হিয়ার পরশ লাগি
‘বৈষ্ণব পদাবলীর রস গ্রহণ করিতে গেলে আমাদের বৈষ্ণবভাবাপন্ন হইবার আবশ্যক নাই। কৃষ্ণকে অবতার অথবা অবতারী মানিবার প্রয়োজন নাই, এমনকি নাস্তিক হইলেও দোষ নাই। মানুষের হৃদয়ের যে প্রবৃত্তি মৌলিক সেই ভালো-লাগাকে চিরন্তন করিয়া ভালোবাসিবার ঈপ্সা বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেরণার উৎস। বৈষ্ণব কবিতার এই ধর্মাতিশায়ী উৎকর্ষের দিকে রবীন্দ্রনাথই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। পুরানো বাঙ্গালা সাহিত্যে রোম্যান্টিক কবিতা বলিয়া কিছু থাকিলে তাহা যে বৈষ্ণব পদাবলী তাহাও তিনিই নির্দেশ করিয়াছিলেন। ’ (সুকুমার সেন)
কথা ছিল দেখা হবে, অপেক্ষায় ছিল সে আসার। তারপর ব্যর্থ অপেক্ষায় ফিরে যাওয়া, আকাশে-বাতাসে-বনস্থলে সেই চলে যাওয়ার অমোঘ চিহ্নগুলি উৎকীর্ণ করে দিয়ে। প্রেমিক কৃষ্ণের অপেক্ষায় থেকেও দেখা না করে ফিরে যাওয়া রাধিকার সেই অভিমানী বেদনার সজল স্পর্শ আজও আমি টের পাই রবীন্দ্রনাথের গানে। দেবব্রত বিশ্বাস কিংবা পীযূষকান্তি সরকারের মন্দ্রস্বরে যতবার বেজে ওঠে ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে / সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে’ ততবারই নতুন করে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেমে পড়ি। নির্জন বনভূমির পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু জলের ঝরে যাওয়ার ছবি ও স্বরক্ষেপণে যে বিচ্ছেদ বেদনা তারই রেশ টেনে ছলোছলো শ্যামলিমায় নিঃসঙ্গ শ্যাম দাঁড়িয়ে থাকেন অবুঝ বেদনায় : ‘পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া যায় খেলে’। আমার কৈশোরে এভাবেই বাবার কাছে রবীন্দ্রগানকে শোনার, চেনার শিক্ষা পেয়েছিলাম আমি। প্রিয়তম এই বর্ষার গানের ভিতর দিয়ে বিরহ বেদনার অনিবার্য সুরটি বারংবার মনে করিয়ে দেয় পদাবলী গান আসলে বিরহ বিধুর, বিচ্ছেদের কষ্টিপাথরেই সেখানে প্রেম উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পূর্বরাগ-অনুরাগ-আক্ষেপানুরাগ-অভিসার পার হয়ে মাথুর আর ভাবসম্মিলনে বৈষ্ণব পদাবলীর ধারা বয়ে চলে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের তত্ত্বকথা বাদ দিলে বৈষ্ণব পদাবলী তাই আমাদের চির বিরহের গান, নায়ক চিরকিশোর কৃষ্ণ আর অন্য সব প্রতিনায়িকাকে ছাপিয়ে অভিসারিকা শ্রীরাধিকাই তার শ্রেষ্ঠ কাব্যনায়িকা।
২।।
‘রাধকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি / অন্যোন্যে বিলসে রস আস্বাদন করি’ – কৃষ্ণদাস কবিরাজের এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্বের কথা। সচ্চিদানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তির অংশ রাধিকা আর তাই প্রেমবিবর্তবিলাস, স্বকীয়া-পরকীয়া, রাগাত্মিকা-রাগানুগা ভক্তি, সখী-মঞ্জরী ভাবের সাধনা ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন ক্লাসে বৈষ্ণব পদাবলী পড়ি, ক্লান্তি বোধ হয়। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক হওয়ার সুবাদে যতবার পাশ কিংবা অনার্সের ক্লাসে বৈষ্ণবপদাবলী পড়িয়েছি, রোম্যান্টিক কবিতা হিসেবেই দেখাতে চেয়েছি একে। নইলে হাজার বছরের পুরনো বাংলা সাহিত্যে কেন আজও রাধা-কৃষ্ণের এই প্রেমলীলা অমরত্ব পেয়েছে? বৈষ্ণব কবিরা ‘প্রেম-মনস্তত্ত্বের (Psychology of love) সুনিপুণ রূপকার’ বলেই না? এই মোবাইল-হোয়াটস্যাপ-ফেসবুকমুখর যুগে আজও আমাদের প্রেমের যে স্বরূপ, তা তো বৈষ্ণব পদাবলীর থেকে আলাদা কিছু নয় :
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।। (জ্ঞানদাস)
প্রথমে চোখে দেখে বা ছবিতে দেখে ভালো লাগা, তারপর তার গূণের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হওয়া ক্রমশ স্পর্শ, আলিঙ্গন পেরিয়ে দুটি মনের নিবিড় অনুভবের জন্য ব্যাকুল যে-আবেগ সেই তো প্রেম। যে-প্রেমের জন্য সমাজ সংসার মিথ্যে হয়ে যায়, যৌবনের বনে মন হারায় ‘পুলকে আকুল দিক নেহারিতে / সব শ্যামময় দেখি’। মন বলে ‘আমি তোমাকে চাই, তুমি প্রয়োজন’। এই প্রয়োজনের ভিতরে থাকে মিলনের আনন্দ, যদিও পাওয়ার পরেও হারানোর বেদনা কুশাঙ্কুরের মতো জেগে ওঠে। তবু মনে হয় এ-মিলনরাত্রি শাশ্বত হোক :
কত মধু-যামিনী রভসে গোঁয়াইলু
ন বুঝলুঁ কৈছন কেল।
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলুঁ
তব হিয়া জুড়ন না গেল।। (কবিবল্লভ অথবা বিদ্যাপতি)
প্রেম হারিয়েও নতুন করে পাওয়ার আনন্দ দেয়। ‘দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া’ – কাছে পেয়েও হারানোর বেদনা নিয়ে তাই পদাবলীর শ্লোকগুলি আমাদের মনোদর্পণে ধরা পড়ে। সুখের জন্য বাঁধা ঘর বারবার ‘আনলে’ পুড়ে যায়। তবু বিশ্বজোড়া প্রেমের আবহে বর্ষা থেকে বসন্ত দোলবিলাসী কৃষ্ণ-রাধার লীলা, বেদনাবহ্নিত অভিসার আর ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনার ছবি বাঙালির মগ্নচৈতন্যে গাঁথা হয়ে থাকে। আধ্যাত্মিক বলয় কিংবা ভগবদ্লীলা বলে তাকে এড়িয়ে গিয়ে আমরা থাকতে পারি না। বরং আধুনিক কবির কলমে এই নবনির্মাণে নন্দিত হই :
চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি
প্রাচীন কবির ভীরু কবিতা।
গোরোচনা গোরি নবীনা কিশোরী
আসে নাই ঘাটে অতর্কিতা।।
আসে নাই ঘাটে মুহূর্ত কাটে
যুগ যুগান্ত আমন্থিয়া।
পথে হল দেরি ঝরে গেল চেরি
দিন বৃথা গেল বৃথাই প্রিয়া।। (অঙ্গে আমার / অরুণকুমার সরকার)
৩।।
পদাবলীর প্রেমের মাধুর্য লুকিয়ে রয়েছে অভিসারের মধ্যে। নির্দিষ্ট স্থানে প্রিয়তম বা প্রিয়তমাকে ডেকে এনে দেখা করার জন্য অভিযাত্রাই তো অভিসার। জয়দেব তো লিখেই গিয়েছেন ‘রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহর বেশম্ / ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্’। বহুগামী পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের একটি অভিসারের ছবি চণ্ডীদাস আঁকলেও নব অনুরাগিনী রাধার একনিষ্ঠ প্রেমাভিসার আমাদের কাছে অধিক মনোহর। এখানে নারীবাদীদের উল্লসিত হওয়ার কারণ যথেষ্ট। প্রসঙ্গত বিশিষ্ট গবেষক শক্তিনাথ ঝা বলেন :
‘বিপরীত রতাতুরা কালিকা মূর্তি এবং বিবর্তবিলাসে রাধা নারী সক্রিয়তার প্রতীক। নারীভূমিকা নিয়ে রাধা মিলনের আশ্রয় হয়, পরমুহূর্তে পুরুষভূমিকা নিয়ে হয় মিলনের বিষয়। ... স্বামী নপুংসক হলেও সন্তান পেতে পারতেন রাধা। কৃষ্ণ চলে গেলেও বৃন্দাবনে তাঁর ভালোবাসার লোকের অভাব হতো না। একনিষ্ঠা রাধার অর্জিত গুণ, ব্যক্তিগত স্বভাব।’
সেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেই আমরা জানি রাধা-কৃষ্ণের প্রেম সমাজস্বীকৃত নয়। আয়ান ঘোষের পত্নী রাধা, সম্পর্কে কৃষ্ণের মামীমা – সহজকথায় বিবাহিত নারীর অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে পরকীয়ার গল্পই রাধাকৃষ্ণের পদাবলীতে ছড়িয়ে রয়েছে। অসামাজিক প্রেম, তবু সকলের কাছে গ্রহণীয় এমনই আশ্চর্য এই বৈষ্ণবকবিতা। যেসব কবিরা এই পদাবলী লিখেছেন, বিশেষত প্রাক্-চৈতন্যযুগের চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির মত কবিরা, তাঁদের জীবনেও সমাজ-অস্বীকৃত প্রেমের হাতছানি। চণ্ডীদাস-প্রিয়া রজকিনী রামী কিংবা বিদ্যাপতির সঙ্গে রাণী লছিমাদেবীর সম্পর্কের গল্প আমাদের অনেকেরই জানা। তাই রবীন্দ্রনাথের সেই পুরনো প্রশ্ন এখনও প্রাসঙ্গিক :
সত্য করো কহো মোরে হে বৈষ্ণবকবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান,
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে? (বৈষ্ণবকবিতা / ‘সোনার তরী’)
আর তাই এই গোপন প্রেমের জন্য অভিসার করতে হয় রাতের অন্ধকারে। রাধাকে অনুশীলন করতে হয় খালি পায়ে, কাদামাখা, কণ্টকাকীর্ণ পথে সাপের ভয় পেরিয়ে প্রিয়তমের আছে যাওয়া। দরজা বন্ধ, পথঘাট ভালো নয় তবু যেতেই হবে। যে অভিসারিকা তারই জয়, আনন্দে সে চলেছে কাঁটা মাড়িয়ে :
মাধব তুয়া অভিসারক লাগি।
দুতর পন্থ- গমন ধনি সাধয়ে
মন্দিরে যামিনী জাগি।। (গোবিন্দদাস)
এই অভিসার নানা ঋতুতে করা হলেও বর্ষাভিসারের পদগুলি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঘোর দুর্যোগের মধ্যে শ্যাম নাগরের অধীর অপেক্ষায় সাড়া দিয়ে রাধিকার সঙ্কেতস্থানে পৌঁছানোর মধ্যে আছে যেন যুদ্ধজয়ের আনন্দ। প্রিয়তমের কাছে গিয়ে তাই সে বলতে পারে :
তোহারি মুরলী যব শ্রবণে প্রবেশল
ছোড়লুঁ গৃহ-সুখ-আশ।
পন্থক দুখ তৃণ- হুঁ করি না গণলুঁ
কহতহি গোবিন্দদাস।।
এই নিবিড় বেদনা মাধুরীতেই সকল কাঁটা ধন্য করে প্রেমের ফুল ফুটে ওঠে। যদিও এ-মিলন ক্ষণস্থায়ী, সত্য আসলে বিরহ আর বিচ্ছেদ। পদাবলীর বৃন্দাবন-বিহারী রোম্যান্টিক কৃষ্ণ থেকে মহাভারতের রাজনীতিবিদ শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ওঠার এ-পথে ছিন্ন মালার মতো পড়ে থাকে রাধার প্রেম। সেই বুক ফাটা ‘রাধাবিরহ’-এর আর্তিতে আমরা আজো শুনতে পাই বিচ্ছেদ কিংবা একালীন ব্রেক-আপের গোপন কান্নার সুর। যে-কান্না আমাদের আজও বলে যায় ‘এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে’।
৪।।
সেই কবে মহিলা কবি বিকটনিতম্বা (মতান্তরে পুরুষকবি ধর্মকীর্তি) লিখেছিলেন : ‘সঙ্গমবিরহবিকল্পে বরমিহ বিরহো ন সঙ্গমস্তস্যাঃ। / সঙ্গে সৈব তথৈকা ত্রিভুবনমনপি তন্ময়ং বিরহে।।’ বৈষ্ণব পদাবলীর মাথুর পর্যায়ের কবিতাগুলি এই বিরহের তাপেই চিরস্মরণীয় হয়েছে। চিরকালের মতো কৃষ্ণের মথুরা চলে যাওয়ায় ‘শূন ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী’। প্রেমিকের এই সুদূর প্রবাসে একলা প্রেমিকার যন্ত্রণা আদৌ কী ভাষায় প্রকাশ করা যায়? হৃদয় নিঙড়ানো যন্ত্রণায় বিপথে পড়ে থাকা মালতী মালার মতো শ্রীরাধার মনের ব্যথা কূল মানে না, শরীরী তৃষ্ণা বাধা মানে না। মাথুরের পদে রাজাধিরাজ কবি বিদ্যাপতি লেখেন :
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খরশর হন্তিয়া।।
কুলিশ শত শত পাত-মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া।।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া।।
শুচিতাবোধ থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পদরত্নাবলী’তে এই ‘কাম’-এর বদলে ‘বিরহ’ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু দেহহীন চামেলির লাবণ্যবিলাস বৈষ্ণবকবিতা কখনোই নয়। যৌনতা এখানে আদৌ নিন্দনীয় নয়, বরং শরীরের নিবিড় উদ্যাপনেই প্রেমের গাঢ়ত্ব টের পাওয়া যায়। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে দেখা যায়, ফাল্গুনী পূর্ণিমায় সারারাত ধরে সম্ভোগের পর রাধিকার দেহে তাঁর রতিক্রিয়ার চিহ্ন আড়াল করতেই রঙের উৎসব হোলি শুরু করেন কৃষ্ণ ব্রজধামে। অস্থি মাংস সহ এই যৌন-চিন্ময় প্রেম পদাবলীকে সংরাগমদির করে তোলে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা বিষ্ণু দের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি :
জীবন উদগ্রীব প্রতীক্ষায়
প্রতীক্ষা না এক মিশ্রসুর!
আকাঙ্ক্ষার নীলে রেঙেছে অঙ্গার,
চাওয়ায় পাওয়া মেশে সে-ভিক্ষায়,
শরীরে মন মেলে মুঠিতে দূর। (ক্লান্তি নেই)
আর সেই প্রতীক্ষার রাত্রি ভোর হয় ‘বহুদিন পর বঁধুয়া এলে’ – সেই ভাবসম্মিলনে দূরের মানুষ কাছে আসে। অনুযোগ-অভিমানের পালা শেষ করে সুখবিলাসে সময় কাটে দু’জনের। যদিও দ্বাদশ সর্গে রচিত ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্যে যে শরীরী মিলনের পূর্ণতা আছে পদাবলীতে তা নেই। এখানে ভাবসম্মিলন আসলে কল্পনার মিলন। যদিও বহিরঙ্গের সেই বিচ্ছেদ আসলে অন্তরঙ্গে মিলনের আভাস দেয়। বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী-বিহারী কিংবা শরৎচন্দ্রের রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তের পাঠকের কাছে একথা নতুন কিছু নয়।
৫।।
‘সে-দিন পহেলা ফাল্গুন : ঘাটে, মাঠে / মদনসখার বিস্মিত অভিযান;’ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদে হাইনের এই ‘স্মৃতিবিষ’ আবৃত্তি করতে করতেই শুরু হয়েছিল আমার শৈশব। রোম্যান্টিকতার হাওয়া লেগেছিল হয়তো জন্মক্ষণেই। তাই ‘তুমি কি অলওয়েজ রোম্যান্টিক কবিতাই লেখো’? এক বন্ধুনীর এই প্রশ্নের উত্তরে আমাকে স্বীকার করে নিতে হয় আমি ‘জন্ম-রোম্যান্টিক’, কারণ আমি নিত্য অনুভব করি : ‘পদাবলী ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে / স্মৃতি আছে তার’ (বিষ্ণু দে)। আসলে এই রোম্যান্টিকতার মধ্যেই তো রয়েছে সুন্দরের জন্য ব্যাকুলতা, দূরত্বের প্রতি আকর্ষণ, বিষণ্ণতা, বিস্ময় আর না-পাওয়ার বেদনা মাধুরী। সৌন্দর্যস্বরূপের হাতে এই জগৎকে বাঁশিরূপে দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ব্যাকুল বাঁশির ডাকে আমরাও অনেক পাওয়ার মধ্যেও যথার্থ দোসরকে না-পাওয়ার বিরহে কাতর হই। দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমাদের একটু একটু কান্না পায়। পরকীয়ার জানালা দিয়ে আমরা আসলে খুঁজতে চাই মুক্তির আকাশ, সেখানে দেহ-মনের সুদূরপারে হারিয়ে যাওয়ার ইশারা আমাদের নিত্য হাতছানি দেয়। পরিপূর্ণ সুখবিলাস আর দিনানুদৈনিকের অভ্যেসে জীর্ণ জীবন রাধাকৃষ্ণের উপমায় ধরতে চায় অধরা প্রেমের শাশ্বত মাত্রাটিকে। তাই শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিসার’ কবিতায় বৃষ্টিতে উতলা মেয়েটি স্বামীর ঘর ছেড়ে প্রেমিকের দুয়ারে এসে দাঁড়ায়, যদিও বাস্তব পরিস্থিতি শেষাবধি তাকে ফিরিয়ে দেয় নিজগৃহে ‘রাধাকৃষ্ণধারা বেয়ে বৃষ্টিরাত ফিরে আসে নিজের দরজায়’। আবার একুশ শতকের কবি দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় লেখেন ‘বৈষ্ণব ফ্লার্টের পদাবলী’ সেখানে ব্যর্থ প্রেমিক কৃষ্ণের জন্য করুণা ছুঁড়ে দিয়ে নারীবাদী রাধিকা রিডিফাইনড হয় : ‘স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী / আত্মগর্বে আমি বিনোদিনী’। ক্রমশ ফাল্গুনী দিন পার হয়ে চৈত্র ঘনায়, সুরের আবীরের নেশায় মেতে ওঠা আমারও কবিমন লিখে ফেলে রোম্যান্টিক কবিতা :
চৈতালি হাওয়া লেগে ঝরে পড়ে কথা
গোপনে কুড়িয়ে রাখি লিখি কবিতায় ...
কবিতা কলমই লেখে প্রেয়সী আমার
মনের দু’চোখে তৃষা, দাহ অনিবার –
দাহ তো আগুনে জানি, ভালোবাসা আলো
সেও তো অনেকরঙা, লাল-শাদা-কালো
কালো নাকি শোকলীন, অশুভ-বিচ্ছেদ?
শ্যাম-গোরী যুগলের হৃদয় অভেদ! (যুগনদ্ধ)
ভক্ত বৈষ্ণবের কাছে হোক না সে ভক্তিরসের কবিতা, আমাদের কাছে বৈষ্ণবকবিতার অন্তিম মূল্য তার রোম্যাণ্টিকতায়, প্রেমের বেদনামাধুর্যে। মিলন-বিরহের সুরে গাঁথা সেই ‘অকথন বেয়াধি’ প্রেম এই একুশ শতকেও ‘তিলে তিলে নূতন হোয়’।।
ঋণস্বীকার :
১) বৈষ্ণব পদাবলী (চয়ন)। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২
২) বৈষ্ণব কাব্য ও আধুনিকতা । তরুণ মুখোপাধ্যায়। রমা প্রকাশনী, ১৯৮৮
৩) অন্য এক রাধা । শক্তিনাথ ঝা । মাইন্ডস্কেপ-মনফকিরা, ২০০৭
৪) হিন্দু আইনে বিবাহ। তপনমোহন চট্টোপাধায়। বিশ্বভারতী, ১৩৬২
৫) গদ্যসমগ্র ১। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রতিভাস, ২০০৭
৬) রবীন্দ্ররচনাবলী এবং একাধিক কাব্যগ্রন্থ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন