মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

এই সংখ্যার কবিঃ কবি কামাল হোসেন


 


কবি কামাল হোসেন

জন্ম কলকাতায় ১৯৫৬ সালের ১৭ জুলাই। শৈশব, কৈশোর, স্কুল জীবন মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। তারপর কলকাতায় ডাক্তারি পড়াশোনা স্থায়ী বসবাস।

ছোটোবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ।

'মুকুল' নামে একটি দেওয়াল পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দশ বছর বয়সে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় 'শিশুসাথী' পত্রিকায়। 'সাথী' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। 'দেশ' পত্রিকায় সনাতন পাঠক (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) পত্রিকাটির প্রশংসা করেন। স্কুলের শেষ দিকে 'দেশ' পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে 'যুগান্তর' পত্রিকা আয়োজিত আন্ত-স্কুল প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার। ১৯৭৩ সালে 'যুগান্তর'পত্রিকা আয়োজিত আন্ত- কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে 'অন্য আকাশ' গল্পের জন্য 'সুলেখা ছোটোগল্প প্রতিযোগিতায়' প্রথম পুরস্কার। ১৯৭৮ সালে শিলাদিত্য পত্রিকা আয়োজিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতায় ' পরম বিশ্বাসের গন্ধ' উপন্যাসের জন্য প্রথম পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অন্য আকাশ' কবিতা ভবন থেকে প্রকাশ করেন প্রতিভা বসু। ১৯৮৭ সালে 'যুগান্তর' আয়োজিত ' বাংলার বাতায়ন' ছোটোগল্প প্রতিযোগিতায় 'মাটির প্রত্যাশা' গল্পের জন্য প্রথম পুরস্কার। ১৯৯৫ সালে চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন 'প্রস্থান' উপন্যাসের চিত্রস্বত্ব ক্রয় করেন। সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত হয় নি।১৯৯৬ সালে 'বানপ্রস্থ'উপন্যাসের জন্য'সোমেন চন্দ পুরস্কার' একই বছরে 'ভারতীয় ভাষা পরিষদ' সংবর্ধনা প্রদান করেন। ২০০০সালে 'দ্বীপভূমি' উপন্যাসের জন্য 'প্রমা পুরস্কার' ২০১৬ সালে 'নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার' ২০১৮ সালে কলকাতার'আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়' 'একুশে সম্মাননা' প্রদান করেন। ২০২১ সালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়'মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্য পুরস্কার' প্রদান করেন। কিছুদিন 'আজকের গল্প' পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। সুরজিৎ ঘোষের 'প্রমা' পত্রিকায় দীর্ঘদিন সহযোগী সম্পাদক ছিলেন।

কয়েকটি প্রধান বই: কবিতা: সীমান্তের মানুষ, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা, প্রান্তর পৃথিবীর উপাখ্যান প্রভৃতি।

গল্প: অন্য আকাশ, উপকথার জন্মবৃত্তান্ত, মর্ত্যে তিন পরি, শীতঘুম, প্রেমের গল্প প্রভৃতি।

উপন্যাস: পরম বিশ্বাসের গন্ধ, বানপ্রস্থ, দ্বীপভূমি, প্রস্থান, স্বভূমি, উপন্যাস সমগ্র প্রথম খন্ড প্রভৃতি।

কামাল হোসেন পেশায় বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।





শরশয্যা

তৃষ্ণাদীর্ণ এক বিচিত্র প্লাস্টিকের খোলসের মধ্যে

আটকা পড়ে চুপচাপ শুয়ে আছি অন্তহীন

আকাশের মুখোমুখি, চারপাশে স্মৃতির বুদবুদ,

চেতনা এখনও কেন জাগ্রত আছে, আলকাতরার

মতো তরল জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে নিশ্চল

শরীরের ওপর, তাপের প্রদাহ ক্রমশ শীতল হয়,

চেতনার নদীর ওপারে বুঝি সেই এক মানবীর

স্পর্শাতীত স্বপ্নাবৃত ওষ্ঠ স্বরচিত কুয়াশায় অপেক্ষমান,

                                               বিচ্ছিন্ন দেহলিতে




যুদ্ধ

 

সেই ব্যস্ত টিকটিকির সঙ্গে চারটে আরশোলার

প্রাণের যুদ্ধ চলতে চলতে অসময়ে বৃষ্টি এলো

শ্রুতির দুঃখিত হাহাকার বেদনায়---

তারপর চূড়ান্ত সংগ্রামের আগেই

এদিকে ওদিকে আনাচে- কানাচে ওরা

পালিয়ে গেল নিজস্ব নিজস্ব তৎপরতায়

 

আমাদের এই ভাঙাচোরা ঘরে

যখনই বৃষ্টি আসে, ভিজে যায় তক্তপোষ,

আলমারি, টেবিল আর বইয়ের কৃতজ্ঞতা

 

ব্যস্ত টিকটিকি আবার ধাওয়া করে,

চারটে আরশোলা তাকে জিভ ভ্যাঙচায়,

বৃষ্টিকে তুচ্ছ করে তের বছর বন্ধ থাকা

দেওয়ালঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রাপিজের খেলা

                                        চলতেই থাকে



রক্তাক্ত পর্যটন

 

অনেকদিন আমরা কেউ কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না,

আজকাল আমরা দুজনেই বড়ো বেশি ব্যস্ত থাকি,

জীবিকা সামাজিকতা রুটিনবাঁধা  

কতো সব বর্তমানাশ্রয়ী বোধাতীত গ্লানি,

নতুন কোনো জ্যোৎস্না বা বৃষ্টিপাতের

ছন্দে ছুটোছুটি করতে কতোকাল ভুলে গেছি,

নৌকাতে চেপে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানোও

যেন অতীতের নিছক শোকগাথা, স্বপ্নের মুগ্ধতা

 

কথাহীন স্মৃতিহীন এই পৃথিবীতে নতজানু হয়ে

ক্রুশকাঁধে আমাদের দুজনের রক্তাক্ত পর্যটন



ওড়া

 

তীব্রতম বেগে ছুটে চলেছে এই ভয়ংকর খেলাগাড়ি,

কখনও বেঁকে যাচ্ছে, কখনও ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে

মাধ্যাকর্ষণের অতলে,

আমি অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছি

তোমার দুই হাতের নিশ্চিন্ত তীর্থে,

অস্তিত্বরক্ষার সাংঘাতিক টানাপোড়েনে

আতঙ্কে ভাসতে ভাসতে আর্তনাদ করে

গতির বিপরীতে আধোচাঁদে উড়তে থাকি

ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো কেমন শান্ত, ব্যথাহীন

 

ওড়ার এই হিসেবছাড়া আবেগও একসময় চুপচাপ ছবি হয়,

তীব্র ধ্বংসভীতি উপেক্ষা করে ছোটো ছোটো তারার ফুলকি

কুয়াশার ব্যাপক শূন্যতায় হাহাকার করে কেঁদে ওঠে

প্রচন্ড মমতায়, ফসিলে আঁকা যেন প্রত্নদাগ



বাড়ি

 

স্বপ্নের মধ্যে পুরোনো  বাড়িটি বেঁচে ওঠে,

বিশাল প্রশস্ত ঘর, লম্বা করিডোর, দক্ষিণের    

অন্যমনা শীতল বারান্দা, ছাদের ওপরে

সূর্যাস্ত রঙা নিঝুম চিলেকোঠা, পাখিরাও

মাঝে মাঝে উড়ে আসে, গল্প করে,

শোনায় রূপকথা, দ্রুতগামী বাতাসের স্নেহ

 

দেওয়ালে টাঙানো পুরোনো ঘড়িটি চুপচাপ

ঝুলে থাকে, সময়ের হিসেব কষে না, কতোদিন

ধ্বনিত হয় না সেই গমগমে আওয়াজ, নিঃসঙ্গ

জাদুঘর বুকের ভেতরে হিমায়িত, ঘুমন্ত বিষণ্ণ

 

অনন্ত স্মৃতির সরণির একপাশে পুরোনো বাড়িটি

আমাকে কাছে ডাকে, দুয়ার খুলে দেয়,

বসতে দেয় পুরোনো পালঙ্কে, মাঝরাতে ধ্বনিত হয় 

                                            পাখির কূজন



আত্মপ্রতিকৃতি

 

দুঃখের দৃশ্যায়নে স্তব্ধ হয় মানুষের মন,

বিবেকের হাতে পায়ে শেকল- অলঙ্কার

কবিকে সাহসী হতে মানা করে, কী দরকার

প্রতিবাদের আগুনে তাপ শুষে নিয়ে বিমূঢ়

ভালোমানুষটির মতো রঙিন আলখাল্লা গায়ে দিয়ে

প্রান্তরের শিশিরে খালি পায়ে পথ হাঁটা

 

তার থেকে এই ভালো, এই প্রলোভন, এই পুরস্কার,

এই অনিয়ম, এই উদ্দীপিত স্বপ্নময় নেশায় আচ্ছন্ন

হৃদয় নিয়ে সৃষ্টির মোহিনী উৎসবে ঝিমোতে ঝিমোতে

                                আত্মপ্রতিকৃতি এঁকে যাওয়া



পুনরুত্থানের মন্ত্র

 

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আজকাল তাঁর লজ্জা হয় না,

নিজের নগ্ন অস্তিত্ব মেধাবী রূপটানে বড়ো উদভাসিত,

'আমার প্রাপ্য আমাকে বুঝে নিতে হবে' --- এরকম হীরকদীপ্ত

বীজমন্ত্র পাঠ করতে করতে প্রাজ্ঞ বীরপুরুষ

উচ্চস্বরে মুখস্ত করতে থাকেন আজকের চ্যাট- শোয়ের সংলাপ

 

সুবিধাভোগী মানুষরাই সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের পটপরিবর্তনে

জার্সি-বদলের মহাযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে

পড়েন চালাক পাখিদের মতো ---

পুনরুত্থানের মন্ত্র গাইতে গাইতে দু-চোখ ভরে

খুঁজতে থাকেন উৎফুল্ল পুরস্কারের সজীব বিগ্রহ



আলোভূমি

 

দূরত্বের আর একটু গোধূলি সীমানায় দাঁড়িয়ে

বিনিময় করি অভিজ্ঞতা অথবা নির্বাক চাউনি।

জানি, এরপর আর কিছু নেই, তখন শুধু

পিছু ফিরে হাঁটা, অন্ধকার প্রযুক্তির বিশাল

ইমারত মাড়িয়ে তৃতীয় বিশ্বের এক বৃষ্টিভেজা

রাত্রিতে ঘরহীন মেষপালকের মতো

ডায়াস্পোরার নিঃশব্দ বিপজ্জনক উপস্থিতি।

 

এভাবেই হাঁটা আর দূর থেকে চেনা, মায়াবী

বসন্তকালের এই বিদ্বেষশূন্য ঋতুতে সম্পর্কের

তরুগাছটি ঠিক বেঁচে থাকে , এও এক বিনির্মাণ,

আশ্চর্য মুগ্ধতা যেমন ডানা মেলে গন্তব্য খোঁজে

সেই অভিনব আলোভূমি।




স্বেচ্ছা-সমর্পণ

 

অনেকদিন বাদে আমি সারনাথের

নতুন জাপানি মন্দিরের সামনের সিড়িতে

বসে থাকলাম ...

 

ওপাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে

তুমি বললে, সামনের মন্দিরটা পুরোনো

বৃদ্ধ জাপানি পুরোহিত হাসেন ঠিক শিশুর মতো

 

শালবীথি মোড়া পুরোনো মন্দির দেখতে দেখতে

শত সহস্র বছরের পেছনে চলে গেলাম

ঝাপসা ছবির মতো হেঁটে চলেছেন গৌতম বুদ্ধ,

পিছু পিছু স্বেচ্ছা-সমর্পণের অঙ্গীকার নিয়ে

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোটি কোটি নগ্নপদ মানুষ

হাঁটছে জরা মৃত্যুকে অতিক্রম করা

                                 স্তব উচ্চারণ করতে করতে



পাহাড়ের বাড়িঘর

 

পাহাড়ের উচ্চতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে

বহুতল বাড়ির সপ্রতিভ নিশ্বাস

প্রতিটি তলা মানে পাহাড়ের একটি স্তর,

যুবতির শরীরের খাঁজের মতো রহস্যময়,

চারপাশে ফুলেদের প্রতিরোধ, রঙিন

বাসনার মতো উৎসবের অমিত বিহ্বলতায়

 

পাহাড় কি সংগীতের মতো অবাধ ছন্দোময়?

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, দূর থেকে ভেসে আসে

বৌদ্ধ মনাস্ট্রির গুম গুম ঢাকের আওয়াজ



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন