্পৃহা।
কিন্তু আমরা তো সামান্য কোনো মানুষের কথা ভাবতে বসিনি, ভাবতে বসেছি রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মানুষের কথা, শ্রেষ্ঠ প্রতিভা ও গভীর মননের এক সম্পূর্ণ সমন্বয় ঘটেছিল যাঁর মধ্যে। কোনো একরৈখিক ভাবনায় তাঁর একটুও ধরা যেতে পারে এমন কথা যদি কেউ ভাবেন তবে তিনি বাতুল। তাছাড়া তাঁর ছিল এক সম্পূর্ণ কবিমন যে মন স্বভাবতঃই নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করেছে এবং নানাভাবে নারীকে গভীরভাবে চেনার চেষ্টা করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধে নারী সম্বন্ধে নানা প্রচলিত ধারণার ছায়া যতই পড়ুক, তাঁর রচিত নারীচরিত্রগুলি তাদের অসামান্য বৈচিত্র্য নিয়ে অনেকসময়ই কেবল জীবনকেই প্রতিফলিত করে, কোনো বাঁধাধরা ধারণাকে নয়। সেই যুগের পুরোনো ধ্যানধারণা অনেকাংশেই তাঁর নারীচরিত্রচিত্রণে সম্পূর্ণ মুক্তচিন্তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেও নারীর অন্তরের শক্তি সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
ক্রমশ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন