যৌনকর্মী
শ্যামলিমা আজ ঘর থেকে মনস্থির করে বেরিয়েছিল, পরাশরকে সরাসরি জানিয়ে দেবে, সম্পর্কটা আর জিইয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। এই সম্পর্ক কোনো পরিণতিতে পৌঁছবে না। অহেতুক দুজনকে দুজন ধরে রাখার তাই কোনো মানেও হয় না। বরং যে যার নিজের মতো পুরনো অবস্থানে ফিরে যাওয়াই ভালো। শ্যামলিমা ফিরে যাবে রেলস্টেশন লাগোয়া বাজারের একপ্রান্তে মধ্যম মানের নিষিদ্ধপল্লীর একটি ব্যারাকঘরে, আর পরাশর তার অরবিন্দপল্লীর পৈতৃক বাড়িতে। যদিও পরাশরের পরিজন বাড়িতে তাকে আবার স্থান দেবে কিনা, তা শ্যামলিমার জানা নেই। কিন্তু সে নিশ্চিত, নিষিদ্ধপল্লীতে তার প্রত্যাবর্তনে কেউ বাধা সৃষ্টি করবে না।
শ্যামলিমা যখন জেলগেটে এসে পৌঁছল, তখন বৈশাখের সূর্য তার ঠিক মাথার ওপরেই। কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হলো। তারপর একসময় ভেতরে ঢুকে একটা লম্বা ঘরের জালের অন্যপিঠে পরাশরের দেখা পেল। বরাদ্দ সময় খুব কম। এই স্বল্প সময়েই তার যা কিছু বলার তা বলতে হবে এবং শুনতে হবে। পরাশরের জেলের মেয়াদ প্রায় শেষ। মাত্র ছ’মাসের জন্য সে অন্তরীণ হয়েছে একটি মিথ্যে প্রতারণার মামলায়।
পরাশর বলল, তুমি আমাকে আজ কী বলতে এসেছ, তা আমি জানি।
শ্যামলিমা অবাক হলো। বলল, কী জানো?
পরাশর বলল, তুমি আমার কাছ থেকে মুক্তি চাইতে এসেছ।
শ্যামলিমা থমকালো। বলল, হয়তো ঠিক তাই নয়। বরং বলতে পারো, আমার কাছ থেকে তোমাকে মুক্ত করতে চাইছি।
-কিন্তু কেন শ্যামলিমা? আমি তো মুক্তি চাইছি না! আমি তো সবকিছু ছেড়ে তোমার বন্ধনে নিজেকে জড়িয়েছি। তাহলে?
শ্যামলিমা সামান্য চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু তাতে কী লাভ! বাড়িতে তোমার মা-বাবা আছেন, দাদা-বৌদি আছেন, তোমার স্ত্রী আছেন। তাঁদের কাছে ফিরে যাও। আমার মতো একজন যৌনকর্মীর সঙ্গে সংসার করার তো কোনো যুক্তি নেই। সম্মানও নেই।
পরাশর বলল, এসব কথা বলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ তুমি। এসব যুক্তি-তর্কের প্রসঙ্গ বাদ দাও না শ্যামলিমা! আর যদি এমনই হয়, আমি ফিরে গেলাম আমার বাড়িতে, কিন্তু তুমি কোথায় ফিরে যাবে শ্যামলিমা? সেই পুরনো পল্লীতেই?
-সে তো তুমি জানোই পরাশর, আর কোথাও আমার ফিরে যাবার জায়গা নেই। একদিন ঘটনাচক্রে ঐ পল্লীতেই আমি থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেটাকেই আমার নিজের ঘর বলে মেনে নিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন তুমি আমার সেই ঘরে এলে। দিনের পর দিন আসতে থাকলে। তারপর আচমকাই একদিন আমাকে বুঝিয়ে, আমার মাসীকে রাজী করিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে আসলে একটা নতুন ঘরে। আমি তখনও জানতাম না, তুমি তোমার নিজের ঘর ছেড়ে আমাকে নিয়ে নতুন ঘরে এসেছ।
পরাশর অধীর হয়ে বলল, হ্যাঁ শ্যামলিমা তাই! আমি তোমার জন্যই নিজের ঘর ছেড়েছিলাম। তোমাকে ভালোবেসে।
শ্যামলিমার চোখ ভারি হয়ে উঠল। তার জীবনে এ এক অসামান্য প্রাপ্তি। তবু!
নিজেকে সামলে নিয়ে শ্যামলিমা বলল, কিন্তু তাতে কী লাভ হলো! আমার অবস্থানের তো কোনো পরিবর্তন হলো না! আমি যৌনকর্মীই থেকে গেলাম, নিষিদ্ধপল্লীতে বা তোমার ঘরে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন